ছেলেবেলার গল্প
দেবজ্যোতি
ভট্টাচার্য
আমি যখন অনেক ছোটো, তখন কাকামণি চাকরি করত
ইন্দাসে। কাকামণির দৃঢ়বিশ্বাস ছিল ছোটোদের সুকান্ত আর নজরুলের কবিতা কন্ঠস্থ করে
ফেলাটা বিশেষ জরুরি কাজ। অতএব সঞ্চিতা আর সুকান্ত সমগ্র নিয়ে আমার ওপর নিয়ম করে আক্রমণ
শানানো হত। সাপ্তাহিক হোমটাস্ক হত একটা করে কবিতা।
শুক্কুরবার অনেক রাত্তিরে
কাকামণি বাড়ি ফিরত। আর শনিবার ভোরবেলা হেঁড়ে গলায় হাঁক পড়ত, “শান্ত—” (আমার এই
ডাকনামটার গল্প পরে বলব’খন। সেও এক ইতিহাস)
আমি ঘুম থেকে উঠে ভয়ে ভয়ে
গিয়ে দেখতাম, মশারির মধ্যে কাকামণি বসে। হাতে সঞ্চিতা। বিদ্রোহী মুখস্ত করতে দিয়ে
গিয়েছিল তার পড়া ধরা হবে এবারে।
মুখস্তবিদ্যেটা মন্দ ছিল না।
অতএব গলায় যতটা সম্ভব বীরত্ব এনে বেশ খানিক বলে গেলাম। কিন্তু মুশকিল হল “আমি
উন্মাদ, আমি উন্মাদ” সে জায়গাটাতে এসে। আমি বললাম,
আমি হুঁহুঁহুঁ
আমি হুঁহুঁহুঁ
আমি সহসা চিনেছি আমারে
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ
কাকামণির ভুরুদুটো গিঁট
পাকিয়ে উঠল। বলে, “হুঁ হুঁ করছিস যে বড়ো! কথাগুলো বল।”
আমি দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লাম।
কারণ ওইটে বললেই ভালোদিদি তারপর থেকে এমন খেপাবে যে সে আর বলার নয়। কাকামণি অবশ্য
অতশত বোঝেনি। ভেবেছে আমি ভুলে গেছি। চুপচাপ ছিল, হঠাৎ রেগে উঠে আমার কানদুটো মুলতে
মুলতে বেজায় জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি উন্মাদ—আমি উন্মাদ” এইটা তুই ভুলে গেলি কী
করে? বল বল—“আমি উন্মাদ—আমি উন্মাদ-”
হঠাৎ ঠাকুমা ঘর থেকে বেরিয়ে
এসে ভীষণ রেগে গিয়ে কাকামণিকে বলে, “তুই যে উন্মাদ, অত চিৎকার কইরা হেই কথাডা
দুনিয়ারে না জানাইলেও হইব। উন্মাদ না হইলে কেউ এইটুক ছ্যাড়ারে এইতা বিএ এমএ-র পড়া
পড়ায়? আবার কানে ধরস! ছাড়, ছাড় কইতাসি—”
ঠাকুমা আমার বেজায় ফেভারিট
বান্ধবী ছিল। ফর্সা টুকটুকে বুড়ি। থানকাপড় পরত ফেরতা দিয়ে। কোঁচকানো কাগজের মত
চামড়ার মধ্যে দিয়ে তার নীল নীল শিরাগুলো দেখা যেত। মাথায় খুদে খুদে করে কাটা চুল।
যখন সবে অক্ষর পরিচয় হয়েছে সেই সময়টা ঠাকুমার সঙ্গে ভারী মজার একটা খেলা চলেছিল
আমার অনেকদিন ধরে। সেইটে এইখানে বলে নি। বাড়ির পুবদিকের বেড়ার কাছে একটা দশেরি
আমের গাছ ছিল। তার ঠিক তলায় বাড়ির পুবদরজা। তার নিচে গাছতলায় পরিষ্কার উঠোন। দুপুর
গড়িয়ে যেই বিকেলের মুখমুখ হত, অমনি সেখানে পাড়ার হরেক বুড়োবুড়ি এসে জড়ো হত। তাদের
কোনও তাড়া ছিল না। বেশ অনেকজন এসে জড়ো হলে ঠাকুমা
এসে দরজার কাছে ঘরের মেঝেতে বসত। সামনে একটা জলচৌকি পেতে তাতে রাখা হত কৃত্তিবাসের
রামায়ণ বা কাশীদাসি মহাভারত। তারপর ঠাকুমা তার থেকে সুর করে পড়ে শোনাত সবাইকে।
ঘন্টাদুয়েক পড়া চলবার পর সব্বাই ফের যে যার বাড়িতে চলে যেত। বর্ষার দিনগুলো বাদ
দিয়ে সারাটা বছরই এমনটা চলত। ম্যাগাজিনের ধারাবাহিক উপন্যাসের মতন। রামায়ণ পড়া
শুরু হল ত চলল দু’তিনমাস ধরে। শেষ হল তো শুরু হল মহাভারত। সেও শেষ হয়ে গেলে ফের
রামায়ণ, এমনি করে।
দুপুরবেলা আমাকে ঘরে আটকে
রাখা একটা কঠিন কাজ ছিল। তা সে মুশকিলের আসান করল ঠাকুমা আমাকে একটা চাকরি দিয়ে।
আমার প্রথম চাকরি। ঠাকুমা যখন পড়বে আমায় তখন তার মাথার পাকাচুল বেছে দিতে হবে। এক
পয়সায় একটা।
ঠাকুমার মাথা ছিল কাশবনের
মতন। কাজটা তাই দেখতে সহজ হলেও আসলে কঠিন ছিল। কারণ ঠাকুমার মাথার চুল হত ধর গিয়ে
দু’তিন মিলিমিটার লম্বা, আর তাতে কষে নারকেল তেল মাখানো। সে চুল আঙুলে করে তোলবার
চেয়ে জলের থেকে শিঙিমাছ হাতে করে ধরাও অনেক সোজা।
ছবিটা আমার এখনও চোখে লেগে
আছে জানো? পুবের দরজায় ঠাকুমা জলচৌকির ওপর ঝুঁকে রামায়ণ পড়ছে আর আমি তার পিঠের ওপর
ঝুঁকে তাই শুনতে শুনতে বেজায় মনোযোগ দিয়ে একটা একটা পাকাচুল শিকার করতে করতেই কোনও
কোনও পাতায় রবিবর্মার সেই অসাধারণ ছবিগুলোর কোনও
একটা এলে তাই দেখছি। কিংবা কোনও জায়গার পাঠ জড়িয়ে গেলে ঠাকুমার মুখটা টেনে ধরে
বলছি, “আরেকবার বলো।”
এমনি করতে করতেই একসময় দেখলাম
আমার সদ্যচেনা অ, আ, ক, খ গুলো কেমন করে যেন কাশীরাম, কৃত্তিবাসের বইয়ের পাতায়
জুড়েমিশে গিয়ে ঠাকুমার মুখে বলা কথাগুলো তৈরি করে ফেলছে। সে এক মহা ম্যাজিক যেন।
মাথার চুল তোলা ভুলে তখন মাঝেমাঝেই ঠাকুমার পিঠে ভর দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠি,
সুগ্রীব বলেন, দেখ আসে দুই নর।
মনে করি, বালি রাজা পাঠাইল চর।।
কিছুদিন বাদে ঠাকুমা এক নতুন
কায়দা করল। মাঝেমাঝেই পড়া থামিয়ে বলে, “দাদা আমার গলা শুকাইয়া গ্যাছে, তুমি একটু
পইড়া শুনাও দেখি!”
নতুন বিদ্যে নিয়ে আমার তখন
বেজায় উৎসাহ। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ভুলভ্রান্তিভরা পাঠ চলে থেমে থেমে, আর থেকে থেকেই
হাসির রোল ওঠে নীচের উঠোনে জমায়েত শ্রোতাদের মধ্যে।
মাসকয়েক বাদে দেখা গেল ছবিটা
বদলে গেছে। সামনে মোটকা রামায়ণ নিয়ে খুদে নাতি রিণরিণে গলায় পড়ে চলেছে। আর ঠাকুমা
গর্বিত মুখে পাশে বসে বসে জমায়েত হওয়া পাড়ার লোকেদের দিকে দেখছে।
মাসের পর মাস ধরে পুবের দরজায়
বসে একটু একটু করে সেই আমার প্রথম বই পড়া। রামায়ণ আর মহাভারত। সেই ভালোবাসা আজও
যায়নি। ওরকম অ্যাকশন প্যাকড থ্রিলার দুনিয়ায় আর আছে নাকি? ভাবো দেখি, পাহাড় উপড়ে
নিয়ে আকাশপথে সুপারম্যান হনুমান উড়ে চলেছে, তাকে বুকে ঢিল মেরে মাটিতে পেড়ে ফেলল
ভরত। তারপর সব শুনেটুনে তিরের পরে তিরের পরে তির মেরে মেরে তাকে ফের পাহাড়শুদ্ধু
আকাশে তুলে দিল আর হনুমানও দিব্যি শোঁ ও ও করে উড়ে লংকায় চলে গেল। আর সমুদ্রের
বুকে সুরসা রাক্ষসী ভার্সাস হনুমানের ফাইট সিকোয়েন্সটা—উফ্ফ্। সেটা যেদিন পড়লাম
তারপর দু’রাত ঘুম হয়নি। খালি স্বপ্নে দেখি, সমুদ্রের ঢেউ থেকে নাকে নোলক পরা একটা
ইয়াব্বড়ো মনস্টারের মুন্ডু আকাশের দিকে উঠে আসছে আর ট্র্যাক্টর বিমের মত হনুমানের
ছায়াটা ধরে তাকে টানছে মুখের দিকে। (এরপর কী হল সেটা তোমরা পড়ে নিও। আমি বলছি না।)
তোমরা যে যাই বলো, আমার কাছে প্রথম
আর শেষ সুপারম্যান অ্যাকশন হিরো কিন্তু --- ঠিক ধরেছ—হনুমান। ও আর কোনওদিন বদলাবে না।
তা হিরোকে অনুসরণ করে
হনুমানগিরি কম করিনি জীবনে। তার মধ্যে যে কাণ্ডটা বাধিয়ে বাড়িতে হৃৎকম্প তুলে
দিয়েছিলাম সেইটে বলে আজকের মত থামব। জ্যোতিভূষণ চাকিমশাইয়দের বাড়ি ছিল আমাদের
বাড়ির একেবারে কাছে। ওঁর ভাই প্রীতিকাকু, মানে কবি প্রীতিভূষণ চাকি ছিলেন আমাদের
সবার প্রিয় প্রীতিকাকু। নানা আবৃত্তির
আসরে অনুষ্ঠান করবার মহলার জন্যে মাঝেমধ্যেই আমরা দল বেঁধে তাঁর বাড়িতে হাজির
হতাম। মহলা চলত। আর চলত গল্প, হাসি খাওয়াদাওয়া। আমাদের বাড়িতে তখন টিউব লাইট ছিল
না। প্রীতিকাকুর বাড়িতে গিয়ে একবার দেখলাম, হলদে বালবের জায়গায় একট সাদা ডান্ডা
দেয়ালে বসানো, আর তার থেকে আশ্চর্য নরম সাদা আলো বের হচ্ছে। জানা গেল ওই হল টিউব
লাইট।
দেখেই মাথায় মতলব খেলে গেল।
বাড়িতে টিউব লাইট লাগাতে হবে। বেজায় বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে টেকনোলজিটা সহজেই বুঝে
ফেলেছিলাম। একটা লম্বা ডান্ডা থাকবে দেয়ালের গায়ে। আর তার থেকে আলো বের হবে। অতএব
জোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। বড়োদের সঙ্গে এসব ব্যাপারে পরামর্শ করার মানে নেই। তারা
যোগবিয়োগ লসাগু গসাগুর বাইরে কিছু বোঝে না। নিজেনিজেই অতএব বন্দোবস্ত সেরে ফেললাম।
একটা কাঠের লম্বা ডান্ডা আর খানিক পাটের সুতলি। তারপর
ঘর ফাঁকা পাবার অপেক্ষা।
সুযোগও এসে গেল। সেদিন
সন্ধেবেলা মা প্রদীপ দিয়ে দোকানের দিকে গেছে। দিদিরা কেউ বাড়ি নেই। কেউ টিউশন করতে
গেছে, কেউ টিউশন পড়তে। ঘরে আমি একা। অতএব তাড়াতাড়ি কাঠের ডান্ডাটাকে দেয়ালের
ছিটেবেড়ার গায়ে সুতলি দিয়ে বেঁধে ফেললাম। বাকি কাজটা সহজ। রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের
বোতল এনে টিউবলাইটের গায়ে খানিক ছিটিয়ে দিয়ে ঠাকুরের সামনে থেকে প্রদীপটা এনে
ছোঁয়াতেই আমার টিউবলাইট জ্বলে উঠেছে। ঘর আলোয় আলো।
ভাগ্য ভালো, মা ঠিক তক্ষুণি
ফিরে এসেছিল। বালতি দুয়েক জল ঢেলে টিউবলাইট তো নেভানো হল। তারপর আমার যা হয়েছিল সে
লজ্জার কথা আর দুনিয়াশুদ্ধু লোককে নাই বা বললাম।
আমি যেবার ক্লাশ সেভেনে পড়ি
সেবার আমাদের ঘরে প্রথম টিউবলাইট জ্বলল। সেদিন সে আলোর তলায় বসে অঙ্ক কষতে গেছি
ঠিক তখন মাথার ওপর একটা ইয়াবড়ো সাপ নেমে এসেছিল। তবে সে গল্প পরে কখনও হবে। আজ এই পর্যন্ত।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য |
_______
অলঙ্করণ - তন্ময় বিশ্বাস
action packed chhelebela
ReplyDeleteএই বিভাগটা একদম জমজমাট। পরের বার কে আসে দেখি।
ReplyDelete