অন্তর্ধান রহস্য
মানসী পাণ্ডা
“ম্যাঁ আঁ আঁ আঁ.... আঁমার হাঁওয়াই
চঁপ্পল?”
বিকট এই চিৎকার শুনে পুবের আমগাছে যতগুলো পাখি বিশ্রাম নিচ্ছিল সব
ক’টাই কিচির মিচির করতে করতে উড়ে পালিয়ে গেল। খোঁড়া কাকটাও
খাঁ খাঁ ডাক ছেড়ে কার্নিশ থেকে সোজা পুকুর পাড়ের
তেঁতুলগাছে পাতার আড়ালে লুকোল। আর
বাঘা, সবেমাত্র
বেরিয়ে এসে পাঁচিলের ছায়াতে শুয়ে
দিবানিদ্রার আয়োজন করছিল, সেও কেঁউ করে ককিয়ে লাফিয়ে উঠল লোমটোম খাড়া
করে। এ সবের ফাঁকে ভোম্বলের হাত থেকে চিরকুটটা হুশ করে উড়ে গেল আর পাক খেতে খেতে
পড়ল পুকুরের জলে। ভোম্বল হাঁই হাঁই করে ধরতে যাবার আগেই নৌকার মতো তরতরিয়ে সেটা
মাঝ পুকুরে। ভোম্বল সাঁতরে যে সেটা নিয়ে আসতে পারবে না তা নয়, শুধু মা
দেখতে পেলেই সব্বনেশে কাণ্ড ঘটবে। আজ তাহলে রাত্তিরবেলা মাংসের
ঝোলের পরিবর্তে নিরামিষ চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতে হবে।
মনে একটু ক্ষোভ থাকল এই যা। ওই
আবছা লেখা ভর্তি চিরকুটটায় সে
খু... পর্যন্ত সমাধান করে ফেলেছিল, আর সামান্য সময় পেলেই খুন, কার খুন, কবে খুন সব
উদ্ধার করে ফেলতে পারত। কিন্তু খুব বেশি হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারছে না, কারণ তার
ষষ্ঠেন্দ্রিয় আর একটা রহস্যের আঁচ অনুভব করছে, যেটা চিরকুটটার মতো ভবিষ্যৎহীন রহস্য নয়, যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। এবং তার পরিধির মধ্যে নিঃশব্দে, সকলের
অজান্তে গুটি গুটি পায়ে তার জাল বিস্তার করছে। ভোম্বলের মতো প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন
এরকম গোয়েন্দা থাকতে এ ঘটনার নিষ্পত্তি না হয়ে যায় না। শুধু যদি একটা সহকারী থাকত! এসব রহস্য বেশ কম সময়ের মধ্যেই সে সমাধান করে ফেলতে পারে।
ছোটোভাই বাবুনের কাছে সহকারী হওয়ার প্রস্তাবটা পেশ করেছিল, কিন্তু খুব
সন্দেহজনক মনে হওয়ার কারণে সে তৎক্ষণাৎ সেটা নাকচ করে। অগত্যা বাঘা, তাদের লালু ভুলো কুকুর তার একমাত্র সহযোগী।
নতুন রহস্যের সূত্র ওই
চিৎকারের মধ্যে লুকিয়ে আছে। চিৎকারের উৎস বিনি, ভোম্বলের ক্লাস নাইনে পড়া দিদি এবং
তাদের সংসারের বখে যাওয়া একমাত্র কন্যা সন্তান। অবশ্যই ভোম্বলের মতে। বাকিরা তো
মাথায় তুলে রেখেছে, বিনি
এই... বিনি সেই। বিনি কী করে? সারাদিন বই
মুখে পড়ে থাকে, গুচ্ছের নম্বর পায়, আর বাকি সময়টা রূপচর্চা করে। ভোম্বলের
ক্লাস সেভেনের বিদ্যায় কিছুতেই ঢোকে না - লেখাপড়ার চর্চা হয়, খেলাধুলার
চর্চা হয়, কিন্তু
রূপচর্চা বস্তুটা কী! ওটা কি উঁচু ক্লাসের সিলেবাসে
থাকে! উঁহু তাহলে তো বড়দা,
মেজদা - মানে ভোম্বলের ক্লাস টুয়েলভ আর টেনে পড়া জ্যাঠতুতো দাদারাও ওটার চর্চা
করত। তাহলে হয়তো কম্পালসারি বিষয় নয়। ভোম্বল এটুকু ভেবেই শান্তিতে আছে।
যাই হোক ওই বিষয়টায় ভালো ফল
করার জন্য বিনি সুযোগ পেলেই সাদা, সবুজ, হলুদ রঙের জিনিসপত্র হাতে মুখে মেখে বসে থাকে। মাথায় যেটা
লাগায় সেটার তো কোনও তুলনা নেই, যেমন বর্ণ তেমন তার গন্ধ, পেটের নাড়িভুঁড়ি উঠে আসবে। যে বিনি
গন্ধের জন্য মাছ খেতে পারে না, সে কোন ক্ষমতার বলে ঐ গন্ধমাদন মাথায় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় সেটার রহস্যভেদে ভোম্বলের গোয়েন্দা
বুদ্ধিও ফেল মেরে গেছে। বিনির সঙ্গে সম্পর্কটা ভোম্বলের তেমন সুবিধার ছিল না, সামান্য দু’একটা
কিল চড় দিলেই কুচুটেটা মা কিম্বা জেঠিমা-কে লাগায়, আর তারপর উত্তমমধ্যম যা পাওনা হত
ভোম্বলের তা বলার নয়। যোগাযোগের যেটুকু ক্ষীণ সুতো লেগে
ছিল দু’জনের মাঝে, ভোম্বলের একটি পরীক্ষার কারণে সেটি পুরো ছিঁড়ে গেছে।
ঘটনাটা ছিল ওই মাথার বস্তুটা
নিয়েই। বিনির ঘ্রাণশক্তিটা কী চিরতরে
বিলুপ্ত হয়ে গেছে, পরীক্ষা করার জন্যই
ভোম্বল সারারাত ভিজিয়ে রাখা বিদঘুটে রঙের মাখনটায় একদলা টাটকা গোবর মিশিয়েছিল।
পরদিন সকালে বিনি সেটা মেখে নির্বিকার ঘণ্টা তিনেক কাটিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলল।
ভোম্বল পুরো ব্যাপারটা তীক্ষ্ণ নজরে রেখে বুঝেছিল মাছের ব্যাপারে বিনি শুধু ভেলকিবাজি
করে, গন্ধ
মোটে পায় না। একটু চিন্তিত হয়েই বিনিকে বলেছিল, “তোর রূপচর্চায় এতটা গোবর মেশালাম তুই
গন্ধ পেলি না?”
“তুই আমার হেনায় গোবর মিশিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ, এই এতটা হবে,” বলে
একমুঠোর মাপে ভোম্বল দেখায়। বিনির মুখটা কেমন বেগুনি হয়ে গেল। এহ, গোবরটার কোনও
প্রতিক্রিয়া হয়ে গেল নাকি?
যাক গে, এসব সাময়িক প্রতিক্রিয়া, ওর প্রধান চিন্তা নাকটা নিয়ে।
“তোর চুলটা যদিও চিকন লাগছে, কিন্তু তোর
নাকটা এক্স-পায়ার করে গেছে,
কোন গন্ধই পাচ্ছিস না,
জলদি বদলে ফেলা দরকার।”
বিনি একটা বিকট ম্যাঁ ডাক
ছেড়ে যাওয়ার পর একটাই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, বিকেলে মায়ের হুকুমে ওদের সারাদিনের
কাজের লোক হাবুদা একটা খিটকেল হাসি নিয়ে ভোম্বলকে রগড়ে রগড়ে গোবর মাখিয়েছিল। হাসির
কারণটা ভোম্বল জানে,
ঐ যেদিন হাবুদা ভয়ংকর নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল
দুপুরে, সবার
শান্তির কথা
চিন্তা করে ভোম্বল হাবুর নাকে একটা কাপড় আটকানোর ক্লিপ আটকে দিয়েছিল। গোটা বাড়িটাই
কেন যে ওর মতো শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে শত্রুপক্ষের মতো আচরণ করে! তবে ভোম্বল লক্ষ করে
দেখেছে, যে কারণে বিনির এত রাগ সেটা নেহাতই বাহ্যিক, কারণ বিনি এখন ওই বস্তুটার সঙ্গে
একদলা গোবর মিশিয়েই মাখে। পুরোটাই অবশ্য চুপিচুপি।
অতীত ছেড়ে এখন বর্তমানে মন
দিলে যদি ভবিষ্যৎ ঠিক করা যায় তাই ভোম্বল এখন নতুন রহস্যটায় মনোনিবেশ করতে চায়।
কাকতালীয় ভাবে এটা আবার বিনিকে জড়িয়ে। ঘটনাটা এরকম যে গত পাঁচদিনে বিনির তিন-জোড়া
হাওয়াই চপ্পল চুরি হয়ে গেল। বাড়ির সকলকে
ছেড়ে, এমনকি
ভোম্বলকে ছেড়ে বেছে বেছে বিনির চপ্পল চুরি! পৃথিবীর সমস্ত মানুষের আক্রোশ তো
ভোম্বলের উপর, তাহলে
কোন ভয়ানক প্রতিশোধস্পৃহু মানুষের নজর পড়ল বিনির উপর? ভেবেই
বুক হিম হয়ে যাচ্ছে ভোম্বলের। আরও কত বিপদ খাঁড়ার মতো ঝুলছে বিনির মাথার উপর!
প্রথম জোড়া চপ্পল যখন উধাও
হয়ে গেল বিনি বেশ খুশি হয়েছিল নতুন জোড়া পেয়ে। বড়োরা মাথা ঘামায়নি তেমন, কোথাও ভুল
করে ফেলে এসেছে ভেবে। দ্বিতীয়টা অদৃশ্য হবার পর সকলের ভ্রু একটু কুঁচকেছে। বিনিও
ভোম্বলকে একটু নজরে রেখেছিল। আজ গেল তৃতীয় জোড়া। বেশ গোলাপি রঙের ফুল-ছাপ দেওয়া।
চুপিচুপি বলতে বাধা নেই ভোম্বলেরও একটু মন হয়েছিল ওগুলো পরার, নেহাত বেশ
শক্ত ধাতের ছেলে তাই বহু কষ্টে নিজের লোভকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই একটু আগেই ভাত
খেয়ে বিনি পা-ময় মধু না কি একটা চটচটে মেখে চপ্পল পরে উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছিল। এর
মধ্যে কে এলো আর কীভাবেই বা চুরি করল ভোম্বল হদিশ করে
উঠতে পারছে না। ভোম্বল কান পাততেই বুঝতে পারল ঘরে মা জেঠিমাদের মধ্যে তুমুল
উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
জেঠিমাকে বলতে শুনল, “হ্যাঁ রে,
এটা ফটিক চোরের কাণ্ড নয় তো!”
“কী যে বল দিদি, ফটিক চোরের এত দুর্দশা হল যে ঘটিবাটি
ছেড়ে শেষে হাওয়াই চপ্পল! তাছাড়া দিন দুপুরে চুরি করার মানুষ সে নয়,” মা প্রতিবাদ করল।
ঠাকুমা কাঁপা গলায় বলে উঠল, “এ
কাজ বাজিগরগুলোর না হয়ে যায় না, হাবু বলছিল বটে অনেকগুলো তাঁবু ফেলেছে পশ্চিমের মাঠে। গতবার
দেখলে না নির্মল সর্দারের কত মুরগি চুরি গেল।”
“হতে পারে, কিন্তু বেছে
বেছে বিনির চপ্পল চুরি করেই কি তারা ক্ষান্ত দেবে?” মা
আবার বলে উঠল, “তাছাড়া ফটক বন্ধ আছে, ঢুকবেই বা কীভাবে?”
মায়ের কথায় যুক্তি আছে, ওদের বিরাট
চৌহদ্দি যার মধ্যে পুকুর,
বাগান, গোয়াল, খামার এঁটে
গেছে - একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বিরাট ফটক
আছে। বাড়িটা আবার একটা ছোটো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ঢোকার জন্য
ছোটো কাঠের দরজা আছে,
যেটা দিনের বেলা খোলা থাকলেও রাত্তিরে
হুড়কো লাগানো থাকে। হুঁ! তাহলে কি
চোর ঘরের মধ্যেই আছে? কিন্তু সে কে?
“তাহলে কী ভোমলা, বিনি ভোমলা কোথায়?” মা
এর রাগী গলার আওয়াজ পেল ভোম্বল।
সর্বনাশ, সন্দেহের
তীর শেষ পর্যন্ত খোদ গোয়েন্দার দিকে! এটা সত্যি, গোয়েন্দারা একটা ইট, কাঠ, পাথরকেও
সন্দেহ করতে ছাড়ে না,
ছাই পর্যন্ত উড়িয়ে দেখে, তাই বলে স্বয়ং গোয়েন্দা আসামীর কাঠগড়ায়!
এ অপমানের একমাত্র উত্তর আসল অপরাধীকে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরা।
ঠাকুমা মা-কে বকে উঠল, “না, বৌমা এটা
তোমার ঠিক নয়, সব
ব্যাপারেই তুমি আমার নাড়ুগোপালের দোষ দেখ।”
বোকা বিনিটা আসল বিপদটা না
বুঝে চপ্পলের শোকে এতক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিল, সেও তাড়াতাড়ি
বলে উঠল, “না মা, ভোমলা নয়, আমি চপ্পলগুলো খুলে যখন কলঘরে গেলাম তখন জানলা দিয়ে দেখেছি
ও পুকুরপাড়ে বসে ছিল।”
এতগুলো বিরুদ্ধ-বচন শুনে মা
তখনকার মতো চুপ করে গেল। আর কথাগুলো শুনে ভোম্বলের মনটা সন্দেশের মতো নরম হয়ে গেল।
আহা, বিনিটা
মনে মনে এখনও ভাইকে ভালোবাসে। মিথ্যা দোষারোপ করল না!
বেশ একটা আবেগ আবেগ ভাব আসছে, নাহ বিনির জন্য কিছু একটা করতেই হবে - নামতেই হবে কোমর
বেঁধে - কী যেন একটা গান আছে না - “পথে এবার নামো সাথী”। সাথী
আর কই, বাঘাকে
নিয়েই নেমে পড়বে রহস্যের অন্ধকারে।
জেঠিমা জানতে চাইল, “হ্যাঁরে
বিনি, প্রতিদিন দুপুরবেলাতেই ঘটনাটা ঘটছে, না?”
“হ্যাঁ, যখন আমি
পায়ের মধুটা কলঘরে ধুতে গেছি, ধর এই মিনিট দশ থেকে বারো সময়ের মধ্যেই, দু’বার তো
তাই খেয়াল করে দেখলাম।”
ঠাকুমার ভয়ার্ত গলা শোনা গেল, “অ্যাঁ, ঠিক
দুপুরবেলা ঘটছে! মানুষ এ চুরি করছে না.... তাহলে কী তেনারা....”
ভোম্বল দেখল কথাবার্তা এবার
অলৌকিকের দিকে মোড় নিচ্ছে। এ বিষয়টাতে সে একদম স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। বরং তদন্তের
কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো। বাঘাকে নিয়ে ভোম্বল বাগানের দিকে এগোল, ওদের ঘরের
পিছনদিকে। প্রথমেই রাজ্যের ফুলের গাছ। মরসুমি ফুল ছাড়াও চাঁপা, গোলাপ, গন্ধরাজ, কামিনী, বেল, জুঁই - কী
নেই সেখানে! আর ফলের বাগান তো বলতে হচ্ছে না – পাঁচ-সাত
রকমের আম ছাড়াও জাম, কাঁঠাল, পাতিলেবু, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, আতা। একটা কষটে
মতো পেয়ারা চিবোতে চিবোতে ভোম্বল ভাবতে বসল। বাঘাও
গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে উদাস চোখে গ্রীষ্মের আগুনঝরা আকাশটার দিকে চেয়ে থাকল
ঘুমের প্রতীক্ষায়।
ভোম্বলকে সন্দেহের বৃত্তটা
গুটিয়ে আনতে হবে, তাহলেই
সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে। প্রথমেই দেখতে হবে সন্দেহভাজন কারা। পুলিশ আর
গোয়েন্দারা যেমন প্রথমেই বাড়ির কাজের
লোকজনদের নিয়ে টানাটানি
করে সেভাবে ভোম্বল তুলে নিল দুটি নাম, হাবুদা আর ঠিকে ঝি মানদা।
হাবুদা তো ভাত খেয়েই গ্রামের আটচালায় তামাক খেতে যায়। তাহলে সে বাদ। মানদা - তার
দেখা মেলে সকালে আর বিকেলে,
চুরির সময় এ তল্লাটে থাকে না – সেও বাদ। এবার পরিবারের লোকজন, যার মধ্যে
জেঠু, বাবা, দাদুর এসব
তুচ্ছ কারণে মাথা ঘামানোর সময় নেই। মা, ঠাকুমারা তো রান্নাঘর আর শাসন-টাসন নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে সর্বদা। বাকি রইল বিনি, বাবুন আর
দাদারা। বাবুনটা মায়ের কাছে দুপুরবেলা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোয়। বিনি? কিন্তু তার
শোক-তাপ দেখে তো মনে হচ্ছে না নিত্য নতুন চপ্পলের লোভে পড়ে এটা ঘটাচ্ছে।
হুঁ! যার মাথায়
এক ছটাকও বুদ্ধি নেই সে করবে এরকম পরিকল্পনা! ইউরেকা, একটা সূত্র
তো ভোম্বলের মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল, বিনির
চপ্পলে তো মধু লেগেছিল নিশ্চয়ই, তাহলে কী খোঁড়া
কাকটা!
টিপ প্র্যাকটিসের সময়
ভোম্বলের বাঁটুলের ঘায়েই ওটা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। তাতে ওর সাহস কমেনি বরং
প্রতিহিংসা বেড়েছে। হামেশাই মাছটা, বাটিটা তুলে পালাচ্ছে। ঠাকুমা রোজ
হাঁ হাঁ করে ওটার পিছনে তেড়ে যায়। এই তো গত পরশু ভোম্বল নিধু ময়রার দোকানে জিলিপি
কিনে সবে কামড় বসাতে যাবে,
এসে হাত থেকে ছোঁ মেরে জিলিপি নিয়ে গেল। ভোম্বলের মতো ছেলেও পাঁচ সেকেন্ড বেকুবের মতো দাঁড়িয়েছিল। ওটার বাসা পুকুরঘাটের
ডানদিকে যে ল্যাংড়া আমগাছটা তার উপরের ডালে।
“চল বাঘা
কাকটার বাসাটা দেখি।” ভোম্বলের কথা পড়তে না পড়তেই বাঘা বীরদর্পে
দৌড় দিল গাছটার দিকে। গাছটা আমের ভারে নুয়ে পড়েছে। এখন এত টক যে দেখলেই দাঁত শিরশির করে।
ভোম্বল চটপট উঠে
পড়ল উপরের ডালে।
তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে, দাদু আম-ভর্তি গাছে দস্যুবৃত্তি করতে দেখলে খড়মপেটা করবে।
সরু ডালটায় শরীরটা শুইয়ে দিতেই বাসাটা নজরে চলে এল। গোটা তিনেক চামচ, বাবুনের ছোটোবেলার
ঝুমঝুমি আর ভোম্বলের কালো মার্বেলটা ছাড়া কিচ্ছু নেই। একটু অসম্ভব মনে হলেও
কাকটাকে প্রায় দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা গিয়েছিল। হিসাব না মেলায় বড্ড হতাশ লাগছে আর
জলতেষ্টাও পেয়েছে। ভোম্বল বাড়ির দিকে
ফিরল।
তাহলে থাকল পড়ে বড়দা আর
মেজদা। যদিও ভাবনাটা একটু বেশিই সাহসী হয়ে
যাচ্ছে, খুঁড়ে
দেখতে দোষ কোথায়। গুটি গুটি পায়ে ভোম্বল এগোল দাদাদের ঘরের দিকে।
এখন ভাইবোন সবার মর্নিং স্কুল চলছে গরমের জন্য। তাই বেলা পড়লে এই চারটে নাগাদ
দাদারা টিউশন পড়তে যায়। এই সুযোগে ঘরটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে ফেলতে হবে, যদি কোনও
সূত্র পাওয়া যায়! ছিঁচকাঁদুনে বিনিটাকে ওরা
সুযোগ পেলেই ভূতের ভয় দেখিয়ে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ে। এটাও সেরকম কিছু কি?
দরজাটা ঠেলে ঢুকতে যেতেই, “এই
কী রে কী চাই?”
বড়দার বাজখাঁই গলার আওয়াজে
চমকে পিছিয়ে এল দু’পা। এই মরেছে দাদা ঘরে কী করছে? ওহো
ভোম্বলেরই হিসাবে গণ্ডগোল। সুখেন মাষ্টারকে
তো ভোম্বল কলকাতা যেতে দেখল সকালে। তাই পড়তে যায়নি। সুযোগটা হাত পিছলে বেরিয়ে গেল।
ওদের পেন, খাতা, বই নিয়ে
ভোম্বল এতরকম সৎকাজ করেছে যে তার ও ঘরে ঢোকা মানা। যেমন সেদিন দাদাদের পেনসিলগুলোর
সীস গুঁড়ো করে মুখে-চোখে কালো ডোরাকাটা
দাগ করে সেজেছিল ভোম্বল আর ওর বন্ধুরা। চেহারাগুলো যা খোলতাই হয়েছিল বলার নয়। শুধু
পঞ্চাটার গায়ের রং-টা এমন আবলুশ কাঠের মতো কালো যে একটু চকমকে ভাব ছাড়া দাগগুলোর
কিছু বোঝা যায়নি। তারপর বিলুদের খামারে রঘু-ডাকাত পালাটা অভিনয় করেছিল। হুঁকো
টানতে টানতে মুখুজ্যেদাদু সব দেখেশুনে কত বাহবা দিল। ভোম্বলকে দাদারা পরে পেনসিলের
জন্য চেপে ধরলেও কিচ্ছু খুঁজে পায়নি। পাবে কী করে, পেনসিলের
কেঠো লাশগুলো তো তখন পঞ্চাদের ডোবায় সাঁতার কাটছে। সাম্প্রতিককালেই, বড়দার বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালের জন্য ধরে রাখা বলির
ব্যাঙটা ভোম্বল সিঁদুর দিয়ে সাজিয়ে দাদার ব্যাগে রেখেছিল। ওরকম অদ্ভুত বর্ণ ব্যাঙ
দেখে ক্লাসে এবং স্কুলে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হওয়ার পর প্রত্যেক মাষ্টারমশাই
দাদাকে পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করেন গম্ভীর মুখে। পরে
হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরে আধঘণ্টা কাটিয়ে ফেরার সময় দাদার মুখটা ব্যাঙটার থেকেও বেশি সিঁদুর-বর্ণ ধারণ করেছিল।
তারপর থেকে দাদাদের ঘরে ভোম্বলের
জন্য কারফিউ জারি আছে।
“যাবি এখান
থেকে, নাকি
মারব মাথায় চাঁটি।” আবার দাদার
তাড়া খেয়ে ভোম্বল আর দাঁড়ানোর সাহস করে উঠতে পারল না।
হুঁ! তথ্য
গোপনের চেষ্টা! দেখা যাবে কে শেষ হাসিটা হাসে।
সন্দেহটা ঠিক জায়গায় আঘাতটা করেছে। শুধু সময় আর প্রমাণের অপেক্ষা।
সন্ধেবেলা বাবা বিনির জন্য
স্বচ্ছ কাচের মতো নীল একজোড়া হাওয়াই চপ্পল নিয়ে এল। সেটা পরে বিনি গোটা ঘর মাথায়
করে তুলল। চপ্পল তো নয়,
যেন গুপী গাইন-বাঘা বাইনের জাদুকরী জুতো। গোটা মুখ থেকে আহ্লাদ সর্দি ঝরার মতো
ঝরে ঝরে পড়ছিল, ভোম্বলের
কাছাকাছি এলে তো বন্যা বয়ে যাচ্ছিল, অ্যাঁ ম্যাঁগো। তারপর বিনি আদুরে
গলায় ঘেঁনিয়েই চলল মায়ের কাছে সে নাকি ওগুলো শোবার ঘরেই রাখবে। মা প্রায় নিমরাজি
হয়ে এসেছে দেখে আর ভোম্বল পারল না, ডেকেই উঠল, “এই
বিনি শোন্।”
বিনি ঘাড়ত্যাড়া টিয়াপাখির মতো
কাছে এসে বলল, “কী চাই?”
“কালকের দিনটা শুধু অন্যদিনের মতো সব
কাজ করে চপ্পলটা বাইরে রাখ।”
“কেন?”
“কালকের দিনটা দেখ না কী হয়...”
“বোকা ঠাউরেছিস আমায়, এটাও হারিয়ে
যাক আর কী!”
“পাঁচ টাকার
কুলের আচার দেব, আর
কে নিচ্ছে সে রহস্যটাও ভেদ করে দেব, তাহলে?”
আচারের লোভে নাকি রহস্যের
গন্ধে বিনির চোখটা চকচক করে উঠল। অন্য কোনও শর্ত
ছাড়াই এককথায় রাজিও হয়ে গেল সন্দেহজনক ভাবে। যাক গে ওসব, কাল মুখোশ
খুলে যাবে। বামাল সমেত চোর ধরা পড়বে। পড়তেই হবে!
পরদিন সময় থাকতেই ভোম্বল সিঁড়ির
আড়ালে লুকিয়ে পড়ল, উঠোনটা
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাঘাটা কোথায় কে জানে, কাজের সময় যদি তাকে পাওয়া যায়। বিনি
মধু মেখে আধঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে কলঘরে গেল। হাতে মোটে মিনিট দশ-পনের সময়। কেউ তো
আসছে না! প্রতিটা সেকেন্ড এক এক ঘণ্টা মনে হচ্ছে। বুকের ভিতরে হাতুড়ির ঘা পড়ছে। ঐ
কীসের একটা ক্ষীণ আওয়াজ হল। উঠোনের
দরজা ঠেলে কে যেন ঢুকছে?
ওহ, বাঘা।
কিন্তু সিঁড়িতে কোনও আওয়াজ নেই। দোতলা থেকে পা টিপে টিপে কারও নেমে আসার কোনও
চিহ্নমাত্র নেই এখনও। সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। তাহলে কি সে কিছু আঁচ করে সাবধান হয়ে
গেল! আরে, বাঘা
কিছু যেন একটা মুখে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে
গেল। কী নিয়ে গেল? ঐ তো আবার
ফিরেছে, মুখে
তো কিছু নেই এখন। ভোম্বল একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করল। এ কি, বাঘা বিনির
নতুন হাওয়াই মুখে তুলে নিয়ে আবার দৌড় দিল বাইরে।
আর দেরি না করে ভোম্বল সোজা
পিছু নিল। বাঘা বাগানের দিকে চলেছে, মাঝে মাঝে এদিক ওদিকটা চোরের মতো
দেখে নিচ্ছে। ফুলের বাগান পিছনে রেখে, বুড়ো পেয়ারা
গাছটা ছাড়িয়ে পাতিলেবুর ঝোপটার আড়ালে কোথায় ঢুকে পড়ল। দু-চারটে
কাঁটার খোঁচা খেয়ে, কয়েকটা
লেবুর ডাল সরিয়ে ভোম্বল হতভম্ব। বাঘা সেখানে থেবড়ে বসে তরিবত করে বিনির চপ্পল চেটে
চলেছে। আগের হারানো চপ্পলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। একবার লজ্জা লজ্জা মুখ
করে ভোম্বলকে দেখে আবার চাটায় মন দিল। হে ভগবান, এ কেমন বিপদে পড়ল ভোম্বল। সহযোগীর
এরকম বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাখ্যা সবার কাছে সে কীভাবে
পেশ করবে ভাবতে ভাবতে পিছন ফিরেই সোজা দু’খানা অগ্নিবর্ষী চোখের সামনে ভোম্বল।
সাক্ষাৎ বিনি অবাক হয়ে একবার তাকে আরেকবার বাঘাকে নিরীক্ষণ করছে।
তারপর “ভোমলা, বাঘাকে নিয়ে
তুই এই নাটকটা করছিস!” বলেই তার বিখ্যাত চিৎকারের জন্য হাঁ
করল। উত্তেজনার
কারণেই হবে হয়তো বিনির সেই হাঁ-তে কোনও স্বর ফুটল না। কিন্তু ভোম্বলের কাছে এখন
এটা পরিষ্কার, ঐ
শব্দহীন চিৎকারের সামনে তার হাজার সততার প্রমাণ নস্যাৎ হয়ে যাবে। আর তার ফল যে কী হবে তা ভোম্বলের থেকে বেশি কেউ জানে না। তাই কালক্ষেপ না করে ভোম্বল বিদ্যুদ্বেগে দৌড় দিল। বাঘাও অপেক্ষায়
থাকল না। পলকপাতে ত্রিসীমানায় তাদের আর দেখা গেল না।
একটু পরেই বাড়িতে ভয়ংকর শোরগোলের সৃষ্টি হল। চতুর্দিকে লোক ছুটল আসামিকে ধরে আনার জন্য। বারান্দায় লাঠি হাতে পাহারায় থাকল
মা। যদিও সন্ধে নাগাদ সকলে ফিরল শূন্য হাতে ভোম্বলের
চিহ্নমাত্র খুঁজে না পেয়ে। কোথায় গেল ভোম্বল? দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় তখন বাড়ি তো নয় যেন একেবারে ফুটন্ত তেলের কড়াই। একমাত্র ঠাকুমাই এই
বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে নিজেকে অবিচল রেখেছিল। শুধু সবকিছু
ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষায় তার চিলেকোঠার
ঠাকুরঘরে যাতায়াতটা বেড়েছিল আর গোপালের ভোগের পরিমাণটাও।
অলংকরণ - মৈনাক
দাশ
Golopotaar build up daarun, ebong ashadranon details, shei tulanay ending ta totota romanchakar noy. Kintu overall really GOOD!
ReplyDeleteThank you
Deleteদারুণ!
ReplyDeleteThank you
Delete