গল্পের ম্যাজিক:: বিলুমামার বিলিতি বালিশ - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


বিলুমামার বিলিতি বালিশ
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

বিলুমামা এসেছে বিলেত থেকে বিলেত মানে লন্ডন থেকে দিদুন তাকে বিলেত বলে আমি, ঘন্টাদা, টুনিদি, বাপ্পাদা, রিনিকিদি আমরা সবাই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন সব মামার দেখা পাই কিন্তু বিলুমামাই কালেভদ্রে আসে রোগা টিঙটিঙে চেহারা বিলুমামার, মাথার চুল খুব ছোটো করে ছাঁটা। বিলুমামা বলে ওটাই নাকি এখন ফ্যাশন দিদুন বলে, “কী রে বিলু, চোরেদের মতো চুল ছেঁটেছিস।”
বিলুমামা ভাবে আমরা সবাই গন্ডমুর্খ, এক্কেবারে আকাট কোন গন্ডগ্রামে পড়ে রয়েছি আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার তা অন্ধকার মানে লোডশেডিং এখানে প্রায়ই হয় রঘুনাথপুরের স্পেশালিটি হল লোডশেডিং আর চড়ুই পাখির সাইজের মশা বিলুমামা বলেছে এরকম মশা আমাজনের জঙ্গলে থাকে আমাজনের জঙ্গলটা দেখার আমার ভারি ইচ্ছে আমি কোনোদিন দীঘা, পুরী যাইনি, আমাজন তো অনেক দূরের ব্যাপার কলকাতা গিয়েছিলাম একবার যখন অসুস্থ  হয়েছিলাম তখন একদিন ভিক্টোরিয়া গিয়েছিলাম বিলুমামার নাকি ইন্ডিয়া আসতে একেবারে ভালো লাগে না এখানে এলেই বিলুমামার নানা রকম ইনফেকশন, সর্দি, পেটব্যথা শুরু হয়ে যায় পেটব্যথা তো আমার প্রায়ই হয় স্কুল থাকলে বা পরীক্ষা থাকলে মিছিমিছি পেট ব্যথা হয় তখন পেঁপের ঝোলভাত খেয়ে থাকতে হয় বিলুমামা মোটেই ভাত খায় না আমাদের বলে, “তোদের কোনও ক্লাস নেই এই ভাত খেয়ে খেয়ে আর ঘুমিয়েই বাঙালিরা গেল।”
সেদিন তো টুনিদিকে বলল, “টুনি একদিনে যা ভাত খায় লন্ডনের মেয়েরা তা এক মাসে খায় না।” তাই শুনে টুনিদি কেঁদেকেটে খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দিল
বিলুমামা শুধু স্যালাড খায় বাঁধাকপির পাতা, লেটুস পাতা আর কী কী সব দিয়ে এমনিতে আমরা আসন পেতে খেতে বসি বিলুমামা এলে ডাইনিং টেবিল বেরোয় কাঁটা চামচ বেরোয় বিলুমামাকে দাদু ডাকে বিল্বধর কিন্তু ফেসবুকে বিলুমামার নাম বিল চ্যাটার্জী
আমাদের টিভি ঠিক করতে আসে খালেদ চাচা সেদিন ঘন্টাদা বলছিল, “খালেদ চাচা তুমি কিন্তু বিদেশে যেও না বিলুমামাকে ওরা বিল বানিয়ে দিল, তোমাকেও খাল বলেই ডাকবে।”
তা বিলুমামা এবার বাড়িতে এল একটা বিলিতি বালিশ নিয়ে বিলুমামার কোম্পানিরই বানানো বিলুমামা বলল, “এই বালিশ কিন্তু সাধারণ বালিশ নয় এই বালিশ ঘুমের সময় ব্রেনকে এনার্জাইজ করে ব্রেনের ক্ষমতা অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে আর অনিদ্রা, অশান্তি ইত্যাদি রোগ নিরাময় করে।”
কিন্তু সেটা আমাদের কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত দিল না রিনিকিদি একবার ঘুমোবে বলে চেয়েছিল, বলল, “একদম হাত দিবি না, তোর মাথায় উকুন আছে।”
রিনিকিদি অপমানে মুখ লাল করে চলে গেল ঘন্টাদা বলল, “দ্যাখ না, ঠিক ওই বালিশটা হাতিয়ে নেব।”
“কী করবে ওটা দিয়ে? আমি জিজ্ঞেস করলাম
“ওটার ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে হবে ওটার ভেতরে কী আছে ওটার ভেতরে কোনও চুম্বক-টুম্বক আছে বলছিল না!”
ঘন্টাদা তো ক্লাস এইটে পড়ে বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানে
বাপ্পাদা সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকে আর বড়োমামা বাড়ি না থাকলেই চুপি চুপি ফেসবুক করে আমার বাবা ঐসব নেশা নেই আমার বই পড়ার নেশা রহস্য, গোয়েন্দা এসব আমি বড়ো হয়ে গোয়েন্দা হবই ঠিক করে রেখেছি ঘন্টাদা বিজ্ঞানী হবে অঙ্কে ৯০ পেয়েছিল আমি ৫০-এর বেশি পাই না তাতে কী? মা বলে বিলুমামাও তো একবার অঙ্কে চল্লিশ আর ভূগোলে ৩৫ পেয়েছিল তাও তো বিলেতে গেল
আমি আবার বিলেতে গিয়ে থাকতে চাই না ওখানে আলুপোস্ত পাওয়া যাবে নাকি ছাই? আমি একবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ডিম্পিকে নিয়ে বেড়াতে যাব সারা ওয়ার্ল্ড ঘুরব এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, অমনি ঘন্টাদা এল বলল, “এই ডাবলু, এই দ্যাখ বালিশটা এনেছি।” কাঁচি দিয়ে বালিশের কোণটা কাটতেই পুচুৎ করে নীল নীল রঙের কেমন জেলি জেলি একটা জিনিস বেরোল
আমি বললাম, “সব্বোনাশ! এবার এটা সেলাই হবে কী করে?
টুনিদির বাক্স থেকে ছুঁচ সুতো এনে ঘন্টাদা নিজেই বসে গেল সেলাই করতে ক্রস স্টিচ অনেকটা কাটাকুটি খেলার মতো
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, “ঘন্টাদা তুমি জিনিয়াস!!
কিন্তু কোথা থেকে বিলুমামা উড়ে এসে ঘন্টাদার কানটা পেঁচিয়ে ধরল বলল, “স্টুপিড, রাস্কেল, ওরাং ওটাং।”
তারপর বিলুমামা বালিশ বগলে নিয়ে গটগট করে ছাতে উঠে গেল বিলুমামা ছাতে ওঠামাত্রই খেয়াল হল আজ মঙ্গলবার না জঙ্গল সাফ করার দিন নয়, দঙ্গল আসার দিন দঙ্গল মানে হনুমানের দঙ্গল প্রতিমাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার বেলা তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে নিয়ম করে তারা আসে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে
ছাতের ওপর পরিত্রাহি চিৎকার শুনে ঘন্টাদা একগাল হেসে বলল, “এসে গেছে।”
আমি বললাম, “ঘন্টাদা যাবে না? বিলুমামার খুব বিপদ।”
ঘন্টাদা বিছানায় মটকা মেরে পড়ে রইল, বলল, “তুই দ্যাখ গে যা আমার কানটা এখনও জ্বালা জ্বালা করছে।” আমি সারা বাড়ি খুঁজে বড়োমামার হনুমান তাড়ানো লাঠিটা কোথাও খুঁজে পেলাম না বড়োমামা আর বড়োমামি গেছে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে বাপ্পাদা গেছে টিউশন টুনিদিকে বলায় টুনিদি বলল, “আমি বাপু ভাত খাওয়া মোটা শরীর নিয়ে নড়তে চড়তে পারব না।”
অগত্যা আমিই ছাতে গিয়ে দেখি প্রায় পনেরো কুড়িটা বড়ো বড়ো হনুমান দাঁত খিঁচিয়ে বিলুমামাকে ঘিরে ধরেছে বিলুমামা ছাতের মধ্যে মাদুর পেতে শুয়েছিল, ওদের দেখে উঠে বসে স্ট্যাচু হয়ে গেছে, নড়তেও পারছে না শুধু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কারণ হনুমানের দলপতিও বিলুমামার কানের গোড়ায় একটি চড় তুলে স্ট্যাচু হয়ে আছে মানে নড়লেই মারবে এরকম অবস্থা দেখি আমার পিছন পিছন রিনিকিদি এসেছে কাপড় তুলতে রিনিকিদিও দাঁড়িয়ে পড়েছে একদম পিনড্রপ সাইলেন্স চারদিকে রিনিকিদি হঠাৎ ঠাকুর ঘর থেকে হনুমান চালিশা নিয়ে এসে বলল, “এটা বিলুমামাকে পড়তে বল সেবার নাকি বাপ্পাদা হনুমান চালিশা পড়ে মুক্তি পেয়েছে।” রিনিকিদি জানে না যে বিলুমামা বাংলা পড়তে বেমালুম ভুলে গেছে তায় আবার সংস্কৃতের বাংলা আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল বড়োমামার সিডি প্লেয়ারে হনুমান চালিশা বাজাতে শুরু করলাম দেখি রিনিকিদি হেসে গড়াগড়ি সব হনুমান চলে গেলেও বিলুমামার বালিশটায় পড়েছে দলপতির নজর আর বিলুমামা সেটা কিছুতেই দেবে না বালিশ অর্ধেক ছিঁড়ে সেই নীল নীল জেলটা বেরিয়ে বিলুমামার সারা গায়ে মুখে লেগে একাকার রিনিকিদি খিলখিল করে বলে উঠল, “এই দ্যাখ বিলুমামাকে একদম নীল রঙ জাম্বুবান লাগছে না? তারই মধ্যে বিলুমামা লম্ফঝম্ফ করে যাচ্ছে
কিন্তু শেষরক্ষা হল না বালিশটা ছিনিয়ে নিয়ে হনুমান এক লাফ মারল পাশের বাড়ির ছাতে, তারপর ভেংচি কেটে, দাঁত দেখিয়ে পালিয়ে গেল বিলুমামা তখন দেখি “অসভ্য-বর্বর-জানোয়ার-বাঁদর” বলে চেঁচাচ্ছে
তারপর একদিন বিলুমামাও লন্ডনে ফিরে গেল আমার ছুটি শেষ হয়ে গিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম পরেরবার মামাবাড়ি গিয়ে শুনলাম যে হনুমানগুলো নাকি আর আসে না ঘন্টাদা বলল ওই বালিশের নীল জেল-এর এফেক্ট আমার মনে হয় ওরা এখন অনেক উন্নত, শান্ত, ভদ্র হয়ে গেছে
“ঠিক বিলুমামার মতো? আমি বললাম
_____
অলংকরণঃ সুমিত রায়

13 comments:

  1. বালিশের খোলে ছিল জেলদার জেল্লা
    হনুমানে কেড়ে তার ফতে হল কেল্লা
    ছিল যে দুরন্ত
    হয়ে গেল শান্ত
    বিলিতি এ বালিশের জুড়ি ভার মেল্লা!

    ReplyDelete
  2. বালিশের খোলে ছিল জেলদার জেল্লা
    হনুমানে কেড়ে তার ফতে হল কেল্লা
    ছিল যে দুরন্ত
    হয়ে গেল শান্ত
    বিলিতি এ বালিশের জুড়ি ভার মেল্লা!

    ReplyDelete
    Replies
    1. :D aare daarun chhora..Thanku thanku

      Delete
  3. দুর্দান্ত হয়েছে। শেষটা জব্বর। বলে কিনা হনুমানরা আর আসেনা। বিলুমামার নীল জেলির প্রভাবে তারা নাকি উন্নত হয়ে গেছে বিলুমামার মত। সেরা।😆😆😆😆😆

    ReplyDelete
    Replies
    1. anek dhanyobad , khub bhalo laaglo tomar matamat jene :)

      Delete
  4. লন্ডনে গিয়ে খালেদ খাল হয়ে যাবে - এটা বিরাট শিক্ষা। হি হি

    ReplyDelete
  5. এখানেও সেই নীল সাদা !

    ReplyDelete
  6. বাঃ বেশ হয়েছে
    আমার ছেলে মেয়ে এটা পড়ে খুব খুশি

    ReplyDelete