গল্পের ম্যাজিক:: রবিনকাকুর বাড়ি - অনসূয়া খাসনবীশ


রবিনকাকুর বাড়ি
অনসূয়া খাসনবী

রবিনকাকু ছিলেন আমাদের সাতপাড়ার এক মানিক। তাঁর মতো ভালো মানুষ দেখা যায় না। পাড়ার কত গরিব বাচ্চা তাঁর বাড়িতে থেকে মানুষ হয়। কত লোকে পাত পাড়ে দিনরাত। রবিনকাকুর রান্নাঘরে সে সবের হিসেব-পত্তর নেই। রবিকাকু রিটায়ার করে একখানা অ্যাস্ট্রোনমিকাল দূরবিন কিনে দিনরাত তাতে চোখ লাগিয়ে বসে থাকেন আর খাতা লেখেন খসখস করে। খাওয়াদাওয়ার সুবিধের জন্য কত গরিব ছেলে আসে বাড়িতে। তাদের পড়ার ব্যবস্থা করে দেন কাকু আর হাতের সামনে পেলেই পাকড়াও করে মহাকাশের রহস্য বোঝাতে বসেন। রবিনকাকুর দরজা হামেশাই খোলা। ছেলেপিলেদের অশিক্ষা কাকু মোটে সইতে পারেনা। এদিকে ভালো মানুষ জেনে রবিনকাকুকে সকলে ঠকায়। সেবার বাজার থেকে ফেরার পথে পদ্মিনী ফিয়াট গাড়ি কিনে আনলেন মাত্র বিশ হাজার টাকায়। সে গাড়ি দুনিয়া কাঁপিয়ে বাড়ির উঠোনে তো বটে, কিন্তু আর কখনও কোন টুঁ শব্দটি করল না। নট-নড়ন, নট-চড়ন হয়ে পড়ে রইল। তাতে পাড়ার বাচ্চারা এসে লুকোচুরি খেলে এখন। আবার, বাজার করতে গিয়েই 'টা মুরগি বাচ্চা গছিয়েছিল গণশা। বলেছিল, ডিম দেবে বড়ো হলে কাকু কাকুও ভাবলেন, ভালো, ছেলেগুলো দুটো ভালো খেতে পাবে। কিনে নিলেন ঠিক দামের চেয়ে বেশি দামে। বড়ো হলে দেখা গেল, তারা কেউ মুরগি নয়, মোরগ।
তারা এখন সারা বাগান ঘুরে বেড়ায়। সন্ধে হলেই লাইন করে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই এক বিচিত্র মুদ্রায়, সোফার উপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে সমবেত স্বরে কঁকঁকঁরকঁ গায়। তারপর কাকুর বানানো কার্ডবোর্ডের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর সারারাত তাদের যখন ইচ্ছা ডেকে ওঠে। কাকুর কাছে আশ্রিত মনু বলেছিল, ‘দিন না কাকু, বেচে দিই। তাছাড়া পোলাও ভালো হয়। আমাদের ফিস্টি আছে জানুয়ারি মাসে। দিন না
মনুর দিদিকে পড়াশুনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন কাকু নিজের মেয়ের মতো। পণ দিতে দেননি। কাকু বলেছিলেন,নিজের বাড়ির লোককে কেউ বেচে মনু? ওরা তো -বাড়িরই লোক হয়ে গেছে পরে মনু, রাজু আর পাপাইকে নিয়ে গিয়ে গণশাকে পিটিয়ে এসেছিল। সে কথা অবশ্য কাকু জানেন না।

কেল্টে ছিল পাড়ার রেজিস্টার্ড ছিঁচকে চোর। পাড়ায় গামছাটা, ঘড়াটা, কুলের আচারের বয়ামটা, হাওয়াই চপ্পলটা চুরি গেলে সকলেই জানকে নিয়েছে লোকের বাড়ির জানালা দিয়ে কুলের বীজ ছোঁড়া, বাড়ির সামনে ময়লার প্যাকেট ফেলার মতো নষ্টামিতে তার জুড়ি মেলা ভার। সকলের বাড়িতে চুরি করে করে, এখন এ পাড়ায় তার আর চুরি করার নতুন জায়গাও নেই। চোরেদেরও কিনা এরিয়া ভাগ করা থাকে। তাই অন্য পাড়ায় গিয়ে চুরির সুবিধাও নেই। এদিকে এমন অবস্থা, গরমে ছাদে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া কেয়া জেঠিমাও, কেল্টে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নামবে জেনে, বলে  উঠেছে, ‘যা রে কেল্টে, বাড়ি যা, আমাদের প্লাস্টিকের মগটাও তো নিয়েছিস। যা, নইলে তোর মাকে বলে দেব
ফোর পাশ করার পর তার মা তাকে মেরেও স্কুল পাঠাতে পারেনি। মায়ের খুব দুঃখ, ছেলেটা একটু পড়লে, গৌতমের দোকানে খাতা লেখার কাজটা পেত। এটা মনে পড়লেই তার মা ইনিয়ে বিনিয়ে সিরিয়াল দেখে শেখা নাকি-কান্না কাঁদতে থাকে। তার জ্বালায় কেল্টের প্রাণ অতিষ্ঠ। তাই মাকে ঘাঁটানোর ভুল সচরাচর করে না সে। এদিকে রাতের ডিউটিও তার প্রায় বন্ধের দিকে।

পাড়ার মধ্যে বাকি ছিল কেবল রবিনকাকুর বাড়ি। একদিন রাতে সেখানেই ঢুকে পড়ল সে পাঁচিল ডিঙিয়ে। দেখল সদর দরজায় হালকা চাপ দিতেই খুলে গেল। অন্ধকার ঘর, একটু এগোতেই কীসের সঙ্গে একটা ধাক্কা লাগতেই কী জানি একটা বাক্স মতো মেঝের উপরে নিজের জায়গা থেকে সরে গেল খানিকটা, সঙ্গে সঙ্গে কী একটা পড়ার আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে কঁ কঁর কঁ করে তারস্বরে একসঙ্গে ডেকে উঠল কতগুলো মোরগ কান প্রায় ঝালাপালা। কেল্টে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে মোরগের ডাক বন্ধ হল। কেল্টে এগুতে যাবে, পায়ের পাতায় কী ব্যথা করে উঠল। অমনি আবার কঁকঁরকঁ ডাক। একটা মোরগ বাক্স থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসে তার পায়ে দিয়েছে ঠুকরে।
উহ বাবাগো!বলে উঠসে অজান্তেই। ঘরের মধ্যে কেউ কে কে করে চীৎকার করে উঠল। কেল্টের চোখ প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম। দরজাটাও হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে যেদিকে পারল দৌড়ল। তাতে সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে পড়ল ছাদে। ছাদের দরজার বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না না থাক, বেশ হালকা আলো আছে। সে দেখল, তাতে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কেল্টে অনেক জায়গায় চুরি করেছে। ভয় তার নেই। তবু কিছুক্ষণ আগে লাফানো পিলেটা তার এখনও লাফিয়ে যাচ্ছে টের পেল। লোকটা তাকে চিনে ফেলে পুলিশে দিলে?
- অ্যাই তুই মনু?
কেল্টে বুঝতে পারল তাকেই বলছে। বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মনু।
কাকু রাত জেগে তারা দেখছিলেন দূরবিনে। শব্দ পেয়ে ভেবেছেন মনু উঠল বুঝি। সময়ে সঙ্গী পেয়ে কাকু ছাড়তে চাইবেন কেন!
- শোন আমার চশমাটা নেই। এদিকে আয়।
কেল্টেও পায়ে পায়ে গেল ছাদে।
- লেখ এখানে আশি ডিগ্রি নর্থ। কাল বলেছিলাম না, একটা নতুন তারার গতি দেখতে পাচ্ছি, ওদিকে। ওই দেখ।
বলেদূরবিন ঘুরিয়ে দিলেন।
কেল্টে দূরবিনের উলটোদিকটা ভয়ে ভয়ে ধরতেই, কাকু বললে,অ্যাই ব্যাটা, এদ্দিন কী শেখালাম তোকে? উলটোদিকটা ধরছিস যে বড়!

দূরবিনে চোখ রাখতেই, কাকু জিজ্ঞেস করলে,কালপুরুষের অবস্থান দেখে নে একবার। আচ্ছা মুখে বল দেখি আগে, ধুত্তেরি মিনমিন করছিস কেন?
কেল্টে ক্লাস ফোর পাশ। তার উপর তার কিচ্ছু মনেও নেই। কালপুরুষের অবস্থান বলতে না পেরে মাথা গোঁজ করে সে দাঁড়িয়ে রইল। কাকু বললেন, ‘ওরে মনু কী হল তোর? কাঁদছিস নাকি? সকালে বকেছি বলে? আচ্ছা দাঁড়া।বলে ফ্লাস্ক থেকে গরম জল গ্লাসে ঢেলে বর্নভিটা গুলে এগিয়ে দিলেন নে খা। এখন তো জাগতে হবে। কাঁদবি না। মনে না থাকলে পড়বি। যতটা পড়বি তার ষাট শতাংশ ভুলবি। তাই বারবার পড়বি। তাহলে মনে থাকবে।
আচ্ছা তাহলে এক পাতা অঙ্কই কর তাহলে তুই। পরীক্ষা না তোর একমাস পর? আমি আধঘন্টা পর দেখব, বলে খাতা ধরিয়ে ছাদের ঘর দেখিয়ে দিলেন কাকু।
কেল্টে সুযোগ বুঝে নিচে নামতে থাকল। কিন্তু খানিক গিয়েই টের পেল সিঁড়ির কাছে কঁক কঁক করছে সেই মূর্তিমান বিপদ। এবার সত্যিকারের মনুর হাতে পড়লে দেখতে হবে না। অন্ধকারে মোরগটা যে কোনদিকে আছে ঠিক তাও বুঝতে পারল না। কেল্টে ছাদের দরজার কাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকল। ওদিকে আধঘন্টা পর কাকু দরজা ঠেলতেই আবার কেল্টেকে দেখতে পেলেন। বললেন, ‘করে ফেলেছিস বুঝি, তা অন্ধকারে কেন বসে আছিস? সিঁড়ির আলোটা জ্বালবি তো! বলে আলো জ্বালতে কাকুও বুঝলেন ভুলটা।

অ্যাই তুই কে? কবে থেকে থাকছিস এখানে? কোত্থেকে এলি? অঙ্ক খাতা কই?
হাঁউমাউ করে কেল্টে কাকুর পায়ে পড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে যা বলল তা হল, একটা অঙ্কও সে পারেনি সে কোন স্কুলে পড়ে না। কাকু যেন তাকে পুলিশে না দেন।
কাকু হাসতে হাসতে বললেন, ‘ধুর পাগল, পড়া না পারলে কেউ পুলিশে দেয়? তুই এখানেই থাক তাহলে। স্কুলে আমি ভর্তি করিয়ে দেব। তবে খেটে খেতে হবে। আমার মোরগগুলোকে দেখবি তুই।
সেই থেকে কেল্টে কাকুর পরম ভক্ত। স্কুলে তো কোনমাস্টারমশাই পড়া না পারলে পিঠে উত্তমমধ্যম না দিয়ে ছাড়েননি। এখানে কাকু তাকে মোরগ দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া মা' খুব খুশি

মনুরা কাকুকে বলেছিল, ‘এ ব্যাটা চোর কাকু। সব ফাঁক করে দেবে।’
কাকু পুরোনো কম্পিউটারের ধূলো ঝেড়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে বলেছিলেন, বাড়িতে বই ছাড়া আর কী আছে? থাক ও। বাল্মিকীও তো দস্যু ছিলেন আগে।’
_____
অলংকরণঃ রুমেলা দাস

3 comments:

  1. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  3. লীলা মজুমদারের যথার্থ উত্তরসূরি

    ReplyDelete