ভ্রমণ:: টো টো কাহিনি (চতুর্থ পর্ব) - তাপস মৌলিক


টো টো কাহিনি
তাপস মৌলিক

তিরিশ বছর আগের কথা। কলেজে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। পড়াশুনো তো ঘন্টা করি! খালি আড্ডা, সিনেমা আর দু’দিন ছুটি পেলেই ক’জন বন্ধু মিলে যেখানে-সেখানে বেরিয়ে পড়া, ঘুরতে। কিন্তু ঘুরব যে, পকেট তো ঢুঢু! প্রধান ভরসা তাই এগারো নম্বর, শোওয়ার জন্য হট্টমন্দির খুঁজি, খাওয়ার জন্য ‘যত্রতত্র’ নামের কোনও হোটেল। সদ্য লায়েক হয়েছি, দুনিয়ার কাউক্কে পরোয়া করি না, যদি কেউ উলটো গায় তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দি। তখন ভাবতাম হুজুগ, নেশা। এখন বুঝি, নিজেদের অজান্তেই কখন যেন কলেজ ছাড়িয়ে আদি ও অকৃত্রিম এই পৃথিবীর পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেছিলাম...

ওরগ্রাম

“তোর মতলবটা কী বল তো ভাস্কর? শেষকালে ডোবাবি না তো!” শুভজিৎ বলল।
নিরুপমের গানের তালে তালে ট্রেনের কাঠের সিট বাজাতে বাজাতে ভাস্কর বলল, “আরে না রে বাবা, রিল্যাক্স। তুই আমাকেও ভরসা করতে পারছিস না? রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন মনে নেই? মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”
সকালের বর্ধমান লোকাল। পাঁচজন ওরগ্রাম যাব বলে বেরিয়েছি। আমি, ভাস্কর আর শঙ্কর আগেও একবার গেছি সেখানে। এবারে সঙ্গে জুটেছে শুভজিৎ আর নিরুপম। গতকাল থার্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই হোস্টেলে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। কোথাও একটা ঘুরে আসতে হবে। কিন্তু চিরকালীন সেই সমস্যা – হাতে পয়সাকড়ি একদম নেই। বর্ধমান যাওয়ার একটা সুবিধে হল ভাস্কর সঙ্গে থাকলে টিকিট কাটার পয়সাটা লাগে না, কোনও না কোনও উপায়ে ভাস্কর প্রতিবার ম্যানেজ করে ফেলে। এবারও ভাস্কর বলেছে, “টিকিটের চিন্তা নেই। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে।” তবু সবার মনেই একটু টেনশন আছে। শুভজিৎ সেটা ভাষায় প্রকাশ করে ফেলেছে, এই যা!
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়। বর্ধমান লোকালে টিটিই-র দেখা পাওয়া সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়ার চেয়েও দুর্লভ। অথচ কিনা আজই এই ভোরবেলা, পরের স্টেশন থেকেই একজন কালো কোট টিটিই আমাদের কামরায় উঠে এলেন। ভাস্করের ইঙ্গিতে আমাদের গানবাজনা চালু রইল। কিন্তু ভবি ভুললে তো! এদিক ওদিক একটু ঘুরে টিটিই সটান হাজির আমাদের সামনে, “ভাই, তোমাদের টিকিটগুলো?”
ভাস্কর ‘টিকিট আমার কাছে’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে ওপরের বাঙ্ক থেকে ওর কাপড়ের ব্যাগটা নামাল। তারপর তার ভেতর থেকে বার করল একটা ছোটো স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেট। সেই প্যাকেটের ভেতর দেখি অল্প একটু কেমন হলদেটে রঙের একটা তরল পদার্থ, আর ভিজে ন্যাতা হয়ে যাওয়া কতগুলো টিকিট।
“দাদা, হাওড়া স্টেশনে টিকিটগুলো ইউরিনালে পড়ে গিয়ে ভিজে গেছিল, তাই এই প্লাসটিকটায় ভরে রেখেছি। বার করে দেখাব?”
টিটিই ভদ্রলোকের মুখটা দেখলাম ঘেন্নায় কেমন একটা হয়ে গেল। “অ্যাঃ, না না বার করতে হবে না, ঠিক আছে,” বলে উনি কার্ল লিউইসের চেয়েও বেশি স্পিডে উলটোদিকে চলে গেলেন।
ভাস্কর অম্লানবদনে ফের পলিথিনের প্যাকেটটা ব্যাগে ভরে রাখছে দেখে শুভজিৎ আর থাকতে না পেরে বলল, “ওগুলো আবার ব্যাগে ঢোকাচ্ছিস!”
ভাস্কর চাপা গলায় বলল, “ঢোকাব না তো কী? এসব আমার অস্ত্রশস্ত্র। তুই কি ভেবেছিস সত্যি? আরে দূর! টিকিটগুলো সব এক বছর আগের। আর লিকুইডটা প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল দুধছাড়া র’ চা। মাঝে মাঝে লিকুইডটা শুধু রিপ্লেনিশ করতে হয়।”

বর্ধমান বাসস্ট্যান্ডে পেটপুরে লুচি তরকারি খেয়ে গুসকরা যাওয়ার একটা বাসের ছাদে উঠে বসলাম। বাসটা ওরগ্রাম হয়ে যাবে। ভেতরে অকথ্য ভিড়, তাই ভেতরে ঢোকার চেয়ে ছাদে বসা অনেক আরামের। ছাদে অবশ্য প্রচুর লোক। তাছাড়া আছে একগাদা ঝাঁকা, আলুর বস্তা, কতগুলো মুরগি ইত্যাদি ইত্যাদি। মার্চ মাসের প্রথম দিক। গরম খুব একটা নেই, শীতও কমে গেছে। বাস ছাড়তেই তারস্বরে আমাদের গান শুরু হল। শহর ছাড়িয়ে যেতে রাস্তার দু’পাশে শুরু হয়েছে সারি দিয়ে লাগানো গাছ আর তার পেছনে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। রাস্তার ধারের গাছগুলোর কিছু কিছু ডালপালা বিপজ্জনকভাবে নিচু। একটু অন্যমনস্ক হলেই মাথায় ডালের ঝাপটা লাগার সম্ভাবনা। রিফ্লেক্সটা এখানে খুব জরুরি। মাথা বাঁচিয়ে আর ঝাঁকা-বস্তা জড়িয়ে বিস্তর ঝাঁকানি খেতে খেতে গেয়ে চলা আমাদের গানগুলো অনায়াসে উচ্চাঙ্গ সংগীত হয়ে যাচ্ছিল। ছাদে বসা আমাদের সহযাত্রীরা বেশ মজা পেয়ে গেলেন। সবাই বর্ধমানের বাজার ফেরত গ্রাম্য লোক। দু-একজন গলা মেলাতে শুরু করলেন আমাদের সঙ্গে। তারপর একজন একটা পল্লীগীতি ধরলেন, শেষ হওয়ার পর আরেকটা, তারপর আরও একটা, গেয়েই চললেন। ভালোই চলছিল, এমন সময় বাসটা এক জায়গায় দাঁড়াল, আর বেরসিক কন্ডাকটরটা ‘টিকিট’ ‘টিকিট’ করতে করতে ছাদে উঠে এল।
ভাস্কর বলল, “আমরা পাঁচজন আছি, ক’জনের টিকিট কাটতে হবে?”
“ক’জনের মানে? পাঁচটা টিকিট হবে।”
“পাঁচটা কেন? আমরা তো আর বাসের ভেতরে ঢুকিনি। ছাতে উঠেছি। এখানে তো হাফ টিকিট হয়। পাঁচের অর্ধেক আড়াই, মানে দু’জনের টিকিট হবে।”
“বাসের ভেতরে আর ছাতে একই টিকিট। ছাতে উঠতে কে বলেছিল? ভেতরে ঢোকেননি কেন?”
“ভেতরে ঢোকার জায়গা আছে নাকি? মুড়ির টিনের মতো তো ঠেসেছেন! ভেতর থেকে পাঁচজনকে ছাতে পাঠিয়ে দিন, আমরা ভেতরে যাচ্ছি।”
তর্কাতর্কি চলল। শেষে রাগের মাথায় কন্ডাকটর বলল, “আপনাদের টিকিট-ফিকিট কাটার দরকার নেই, যাওয়ারও কোনও দরকার নেই, বাস থেকে নেমে যান।” অপ্রত্যাশিতভাবে এবারে আমাদের পক্ষ নিলেন আমাদের সহযাত্রীদল। তাঁরা বললেন, আমরা নেমে গেলে তাঁরাও নেমে যাবেন। এতক্ষণ যে সবাই মিলে গান গাইলাম তার কি কোনও দাম নেই? আমাদের অভয় দিয়ে বললেন, “পেছনেই আরেকটা বাস আসছে, বাকিটা ওটার ছাদে চড়ে চলে গেলেই হবে।” ছাদ প্রায় ফাঁকা হবার জোগাড়। বেগতিক দেখে কন্ডাকটর দুটো টিকিটেই রাজি হয়ে গেল।

ওরগ্রামে নেমে পিচরাস্তা ছেড়ে ডানদিকে গ্রামের ভেতর ঢুকে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরলাম। আধমাইল হাঁটলেই ফরেস্ট বাংলো। বেলা প্রায় একটা বাজে। বাংলোর কেয়ারটেকার সোহরাব আলি তখন খেয়েদেয়ে আরাম করে তাঁর ঘরে খাটে আধশোওয়া হয়ে একটা বই পড়ছেন। ভাস্কর ‘কী চাচা, কেমন আছ’ বলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। সোহরাব চাচা আমাদের পূর্বপরিচিত, আগের বার যখন এসেছিলাম তখন চাচাই কেয়ারটেকার ছিলেন। কী বই পড়ছেন কৌতূহল হওয়ায় বইটা খুলে দেখি, যা ভেবেছি তাই – কালকূট। ভদ্রলোক সমরেশ বসুর সাংঘাতিক ভক্ত। ওরগ্রামের এই বাংলোতে একা একা পড়ে আছেন। নিজেই বাজার করেন, নিজেই রান্নাবান্না করেন। তা সত্ত্বেও প্রচুর সময়। লোকজন তো বড়ো একটা আসে না এখানে, এক মাঝে মাঝে সরকারি অফিসাররা ছাড়া। তাই বলে আলস্যে সময় নষ্ট করার লোক সোহরাব চাচা নন। গ্রামে একটা লাইব্রেরি আছে। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে যাওয়া চাচার বাঁধা। ওখানে অনেক খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন পড়া যায়। আর বাংলোয় আছে লাইব্রেরি থেকে আনা কালকূট।
ওরগ্রাম ফরেস্ট বাংলোর বুকিং হয় বর্ধমানের জেলা পরিষদ থেকে। আমাদের কোনও বুকিং-টুকিং নেই। হুট করে চলে এসেছি চাচার ভরসায়। কিন্তু চাচা খুব একটা ভালো খবর শোনাতে পারলেন না। বললেন আজ সন্ধেবেলাতেই ফরেস্ট রেঞ্জার সাহেবের এখানে আসার কথা। উনি এলে বাংলোয় বুকিং নেই এমন কাউকে থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। চাচার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
মুশকিল! একতলা বাংলোটায় মাত্র দুটো ঘর। অবশ্য সে ঘর দুটো যথেষ্ট বড়ো বড়ো। দুটোর ভেতরেই একটা ছোটো বসার জায়গা, চারটে করে খাট, কিচেন, বাথরুম সব আছে। আমাদের পাঁচজনের একটা ঘরেই অনায়াসে হয়ে যাবে। কিন্তু রেঞ্জার সাহেবের নাকি ফ্যামিলি আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে আসার কথা, দুটো ঘরই তাঁর চাই। সাহেবের অবশ্য আসতে দেরি আছে, সেই সন্ধেবেলা। তাই চাচা একটা ঘর আমাদের জন্য খুলে দিলেন। বললেন একটু সাবধানে থাকতে, ঘর-টর অগোছালো না করতে। তবে সন্ধের আগেই অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে, নতুবা বর্ধমান ফেরত।
ভাস্কর বলল, “চল, আগে তো আরাম করে স্নান-টান সেরে নিই, তারপর দেখা যাবে।”
নিরুপম বলল, “তারপর? ব্যাক টু বর্ধমান? শেষে তোদের বাড়িতে থাকতে হবে নাকি?”
ভাস্করের বাড়ি বর্ধমান। বলল, “আরে দেখি না! এসে যখন পড়েছি, ব্যবস্থা কিছু একটা হবে।”

পেল্লায় বাথরুম। শাওয়ার খুলে ঠান্ডা জলে ইচ্ছেমতো স্নান করলাম। শরীর জুড়িয়ে গেল। সঙ্গে খিদেটাও চাগাড় দিয়ে উঠল। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। এখন এই বেলা দুটোর সময় চাচাকে রান্না করতে বলার কোনও মানে হয় না। তাছাড়া বাজার-টাজার কিছু করা আছে কিনা জানা নেই। তাই সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম। বড়ো রাস্তার মোড়ে এসে দেখলাম দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ মনে হচ্ছে। একটা মুদি দোকান খোলা আছে দেখে পাঁচশো মুড়ি আর একটু সরষের তেল কেনা হল। তারপর মুড়িমাখা দিয়েই লাঞ্চটা সারতে হল।
খেয়েদেয়ে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে ভাস্কর বলল, “চল এবার বশিরের খোঁজে যাওয়া যাক।”
এখানে বশির আর আনসার বলে ভাস্করের দুই বন্ধু থাকে। গতবার একদিনের জন্য এসে আলাপ হয়েছিল। বশিরদের বাড়িটা বাসস্টপ থেকে বর্ধমানের দিকে প্রায় হাফ কিলোমিটার, বাসরাস্তার ধারেই। বিশাল তিনতলা সাদা বাড়ি। ইংরিজী ‘ইউ’ অক্ষরের মতো তিনদিকে ঘোরানো, ইউ-এর ল্যাজদুটো পেছন দিকে, দুটো ল্যাজের ফাঁকে একটা বিশাল পুকুর। বশিরের দাদা এখানকার পঞ্চায়েত প্রধান, বেশ বড়ো নেতা।
বশির বাড়িতে থাকলেও ওর সঙ্গে দেখা করা মানে প্রায় গেছোদাদার সঙ্গে দেখা করার মতো। প্রথমে কাউকে বলতে হবে বশিরের খোঁজে এসেছি। সে গিয়ে ভেতরবাড়িতে খবর দেবে। ভেতরবাড়ির লোক বলবে আগে বাইরের বাড়িতে খুঁজে দেখ। বাইরের বাড়ির লোক বলবে, না ভেতরবাড়িতে থাকার চান্সই বেশি। তারপর ভেতরবাড়ির লোক তিনটে তলার অগুন্তি ঘরে ঘরে খুঁজে এসে বলবে, না পাওয়া গেল না। তখন বাইরের বাড়ির লোক বাইরের বাড়ির তিনটে তলার অগুন্তি ঘরে খুঁজতে শুরু করবে, আর এর ফাঁকে বশির বাইরে এসে বলবে, “আরে, তোরা এখানে? কখন এলি? কী খবর?”
প্রায় পনেরো মিনিট পর বশির ঘুমচোখে নিচে নেমে এল। আমাদের দেখেই উৎসাহে ওর ঘুম-টুম উধাও হয়ে গেল, “আরে! তোরা? কী ব্যাপার? ঘুরতে? থাকবি তো আজ? ফরেস্ট বাংলোতে উঠেছিস? চল, আমিও যাই সেখানে।”
“ফরেস্ট বাংলোতেই তো উঠেছি, কিন্তু কেস গড়বড় আছে। চাচা ঝামেলা করছে।”
রেঞ্জার সাহেবের ব্যাপারটা বশিরকে ব্যাখ্যা করা হল। বশির শুনে বলল, “এতে অসুবিধের কী আছে? আমার এখানে চলে আয়। এত বড়ো বাড়ি রয়েছে।”
“তোদের অসুবিধে নেই জানি। আমাদের আছে। মানে, এখানে থাকার তো কোনও অসুবিধেই নেই, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চিন্ত, কিন্তু ঠিক হৈ-হল্লা করা যাবে না। কাল সবে পরীক্ষা শেষ হল, এলাম ফরেস্ট বাংলোয় একটু গা-হাত-পা মেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকব, ঘোরাঘুরি করব, খাব-দাব। কারও বাড়িতে থাকলে ঠিক সেই মজাটা হয় না।”
“তাও ঠিক। তাহলে আরেকটা কাজ করলে হয়। রেঞ্জার সাহেবকেই না হয় আমাদের বাড়ি থাকতে বলব। দাঁড়া, দাদাকে গিয়ে বলি।”
আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বশির আবার ভেতরে চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরে এসে বলল, “তোদের কে বলেছে রেঞ্জার সাহেব আজ এখানে আসছে?”
“কেন? সোহরাব চাচা!”
“দূর! দাদাকে গিয়ে বলাতে দাদা তো অবাক হয়ে গেল। বলল, সে কী, আমাকে তো রেঞ্জার সাহেব আজই বর্ধমানে ডেকে পাঠিয়েছেন। দাদা তো একটু পরেই বেরোচ্ছে।”
বোঝা গেল রেঞ্জার সাহেবের প্ল্যান নিশ্চয়ই চেঞ্জ হয়েছে। আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এবার তবে ফিরে গিয়ে পুরো বাংলোটার দখল নিতে হয়। বশিরও আমাদের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু চাচা কিছুতেই বিশ্বাস করে না! বলে, “হতেই পারে না, উনি নিজে বুকিং করেছেন। এই একটু পরেই এসে পড়লেন বলে। আপনারা আপনাদের ব্যাগ-পত্তর সরান, ঘর খালি করে দিন।”
ঠিক হল, সন্ধে অবধি দেখা যাক অপেক্ষা করে। তারপর যা করার করা যাবে। বশির বলল, “চল তাহলে এখন আনসারের কাছে যাই। ওকেও ধরে নিয়ে আসি।”
ঘর খালি করে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আমরা ফের বেরিয়ে পড়লাম সবাই মিলে।

ফরেস্ট বাংলো থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে ‘সমন্বয়ী প্রকল্প’ বলে একটা কো-অপারেটিভ আছে। গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে তারপর একটা পিচ রাস্তায় উঠে আমরা চললাম সেদিকে। আনসার সেখানে দরজির কাজ করে, থাকেও সেখানে। খুব ছোটোবেলাতেই আনসারের বাবা-মা মারা গেছেন। তারপর আনসার আর তার দুই দিদি এই সমন্বয়ী প্রকল্পেই বড়ো হয়েছে। বশির ওর স্কুলের বন্ধু। বন্ধুত্ব ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। বড়োলোকের সুখী ছেলে বশিরের সঙ্গে আনসারের বন্ধুত্বের কেমিস্ট্রিটা কী কে জানে!
সমন্বয়ী প্রকল্পের কথা আগেরবার শুনেছিলাম, দেখা হয়নি। চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বিশাল এলাকা। ভেতরে প্রচুর গাছপালা। লোহার গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে-বাঁদিকে সারি সারি ঘর। সব ঘরেই নানারকম কাজকর্ম চলছে। কোনও ঘরে তাঁত বসানো আছে, কাপড় বোনা হচ্ছে। কোনও ঘরে মেয়েরা শাড়িতে জরির বা সুতোর কাজ করছে। আবার কোনও ঘরে আচার-আমসত্ত্ব তৈরি হচ্ছে, মাদুর-চাটাই বোনা হচ্ছে, হাতপাখা বানানো হচ্ছে, চটের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। একদিকের একটা ঘরে কয়েকজন কাঠের মিস্তিরি কাজ করছে, ছোটো ছোটো টুল, জলচৌকি, ঠাকুরের আসন তৈরি হচ্ছে। তার পাশের ঘরটা দরজিদের। সেখানে পাঞ্জাবি-পাজামা, কুর্তা, ফতুয়া ইত্যাদি সেলাই হচ্ছে। আনসারকে সেখানেই পাওয়া গেল। প্রকল্পের ভেতরটা আনসারই আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল।
ভেতরদিকে একপাশে সারি সারি ফলের বাগান। পেয়ারা বাগান, আমবাগান, কলাবাগান ইত্যাদি। এসব বাগান থেকে ফল চলে যায় বিক্রির জন্য বাজারে, আবার ভেতরের আচার-আমসত্ত্ব তৈরিতেও কাজে লাগে। পড়ে যাওয়া বা কেটে ফেলা গাছের কাঠ লাগে ছুতোর মিস্তিরিদের। অন্যদিকে পর পর তিন-চারটে বড়ো বড়ো পুকুর। কোনও পুকুরে চিংড়ি মাছের চাষ হয়, কোনওটায় চারাপোনার, জিওল মাছের, তেলাপিয়ার। বাগানে আর পুকুরেও অনেক লোক কাজ করছে। প্রকল্পের ভেতরে পুরো জায়গাটাই পরিষ্কার ঝকঝক করছে। এমনকি ফলবাগানগুলোতেও গাছের নিচের জমি সাফসুতরো করে ঝাঁট দেওয়া, একটাও ঝরা পাতা পড়ে নেই। অজস্র পাখি ডাকছে গাছে। চারদিকে সবকিছু এমন সুশৃংখল মসৃণভাবে হয়ে যাচ্ছে, কোনও কোলাহল নেই, তাড়াহুড়ো নেই, হাঁকডাক নেই - দেখে খুব আশ্চর্য হলাম। এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে এমন আধুনিক পেশাদারী কায়দায় পরিচালিত কো-অপারেটিভ সোসাইটি কল্পনাই করতে পারিনি।
সমন্বয়ী প্রকল্প সরকারেরই একটি প্রকল্প। গ্রাম পঞ্চায়েত তার খবরাখবর নিলেও এটি সম্পূর্ণ স্বনির্ভর, স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রকল্প। বশিরের কাছে শুনলাম এটা লাভজনকও বটে। বিপদে-আপদে কিংবা কাঁচামাল কেনার জন্য আগাম লোন হিসেবে সরকার থেকে গ্রান্ট অবশ্যই পাওয়া যায়, কিন্তু প্রকল্পের জিনিস বাজারে বেচেই ওতে যারা কাজ করে তাদের মাইনে দেওয়া হয়, তারপরেও লাভ থাকে। এককালে এই ওরগ্রামের লোকেদের প্রধান জীবিকা ছিল চুরি-ডাকাতি। এখন গ্রামের অর্ধেকের বেশি মেয়ে-পুরুষ সমন্বয়ীতেই কাজ করে। বাকিরা চাষবাস বা ব্যাবসা করে। বাপ-ঠাকুরদার পেশা ডাকাতি এরা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। প্রকল্পের ভেতরে কিছু লোকের এবং কিছু অনাথ ছেলেমেয়ের থাকার ব্যবস্থাও আছে। আনসার সেখানেই থাকে। সে অবশ্য বাসস্ট্যান্ডে একটা দরজির দোকানও খুলেছে। সমন্বয়ীতে কাজ করতে হয় সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি। এর আগে-পরে আনসার নিজের দরজির দোকানে বসে। পয়সা জমিয়ে গ্রামে একটা বাড়ি তুলতে চায় আনসার। সমন্বয়ীতে তো সারাজীবন থাকা যাবে না, কেননা তাহলে বিয়ে-শাদি করা যাবে না।

সমন্বয়ী থেকে ফরেস্ট বাংলো ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে সাতটা বেজে গেল। দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে রেঞ্জার সাহেবের কোনও পাত্তা নেই। দেখি সোহরাব চাচা গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। শঙ্কর বলল, “কী এত ভাবছ চাচা, সাহেব আর আসবেন না।”
চাচা বললেন, “এত এত বাজার করলাম, মুরগি আনলাম, সেগুলো কী হবে এখন?”
“আরে সে জন্য তোমার চিন্তা? আমরা আছি কী করতে? মুরগির ঝোল লাগিয়ে দাও। বশির আর আনসারও এখানেই খাবে আজ। দুটো ঘরই খুলে দাও শিগগির।”
চাচা খুশিমনে চলে গেলেন রান্নাবান্নার জোগাড় করতে, আর একটা ঘর খুলে হই হই করে ঢুকে পড়লাম আমরা। এরপরে যা আরম্ভ হল সেটাকে দক্ষযজ্ঞ, নরক গুলজার, হনুমানের লঙ্কাদহন পর্ব, স্বর্গে মত্ত হস্তীর হানা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা উপমায় অলংকৃত করা যায়। আমাদের সাতজনের সমবেত অত্যুচ্চাঙ্গ সংগীতের কনসার্টের ঠেলায় সারা পাড়া সচকিত হয়ে উঠল। ঘরের কিচেনে অনেক বাসনপত্র রাখা ছিল। কেউ যদি মনে করেন এখানে এসে নিজেরাই বাজার করে রান্না করে খাবেন, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। বশির কতগুলো বড়ো বড়ো ডেকচি আর হাঁড়ি-কলসি কিচেন থেকে বার করে আনল। তারপর হাতা আর খুন্তি দিয়ে শুরু হল সেগুলো পেটানো, উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গত হিসেবে। সঙ্গত কারণেই চাচা একবার হাঁ হাঁ করে ছুটে এল ডাকাত পড়েছে কিনা দেখতে। তাকে মিষ্টি করে ফেরত পাঠাল ভাস্কর, “আরে তুমি এখানে কেন আবার! রান্না ফেলে এমন করে আসতে নেই, নুন-টুন কম পড়ে গেলে কী হবে?”
ন’টার সময় ভাত-ডাল বেগুনভাজা আর মুরগির ঝোল দিয়ে এলাহি খাওয়া সারার পর বশির চলে গেল বাড়ি। আনসারও রওনা দিল সমন্বয়ীর দিকে, দশটার সময় সেখানে গেট বন্ধ হয়। আমাদের কনসার্ট তারপরও চলল বেশ কিছুক্ষণ। রাত বারোটার সময় আলো নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়ার পর আমি আর শংকর বেরিয়ে এলাম বাইরে। ওরগ্রামের তখন মাঝরাত। ফরেস্ট বাংলোটা মোটেই জঙ্গলের মধ্যে নয়, বরং একেবারে গ্রামের মধ্যে। শীতের শেষের নিঝুম রাতে আবছা চাঁদের আলোয় তখন চারপাশের মাঠঘাটে কুয়াশার চাদর নেমে আসছে। দূর থেকে শেয়ালের দলের ডাক ভেসে আসছে। ওদের কনসার্ট তখনও শেষ হয়নি।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

_____
ছবিঃ লেখক

3 comments:

  1. অনেকদিন পর পেলাম.. As usual অসাধারণ লাগলো

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ। হ্যাঁ, অনেকদিন পর ফের শুরু হল। :-)

      Delete
  2. বরাবরের মতই অসাধারণ রান্না! থুড়ি লেখা।

    ReplyDelete