গল্পের ম্যাজিক:: মন্ত্রসিদ্ধি - রঞ্জন ঘোষাল

অণু-কল্পবিজ্ঞান

মন্ত্রসিদ্ধি
রঞ্জন ঘোষাল

গ্রহান্তরের প্রাণীরা ধরা দিল তো অবশেষে! এখন শান্ত সুশীল হয়ে নাসা-র অ্যারিজোনা বেস স্টেশনে বসে সব কিছু কেমন উগ্‌রে দিচ্ছে। অথচ গত পনেরো ঘন্টা ধরে কী নাকানি-চোবানিটাই না খাওয়াল।
ওদের মহাকাশযানটির নাট-বল্টু খুলে ফেলে এবার ভালো করে রিভার্স এঞ্জিনিয়ারিং করতে হবে।
পাঁচ লক্ষ আলোকবর্ষ জাম্প করে এসেছে ব্যাটারা। বাপ্‌ রে!
*      *      *
নাসার নাসিকাগ্রে মাছির মতো বসে আছেন প্রোফেসর অমিতাভ ভট্টাচার্য। ২০১১-র পর থেকে নাসা-উৎক্ষেপিত যাবতীয় মহাকাশযানের যা অতি সংবেদনশীল প্রত্যঙ্গ, সেই ঘ্রাণিকা অংশটির ডিজাইন অমিতাভর টিমের।
অমিতাভ নাসার অ্যারিজোনা ফেসিলিটিতে তড়িঘড়ি পৌঁছে গেছেন। এসে এই ভিন্‌গ্রহী মহাকাশযানটির নাসিকা অংশের কৃ‌ৎকৌশল দেখে মুগ্ধ। এইখানেই তাহলে নিহিত আছে হাইপার জাম্পের আসল কেরদানি!
রহস্যটা কী?
অগুন্তি আণুবীক্ষণিক মাছি।
কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে যেতেই মৌচাকে, না, ঢিল নয়, একটা যেন বাতাসের ঝাপটা লাগল। আগন্তুক যানের কোটি কোটি মাছিতে ঢেকে থাকা বর্মটিতে সামান্য কুঞ্চন দেখা দিল। একটু চাঞ্চল্য। তারপরেই মাছিরা আবার ধ্যানস্থ। আশ্চর্য!
একটা ফরসেপের ডগায় করে তুলে মাইক্রোস্কোপের স্লাইডে সামান্য আঠা মাখিয়ে একটি মাছিকে বসিয়ে দিয়ে অণুবীক্ষণে চোখ রাখলেন অমিতাভ।
কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
*      *      *
আজ ২০১৭-র পয়লা এপ্রিল। খবরটা আজকে কোনও মিডিয়াই ক্যারি করবে না। অল ফুল্‌স ডের ধাপ্পা বলে খবরটাকে সব নিউজ চ্যানেল ইগনোর করবে। সেটা খানিকটা বাঁচোয়া। গ্রহান্তরের সবুজ প্রাণীদের, সর্বমোট চারজন, ইন্টারোগেট করার জন্য পেন্টাগন থেকে, নাসার হিউস্টন ফেসিলিটি থেকে, অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগ থেকে এবং হোয়াইট হাউস থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন।
চারজন এলিয়েন কোনও রকম মহাজাগতিক বায়োবীজাণু বহন করছে কিনা কিম্বা কোনও রেডিও-অ্যাকটিভ রশ্মি বিকিরণ করছে কিনা সেটা দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে একটি লেকচার রুমে সবাই বসেছেন এলিয়েনদের ঘিরে। এডোয়ার্ড চ্যাং, অ্যারিজোনা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স প্রথমে বলতে শুরু করলেন – সমবেত ভদ্র ও ভদ্রমণ্ডলী, আমরা এদের কমিউনিকেশন প্রোটোকল জানি না। এরা প্রোটিন-বেসড বায়ো অর্গ্যানিজম এটুকু বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য রোবট হওয়াও বিচিত্র নয়। এরা কি ভোকালি, মানে শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে কমিউনিকেট করে, না জেশ্চারের সাহায্যে, নাকি সরাসরি মস্তিষ্কে ...
বলতে না বলতেই উপস্থিত সবার ব্রেইনে পিং করে আওয়াজ হল। এবং বোঝা গেল প্রশ্নোত্তরের আসরটি এই আগন্তুকরাই পরিচালনা করবেন। প্রত্যেকের মস্তিষ্কে জোরালোভাবে এদের সিগন্যাল ভেসে এল, তোমরা কি আমাদের নতুন ক্যাপ্‌টর? আমাদের বন্দি করেছ কেন? কে তোমাদের কর্তা? আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এলিয়েনদের রীতি এ রকমই বটে। গল্পে কমিক্‌সে দেখা গেছে, ওরা এসেই সাধারণত বলে, টেক আস টু ইয়োর লিডার। এবং কোনও এক অজ্ঞাত কারণে গল্পকারেরা ধরে নেন যে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টই সেই ব্যক্তি, যাঁকে মনুষ্যসমাজের নেতা হিসেবে গণ্য করা উচিত। কিন্তু সে জমানা এখন আর নেই রে ভাই! হোয়াইট হাউস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পেন্টাগন বলল, আমাদের লিডার বলতে এখন ইয়ে, মানে ইউনাইটেড  নেশনসের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্টনিও গুতেরেস-এর কথা যদি বলো, উনি এখন ছুটিতে।

এলিয়েনদের মুখপাত্র এগিয়ে এল। বলল, “তোমাদের গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি কোন্‌জন? তার সঙ্গে আমাদের কথা বলিয়ে দাও। এবার নাসার তরফ থেকে নরেন্দ্র মোদীর নাম উঠল। সব চেয়ে তেজি রফ্‌তারে জিডিপি বাড়িয়ে যিনি সওয়া বিলিয়ন আবাদির দেশকে বিকাশের পথে নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি অবশ্যই পৃথিবীর বুদ্ধিমানতম ব্যক্তি হবেন।
এলিয়েনরা বলল,বুলাও উন্‌কো।
ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলেন বিজ্ঞানী অমিতাভ ভট্টাচার্য। এসে বললেন, “তার আর দরকার হবে না। মশা  মারতে কামান দেগে লাভ নেই। এই চারজন ভিনগ্রহী বন্ধুকেও ছেড়ে দেওয়া হোক। এরা এই পৃথিবীতে নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াক। চাষবাস করুক। গঙ্গার হাওয়া খাক। এরা মহাকাশচারী স্বেচ্ছায় হয়নি। এদের বন্দি করে আনা হয়েছে। এনেছে একদল মহাজাগতিক ক্ষুদ্র মাছি। ভয়ঙ্কর তাদের উদ্দেশ্য। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তারা বুদ্ধিমান প্রাণীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের স্পেসিমেন হিসেবে ধরে খাঁচায় পুরে রাখছে কোনও এক বদ্‌ উদ্দেশ্যে। এখানে নেমেছে পৃথিবীর কিছু লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদের মহাকাশযানটি আসলে একটা বিরাট কয়েদখানা।
মাছি? মানে ভন্‌ভন করা মাছি? যারা আম-কাঁটালের টাইমে এসে উপদ্রব করে সব চেয়ে বেশি?একজন মালয়েশিয়ান বিজ্ঞানী প্রশ্নটা না করে পারলেন না।
অমিতাভ বললেন, “হ্যাঁ। সেই গোত্রেরই জিনিকিন্তু মহা ধুরন্ধর। নিজেরা মহাকাশযানের বাইরের খোলস সেজে ঘুরে বেড়ায়। আর যানের পেটের মধ্যে রাখে বন্দিদের।
কোথায়? কোথায় সেই মাছির দল?পেন্টাগন আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করল।
অমিতাভ বললেন, “ধরা পড়তেই পালিয়েছে। প্রত্যেকটি পতঙ্গ তাদের জেট্‌প্যাক সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি ক্যাঁক করে চেপে ধরতেই প্রত্যেকে মুহূর্তের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত ট্রান্সগ্যালাকটিক জেটপ্যাক অ্যাকটিভেট করে পালিয়েছে। রেখে গেছে খালি ওদের স্পেস্‌ক্রাফ্‌টের খোলসটা আর এই কজন বন্দিকে। তা হ্যাঁরে বনমালী, হাইপার জাম্পের রহস্য কিছু শিখলি তোরা?
এলিয়েনদের নেতা, যাকে বনমালী বলে ডাকা হল, সে ঠোঁট উলটে বলল, ওদের মক্ষিরাণীটি ভীষণ ধুরন্ধর। কিচ্ছু ফাঁস করেনি। শুধু বুঝেছি ঐ মাছিরাই হল হাইপার-জাম্প মারা গ্যালাকটিক এঞ্জিনের এক একটি ইউনিট। ওরা ওদের ক্লাস্টারের সম্মিলিত শক্তিতে স্পেসস্টেশনটাকে চালিয়ে নিয়ে চলে, এক ছায়াপথ থেকে  অন্য ছায়াপথে। হাইপার জাম্প মারবার মুহূর্তে ওরা একবার সমস্বরে বলে ওঠে জয় শ্রীহনুমানব্যস্‌, সঙ্গে সঙ্গে এক নক্ষত্রলোক থেকে অন্য নক্ষত্রলোকের স্পেসে উত্তরণ। তা তোমাদের এ তল্লাটে শ্রী হনুমান নামের কেউ আছে নাকি? আমাদের জিজ্ঞেস করছিল। আমরা তো বাপু অমন নাম কখনও শুনিনি।”

অমিতাভ প্রমাদ গুণলেনহনুমানজীর স্মরণমাত্রে হাইপার জাম্প-গুণ প্রাপ্ত হওয়া যায়? অথচ আর্যাবর্তের সন্তান হয়েও অজরামর পরমগুণান্বিত শ্রী হনুমান জপশক্তির খোঁজ ভারতীয়রা এখনও পায়নি এ তো ভারি  লজ্জার কথা। একটি জেটপ্যাক ও জয় শ্রীহনুমান মন্ত্র। ব্যস? তাহলেই এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে লাফ দিয়ে পৌঁছোনো যাচ্ছে? অমিতাভর আর তর সইছে না। এক্ষুনি একটা জুত মতো জেট-প্যাক বানিয়ে ফেলতে হচ্ছে। জয় হনুমান জ্ঞানগুণসাগর, জয় কপীশ তিঁহ লোক-উজাগর। অমিতাভ রামায়ণের দেশের ছেলে। জেট-প্যাক যন্ত্রের সঙ্গে এই মন্ত্রটি জুতে দেওয়া, এই তো? কাজ হবেই। দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এলিয়েনদের বললেন, ফলো মি। তোমাদের দেশে ফেরার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
_____
অলংকরণঃ সুমিত রায়

1 comment:

  1. জাম্পেশ, মানে ইয়ে জম্পেশ হয়েছে। যদিও দুর্জনে 'রঞ্জনৈতিক উদ্দেশ্য়পোণোদিত' বলে একটু হাল্লাগুল্লা করতেই পারে।

    ReplyDelete