গল্পের ম্যাজিক:: আরুন্সিদের অভিশাপ - তন্ময় ধর


আরুন্সিদের অভিশাপ
তন্ময় ধর

রাত্রি পৌনে এগারোটায় যখন টার্কুইনিয়া স্টেশনে নামলাম, তখন চারপাশ শুনশান। তিনজন রহস্যময় মানুষ ট্রেনের সামনের দিক থেকে স্টেশনে নেমেই মুহূর্তের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। অক্টোবরের রাত্রির তীব্র শীতল হাওয়ায় স্টেশনের টিমটিমে আলোগুলো যেন আরও ভৌতিক হয়ে উঠল। খাস ইউরোপে এই জেট যুগেও যে এমন মধ্যযুগীয় অন্ধকার পরিবেশ কোথাও থাকতে পারে, এতটা প্রত্যাশা করিনি। স্টেশনে অবশ্য ওয়াই-ফাই ছিল। তাতে জুড়ে ফোন থেকে হোয়্যাটস অ্যাপে ক্রমাগত কল করে চলেছি কনফারেন্সের উদ্যোক্তা মার্সেলোকে। ফোন তুলছেন না উনি। রাতের হাওয়ার শীতলতা বেড়ে চলেছে।
হঠাৎ অন্ধকার গাছপালা আর পরিত্যক্ত গাড়ির পিছন থেকে রহস্যকাহিনির নায়কের মতো আবির্ভূত হলেন মার্সেলো।
“আই প্রিজিউম, অর্ক। স্যরি ফর দ্য ডিলে।”
আমি হাসলাম। গাড়িতে বসেই মার্সেলোর প্রশ্ন, “ইতালিতে আগে আসা হয়েছে কি?”
“না। ইউরোপেই প্রথম।”
“ওকে,” মার্সেলোর হাসি আরও চওড়া হল, “সো, এনি স্পেশ্যাল ইন্টারেস্ট? কনফারেন্সের বাইরে স্পেশ্যাল কিছু দেখতে চান?”
“সময় পেলে কোনও পুরোনো রহস্যময় দুর্গ দেখার ইচ্ছে আছে।”
“রহস্যময় মানে? ভৌতিক? অলৌকিক?”
মাথা কাত করলুম। মার্সেলো কান-এঁটো-করা হাসি হাসলেন, “আমারও এসব ব্যপারে বিপুল উৎসাহ। আমার জীবনেই এ নিয়ে রহস্য গল্প আছে। তবে এখানে কাছাকাছি তো তেমন কিছু নেই। কনফারেন্সেও ঠাসা কর্মসূচি। দেখা যাক, যদি সময় বের করা যায়, এখান থেকে ঘন্টা দুয়েকের দূরত্বে জঙ্গলের মধ্যে একটা পরিত্যক্ত ভৌতিক দুর্গ আছে... আমিই নিয়ে যাব সময় বুঝে।”
হঠাৎ করে ব্রেক কষলেন, “সামনের এই হোটেলেই আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। মালিককে সব বলা আছে। জাস্ট কনফারেন্সের ইনভিটেশন লেটার দেখিয়ে, রেজিস্টারে সই করে রুমে ঢুকে যান। রুমেই রাতের খাবার পৌঁছে যাবে। অন্য এক সায়েন্টিস্টকে আনতে আমাকে সিবিটাবেচিয়া যেতে হবে এক্ষুনি। প্লিজ অনুমতি দিন।”
দেরি না করে মার্সেলো চলে গেল। আর হোটেলে ঢুকে ঘর দেখে আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম। হোটেলটা আসলে প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো এক দুর্গের অংশ। পাথুরে সিঁড়ি, পাথুরে লতাপাতা আঁকা দরজা-জানালা, প্রাচীন ধাতুপাত্র আর মৃৎপাত্রের অতুলনীয় শৈল্পিক অলঙ্করণ ঘরটাকে আমার প্রত্যাশার সহস্রগুণ করে রেখেছে। খিদে বিশেষ ছিল না। সামান্য পাস্তা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের বারো ঘন্টার জার্নিতে শরীর বেজায় ক্লান্ত ছিল। শুয়ে পড়তেই গভীর ঘুম।
হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বিছানায় বসে দেখি চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলটা কোথায় রেখেছি, হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছি। অদ্ভুত একটা ভয়ে ঘামে সারা শরীর ভিজে গিয়েছে। অনেক চেষ্টায় মোবাইল খুঁজে পেয়ে টর্চ জ্বেলে হোটেল রুমের বাইরে এলাম। সিঁড়িতেও ঘন অন্ধকার। হয়েছেটা কী? সারা হোটেলের ফিউজ উড়ে গিয়েছে নাকি? তিনতলা থেকে নামতে নামতে একেবারে হোটেলের লবিতে চলে এলাম। চারপাশে রাস্তায় এবং অন্যান্য হোটেলে নিষ্প্রভ আলো জ্বলছে। হঠাৎ খেয়াল হল এতক্ষণ ধরে ভয়ে-উত্তেজনায় সময় দেখা হয়নি। মোবাইলে দেখলাম, রাত একটা বেজে বাইশ মিনিট।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক চেপে হঠাৎ একটা গাড়ি থামল গেটের কাছে, “অর্ক, এনিথিং রং? এত রাতে হোটেলের বাইরে!”
“নাথিং রং স্যার। হোটেলের আলো হঠাৎ নিভে গিয়েছে। কীসের একটা চিৎকারও শুনলাম। তাই দেখতে এসেছিলাম। এসে দেখছি কেউ নেই। হয়তো ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছি। এনিওয়ে, তখন তাড়াহুড়োয় শুভরাত্রি জানাতে ভুলে গিয়েছি। শুভ রাত্রি।”
“ইয়া... ওয়েলকাম,” মার্সেলো অদ্ভুতভাবে হাসলেন, “আপনাকে কিন্তু আমি এখনই গুড নাইট জানাতে চাইছি না। আমি নিজে রাতে ঘুমোই কম। তার ওপর আজ তিনজন গেস্টকে রিসিভ করতে গিয়ে ঘুম কেটে গিয়েছি। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আই হ্যাভ আ প্ল্যান। আজ এখনই কিন্তু একটা অভিযান হয়ে যেতে পারে। ঘন্টাদুয়েকের দূরত্বে সেই ভৌতিক দুর্গটায়। রাতে পারমিশন দেয় নাকিন্তু ওই এলাকার পুলিশ ইন্সপেকটর আমার বিশেষ পরিচিত। আজ অমাবস্যার রাত। এখন স্টার্ট করলে রাতের ফাঁকা রাস্তায় আড়াইটের মধ্যে পৌঁছে যাব।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজি হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। শুনশান রাস্তায় গাড়ি যেন সুপারসনিক স্পিডে ছুটতে লাগল। পথের দু’পাশের বাড়িঘর আবছা কুয়াশার মতো হুশ করে মিলিয়ে গেল। অন্ধকার জঙ্গলের ভিতরের এক রহস্যময় পথে ছুটতে লাগল গাড়ি। রাস্তায় একটাও আলো নেই।
আশ্চর্য হলাম। এখানে আসার আগে টার্কুইনিয়া সম্পর্কে উইকি-গুগল ঘেঁটেছি ঢের। শহরের কান ঘেঁষে এমন জঙ্গল যে নেই, তা হলফ করে বলতে পারি। যত অবিশ্বাস্য গতিতেই গাড়ি চলুক, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এমন ঘন জঙ্গলে হাজির হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমার আশ্চর্য ভাবটা লক্ষ্য করেছিলেন মার্সেলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “অবাক হবেন না। সব জিনিস উইকি-গুগলে থাকে না।” তারপর অবিশ্বাস্য শীতল স্বরে আদেশ করলেন, “আপনার ফোন দু’টো সুইচ অফ করে দিন। নইলে কিন্তু ভূত দেখা হবে না।”
“কিন্তু এখনও তো প্রায় ঘন্টাখানেকের রাস্তা।”
“যা বলছি তাই করুন। প্রশ্ন করবেন না। ট্রাস্ট মি। প্রশ্ন করে আমি চরম দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। সে গল্প পরে বলব। এখন যা যা করতে আদেশ করব, নির্দ্বিধায় তা করতে হবে আপনাকে।”
মার্সেলোর গলার স্বর ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে। মুখের পেশীগুলো শক্ত, চোখদুটোও অস্বাভাবিক লাল। কে বলবে, এই মানুষটিই কত শান্ত বিনীতভাবে আমাকে মাত্র তিন ঘন্টা আগে টার্কুইনিয়া স্টেশনে রিসিভ করেছিলেন।
ঘ্যাঁচাং করে ব্রেক চাপলেন মার্সেলো।
“নামুন এবার। প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা এবার পায়ে হেঁটে যেতে হবে। রাস্তার ধারে কিছু দেখলে সেদিকে তাকাবেন না। আর কোনও শব্দ শুনলে পেছনের দিকে তাকাবেন না,” হুকুম করে গাড়ি থেকে নামলেন মার্সেলো। “আমার পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকুন,” বলে হাঁটা শুরু করলেন।
জল-কাদা-পাথর আর গাছের ভাঙা ডালে জর্জরিত সে রাস্তার মতো খারাপ রাস্তা আমি জীবনে দেখা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি কোনোদিন। গাড়ি থেকে নামামাত্রই পচা মাংসের একটা বীভৎস গন্ধ এসে নাকে লেগেছিল। সেটার তীব্রতা ক্রমশ বেড়ে চলল। সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার রাস্তায় আধবুড়ো মার্সেলো অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলতে লাগলেন। আমি জল-কাদা মাখামাখি হয়ে নিজের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা আর অদৃষ্টকে গালি গালি দিতে দিতে এগিয়ে চললাম। চোখের কোণে বারবার দেখছি, মাঝেমাঝেই পথের দু’পাশে ধোঁয়ার মতো কী যেন ছায়ামূর্তি নড়ে উঠছে। হঠাৎ দেখি, সামনে মার্সেলো নেই। অতিকায় এক প্রেতপুরী সামনের অন্ধকারে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে রহস্যময় ভৌতিক দুর্গের ছবি বা ভিডিও কম দেখিনি, ভুতুড়ে সিনেমাও কম দেখিনি, ভূতের গল্পও কম পড়িনি। কিন্তু আমার সমস্ত বোধ-কল্পনার চূড়ান্ত সীমা বহুগুণ ছাড়িয়ে শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিল ওই দুর্গ। পা দুটো যেন আটকে গিয়েছে। মুখ দিয়ে সামান্য শব্দও বের হচ্ছে না শত চেষ্টাতেও।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। মার্সেলো কোন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে অত্যন্ত নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে উঠলেন, “আরে আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। শিগগির দুর্গে ঢুকুন। আজ সত্যিই দেখা পাওয়া যাচ্ছে তাদের। ভেতরে ঢুকে হাজার ভয় পেলেও কিন্তু মুখে একটাও শব্দ করবেন না। প্রাণ গেলেও মুখে শব্দ নয়।” বলেই হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে হাড়হিম এক অন্ধকার জগতের মধ্যে আমায় টেনে নিয়ে চললেন।
খানিকটা এগিয়ে আরও একটা অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে পড়লেন মার্সেলো, “আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, ভয় পেলেও মুখে শব্দ করবেন না। যা বলার আমিই বলব। মোম জ্বেলে প্ল্যানচেট করতে হবে এখানে।” গলার স্বর একেবারে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, “অষ্টম আর নবম শতকে এখানে সত্তর জন মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সামনের ঘরটার মেঝের নিচে তাদের কঙ্কালগুলো পোঁতা আছে।” একটু থেমে অদ্ভুত স্বরে বলতে শুরু করলেন, “আমার ঠাকুর্দা একা এই ঘরে প্ল্যানচেট করেছিলেন। এরপর ছ’দিন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘর থেকে যেন বেমালুম উবে গিয়েছিলেন। বন্ধুবান্ধবেরা দুর্গের আশেপাশে পাহারায় ছিলেন। তাঁরা তাজ্জব হয়ে যান। অনেক খুঁজেও আশেপাশের কোনও জঙ্গলে বা গ্রামে পাওয়া গেল না। ছ’দিন পরে ঠাকুর্দা কোথা থেকে যে ফিরলেন কেউ জানে না। বদ্ধ উন্মাদ এবং স্মৃতিভ্রংশ। সারা শরীরে পচা মাংসের তীব্র দুর্গন্ধ। পরে বিস্তর চিকিৎসা করেও ঠাকুর্দার পাগলামি সারানো যায়নি, স্মৃতিও ঠিকঠাক ফেরেনি। কিন্তু কালো রঙের একটা ডাইরিতে ঠাকুর্দা বিস্তর আঁকিবুকি কেটেছেন। আমি পাঠোদ্ধারের বিস্তর চেষ্টা করে বুঝেছি ওই নকশা এবং আঁকিবুকিগুলো ওই দুর্গেরই বিভিন্ন অংশের। আমি এবং আমার জনাকয়েক বন্ধু দিনের বেলায় দুর্গে বারবার এসে বিভিন্ন অংশের নকশা তৈরি করেছি। কিন্তু অনেক রহস্যের সমাধান করতে পারিনি। দুর্গেই অনেক রহস্য রয়ে গিয়েছে। আর কোনও এক গুপ্ত পথে দুর্গের বাইরে কোনও এক ভয়ঙ্কর স্থানে গিয়েছিলেন ঠাকুর্দা। গোটা ডাইরিতে বিভিন্ন আঁকিবুকির মাঝে খাঁটি ইতালীয় ভাষায় ওই একটি কথাই কয়েকবার লেখা আছে - ‘পোর্তা দেল’ ইনফের্নো’ - অর্থাৎ গেটওয়ে অফ হেল, নরকের দ্বার। আমরা ছয় বন্ধু রাতের পর রাত বারবার প্ল্যানচেট করেও কিছু পাইনি। হতাশ হয়ে প্ল্যান বদলাতে হল। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ছিল রিকার্দো। সে অমাবস্যার রাতে একা বসল প্ল্যানচেটে। আমরা দুর্গের বাইরে একটু দূরে পাহারায় রইলাম। প্রায় ঘন্টা তিনেক বাদে রাত একটা নাগাদ দুর্গের ভিতর থেকে তীব্র পাশবিক চিৎকার ভেসে এল। আমাদের সঙ্গে বড়ো টর্চ আর বন্দুক ছিল। টর্চ জ্বেলে আমরা দুর্গের ভেতরে ছুটে এলাম। দেখি, রিকার্দোর মৃতদেহটা এই ঘরটার ঠিক মাঝখানে বীভৎসভাবে পড়ে রয়েছেচোখ দুটো বিস্ফারিত, যেন ভয়ঙ্কর কিছু একটা দেখেছে। দুটো হাতের ভঙ্গিমা এমন যেন সামনে থেকে আসা মারাত্মক কোনও আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। পায়ের জুতো ছিটকে পড়ে আছে দূরে। আর যেটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সেটা হল মাথার অর্ধেকটা তীব্রভাবে আগুনে পুড়ে গিয়েছে। স্থানীয় পুলিশ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনেছিল। তাঁরাও ওই আগুনের রহস্য উদ্ধার করতে পারেননি। অন্য কোনও অস্ত্রের চিহ্নও খুঁজে পাননি। তবে রিকার্দোর মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে খুনী বা খুনীরা একটা চিহ্ন এঁকে রেখে গিয়েছিল, যে জ্যামিতিক চিহ্নটা ঠাকুর্দার পোর্তা দেল’ ইনফের্নো কথাটার নিচে বারবার আঁকা ছিল। তার মানে এখানেই কোথাও সেই নরকের দ্বার আছে।” এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে মার্সেলো থামলেন।
“কিন্তু আমাদের কাছে কোনও অস্ত্র নেই। এই রাতের অন্ধকারে এসব খুঁজতে যাওয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। দিনের আলোয় সব দেখেশুনে খোঁড়াখুঁড়ি করলে হয়তো...”
“ভয় পাচ্ছেন? বাঙালী জাতি শুনেছি খুব সাহসী। আপনি আপনার জাতিসত্তার প্রতি অবিচার করছেন,” মার্সেলো ব্যঙ্গের স্বরে বললেন, “দিনের বেলায় খুঁজিনি ভেবেছেন? আর্কিওলজিস্ট থেকে শুরু করে অনেক রকম বিশেষজ্ঞ এনে সব মিলে তেইশ বার অভিযান চালিয়েছি, দিনে ও রাতের বিভিন্ন সময়ে। কিচ্ছু পাইনি। কিন্তু আজকে অদ্ভুত কয়েকটা ইঙ্গিত পেয়েছি, অদ্ভুত একটা গন্ধ পেয়েছি।”
মার্সেলোর কথা শেষ না হতেই সেই পচা মাংসের দুর্গন্ধটা যেটা এতক্ষণ কোথায় চাপা পড়েছিল, ভক করে বেরিয়ে এল। সেই গন্ধের আচমকা ধাক্কায় পেট মোচড় দিয়ে হড়হড় করে বমি হল আমার। বমির ঝাঁকুনিতে শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মাথা ঘুরে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম জানি না। চোখ খুলতেই দেখি, সামনে একটি মোমবাতি জ্বলছে। উদ্বিগ্ন মুখে এক বৃদ্ধা সামনে বসে আছেন। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে তিনি হাত দেখিয়ে নিরস্ত করলেন। তারপর বিশুদ্ধ ইতালীয় ভাষায় কীসব বলতে শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে ফোন সুইচ অন করে অনুবাদের সফটওয়্যার চালু করলামবৃদ্ধার দীর্ঘ কাহিনি শুরু হল, “বাবা, যেসব ভূতের গল্প এ দুর্গ সম্পর্কে শুনেছ, তা সত্যি নয়। এখানে কোনও ছায়ামূর্তি দেখা যায় না, চিৎকার শোনা যায় না। সবই ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিভাগের কারসাজি। মার্সেলোর দাদুর পাগল হওয়া বা রিকার্দোর মৃত্যু - সবই তাঁদের নিজেদের ভুলে, স্বাভাবিক দুর্ঘটনায়। কোনও অলৌকিক ঘটনার হাত এগুলোর পেছনে ছিল না। তবে ওঁরা জাতিস্মর ছিলেন। বহু পূর্ব জন্মের এক মর্মান্তিক স্মৃতি ওঁদের তাড়া করে এখানে এনেছিল। তারই জেরে মার্সেলোর ঠাকুর্দার উন্মাদ হওয়া এবং রিকার্দোর মৃত্যুবাবা, তুমি জন্মান্তর বিশ্বাস কর?”
বৃদ্ধা এমন করুণ এবং সমর্পিত স্বরে প্রশ্ন করেছেন যে ‘হ্যাঁ’ ছাড়া কোনও উত্তর দেওয়া যায় না। মাথা কাত করলাম। বৃদ্ধা হাসলেন, “সে জন্মে তুমি আর মার্সেলোই আমাদের অনেককে বাঁচিয়েছিলে। সে কাহিনি হয়তো তোমার স্মরণে নেই। কিন্তু ছবিগুলো দেখলে এবং সে জায়গায় গেলে তোমার সবই মনে পড়বে।” প্রাচীন এক পানপাত্রে কোনও এক অজানা ফলের রস এগিয়ে দিলেন, “এটা খেয়ে নাও এক চুমুকে। শরীরে বল পাবে।”
খেয়ে নিলাম এক চুমুকে। শরীরের দুর্বলতা যেন মুহূর্তে কেটে গেল। আর চোখের সামনে বিস্মৃত এক জীবনের আলো ফুটে উঠতে চাইল। বৃদ্ধা আসল কাহিনি শুরু করলেন, “অষ্টম শতকের শেষ দিকের কথা। গোটা ইতালিতে ক্রিশ্চিয়ান আধিপত্যের দাপটে তখন আমাদের প্রাচীন আরুন্সি বা অউসোনি ধর্মবিশ্বাস ধুয়েমুছে সাফ। গণহত্যা করে, ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে, মন্দির ধ্বংস করে ইতিহাস থেকে প্রায় সব চিহ্নই মুছে ফেলা হয়েছে পঞ্চম শতকের মধ্যেই। তারপর তিনশো বছর ধরে আমরাই সে সভ্যতার একমাত্র প্রদীপ জ্বেলে রেখেছিলাম এই দুর্গে। বাবা, তুমি সে জন্মে এ দুর্গের অধিপতি ছিলে। তোমারই পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গেরই পিছনের এক গুপ্ত কক্ষে আমি মেয়েদের ধর্মশিক্ষার এক স্কুল খুলেছিলুম। আশেপাশের গ্রাম থেকে ছোট্ট মেয়েরা লুকিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে আসত সেই সান্ধ্য স্কুলে। ক্রিশ্চিয়ান শাসকদের কাছে সে খবর কীভাবে যেন পৌঁছে গেল একদিন। বিশাল সৈন্য নিয়ে দুর্গ আক্রমণ করল ওরা। সন্ধ্যেয় স্কুল চলছিল তখন। মার্সেলো সে জন্মে ছিলেন তোমার সেনাপতি। তোমরা দু’জনে বাচ্চা মেয়েদের দুর্গের পেছনের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে জনাকয়েক সৈন্য নিয়েও প্রবল যুদ্ধ করলে। মার্সেলোর মৃত্যু হল। দুর্গ দখল করে আগুন লাগিয়ে দিল রোমান সৈন্যরা। সে গোপন কুঠুরি থেকে টেনে বের করতে লাগল বাচ্চা মেয়েদের। তোমার তখন সব সৈন্য মারা গিয়েছে। তুমি একাই যুদ্ধ করে আমাকে এবং আমার আঠারো জন ছাত্রীকে বাঁচিয়ে অন্য এক গোপন কুঠুরিতে নিয়ে রেখেছিলে। সেখান থেকে এক গুপ্ত রন্ধ্রপথে আমরা দেখলাম কীভাবে সত্তরটি বাচ্চা মেয়েকে বীভৎস অত্যাচার করে জীবন্ত ছুঁড়ে ফেলা হল এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ডে। সে অগ্নিকুণ্ড এই পাশের ঘরেই তৈরি করা হয়েছিল। এস, তার ধ্বংসাবশেষ দেখবে এস।” আমার হাত ধরে এক স্বল্পালোকিত ঘরে নিয়ে গেলেন বৃদ্ধা। সত্যিই স্মৃতির কুয়াশার ওপারে আবছা হয়ে ফুটে উঠতে লাগল সেই মর্মান্তিক দহন-দৃশ্য।
“কী? মনে পড়ছে?”
আমি চমকে উঠে বললাম, “বাধা দিতে গিয়ে আমিও তো মারা পড়েছিলা।”
“এই তো! মনে পড়েছে,” বৃদ্ধা আধা-অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নিজের নাম কী ছিল, মনে পড়ছে কি? আমার নাম মনে পড়ছে?”
আমি আবিষ্ট স্বরে বললাম, “আমার নাম ছিল আন্তোনিও। আপনার নাম ছিল ইসাবেলা।”
“বাহ। সবই যখন মনে পড়ছে, তখন এবার আসল জিনিসটা দেখাই। যেটা এই গোটা কাহিনির একমাত্র পুঁথিগত প্রমাণ। বার্চ গাছের ছালে প্রাচীন জৈব রঙ দিয়ে আঁকা ওই ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডের ছবি। মার্সেলোর ঠাকুর্দা সে জন্মে দুর্গবিজেতা ক্রিশ্চিয়ান দলের ধর্মযাজক ছিলেন। নাম ছিল জিয়োর্জিও। তিনি বহু চেষ্টা করেও ওই নির্যাতন, ওই হত্যাকাণ্ড থামাতে পারেননিউলটে তাঁকে দিয়ে শাসকদল ডাইনিহত্যার এক মিথ্যে রিপোর্ট লিখিয়ে নেয়। পরে জিয়োর্জিও পাগল হয়ে যান এবং এই ছবি আঁকেন।”
“আমার মৃত্যুর পর আপনাদের কী হয়েছিল?”
“আমি আর ওই আঠারো জন মেয়ে গুপ্তকুঠুরিতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাই। দরজা কেউ খুলতে পারেনি। রন্ধ্রপথে ভেসে আসা আমাদের চিৎকার শুনে জিয়োর্জিও খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু খুঁজে পাননি।”
“একটা ব্যপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আপনি এই ধারাবাহিক ইতিহাস কীভাবে জেনেছেন? আর কে কবে জাতিস্মর হয়ে এক এক জন্মে এক এক জায়গায় জন্মাচ্ছে, সেসব আপনি জানছেন কী করে?”
বৃদ্ধা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, “সে রহস্য এই বার্চ কাগজের ছবির মধ্যেই লুকোনো আছে। এই নাও, ভাঁজ করে তোমার পকেটে রেখে দাও। মার্সেলোর ঠাকুর্দার কালো ডাইরিতে এর সমাধানসূত্রও রয়েছে। সেসব পরে ভেবেচিন্তে সমাধান কোরো। যে গুপ্তকুঠুরিতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আমরা মারা পড়েছিলাম, সেটা এখন দেখে নাও। এই যে তার গোপন দরজা। জোরে ধাক্কা দাও।”
জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলআর ওপাশ থেকে হিম ঠান্ডা জলের ঝাপটা এসে লাগল মুখে। চমকে উঠতেই দেখলাম, আমি বিছানায় শুয়ে আছি। মার্সেলো সামনে উদ্বিগ্নভাবে বসে রয়েছে। আমি চোখ খুলতেই বলে উঠলেন, “এই তো! জ্ঞান ফিরেছে! ওফ, যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন...”
“আমি কোথায়? ইসাবেলা কোথায় গেল?”
“আপনি হোটেলেই আছেন। হোটেলের সিঁড়ির অন্ধকারে রাত একটা কুড়ি মিনিট নাগাদ পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে আপনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।”
“কিন্তু আপনি যে আমায় আরুন্সিদের দুর্গে নিয়ে গেলেন। জঙ্গলের মধ্যে সেই ভাঙা দুর্গ, যেখানে প্ল্যানচেট করতে গিয়ে আপনার ঠাকুর্দা ছ’দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হন এবং পরে উন্মাদ হয়ে যান...”
“কী আশ্চর্য! আমি আপনাকে দুর্গে নিয়ে যাব কেন মাঝরাতে? আমি বলে অতিথিদের রিসিভ করতে গিয়ে নাওয়া-খাওয়ার সময় পাচ্ছি না। কিন্তু আমার ঠাকুর্দার কাহিনি আপনি জানলেন কী করে?”
“ইসাবেলা আমায় বলেছেন। আপনার ঠাকুর্দার কালো ডাইরিটা আমার খুব দরকার...”
“আশ্চর্য ব্যাপারকালো ডাইরিটার কথাও জানেন? ওটার খবর তো আমি ছাড়া কেউ জানে না,” মার্সেলো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, “কিন্তু ইসাবেলা কে?”
পুরো কাহিনিটা আস্তে আস্তে বললাম আমি। মার্সেলো সব শুনে বললেন, “সেই পাথুরে প্রমাণ, আই মীন, সেই বার্চ পেপারের ছবিটি কোথায়?”
আমার এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। পকেটে হাত ঢুকিয়েই চমকে উঠলাম। সত্যিই সেই বার্চ পেপারটি রয়েছে। সেটার ভাঁজ খুলে মেলে ধরতেই মার্সেলোর বাকরোধ হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর এক হত্যাকান্ডের ছবি। তার চারপাশে প্রাচীন লিপিতে অনেক কিছু লেখা, অনেক জ্যামিতিক নকশা আঁকা।
এরপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সেদিনের কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাটছাঁট করে ক্যাগলিয়া, স্যাপিয়েঞ্জা, বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগের বিজ্ঞানীদের ডেকে আনা হল। জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিউট থেকে গবেষকেরা এলেন। ইতালির অন্যতম প্রাচীন চিত্র আবিষ্কারের অনেক তারিফ হল। কিন্তু গবেষকদের অনেক চেষ্টাতেও ওই ছবির চারপাশের লিপি ও নকশার মর্মোদ্ধার সম্ভব হল না। মার্সেলোর দাদুর কালো ডাইরির সাহায্য নিলাম, সারা ইউরোপ থেকে অনেক লিপি বিশারদ, জ্যামিতিবিদ এলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকের কাছে ই-মেল মারফত তার ছবি পাঠানো হল। সম্বর্ধনার জেরে আমার ভিসার মেয়াদ দু’সপ্তাহ বাড়ানো হল। এরই মধ্যে একদিন তোতাকাহিনি গল্পের মতো মার্সেলো বলে উঠলেন, “আসল জায়গাটাই তো আপনার দেখা হয়নি। দুর্গটাই তো দেখেননি। ওখানে কোনও সমাধান-সূত্র থাকতে পারে।”
“সত্যিই তো। আবিষ্কারের আতিশয্যে আমরা আসল দুর্গটার কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। লেটস গো। এক্ষুনি চলুন।” এগারো জনের গবেষকদল চমকে উঠে তখনই রওনা দিলাম। সামনের গাড়িতে ছবি, ডাইরি সমেত পাঁচজন বিজ্ঞানীআর পিছনের গাড়িতে আমরা ছ’জন। জঙ্গল নেই পথের দু’পাশে। সেদিনের ভয়াল রহস্যময় রাত্রির সঙ্গে কিছুই মিলছে না।
হঠাৎ তীব্র এক ঝাঁকুনি। ড্রাইভার ব্রেক চেপে গাড়িটাকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “ভূমিকম্প।” দরজা খুলে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামনের বিশাল কয়েকটা পাথুরে বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। লোকজন উত্তেজিতভাবে ছোটাছুটি করছে। মাটি কাঁপছে তখনও। অমন তীব্র ভূকম্প এবং ধ্বংসলীলা আমি আগে কখনও দেখিনি। পুলিশ এসে আমাদের দ্রুত উদ্ধার করে রোম শহরে নিয়ে গেল। পরের দিন দুপুরেই আমার ফ্লাইট ছিল। প্লেনে ওঠার ঠিক আগে মার্সেলোর মৃত্যুসংবাদ পেলাম। গাড়িটা নাকি বিশাল বাড়ির চাপে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর শর্টসার্কিট থেকে লাগা আগুনে নাকি সব পুড়ে যায়। মৃতদেহ উদ্ধার হয়নি।
মার্সেলোর মৃত্যুসংবাদ আমি বিশ্বাস করিনি। উনি নিশ্চয় কোনও ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে গেছেন। একদিন উনি নিশ্চয় ওই ছবি আর ডাইরি নিয়ে ফিরে আসবেন, সমস্ত সমাধান-সূত্র সমেত। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।
_____

1 comment: