হারাধন কাকার পুঁটলি
বুম বোস
“কীইইইইই! আর
একবার যদি
তুমি আমার
বাপের বাড়ি তুলে
কথা বলেছ, তাহলে
কিন্তু রক্ত
গঙ্গা বয়ে
যাবে, এই বলে দিলাম।”
“হ্যাঁ, ওই তো পারো।
বাপের বাড়ি থেকে
ওই আঁশবটিটা ছাড়া
তো কিছুই আনোনি।”
“কেন আনতে যাব
শুনি??? তোমার ফুর্তি করার জন্য?”
“এত্ত
বড়ো কথা!!! তুমি বোধহয় ভুলে
গেছ বউ যে তুমি
কার সঙ্গে কথা বলছ!
একসময় আমার নাম
শুনলে গ্রামের উঁচু সে উঁচু মাথা থরথর করে কাঁপত।”
“সে তো কাঁপবেই। ভাড়া করা গুন্ডা
ছিলে যে।”
“গুন্ডামির আর দেখেছটা কী! ধড় থেকে মাথাটা
যখন কুচুৎ করে
কেটে নামিয়ে
দেব তখন বুঝবে গুন্ডামি।”
“কীইইই!!! যত
বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা!! বলি
ও মালতী, আন তো আঁশবটিটা.......”
ব্যস, ওই শুরু
হল। রোজ রোজ এই এক ঝামেলা। দিনে চারবেলা খাবে আর
ঝগড়া করবে। আর
কোনও কাজ
আদৌ হারাধনকাকা আর
রাঙাকাকিমার
আছে কিনা
তা নিয়ে
গ্রামের সবার মনে যথেষ্ট
সন্দেহ রয়েছে। আজও অ্যালার্ম
ঘড়িটার জায়গায় ওদের দুজনের চিৎকারই ঘুম ভাঙ্গালো বাবিনের।
হারাধনকাকা
আর রাঙাকাকিমার জ্বালায়
সারা গ্রাম অতিষ্ঠ।
কিন্তু কিছু করার নেই। গ্রামের পুরোনো
লোক বলে কথা।
আর তাছাড়া দুজনের
মুখ যতটা খারাপ, মানুষ দুটি ঠিক
ততটা খারাপ নয়।
বাবিন তো এও শুনেছে
যে, ওদের
এই ঝগড়ার
পালা নাকি ওর জন্মের আগে
থেকে চলে আসছে।
তাই গ্রামের
সবার অন্যান্য দৈনন্দিন অভ্যাসগুলির
মতো এদের ঝগড়া সহ্য করাটাও একটি দৈনন্দিন
অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অত্যন্ত অনিচ্ছা
সত্ত্বেও
বাবিন বিছানা ছেড়ে
কলতলায় গিয়ে
চোখমুখ ধুয়ে নিল।
তারপর দুধ বিস্কুট
খেয়ে পিঠে ব্যাগ
নিয়ে রওনা দিল অঙ্ক
স্যারের
বাড়ির উদ্দেশে।
“আচ্ছা, কণিষ্কের
তো মাথা ছিল
না, তাহলে সে না
দেখে যুদ্ধ করত কী
করে?”
অচিন্ত্য’র এরকম একখানা জব্বর প্রশ্ন শুনে
বাবিনের হাতের রুটি-আলুভাজা
টিফিনবক্স
থেকে আর
মুখ অবধি
পৌঁছল না, পড়ে গেল ধুলোবালিময় মেঝেতে। অনেক চেয়েও
না আটকাতে
পারা, পেটের
গভীরতম কোণ
হতে উৎপন্ন হওয়া দমফাটা হাসিটা শেষমেশ
আছড়ে পড়ল ক্লাসরুমে। প্রায় দশ মিনিট পর কোনোমতে
বাবিন নিজের হাসি থামিয়ে
বলল, “ওরে গাধা, কণিষ্কের যে
মাথা ছিল না তোকে কে বলল! কণিষ্কের
যে মূর্তিগুলো
পাওয়া গেছিল সেগুলোর
একটারও মাথা
ছিল না, তাই বইতে
কণিষ্কের
মাথা কাটা মূর্তির
ছবি থাকে। বুঝলি?”
“তুই এত কিছু কী করে জানলি?” অচিন্ত্য অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করল।
বাবিন মুচকি
হেসে বলল, “কাকাবাবু পড়ে।”
সম্রাট কণিষ্ক যে আসলে
স্কন্দকাটা ছিলেন না, অচিন্ত্যকে সেটা বোঝাতে বোঝাতেই টিফিন ব্রেকটা শেষ হয়ে
গেল। ওরা আবার বই
খাতা খুলে যে
যার পড়াশোনায় মন দিল।
স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাবিন আর অচিন্ত্য ঠিক করল নদীর
ধারের জঙ্গলে
যাবে কুল পাড়তে। যেমন ভাবা তেমনই
কাজ। বিকেল থাকতে থাকতেই
ওরা পৌঁছে গেল
নদীর ধারের জঙ্গলে। তারপর
দু’জনে মিলে
একটি গাছ থেকে
টপাটপ কাঁচা
কুল পেড়ে আয়েশ করে
খেতে শুরু করল। এমন
সময় হঠাৎ শুকনো পাতায় কারও হাঁটার মড়মড় শব্দ
শুনে চমকে উঠল ওরা। দূর থেকে
কারও যেন
কথা বলারও
শব্দ পেল ওরা
দু’জন। হাঁটার শব্দটা
ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল
ওদের দিকে। বাবিন
তখনই অচিন্ত্য’র হাত
ধরে ধীর পায়ে কিছুটা দূরে গিয়ে একটা মোটা গাছের
পেছনে লুকিয়ে পড়ল। তারপর
গাছের আড়াল থেকে একটু
মুখ বাড়িয়ে দেখল দু’জন লোক
হাঁটতে হাঁটতে নদীর
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনের
মধ্যে একজনের পিঠে একটা চটের বস্তা, যেটা দূর
থেকে বেশ ভারী বলেই
মনে হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে আরেকজন
কে? খুব
চেনা চেনা ঠেকছে! বাবিন আরেকটু ভালো করে
দেখার চেষ্টা
করল।
“আরে এ
তো আমাদের হারাধন কাকা,” চমকে
উঠল বাবিন।
হারাধনকাকা এখানে কী
করছে? সঙ্গে
ওই লোকটাই বা কে? আর ওই
বস্তাটার
মধ্যেই বা কী রয়েছে? প্রশ্নের
ঠেলায় কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম
জমতে শুরু করল
ওর। এদিকে অচিন্ত্য’র যেন কোনও
ভ্রুক্ষেপই নেই, মনের সুখে কুল খেয়ে চলেছে।
কিন্তু বাবিনের মনে
উদ্ভট সব চিন্তা-ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ও যেটা ভাবছে
সেটা যদি সত্যি
হয়? কী সাংঘাতিক!
ঝুপ করে
একটা শব্দে সম্বিত
ফিরল বাবিনের। সামনের দিকে তাকিয়ে ও দেখল
হারাধনকাকারা ফেরার পথ
ধরেছেন, আর ওই ভারী, রহস্যময়
চটের বস্তাটি ভেসে যাচ্ছে নদীর
জলে। দূরে, বহু দূরে।
অচিন্ত্য চলে যাওয়ার
পর থেকেই শরীরটা কেমন যেন
শিরশির করছে বাবিনের। পা
দুটোও কেমন
যেন ভারী ভারী লাগছে ওর। রাস্তাটা আজ যেন
শেষই হতে চাইছে
না। রোজ তো
ইস্কুল থেকে এই
রাস্তা দিয়ে একাই
বাড়ি ফেরে ও, কিন্তু আজ এমন
লাগছে কেন? তবে কি
ও ভয় পাচ্ছে?
“কী করে
বাঁচাবো
বলো মাথা...
কে সি
পালের ছাতা............ ।’
রাস্তার ধারের সেলুনটা
থেকে আসা আচমকা গানটা বাবিনের দুশ্চিন্তা আরও দশগুণ বাড়িয়ে
দিল। কণিষ্কের মাথা, কে সি পালের ছাতা, হারাধন কাকা........ সব কেমন
যেন গুলিয়ে যাচ্ছে ওর, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে
খুব।
সাতপাঁচ, হাতিঘোড়া, আকাশকুসুম ভাবতে
ভাবতে যথারীতি বাড়ি পৌঁছে গেল বাবিন। কিন্তু দরজা
ঠেলে বাড়ি ঢুকতেই একটা
অদ্ভুত পচা দুর্গন্ধ পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খিঁচড়ে গেল ওর। রাগে বিড়বিড় করতে করতে টেবিলের ওপর
ব্যাগটা রেখে যেই
না বসতে যাবে, এমন
সময় ওর চোখ গেল খাটের নিচে রাখা একটা কালো
গোল মতো পুঁটলির দিকে।
“মা, খাটের
তলায় এই
কালো পুঁটলিটা কীসের
গো?”
চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল বাবিন। মা রান্নাঘর থেকে
চেঁচিয়ে বলল, “ওটা তোর হারাধন কাকুর, সকালে
রাখতে দিয়ে গেছে। সন্ধেবেলা নিয়ে যাবে।” মায়ের
কথা শুনে ওর
মাথাটা কেমন
ঘুরতে শুরু করল। চারপাশে
সব কেমন যেন ঘুরছে, কাঁপছে। চোখের পাতা আস্তে আস্তে বুজে আসছে ওর।
ক্লান্তিরা
ভিড় করে ডেকে আনছে ঘুম।
সন্ধেবেলা ঘুম ভাঙতেই
বাইরে দিয়ে
সবার কথাবার্তার শব্দ পেল
বাবিন। ও বিছানা থেকে উঠে চোখ দুটো বার পাঁচেক
কচলে বাইরে এল। আর এসেই দেখল
হারাধন কাকা
হাতে ওই কালো পুঁটলিটা ধরে দরজার
সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর সকাল থেকে
সন্ধে পর্যন্ত সমস্ত কথা
মনে পড়ে গেল।
ও চিৎকার করে উঠল, “মা, হারাধনকাকা খুনি।” বাবিনের কথা
শুনে সবাই
অবাক।
“কী সব আজেবাজে বকছিস তুই? পাগল হয়ে গেলি নাকি!” মা ঝাঁঝিয়ে উঠল।
“আমি সত্যি বলছি মা, হারাধন কাকা রাঙা কাকিমাকে খুন
করে ধড়টা নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। আর
মুন্ডুটা
আছে ওই কালো পুঁটলিটায়। ওটা সারা দিন
আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল, এখন
নিশ্চয়ই ওটা মাটির
তলায় পুঁতে দেবে।” একটানা বলে থামল বাবিন। ওর কথা শেষ হতেই বাড়ির
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সবচেয়ে জোরে
হাসল হারাধনকাকা।
হাসতে হাসতে দরজার বাইরে
গিয়ে বলল, “কই গো বউ, এসে
শুনে যাও
বাবিন কী বলছে! আমি
নাকি তোমায় খুন করেছি।” হাঁকডাক শুনে রাঙা কাকিমা আঁচল দিয়ে
মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে
এসে বলল, “কী হল, বলি অমন ষাঁড়ের
মতো চেঁচাচ্ছ কেন?”
“দেখ দেখ
বাবিন কী বলছে, আমি নাকি
তোমায় খুন করেছি,”
হারাধনকাকা
হাসতে হাসতে বলল। রাঙাকাকিমা
নাকে নাকে
বলল, “অ্যাঁ........ অত সোজা নাকি! গায়ে
হাত দিয়ে
দেখাক তো.......”
“তাহলে ওই
বস্তা... ওটায় কী ছিল?”
বাবিন জিজ্ঞাসা করল।
“ওতে তো
আমার বাগানের আবর্জনা
ছিল, প্রতিমাসে আমি
নদীতে গিয়ে
ফেলে আসি।”
“আর ওই পুঁটলিটা?”
“ওতে একটা
বড়ো তাল
রয়েছে। সকালে বাজার থেকে
এসে দেখি তোর কাকিমা
বাড়ি নেই, তাই তোদের
বাড়ি রেখে গেছিলাম,” হারাধন কাকা বলল।
“আর ওই পচা গন্ধটা!” মায়ের
দিকে তাকাল বাবিন।
“সে তো রান্নাঘরে একটা ইঁদুর মরে পড়েছিল। কিছুক্ষণ আগে ফেললাম।”
মায়ের কথা শুনে লজ্জায়
কান লাল হয়ে
গেল ওর।
ছুট্টে আবার ঘরের ভেতর
ঢুকে গেল ও। সেই
দেখে আবার হাসিতে
ফেটে পড়ল
সবাই।
_____
অলংকরণঃ দীপিকা
মজুমদার
No comments:
Post a Comment