নদীর
পাড়ের রহস্য
সূর্যনাথ
ভট্টাচার্য
—
নেদোটা আবার কোনও ফিকির করছে, মাষ্টারমশাই, রুমালে মুখ মুছে ধপ করে চেয়ারে বসে
পড়লেন বিরূপাক্ষ দারোগা। চেয়ারখানা একবার ককিয়ে উঠে চুপ মেরে গেল।
মাষ্টারমশাই উৎসুক মুখে
তাকালেন, কিছু বললেন না। আমিই জিজ্ঞেস করলাম, এবার
কী করল নন্দ?
— সেইটিই তো জানতে হবে, দারোগাবাবু চোখদুটো কয়েক পাক ঘুরিয়ে বললেন, এখনও
ধত্তে পারিনি। কিন্তু জানি ব্যাটা ফের কিছু একটা চালাকি করছে।
ব্যাপার যা জানা গেল, তা এই — নন্দ মল্লিক পৈতৃক ব্যাবসা লাটে তুলে এবার মাছের ব্যাবসা ধরেছে।
নীলসায়রের পশ্চিমদিকে খানিকটা জায়গা ইজারা নিয়ে তাতে সে মাছ ধরার কারবার করে।
নীলসায়রে মাছের চাষ হয়, সরকারি উদ্যোগ। পুঁজিপতিরা তাতে
ব্যক্তিগত পয়সা লাগিয়ে অংশীদার হতে পারে। নন্দ সেইরকমই এক ভাগের মালিকানা ভাড়া
নিয়েছে। তার এলাকায় সরোবরের কিনারা থেকে একশো গজ পর্যন্ত তার মাছ ধরবার সীমানা।
কিন্তু ফিশারিজ বিভাগ থেকে নালিশ এসেছে, সে নিয়মিত ভাবে ঐ
সীমা লঙ্ঘন করে নৌকা নিয়ে যায়।
নন্দ ফন্দি করে ব্যাবসায় দু’নম্বরি
করে থাকে। কিন্তু এর মধ্যে আর কী করে ফাঁকি দেবে? নালিশ সত্যি
প্রমাণিত হলেই তাকে তা বন্ধ করতে হবে। কিছু গুনাগারও দিতে হবে নিশ্চয়ই।
দারোগাবাবুকে বললাম, চুপচাপ গিয়ে হাতে নাতে ধরে ফেলুন একদিন।
—
আরে, সে চেষ্টা কি
আর করিনি? সে ব্যাটা সটান অস্বীকার করল। আমরা লুকিয়ে সব
দেখেছি শুনে আমাকেই উলটে বললে, আবার লুকোছাপা কেন? তার কোনও কসুর নেই, ডিপাটমেন্ট থেকে ভুল মাপ করেছে।
আমি নিজে সরেজমিন করে যেন তাকে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করি।
—
তারপর? আপনাকে
মাপজোখ সব দেখাল?
— দেখালই তো। আজকেই তো গিয়ে টুঁটি চেপে
ধরেছিলাম। তা বললে, আপনি নিজের চোখেই সব দেখে যান হুজুর। বলে
তার স্যাঙাৎ ফটকেকে পাঠাল নৌকা নিয়ে। সে নৌকা পাড়ের কাছে শক্ত কাছি দিয়ে বাঁধা।
ফটিক যতদূর সম্ভব চলে গেল, দড়িটা টান টান হয়ে আর আগে বাড়তে
দিচ্ছে না। পরিষ্কার দেখলাম, সরকারি সীমানা করা খুঁটিগুলো
পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা চলে গেছে। নেদো বললে, এইবার দেখুন
হুজুর আমি নৌকা পাড়ে লাগাচ্ছি। বলে হিড়হিড় করে দড়ি টেনে নৌকা পাড়ে লাগিয়ে বলল,
মাপ করে দেখুন হুজুর কতোটা টেনে আনলাম।
—
দেখলেন সেই দড়ির মাপ?
— দেখলাম বৈকি, ছাড়ব নাকি! বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই, বিলকুল একশো গজ। একটুও বেশি নয়!
—
কী বলছেন দারোগাবাবু? ইলাস্টিকের দড়ি নাকি?
—
কী যে বলেন? চার-ফেরতা নাইলনের কাছি, সে একটুও বাড়ে না। তাজ্জব
হয়ে ভাবছি, মাপে কোনও কারসাজি করল? আলাদা
করে আমাদের ফিতে দিয়ে নিজে মেপে দেখলাম। সেই একশো গজ, কোনও
ভুল নেই। তাহলে সত্যিই সরকারি মাপে ভুল আছে নাকি? কিন্তু তাই
কি হয়?
আমারও বেশ খটকা লাগছিল। আমার
সঙ্গে পল্টুও অবাক হয়ে শুনছিল। বললাম, দড়ি শক্ত করে বাঁধা
ছিল তো? আলগা হয়ে স্লিপ করেনি?
বিরূপাক্ষ দারোগার কাজে কটাক্ষ
করলে তিনি ভারি অসন্তুষ্ট হন। একটা তাচ্ছিল্যের গলাঝাড়া দিয়ে বললেন, কী যে বলেন মশাই। ওসব কিছুই নয়। একবার নয়, তিন-তিন
বার আচ্ছা করে মাপজোখ করেছি। কিছু একটা ধান্দা করেছে বুঝেছি, কিন্তু কী করে যে নৌকা অদ্দূর যাচ্ছে, সেটা কিছুতেই
ধরতে পারলাম না। তবু সিবিল বিভাগ থেকে লোহার চেন আনতে পাঠিয়েছি। তাই দিয়ে এবার
মেপে দেখব।
—
দড়িতে কোনও কায়দা নেই মনে হয়, মাষ্টারমশাই এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন, এত কাঁচা কাজ নন্দ করবে না।
—
অ্যাঁ, তাহলে?
মাষ্টারমশাই হঠাৎই প্রশ্ন
করলেন, আচ্ছা সরোবরের পাড়টা নিশ্চই খানিকটা উঁচু, তাই না?
—
পাড়? হ্যাঁ — তা পাড়
থেকে জলের কিনারা খানিকটা নিচে তো বটেই। ফুট বিশেক হবে। সিঁড়ি কাটা আছে কয়েক ধাপ,
নেমে যেতে হয়। কিন্তু তাতে কী হল?
—
তাতেই তো হল। দড়িটা আসলে
একশো নয়, একশো গজ আর ঐ বিশ ফুট লম্বা।
—
তাতে কী? কিনারা থেকে একশ’ গজ দূরেও তো জল ততটাই নিচে। বিশ ফুট তো কাটাকুটি হয়ে
যাচ্ছে?
—
হচ্ছে না। আমার আন্দাজ
মতো নন্দ একশো গজ পেরিয়ে আরও অন্তত দশ-পনের ফুট এগিয়ে যেতে পারে।
—
কী করে জানলেন?
—
অঙ্কশাস্ত্রে ট্রিগোনোমেট্রি বলে একটা
বিষয় আছে দারোগাবাবু, তা দিয়ে বার করা যায়। পাড়টা যদি খাড়াই কুড়ি
ফুট নেমে যেত, তাহলে একশো গজ বিশ ফুট লম্বা দড়ি দিয়ে জলের
তলে একশো গজ — অর্থাৎ তিনশো ফুটের পরেও প্রায় উনিশ ফুট আগে চলে যাওয়া যেত। যেহেতু
পাড় খাড়াই নামেনি, তাই কিছু কম হবে। পাড়ের স্লোপ জানা থাকলে
কষে বার করা যায় ঠিক কতটা আগে যাবে।
খানিকক্ষণ বিরূপাক্ষ দারোগার
মুখব্যাদান বন্ধ করতে ভুল হয়ে গেল যেন। তারপর কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে বললেন, দড়ি কি অঙ্ক কষতে পারে নাকি?
—
না। কিন্তু ঐ দড়ি দিয়েই আরও আগে চলে
যাওয়া যাবে। কিঞ্চিৎ জ্যামিতির ব্যাপার আছে।
ট্রিগোনোমেট্রিই শুধু নয়, আবার জ্যামিতি! দারোগাবাবু আর দেরি করলেন না, ত্বরিতে
উঠে পড়লেন। মাষ্টারমশাই যেন কী? সবেতেই অঙ্ক টেনে আনবেন।
দারোগাবাবুর যা অতি অপছন্দ। কিন্তু এটুকু জানেন, মাষ্টারমশাই
যখন বলছেন, সে কথার ওজন আছে। টুপিটা মাথায় চড়িয়ে তিনি বললেন,
এসে আপনার বাকি কথা শুনব, আগে নেদোটাকে থানায়
জমা করে আসি।
দারোগা চলে যেতে পল্টু বলে
উঠল, কী জ্যামিতি আছে বুঝলাম না তো?
আমিও বললাম, দড়িটা একশো গজের চেয়ে লম্বা ঠিকই। কিন্তু টানা হয়েছে তো একশো গজই। তাতে
নৌকাটা তার চেয়ে বেশি এগিয়ে আসবে?
মাষ্টারমশাই চট করে একটা
কাগজে কিছু আঁকিবুঁকি কেটে পল্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আসবে। প্রথমটা একটু কাউন্টার-ইন্টুইটিভ লাগে ঠিকই। এইটে দেখলেই সব
পরিষ্কার হয়ে যাবে।
পল্টুর ঘাড়ের ওপর দিয়ে দেখি
কাগজটায় লেখা —
ব্যাপারটা এবার বোঝা গেল, কী করে একশো গজ দড়ি টেনে নন্দ একশো গজের বেশি দূর থেকে নৌকাকে নিয়ে আসছিল।
কেননা সে কুড়ি ফুট উঁচু থেকে দড়ি টানছিল। দেখি পল্টুও বুঝেছে কিন্তু যেন বিশ্বাস
করতে পারছে না।
পল্টুর বিস্ফারিত দৃষ্টি দেখে
মাষ্টারমশাই বললেন, ক প্লাস খ ইজ গ্রেটার দ্যান গ। কেন বল তো
পল্টুবাবু?
পল্টু চেঁচিয়ে বলল, বুঝে গেছি। ক, খ আর গ তো ত্রিভুজের তিনটে বাহু!
—
কারেক্ট। আর স্কুলের জ্যামিতিতেই
পড়েছ কিনা, সাম অফ এনি টু সাইডস অফ আ ট্র্যাঙ্গল ইজ —
—
গ্রেটার দ্যান দ্য থার্ড!
_____
ছবি - আন্তর্জাল
বোঝবার ভুলে সামান্য কঠিন মনে হচ্ছিল।
ReplyDeleteএখন ঠিক আছে তো দাদা?
ReplyDelete