ট্রেডমিল
শুভজিৎ
বরকন্দাজ
নতুন
কেনা স্মার্টফোনে ও.এল.এক্স-এর অ্যাপসটা ডাউনলোড করার পর থেকেই আমার বেশ বাতিক
লক্ষ্য করছি ক’দিন ধরে। দিনের মধ্যে ঘুরে ফিরে বারেবারেই চোখ চলে যাচ্ছে নতুন কী আপলোড
হল তার দিকে।
এ এক
মজার জিনিস। পুরনো জিনিস কেনাবেচার অতি
আধুনিক বন্দোবস্ত। শুনেছি, একটু নজর রাখলেই
নাকি মোক্ষলাভ হতে পারে এখানে। কেউ অভাবে, কেউ স্বভাবে বিক্রিবাটা
করে দেন তাঁর শখের জিনিসটাকে। আমিও তেমন কিছু একটার সন্ধানে
আছি। তবে জিনিসটা যে ঠিক কী তা
এখনও জানি না। মনে হচ্ছে কিছু একটা পাব
আর দিব্যি দাঁও মেরে দেব সস্তাতে।
আমারই
এক বন্ধুও সদ্য সদ্য এমন দাঁও মেরেছে সস্তায় একটি মোটর সাইকেল কিনে। এখন সে দিব্যি সেটায় চেপে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে এধার ওধার। দেখে আমার ইচ্ছেটাও জোরালো হয়েছে। রাত্রি দিনে এখন মোবাইলেই নেশার মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকছি ঘন্টার
পর ঘন্টা।
খুব বেশিদিন
অপেক্ষা করতে হল না। দিনকয়েক পরেই দেখলাম এক ভদ্রলোক
আপলোড করেছেন তাঁর ট্রেডমিলটিকে তিনি বিক্রি করে দিতে চান। দারুণ কন্ডিশনে অত্যন্ত সস্তায় নামমাত্র দামে বেচে দিচ্ছেন তিনি
এটাকে। আর্জেন্ট সেল।
দেখে
হামলে পড়লাম। আহা! আমার কতদিনের সখ একটা ট্রেডমিল কেনার। পাহাড়প্রমাণ দাম দেখে তেমন করে আর ওদিকে এগোতে পারিনি আজ পর্যন্ত। আজ এ তো সুবর্ণসুযোগ। মাত্র সাতহাজার টাকায় ভদ্রলোক
বেচে দিতে চাচ্ছেন তাঁর সাতচল্লিশ হাজার টাকায় কেনা ফুললি অটোমেটিক মোটরাইজড ট্রেডমিলটাকে!
আনন্দে
যেমন আত্মহারা হয়ে পড়লাম, তেমনি মনে ভয়ও দেখা
দিল। চিটিং কেস নয়তো? আজকাল তো হামেশাই হচ্ছে এধার ওধার! মনে মনে অনেক যোগ বিয়োগ কাটাকুটি সেরে শেষমেষ ও.এল.এক্স-এর চ্যাটিং অপশন থেকে ভদ্রলোকের ফোন নম্বর খুঁজে
নিয়ে ফোন করে বসলাম।
আমার
ফোন পেয়ে ভদ্রলোক স্বাভাবিক গলাতেই জানালেন, হ্যাঁ, তিনি জেনে বুঝেই এত কম দামে এটা বিক্রি করছেন। এতে কোনও ফাঁকি নেই। আসলে তিনি কাজের সূত্রে বাইরে
থাকেন। এটা কিনেছিলেন তাঁর প্রায়
বৃদ্ধ বাবার জন্যে। কিন্তু এটা তিনি ব্যবহার
করে স্বাচ্ছন্দ্য পাননি। তিনি বর্তমানে আর বেঁচে নেই। সেই থেকে এটা বলতে গেলে একেবারেই আনইউজড হয়েই পড়ে আছে। মিন্ট কন্ডিশনে। আমি গেলে জিনিসটা তিনি দেখাতে
পারেন। কেনাকাটা আমার ব্যক্তিগত
ব্যাপার।
আমি তাঁকে
আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। আজ সন্ধ্যায় আসছি বলে ফোন
রেখে দিলাম। এত সস্তায় আমার স্বপ্নপূরণ
হতে চলেছে। এ জিনিস হাতছাড়া করা যায়
না। আমি দারুণ উৎসাহে টাকা জোগাড়ের
বন্দোবস্তে নেমে পড়লাম।
****
কয়েক
ঘন্টার মহাব্যস্ততার পর রাত্রি ন’টা নাগাদ যখন আমার মেসবাড়ির ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে থিতু
হলাম ততক্ষণে অনেক কান্ড ঘটে গেছে। আমার দশ বাই বারো ঘরটার এককোণে
বইয়ের গাদার পাশে রাজকীয় ভঙ্গিতে শোভা পাচ্ছে cruze
ব্র্যান্ডের অটোমেটিক মোটরাইজড ট্রেডমিলটা। আনন্দে আমি এতটাই আত্মহারা হয়ে পড়েছি যে রাত্রে খাওয়ার কথাই
ভুলে গেলাম। এর মধ্যে ট্রেডমিলটার ডিজিটাল
ডিসপ্লে মিটারে স্পিড, টাইম ইত্যাদি যাবতীয়
ডিটেলস অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছি। কয়েক চক্কর দৌড়ে-টৌড়ে আমার
মন এখন দারুণ ফুরফুরে।
মাঝরাত্তির
পর্যন্ত এসব চলল। ক্লান্ত হয়েই একসময় কখন যেন
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোররাতের দিকে ঘুমটা ভেঙে
গেল। অন্ধকারে কীসের যেন শোঁ শোঁ
আওয়াজ হচ্ছে একনাগাড়ে। ঘুমঘুম চোখে উঠে পড়লাম। জানালাটা খোলা ছিল। বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝড় উঠেছে। বেশ দমকা হাওয়া আর সাথে টিপ টিপ বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। ঘরে ঠান্ডা বাতাস এসে ঢুকছে।
জানালাটা
বন্ধ করে আবার এসে শুতে যাব, খেয়াল করলাম,
দরজাটাও খোলা। ভারি অবাক হলাম। কাল রাতে শোওয়ার আগে তো দরজাটা বন্ধ করেই শুয়েছিলাম। তাহলে!
বিছানাটা
ডাকছিল। ঘুম ঘুম ভাবটা আবার ফিরে
আসছে। ভাবলাম, কাল বোধহয় উত্তেজনায় দরজার ছিটকিনিটা লাগাতেই
ভুলে গিয়েছিলাম। আনন্দের আতিশয্য বোধহয় একেই
বলে। দিব্যি প্রসন্ন মনে উঠে গিয়ে
দরজাটা বন্ধ করলাম। ট্রেডমিলটার দিকে একবার চোখ
গেল। ওটা দরজার পাশের দেওয়ালে
সেট করা। চকচকে শরীর নিয়ে আমার দিকে
তাকিযে আছে। মনে খুশি খুশি ভাবটা আবার
ফিরে এল। এখনই একবার গা ঘামিয়ে নিতে
পারলে মন্দ হত না। কিন্তু মনের ইচ্ছেটাকে আপাতত
দমিয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে এসে শুতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, কাল রাতে আরেকটা ভুল করে রেখেছি। ট্রেডিমিলের ইলেকট্রিক পাওয়ার সুইচটাই অফ করা হয়নি। নিজের উপর ভারি বিরক্ত হয়ে সুইচটা অফ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
*****
দ্বিতীয়
রাত্রে আমার ঘরে একটা নতুন ফ্যাসাদ হল। আজও ঘুমোতে বেশ রাত্রি হয়েছিল। ঘুমে কাদা হয়েই ছিলাম একপ্রকার। কীসের যেন ঘষটানির একটা আওয়াজে শেষরাতের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমচোখে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে দারুণ
বিস্ময়ে চমকে গেলাম। আমার ঘরের জানালাটা যথারীতি
খোলা। ঘরের দরজাটাও।
এ কী
করে হয়! স্পষ্ট মনে আছে, কাল রাতে শোওয়ার আগে জানালা দরজা সবই ঠিকমতো বন্ধ করেই শুয়েছিলাম। কোনও ভুল হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। তাহলে!
ঘরের
আলোটা জ্বেলে কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে বিছানার উপর বসে রইলাম। মনে মনে ভাবছি, এটা কী করে সম্ভব! তাহলে কি দরজা জানালার ছিটকিনিটা আমি
ঠিকমতো লাগাইনি! নাহ! এমন ভুল তো আমার খুব
একটা হয় না। হঠাৎ আওয়াজটার কথাও মাথায়
এল। কীসের যেন একটা ঘসঘস শব্দও
তো শুনেছিলাম!
নাহ, ভোর চারটে বেজে গেছে। আর ঘুমের চেষ্টা করা বৃথা। খোলা দরজা দিয়ে হালকা শীতের বাতাস ঢুকছে ঘরে। শীত শীত লাগছে বেশ। উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করলাম। দরজাটাও বন্ধ করে ফিরে আসতে গিয়ে পাশের দেওয়ালের দিকে নজর গেল। ট্রেডমিলটার ইলেকট্রিক সুইচটা আজও অন।
মনের
মধ্যে এবার বেশ একটা ধন্দ শুরু হল। কাল রাতে তো সু্ইচটাকে দিব্যি
বন্ধ করে শুয়েছি। তাহলে এটা অনই বা হল কী করে! তবে কী কোনও ছিঁচকে চোরের উৎপাত শুরু হল শেষমেষ!
কিন্তু দীর্ঘদিন এ পাড়ায় আছি। তেমন কোনও ঘটনা তো ঘটতে দেখিনি আজ পর্যন্ত। ভাবতে ভাবতে ঘুমটা আর এলই না। আলোটা জ্বেলেই শুয়ে শুয়ে মোবাইলে মৃদু শব্দে গান শুনতে লাগলাম।
*****
দিন দুইয়ের
জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম একটা জরুরী কাজে। ঘটনাটা মাথা থেকে উড়ে গেছে
এরমধ্যেই। কাজের চাপে একটু ব্যস্ত হয়ে
পড়াতে ওসব নিয়ে আর ভাবার সময় পেয়ে উঠিনি। গতকাল রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত
শরীরে তাড়াতাড়িই বিছানা নিয়েছিলাম। শরীরটা খারাপ থাকায় ঘুমটাও
হয়নি তেমন। বারেবারে ভেঙে যাচ্ছিল।
হালকা
হালকা ঘুম আর জাগরণের মধ্যেই অস্থিরভাবে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি দীর্ঘক্ষণ ধরে। মাথার মধ্যে কেমন একটা যন্ত্রণা হচ্ছে যেন। শেষরাতের দিকে সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। এমন সময় ঘটাং করে খুব হালকা একটা শব্দ এল কানে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়েছিলাম। কিন্তু শব্দটা ঠিকই শুনেছি।
শব্দটার
সাথে সাথে একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল গায়ে। বুঝলাম আমার ঘরের জানালাটা খুলে গেল। সাথে সাথেই আর একটা মুদু ঘটাং শব্দ হল। বুঝলাম এবার দরজাটাও…
গা-টা কেন জানি শিরশির করে উঠল আমার। ঘটনাটা কী দেখা দরকার! নির্ঘাৎ কাল যা ভেবেছি তাই। ছিঁচকে চোরেরই আমদানি হচ্ছে
আজকাল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘাড় ঘুরিয়ে
পেছনে ফিরে তাকাতে গেলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, গায়ে একটুও জোর পেলাম না! একটা আলগা বাঁধন যেন
আমার শরীরটাকে বেঁধে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম ইন্দ্রিয়লুপ্ত
মানুষের মতো। অথচ পরিষ্কার বুঝতে পারছি
আমার ঘরে কেউ প্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, হালকা পায়ে
হেঁটে চলেও বেড়াচ্ছে।
ঘরররর
ঘররর শব্দটা শুরু হল একটু পরে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল একনাগাড়ে। বুঝতে পারছি ঘরে কিছু একটা চলছে। কিন্তু আমি ভয়নাক নিরুপায়। পাশ ফিরব সে উপায় নেই। বিছানার সাথে অদৃশ্য বাঁধনে যেন বাঁধা রয়েছে আমার শরীররটা। বাহ্য চেতনা লুপ্ত হয়নি একেবারেই। সবকিছুই অনুভব করতে পারছি আমার শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে। কিন্তু কিছুই যেন করার নেই আমার। শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে একমুহূর্তেই। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!
একটু
পরেই শব্দটা থামল। আবার মৃদু ঘটাং করে একটা
শব্দ উঠল। তারপর সব চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ পর শরীরটা অনেকটা আলগা হয়েছে মনে হল। খুব সন্তর্পণে পাশ ফিরলাম। বন্ধ চোখটা ধীরে ধীরে মেললাম। প্রথমেই নজর পড়ল ঘরের দরজার দিকে। সেটা যথারীতি খোলা। এবার চাইলাম ট্রেডমিলটার
দিকে। একটু আগের যন্ত্রচালিত শব্দটা
ওদিক থেকেই এসেছিল আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। ট্রেডমিলটাও দেখলাম তার দীর্ঘ শরীর নিয়ে আবছা অন্ধকারে আমার
দিকে ঝাপসা হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। গা-টা কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠল। ট্রেডমিলটার বোবা চাউনি আমার ঠিক ভালো লাগল না। জোর করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঘরের আলোটা জ্বেলে দিতেই মনটা অনেকটা চনমনে হয়ে উঠল। প্রথমেই নজর গেল সুইচটার দিকে। ট্রেডমিলটার সুইচটা আজও অন। রোজ রোজ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কারই বা ভালো লাগে! মেজাজটা বিগড়ে রইল সারাটা দিন ধরে।
****
আজ রাতে
আমি তক্কে তক্কে রয়েছি। আজ আমাকে এ রহস্যের কিনারা
করতেই হবে। কে আসছে আমার ঘরে এই হালকা
শীতের কাকভোরে? কে এই রহস্যময় আগন্তুক!
বেশ তাড়াতাড়ি
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ট্রেডমিলটার প্রতি আমি আগ্রহ
হারিয়ে ফেলেছি অনেকটাই। ওটা ছুঁতেও যেন এখন আর ইচ্ছা
করছে না। মনে হচ্ছে এক দীর্ঘদেহী অশরীরী
এসে বসে আছে আমার চোখের সামনে। মনে মনে একটা অস্বস্তি কাজ
করছে গতকাল থেকে। ঠিক করে ফেললাম, আজ রাতটাই শেষ। এটা আর ঘরে রাখা যাবে না। যার জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দিয়ে আসব মানে মানে। পুরনো জিনিস কেনার শখ আমার ঘুচে গেছে এ জন্মের মতো।
কখন যেন
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অঘ্রাণের হালকা শীতে পাতলা
চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমনোর মতো শান্তি বোধহয় আর কিছুই নেই! কিন্তু আজও ঘুমটা ভেঙে গেল শেষরাতে। খুব ধীরে আলতো চোখ মেলে চাইলাম। ঘরময় পাতলা অন্ধকার। দু’একটা মশা বিনবিনানি নিয়ে
কানের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আর একটু পরেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে আমার সাথে। আজ একটা হেস্তনেস্ত হবেই হবে।
মোবাইলের
মৃদু আলোয় সময় দেখলাম, ভোর চারটে বেজে কুড়ি। অর্থাৎ আর একটু পরেই…
হঠাৎ
মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঘরের জানালা আর দরজার ছিটকিনিটা খুলে দিলাম। আলতো করে ভেজানো রইল। এর ফলে ঘরের ঠান্ডা ভাবটা
দ্বিগুণ হল। গলা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে
আবছা অন্ধকারে অধীর আগ্রহ নিয়ে আমি নিশ্চুপ হয়ে অপেক্ষায় রইলাম।
মিনিট
দশেক পরে দরজায় মৃদু শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল খুব আলতো ছোঁয়ায়
দরজাটা কেউ ঠেলে খুলে ফেলল। আমি আজ দরজার দিকেই মুখ করে
শুয়ে আছি। খুব আলতো করে আধবোজা চোখে
চেয়ে রয়েছি। কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্যে
আমার সারা শরীরময় শিহরণ খেলে গেল। এ দৃশ্য দেখব সে আমার কল্পনাতেও
ছিল না। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলাম, অঘ্রাণের পাতলা কুয়াশা সঙ্গে নিয়ে আমার ঘরে
ঢুকছে দীর্ঘদেহী একটা আবছা ছায়া। তার পিছনে পিছনে আরও একটি
ঈষৎ খর্বকায় ছায়া। তবে কি এই কাকভোরে আমার ঘরে
এসে ঢুকে পড়েছে দুই চলমান অশরীরী! বুকের ভিতরে
ঠান্ডা শিরশিরানি টের পাচ্ছি। হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল ভয়ে, উত্তেজনায়। কিন্তু কীসের এক দুর্জয় সাহসে ভর করে আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে
রইলাম কাকভোরের দুই আগন্তুকের দিকে।
প্রথমজন
দেয়ালের সুইচটা অন করে ট্রেডমিলটাকে চালু করে দিলেন। দ্বিতীয়জন তখন গভীর মমতায় হাত বুলোচ্ছেন ট্রেডমিলটার গায়ে। যেন আদর করছেন তার প্রিয় পোষ্যকে। ক্রমশ আবছা অন্ধকারের স্তর ভেঙে স্পষ্ট হচ্ছে আমার চোখের সামনে
ছায়ামানুষের অবয়ব দু’টো।
প্রথমজন
একজন বৃদ্ধ। গা-ঢাকা পুলওভার, মাথায় মাঙ্কি
টুপি। সত্তরোর্ধ বয়স মনে হল। দ্বিতীয়জন স্থূল পৃথুলা শরীরের এক ভদ্রমহিলা। তার কান মাথা শরীর ঢাকা পশম চাদরে।
ট্রেডমিলটা
চালু হয়েছে। গররররর করে আওয়াজ হচ্ছে মৃদু। বোবা বিস্ময়ে লক্ষ করলাম ট্রেডমিলে উঠে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাঁর হ্যান্ডেলটা
ধরে হালকা জগিং শুরু করে দিয়েছেন ধীরগতিতে। আর দ্বিতীয়জন অর্থাৎ সেই
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা খুব মনোযোগ সহকারে সেই দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করছেন আনন্দিত মনে। এই স্থূল জগতের কোনও কিছুর প্রতিই যেন তাদের কোনও দায় নেই। কোনও আগ্রহ নেই।
অঘ্রাণের
কাকভোরের এই অদ্ভুত বিরল দৃশ্যটি দেখতে দেখতে আমি ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ঘেমে উঠলাম। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানি না। এই মুহূর্তে ভদ্রমহিলাকে জগিং করতে দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে সাহায্য করছেন নিবিষ্ট মনে।
হঠাৎ
শরীরে কীসের যেন এক প্রবল টান অনুভব করলাম। দুর্দম্য সাহস নিয়ে ঝটকায় উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। কিন্তু ভারি আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল সেই মুহূর্তে। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখলাম কোনও এক অলৌকিক জাদুবলে একটু আগে অভিনীত
হওয়া দৃশ্যখানা যেন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল। দৃশ্যান্তর ঘটে গেল চোখের
নিমেষে। আমার ঘরখানা শূন্য হয়ে খাঁ
খাঁ করতে লাগল। ভয়ানক চমকে উঠলাম। তবে কি আমি স্বপ্ন দেখছি এতক্ষণ! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একটু আগে আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা আর যাই হোক স্বপ্ন হতে পারে না কিছুতেই।
শরীরটা
ক্রমশ অসাড় হয়ে এল। আমার চেতনা যেন বিলুপ্ত হয়ে
আসছে। ট্রেডমিলটার দিকে চোখ পড়ল। মনে হল ওটা যেন এই মুহূর্তে আমাকে আকর্ষণ করছে তীব্রভাবে। চুম্বকের মতো টানছে আমার গোটা শরীরটাকে। আমি শক্ত করে শরীরটাকে বিছানার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু না, এক ঝটকায়
কখন যেন আমি উঠে পড়লাম ট্রেডমিলটার উপরে।
উঠতেই
ট্রেডমিলটা চালু হয়ে গেল। ডিসপ্লেটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, স্পিড অ্যাডজাস্ট হচ্ছে অটোমেটিক। প্রথমে ধীর লয়ে। আমি দৌড়োতে শুরু করেছি। ক্রমশ গতি বাড়তে থাকল। বাড়তেই থাকল। চোখ গেল ডিসপ্লেটার দিকে। ঘন্টায় চল্লিশ কিমি।
নাহ! এ অসম্ভব।
ক্রমশ
গতি আরও বাড়তে থাকল মারাত্মক হারে। পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলছে ডিজিটাল
মিটারের স্পিড। পাগলের মতো দৌড়োচ্ছি আমি। আমার শরীর থেকে যেন মনে হচ্ছে খুলে যাবে সমস্ত হাড়-পাঁজর। ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠল। শরীরটা যেন পালকের মতো খুলে
খুলে পড়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো হয়ে। দারুণ ভয়ে আমি ভয়ানক চিৎকার
করে কঁকিয়ে উঠলাম, আমাকে থামাও… কে আছ… আমাকে থামাও… বাঁচাও… কে আছ…
প্রচন্ড
যন্ত্রণার মধ্যে দেখি কখন যেন ট্রেডমিলটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই দু’জন ছায়ামানুষ। তারা আমাকে ওভাবে পাগলের মতো দৌড়োতে দেখে প্রচন্ড হাততালিতে
ফেটে পড়ছেন। ভদ্রমহিলা ঝুঁকে পড়ে ভয়ানক
বীভৎসভাবে হাসতে হাসতে যেন লুটিয়ে পড়ছেন মাটিতে। ভদ্রলোক আগুন চোখে আমাকে মাপছেন। চোখ দিয়ে যেন হুকুম করছেন,
জোরে, আরও জোরে… আরও…
স্পীডমিটারের
কাঁটায় গতি বেড়েই চলেছে। চারদিকে যেন আগুন ছিটকে পড়ছে এবার। আমি প্রচন্ড ভয়ে আর আতঙ্কে উন্মত্তের মতো দৌড়োতে দৌড়োতে আর্তচিৎকার
করে চলেছি গলা চিরে। থামাও… থামাও… কে আছ… থামাও… বাঁচাও আমাকে… বাঁচাও…
হঠাৎ
প্রচন্ড এক ধাক্কায় ঘটাং শব্দে ছিটকে গিয়ে পড়লাম হাত কয়েক দূরের শক্ত মেঝের ওপর। চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে ঘরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল দুই বৃদ্ধ
মানুষের গগনবিদারী কানফাটানো হাসির উল্লাসে।
****
জ্ঞান
ফিরতে সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করলাম। ব্যথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা। বাইরের খটখটে আলো এসে ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময়।
কাকভোরের
ঘটনাটা মনে পড়তেই থরথর করে কেঁপে উঠল শরীরটা। একবার মনে হল সত্যি। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল
স্বপ্ন। কারণ আমি মেঝেতে না, বিছানাতেই শুয়ে আছি ধ্বস্ত শরীরে। দেওয়ালের দিকে দেখি ট্রেডমিলের সুইচটা আজও অন। জানালা দরজাটাও যথারীতি হাট করে খোলা।
অনেক
কষ্টে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে আনলাম। ট্রেডমিলটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, আজই এর শেষদিন। একে বিদায় করে তবেই আমার শান্তি।
বেলার
দিকে ভদ্রলোককে ফোন করলাম। লাইনটা পাওয়া গেল না। যন্ত্রচালিত স্বর শোনা গেল বেশ কয়েকবার। নম্বরটি পরিসেবা সীমার বাইরে।
সন্ধের
দিকে দু’জন বন্ধুকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম ট্রেডমিলটাকে নিয়ে। আজ এটাকে বিদায় করে তবেই ঘুমাবো। এরকম সর্বনাশী জিনিসের সাধ আমার ঘুচে গেছে এ জন্মের মতো। ঘন্টাখানেক এ পাড়া সে পাড়া ঘুরে একটা গলির মুখে এসে ভ্যান রিকসা
থামালাম। এ গলিতে দু’টো বাড়ির পরেই
ছিল বাড়িটা। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে ট্রেডমিলটাকে
তুলে নিয়ে রওনা দিলাম গলির তিন নম্বর বাড়িটার দিকে। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওটার দিকে মনে হচ্ছে এই নিরীহ জিনিসটাই কত
বিশ্রী, কতটা ভয়ঙ্কর! কাল
রাতের ঘটনাটা বারে বারে ভেসে উঠছে মনের মধ্যে।
দু’টো
বাড়ি পেরিয়ে এসে ভয়ানক চমকে গেলাম। যে দৃশ্য নজরে এল তা দেখে
পা দু’টো যেন অভিশপ্ত রথের চাকার মতো গেঁথে যেতে লাগল মাটির সাথে।
এ কী
করে সম্ভব!
যে বাড়ি
থেকে সামান্য কয়েকদিন আগেই কিনে নিয়ে গেছি সেকেন্ড হ্যান্ড ট্রেডমিলটাকে, সেখানে এখন খাঁ খাঁ করছে একটা বাড়ির ভগ্নাংশ। একদিকে ফ্ল্যাট বানানোর তোড়জোর শুরু হয়েছে। বোবা বিস্ময়ে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে চেয়ে রইলাম।
বিহ্বল
হয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর পাশের বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমার মুখ থেকে সবকথা শোনার পর অবিশ্বাসে তিনি মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখেই শুনলাম, এই বাড়ির যিনি মালিক ছিলেন, তাঁরা স্বামী স্ত্রী এবং
তাঁদের একমাত্র সন্তান ব্যাঙ্গালোরে এক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে বছর দুয়েক আগেই গত হয়েছেন। তাঁদের বাড়িটাই ভেঙে এখন সরকারী উদ্যোগে আবাসনের কাজ শুরু হয়েছে।
হতভম্ব
হয়ে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ও.এল.এক্স-এর অ্যাপটা খুললাম। চেক লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়েও কোথাও সেই বিজ্ঞাপনটাকে আর খুঁজে পেলাম
না। মোবাইলের কল লিস্ট থেকেও
কখন যেন উধাও হয়ে গেছে নম্বরটি।
অসহায়ের
মতো যন্ত্রটার দিকে চাইলাম। চকচকে শরীর নিয়ে ট্রেডমিলটা
তখনও আমাকে ইশারা জানাতে থাকল এক ভয়ানক আবেদনে।
________
ছবি - সুজাতা
ব্যানার্জি
লেখক
পরিচিতি - বর্তমানে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় রত। শিশু
কিশোর সাহিত্য রচনায় অত্যান্ত সাবলীল। লেখেন এই সময়ের বহু পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশিত
গ্রন্থের সংখ্যা সাত। সম্পাদনা করেন জনপ্রিয় শিশু-কিশোর সাহিত্য পত্রিকা
ইষ্টিকুটুম এবং সীমান্তহীন সাহিত্য পত্রিকা পানকৌড়ি। ভালবাসেন কবিতা, গান আর
উন্মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়াতে। আগ্রহ ফটোগ্রাফিতে আর নির্ভেজাল
বন্ধুত্বে।
Good one
ReplyDelete