গল্পের ম্যাজিক:: মঙ্গল যাত্রা - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


মঙ্গল যাত্রা
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

হ্যাঁ, আমরা সবাই চলেছি মঙ্গল যাত্রায় পৃথিবীটা এক্কেবারে থাকার অযোগ্য হয়ে গেছে তার জন্য দায়ী অবশ্য আমরাই অসুখ-বিসুখে, পলিউশনে, দাঙ্গায়, অতিমারী, মারামারিতে একেবারে শেষ ধম্ম ধম্ম করে অধম্ম বেড়ে গেল
পৃথিবী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়েই  চলল ‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকাবনে’, মহাপুরুষেরা আর আসছে না কলি যুগ পার হতে চলল
তাই আমাদের মঙ্গল যাত্রায় মঙ্গল শঙ্খ বাজিয়ে দাদু একবার ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটা গেয়ে দিল
তীরবেগে শোঁ শোঁ শব্দে আমরা এগিয়ে গেলাম বড়োজেঠু প্রচণ্ড ভয়ে বড়ো জেম্মার গায়ের ওপর আসতেই জেম্মা এমন এক ধাক্কা দিল, জেঠু এসে আমার ঘাড়ে পড়ল আমার হাত থেকে জুসের বোতল ছিটকে গিয়ে হাড়জ্বালানো সেজদার গায়ে পড়তেই সেজদা শাসাল, “এই অপু, যদি ফের এরকম দেখেছি, মহাকাশে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেব।”
আমরা ইতিমধ্যে মহাকাশের মহাসমুদ্রে চলে এসেছি জেঠুর টাকের মতো চকচকে গ্রহদের পৃষ্ঠদেশ দেখা যাচ্ছে সবাই যখন জানালা দিয়ে গ্রহ তারা দেখতে ব্যস্ত তখন ছোটকা অদৃশ্য একটু আড়ালে গিয়ে ওপরে তুলে রাখা রসগোল্লার কৌটো বার করার চেষ্টা করছে আসলে এখানে আসতে হবে বলে ওজন কমানোর জন্য ছোটকাকে কড়া ডায়েটে রাখা হয়েছিল তিন দফা টকদই আর শসা
কাকুর ব্যাপার-স্যাপার প্রথমে দাদুর, তারপর জেঠুর, তারপর আমাদের চোখে পড়ল সবাই হই হই করে উঠেছি এমন সময় ছোটোকাকু রসগোল্লার কৌটোটা বগলদাবা করে দরজা খুলে মাস্ক মুখে দিয়েই মহাকাশে এক লাফ দিল সবাই হাহাকার করে উঠল
দাদু হাত নেড়ে বলল, “চিন্তা কোরো না, ওর গায়ে অক্ষয় কবচ দিয়েছিল ওর ঠাকুমা ওর কিছু হবে না ওকে আমরা ঠিক খুঁজে বের করব।”
এর মধ্যে আমাদের যানের ক্যাপ্টেন সায়েন্টিস্ট মেজকা বলল, “ওকে আর খুঁজে পাব না আমরা, নিজেরাই তো হারিয়ে গিয়েছি এই দেখো, ম্যাপটা উলটো ছিল যে খেয়াল করিনি তারপর এখন একটা এস্টেরয়েড ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে।”
“সে কী!” বলে হেঁচকি তুলে জেঠু হামাগুড়ি দেওয়ার পজিশনে সিট্ থেকে নেমে বসে পড়ল
আমি এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বললাম, “ও তো তোমার ম্যাপে মশা মারার দাগ।”
“মশা কে মেরেছিল শুনি? মেজকা মুখ খিঁচিয়ে বলল
হাড়জ্বালানো সেজদা বলল, “নিশ্চয়ই অপু তাছাড়া আর কে?”
বুঁচি বমি-টমি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ জেগে উঠল ধড়মড় করে। বলল, “মঙ্গল কি এসে গেছে মা?
“হ্যাঁ মা, এই তো এসে গেছে,” বলে জেঠিমা আমার দিকে তাকিয়ে ওকে কিছু বলতে নিষেধ করল ইশারা করে
বুঁচি অমনি উঠে বসে আয়নাটা বার করে লিপস্টিক, লাইনার, কাজল, পাউডার সব বার করে সাজতে বসল
বললাম, “এত সেজে কী হবে? তোর ওই বোঁচা নাকের চেহারা দেখে কোনও এলিয়েনই তোর কাছে আসবে না।”
বুঁচি নাকিসুরে বলল, “দেখো মা অপুটা কী বলছে।”
এর মধ্যেই একটা গড়গড় গড়রাম শব্দে আমাদের যান যেন কোথায় একটা এসে নামল
মেজকা দেখলাম মাথায় হাত দিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে পড়েছে
দাদু অভয় দিয়ে বলল, “দূর, এত চিন্তা কীসের? মঙ্গলই হোক আর জঙ্গলই হোক, বিপদ বরণ বাঁড়ুজ্যে কি এমনি এমনি আমার নাম?
দাদুকে অনুসরণ করে আমরা সবাই একে একে নেমে এলাম
দাদু মাস্কটা সরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলল, “আহ! চমৎকার বাতাস এখানে। দিব্যি শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে।” শুনে আমরাও মাস্ক খুলে ফেলে আনন্দে লাফাতে শুরু করলাম দাদু আপন মনে গেয়ে উঠল ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’। গাইতে গাইতে দাদু সামনের কুয়াশার মধ্যে কোথায় জানি উধাও হল বুঁচি ক্যামেরাটা বার করে “ও মা, এলিয়েনের ছবি তুলব” বলে
হাড়জ্বালানো সেজদা আমার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, “এই গ্রহটার নাম কী বল তো?
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী জানি? হবে একটা কিছু
সেজদা আরেকটা গাঁট্টা মেরে বলল, “পারলি না তো? ফেল ফেল গলগ্রহ।”
হ্যাঁ! তুমি তো সব জানো!” বলতে গিয়ে দেখলাম সেজদাও কোথায় একটা চলে গেছে আমার চারপাশটা এত তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল কেন কে জানে?
চারপাশটা কেমন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া তার মধ্যে কেমন একটা ফিসফিস আওয়াজ
আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল
মনে হয় অনেকক্ষণ কেটে গেছে চোখ খুলে মাথার ওপর লাল নীল তারায় ভরা আকাশ দেখতে পাচ্ছি বাকি আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না এখানে রাস্তাগুলো গোলাপি ঢেউ খেলানো, আঁকাবাঁকা কিছুক্ষণ হাঁটলে কীরকম গোলকধাঁধার মতো লাগে অনেকবার ঘুরেফিরে ডাক দিলাম জেঠু, জেম্মা, বুঁচিইইইই, মেজকা, সেজদাআআআ কোনও সাড়া নেই
হঠাৎ মনে হল যেন দাদুর গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাচ্ছি এই গলা চিনতে আমার একটুও অসুবিধে হয় না
এই গোলাপি গ্রহে তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটা যায় নইলে আমার এত হাঁটার অভ্যেস নেই বাপু বেশ ভেসে ভেসেই যাচ্ছি মনে হচ্ছে কিন্তু রাস্তায় জনপ্রাণী নেই যদি এখানে কোনও প্রাণী থেকেও থাকে, হয় তারা ঘুমুচ্ছে নয় আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ করছে ভাবতেই একটা কাঁপুনি লাগল
যেখানে এলাম সেখানে একটা ইগলুর মতো দেখতে ঘর দেখতে পেলাম তার মধ্যে থেকেই গানের আওয়াজটা ভেসে আসছিল
ভেতরে গিয়ে দেখি, কী অদ্ভুত কাণ্ড! স্বচ্ছ কাচের বুদ্বুদের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সবাই দাদু, জেঠু, জেম্মা, বুঁচকি
দাদু রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে চলেছে নিজের মনে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে? আবার অদৃশ্য শ্রোতাদের হাত তুলে ধন্যবাদ বলছে বলছে, “না না, কী যে বলেন, আমি শিল্পী নই আরেকটা কিছুতেই গাইতে পারব না।” তারপর লজ্জা লজ্জা মুখ করে পরের গানটা শুরু করছে ‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি।’
আর ওদিকে বুঁচকি বলছে, “আমি সত্যিই মিস ইউনিভার্স হয়ে যাব ভাবতেই পারিনি কী যে ভালো লাগছে।” এই বলে বুঁচকি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করল তারপর হাত নেড়ে নানারকম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পোজ দিতে শুরু করল যেন চারদিক থেকে ওর ছবি তোলা হচ্ছে
জেম্মা বলছে, “রাঁধুনি নাম্বার ওয়ানের শো-তে আসতে পেরে আমার দারুণ লাগছে আজ আমি আমার লৌহচুর থাম্বিট্টু দক্ষিণী লাড্ডু তোমাদের শেখাব।”
জেঠু যেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে কুস্তি লড়ে তাকে পরাস্ত করেছে বলছে, “আর ভয় করি না, এমন প্যাঁচে ফেলব তোকে - হাফ মার্ডার ডবল চিঁ চিঁ।”
আমার ভরসা ছিল যে সায়েন্টিস্ট মেজকা নিশ্চয়ই এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে, তা দেখি মেজকাও ওই বুদ্বুদের মধ্যে বন্দি হয়ে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে নোবেল জয়ের ভাষণ দিচ্ছে
এমন সময় দেখি হাড় জ্বালানো সেজদা কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছে, আমার সামনে হাত জোড় করে মিনতি করে বলছে, “অপু, খুবই ডেঞ্জারাস গ্রহ এটা এখানকার প্রাণীদের চোখে দেখা যায় না ফিসফিস করে কানের কাছে কথা বলে মানুষকে বশ করে নেয় যেমন আর সবাইকে করেছে তুই একটা কিছু কর অপু।”
আমি খুব খুশি হয়ে বললাম, “তাহলে মানছ আমি পরিবারের মধ্যে সব থেকে বেশি বুদ্ধিমান?”
“হ্যাঁ, মানছিই তো।”
“যতীন, মানকে, ভূতো - সবার থেকে আমার বুদ্ধি বেশি?”
“হ্যাঁ, তুই তো পাড়ার বেস্ট বয় ঘুঘুডাঙ্গা ভুবনমোহিনী স্কুলের রত্ন।”
“একদিন আমি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কিছু একটা হয়ে যেতেই পারি?”
এর মধ্যে যেন কার ফিসফিসে গলা শুনতে পেলাম “এই হতভাগা অপু, ওর কথা শুনিসনি রে কান চাপা দে তাড়াতাড়ি আপনা আপনিই হাতদুটো কানের ওপর চলে গেল।”
তারপর দেখি চোখের সামনে সব একে একে উধাও হতে শুরু করল কেউ নেই চোখের সামনে, শুধু গোলাপি গ্রহের ধু ধু প্রান্তর কোথা থেকে সেখানে রসগোল্লার হাঁড়ি হাতে উড়তে উড়তে নামল ছোটকা কী করে এমনভাবে নামল কে জানে!
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “হুঁ হুঁ, আমাকে বশ করা এত সহজ না, বুঝলি আমি সারাজীবনে একটাই জিনিস চেয়েছি, রসগোল্লা আর রসগোল্লা আর সেটা আমার হাতেই আছে আমিই বরং রসগোল্লা খাইয়ে এলিয়েন ছানাকে বশ করেছি।”
এলিয়েন ছানা কই দেখি?”
ওদিক থেকে টুকি দিল নেড়া মাথা দুটো চুল, তিনটে দাঁত।
এ তো মনে হচ্ছে আমার ক্লাস টু-তে পড়া ছাত্তর ভেংচু
ভেংচু আমাকে ভেংচি কেটে প্রবল হাসতে শুরু করল মাত্তারমোছাই, মাত্তারমোছাই হি হি হি হি
চোখ খুলে দেখি, অনলাইন ক্লাসে ভিডিও অন করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী সব মহাজাগতিক স্বপ্ন দেখেছি ভেংচুর চোখমুখ দেখে মনে হল কিছু ভুলভাল বকেছি, সেটা রেকর্ডও করেছে
হাত জোড় করে বললাম, “ভেংচু, ভিডিওটা কিন্তু কোথাও পাঠিও না লক্ষ্মী সোনা ভেংচু।”
ভেংচু ভেংচি কেটে বলল, “পাতিয়ে দিয়েতি, ছব গ্লুপে, ফেছবুক, হোয়া ছাপ, ইনতা গ্লাম...”
_____
ছবিঃ লেখক

4 comments: