শীতের রবিবারের দিনলিপি
বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
শীতের
এক রবিবার আমাদের বাড়ি বেড়াতে এল গুলুমামা। গুলুমামা
এলেই আমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসবে। আর
গুলুমামা এলেই পড়াশোনা বন্ধ, প্রচুর মজার গল্প-আড্ডা। আমার মনের সমস্যাগুলোও
সমাধান করার সেরা লোক হল গুলুমামা। এবার আসতেই মামা বলল, “কী রে ভ্যাবলা, অমন
হাঁড়িমুখ করে বসে আছিস কেন?”
আমি
বললাম, “শীতের রবিবারগুলো কেমন বেকার ভাবে যেন কেটে যাচ্ছে। তেমন মজা পাচ্ছি না
মামা। বাবা বলেছে, পিকনিক-চিড়িয়াখানা সব পরের মাসে নিয়ে যাবে।”
মামা
বলল, “হুম। তাহলে তো
তোকে আমার স্পেশাল বাণী দিতেই হচ্ছে। শীতকালের রবিবারগুলোতে সারাটা দিন কীভাবে কাটাতে হয় সেটা আমার থেকে
শিখে নে।”
আমি
জিজ্ঞাসু চোখে বললাম, “বল তাহলে।”
মামা
বলতে শুরু করল, “শীতে ভালো থাকতে নিম্নলিখিত বিধিগুলো রবিবার কিংবা অন্যান্য ছুটির
দিনে মেনে চলবি।
১)
শীতকাল মানে হল খাদ্যোৎসব। খাবারকে
শীতকালে একদম অবহেলা করবি না। মাথায় রাখবি, ফুলকপির রোস্ট, বাঁধাকপির চচ্চড়ি আর
পালং-পনির আমরণ অনশন শুরু করে দেবে যদি তুই সেগুলো
না খাস। খাবারের সাগরে ঝাঁপ মারবি চোখ-কান-নাক বুঝে। তবে হ্যাঁ, মুখ খবরদার বুজবি
না, নইলে খাবারগুলো ঢুকবে কোথা দিয়ে?
২)
বহু লোককে দেখবি যে শীতকালে বেশ আনডিসিপ্লিনড ভাবে ভোর ভোর উঠে পড়ে। তুই সেসব মোটেও করবি না। ঘড়ি ধরে
চলবি। যদি সকাল সাতটার সময় ওঠার কথা হয়, তবে তুই শীতকালে উঠবি সকাল ন’টায়। পাক্কা
দু’ঘন্টা পরে। দু’ঘণ্টার বেশি হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু কম যেন না হয়। এটাই হল সময়ের
দাম!
৩)
ঘুম থেকে উঠে যোগ ব্যায়াম, দৌড় করতে হবে না। শীতকালে ওগুলো বাদ। ওগুলো বুড়ো আর
বোকাদের কাজ। ঘুম থেকে উঠে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করবি। কোনদিকে ভাবছিস? সোজা
রান্নাঘরের দিকে। কনকনে শীতের সকালে গরম গরম কড়াইশুটির কচুরি ভাজা হচ্ছে দেখলে তোর মন ফুরফুরে
থাকবে। কচুরির থালা আর
ধোঁয়া ওঠা সবজির বাটির দিকে তাকালে তোর মনঃসংযোগ বাড়বে। সকালে ক’টা কচুরি খেলি সেটা গুণলে বড়ো হয়ে হিসেবে পোক্ত হবি। আর
খবরদার আট-দশটার আগে থামবি না। নইলে বড়ো হলে তালপাতার সেপাইয়ের মতো চেহারা হবে।
৪)
পড়াশোনার মতো জীবনের একঘেয়ে, নিত্য-নৈমিত্তিক কাজগুলো থাকবেই। কিন্তু মাথায় রাখবি
ভ্যাবলা, তুই কোনও সাধারণ বালক নস। শুধুই পড়াশোনার মতো সাদামাটা কাজের জন্য ভগবান
তোকে পৃথিবীতে পাঠায়নি। অন্যে যা করে, তা করলে চলবে না। সকালের ব্রেকফাস্টের পরেই
তোকে শীতকালের ছুটির সকালের মহান কাজটা করে ফেলতে হবে। সেটা কী নিশ্চয়ই ভাবছিস? সেটা
হল ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠের দিকে হাঁটা লাগানো। শতরান নয়, মাত্র শূন্য বা একরান
করে আউট হওয়াটাই হবে তোর লক্ষ্য। মহান ব্যক্তিরা তেমনটাই হয়। আমি যে কতবার অমনভাবে
আউট হয়েছি তা গুণতে
শুরু করলে সারা শীতকাল চলে যাবে!
৫)
খেলাধুলো যতই কর, সময়ের যে একটা দাম আছে, এটা কখনওই ভুলে যাবি না। ঠিক দুপুরের আগে
ফিরে আসবি। রবিবার হলে মাছ-মাংস তো থাকবেই। কিন্তু শেষ পাতে একটু নতুন গুড়ের
সন্দেশ হল শীতকাল-স্পেশাল। ফাঁকতাল পেলেই মিষ্টির বাক্স থেকে মিষ্টি নিয়ে দু’টি
মুখে পুরে দিবি। পরে কেউ জিজ্ঞেস করলে গণেশের বাহনের নামে দোষ চাপিয়ে দিবি। বেনিফিট
অব ডাউটে সবাই তোকে ছেড়ে দেবে।
৬)
যেমন ঘড়ি ধরে খাওয়া, তেমনি ঘড়ি ধরে ঘুম। না না, রাতের ঘুমের কথা বলছি না। আমি বলছি
দুপুরের ভাতঘুমের কথা। খাওয়ার পরে তোকে মা-বাবা বিভিন্ন রকমের প্রলোভন দেখাবে।
যেমন, গল্প শোনা, রোদে বসে লুডো খেলা, শপিং মলে বেড়াতে যাওয়া, আঁকার খাতায় ড্রয়িং
করা ইত্যাদি। কিম্বা বেরসিক বাবা এই শীতের দুপুরেও তোর সামনে অঙ্কের খাতা-বই এগিয়ে
দেবে। কিন্তু তুই কোনও প্রলোভন বা কোনও জোর-জবরদস্তিতেই যাবি না। আমার বাণী মনে
রাখবি। দুপুরের
খাওয়ার পরেই ভাতঘুম। আহা, ভরপেট খেয়ে শীতের মধ্যে দুপুরে ঘুমোনোর মজাই আলাদা। মরা
হাতি লাখ টাকা। আর শীতের ভাতঘুম হল কোটি টাকা। বুঝলি?
৭)
বিকেলে খেলতে গেলে মাথায় রাখবি যে বকুনির সমূহ সম্ভাবনা। তোর মা-বাবা মানে, আমার
দিদি-জামাইবাবু বকুনি দেবে এই বলে, ‘সকালেও
খেলতে গেছিল। বিকেলেও বাবু খেলতে চলেছেন! পড়াশোনার নামগন্ধ নেই, সারাক্ষণ খালি
খেলা-খেলা-খেলা।’ তোর ক্রিকেট খেলা তুলে এই কথা যেন কেউ না বলতে পারে। ক্রিকেটের
সুখ্যাতি আর তোর নিষ্কৃতি – দু’দিকই তোকে দেখতে হবে। সুতরাং ওই সময়টা টুক করে দুটো-কার্টুন
ফিল্ম দেখে নিবি।
৮)
সন্ধেবেলা পড়তে বসতে না বসতেই
তোর পড়ার টেবিলে গরম গরম
মুড়ি-তেলেভাজা হানা দেবে। একবার হানা দিয়েছে যখন, তখন শত্রুর সংহার করাটা তোর
ধর্ম। মানে বলতে চাইছি যে উপাদেয় কড়মড়ে তেলেভাজা শীতের সন্ধেবেলা খেয়ে ধ্বংস করাটা
তোর কর্তব্য। তোর মন
বলতেই পারে যে সকাল ও দুপুরের খাওয়ার পরে সন্ধের তেলেভাজা গলাধঃকরণ করা একটু পরিশ্রমের
কাজ। কিন্তু এমন পরিশ্রমসাধ্য কাজই তো শীতে করে আনন্দ! অতএব তেলেভাজা খেয়ে নিবি। আর
সাথে সাথে একবার ঘড়ি দেখে নিবি। রাতের খাবার খেতে কতক্ষণ বাকি, সেটা তাহলে বুঝতে
পারবি। এবার এমন ভাব দেখাবি যেন পড়তে পড়তে তুই খাবার কথা ভুলেই গেছিস। পাক্কা
তিনবার ডাকবার পরে তোর মা যখন রেগে-মেগে ঘরে ঢুকে বলতে যাবে, ‘খেতে ডাকলে আসিস না কেন?’; তখন তুই এমন ঘাড় গুঁজে ইতিহাস
পড়বি যেন পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধটা তুই আজকে ঘটিয়েই ছাড়বি! তোর পড়ার একাগ্রতা দেখে মহম্মদ
বিন তুঘলক যেন দিল্লি থেকে রাজধানী সরিয়ে কলকাতায় এনে ফেলবে! এতে তোর মা-বাবা খুশিতে
গলে মাখন হয়ে হবে।
৯)
রাতের খাবার নিয়ে আর বেশি কিছু বলছি না। যেমন খিদে থাকবে খাবি। কেবল মাথায় রাখবি
যে শীতের রাত লম্বা কিনা। আর পেট বাবাজিকে কিছু একটা দিয়ে সারারাত ব্যস্ত রাখতে
হবে। তবেই তুই শান্তিতে ঘুমোতে পারবি। অতএব, খাওয়াকে অবহেলা করিস না বাপু।
১০)
রাতের খাবার পরে আর কোনও দিকে তাকাবি না। কেউ বেশি বকালে বলবি, ‘পরেরদিন ইস্কুল আছে। তাড়াতাড়ি
শুতে হবে।’ এই বলে
সোজা বাথরুম করে খাটের দিকে হাঁটা দিবি। তারপর খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্র বলবি, ‘জাম্পিং-জাম্পিং-ঝপাং’।
এই বলে, সাঁতারুরা
যেমন ঝপাং করে ঝাঁপ দেয়, তুইও তেমনি খাটে ঝাঁপ দিবি। তোর গন্তব্য সোজা চাদর ও
কম্বলের তলা। আর কোনও কথা নেই। সোজা ঘুম।”
এতকিছু
বলে মামা থামল।
আমি
উৎসাহিত হয়ে বললাম, “দারুণ মামা, ফাটাফাটি! সামনের রবিবার থেকেই তোমার কথা অক্ষরে
অক্ষরে মেনে চলব।”
এমন
সময় ফুলকপির সিঙ্গারা আর চা একটা ট্রেতে নিয়ে ঘরে ঢুকল মা। তারপর বলল, “মামা-ভাগনে
মিলে এত কীসের কথা
আলোচনা হচ্ছে?”
গুলুমামা
তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ভ্যাবলাকে বলছিলাম যে, শুধু দুষ্টুমি করলেই চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে
পড়াশোনাতেও মন দিতে হবে। রোজ যোগব্যায়াম করতে হবে। রেলগাড়ির মতো দৌড়তে হবে। আর
হ্যাঁ, এই বয়স থেকেই ভালোমন্দ আহারের প্রতি ত্যাগের দৃষ্টি আনতে হবে। পিংপং বলের
মতো ফিট থাকতে হবে।”
মা
কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “ভালো। তবে নিজে তো ছোটোবেলায় এর একটাও মানতিস না!”
মায়ের
কথায় মামা হাসতে গিয়ে কাশতে শুরু করল। মা-ও মামার কথা শুনে, আমিও মধ্যিখান থেকে,
ফিক করে হেসে ফেললাম।
_____
অলংকরণঃ সুজাতা চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment