লিরিকদার দুর্গাপুজো
অভিষেক সেনগুপ্ত
আমাদের পাড়াটাকে শুধু পাড়া
ভাবলে ভুল হবে। শাঁখারি পুকুর হাউজিং কমপ্লেক্স প্রায় হাজার দু’য়েক পরিবারের
টাউনশিপ। দুটো পেল্লাই পুকুরের ধারে সারি সারি ফ্ল্যাট। ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রাইমারি
ও হাইস্কুল। দুটো খেলার মাঠ। একটা পার্ক। সার্কাস ময়দান। আর একপাশ দিয়ে ঝিরিঝিরি বয়ে
যাওয়া রুগ্ন বাঁকা নদী। একসময় এই নদীতে নাকি পালতোলা নৌকা চলত! বর্ধমান তখন হয়তো
শের আফগানের ডেরা। অথবা প্রতাপচাঁদ, মহাতাবচাঁদের যুগ। সময়ের স্রোতে বাঁকার গা
থেকে নদী শব্দটা ধুয়ে গিয়েছে। এখন অনেকটা বুড়ি গঙ্গার মতো হাল। নালা
বলাই ভালো। তবু এই বাঁকা আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের অহংকার!
আরও একটা জিনিস আমাদের
পাড়ার অ্যাসেট — লিরিকদা। শুধু
হাউজিং বললে ভুল হবে, সারা বর্ধমানেরই। বিরাট কোহলি
যেমন ভারতীয় ক্রিকেটের মুখ, লিরিকদাও তেমনি আমাদের মতো কচিকাঁচাদের
আইকন! সৃষ্টি আর কৃষ্টি মানুষকে ধীরে ধীরে অমর করে তোলে। লিরিকদার শহর জোড়া
খ্যাতির পিছনে ওর মস্তিষ্কপ্রসূত নানা ঘটনা। শীতকালীন ফাংশন, জন্মদিনের পার্টি,
অ্যানুয়াল স্পোর্টস কিংবা পয়লা জানুয়ারির ফিস্টি — লিরিকদার ছোঁয়ায় সুপারহিট। এই
কমপ্লেক্স হল ওর লীলাভূমি। আমাদের দৃঢ়
বিশ্বাস, লিরিকদাকে নিয়ে একদিন বায়োপিক হবেই হবে!
লিরিকদার সমস্ত অভাবনীয়
ঘটনার বেসক্যাম্প আমাদের ক্লাব ‘দিনরাত’। আরামবাগ রোড, কালীবাজার ছাড়িয়ে নিবেদিতা ব্রিজ টপকে ডানহাত নিলেই আমাদের
হাউজিং কমপ্লেক্স। বাজার, পথচলতি মানুষ, সাইকেল, ভ্যান, রিক্সা, টোটোর ভিড়, বাসের
মুহুর্মুহু হর্নের তাণ্ডব এড়িয়ে এক টুকরো মরুদ্যান! সবুজের সমারোহ। মেন গেট ছাড়িয়ে
একটু এগোলে একটি মাঝারি পার্ক। তারই পশ্চিম
কোণে বটগাছের তলায় দিনরাত ক্লাব। তবে ঘর না বলে তাঁবু বলাই উচিত। চারটে বাঁশের
খুঁটির ওপর খড়ের চাল। বাতিল প্লাইউড দিয়ে তৈরি দেওয়াল। নড়বড়ে
এবং বিপজ্জনকও। তবু ক্লাবটা আমাদের প্রাণ।
লিরিকদা ‘দিনরাত’-এর প্রতিষ্ঠা পুরুষ। ওর বার্থডেতেই ক্লাবের জন্মদিন পালন হয়। বাইরে থেকে ‘দিনরাত’-কে দেখে
কোনও পরিত্যক্ত স্টেশনের টিকিট কাউন্টার মনে হতে পারে। ভিতরটা কিন্তু ফাইভস্টার।
কী নেই! হ্যাঙ্গিং টিভি, লাইব্রেরি, দুটো ক্যারামবোর্ড, ফুটবল-ক্রিকেট-হকির
সরঞ্জাম। ওয়াকিটকির মতো পুরোনো আমলের একটা মোবাইল ফোনও। নেহাত প্লাইউডের দেওয়াল, না হলে লিরিকদা এতদিনে ‘দিনরাত’-এ এসিও লাগিয়ে ফেলত!
দিন ও রাত এক করে তিলেতিলে
‘দিনরাত’-কে গড়ে তুলেছে লিরিকদা। এই ক্লাব ওর
প্রতিটা অবিস্মরণীয় ঘটনার রাজসাক্ষী। আর সেইসব ঘটনার স্মারক যত্ন করে রাখা
ক্লাবঘরের শোকেসে। যদি কেউ লিরিকদাকে নিয়ে কখনও গবেষণা করে, কাজে লাগবে ওইসব নিদর্শন!
লিরিকদার আসল নাম ঋত্বিক।
সেটা যে কী করে লিরিক হয়ে গেল — সে এক
ইতিহাস। লিরিকদার বাবা, মানে সুশান্তজেঠু হসরত জয়পুরি বা গুলজারের মতো লিরিসিস্ট ছিলেন না। এমনকি তাঁদের ভক্তও নন। কোনও কালে তিনি পদ্যও লেখেননি। তাঁর ছেলের এমন নাম দিয়েছিল
পাড়ার লোকজন। ছোটো থেকে লিরিকদা রামতোতলা। কথা বলার
সময় জিভ জড়িয়ে যায়। সেটা ম্যানেজ করার জন্য যে কোনও শব্দের শুরু ও শেষে চন্দ্রবিন্দু সহকারে ‘ল’ ও ‘ক’ জুড়ে দেয়। শুনলে মনে হবে ভূত বুঝি কথা বলছে! লিরিকদার ভাষাকে আমরা নাম দিয়েছি
‘লি-কোড’! আমরা ছাড়া আর কেউ পাঠোদ্ধার করতে পারে না। তা ছেলেবেলায় নাম জিজ্ঞাসা
করলে লিরিকদা বলত, ‘লিঁকিঁক’। সেটাই লোকমুখে ঘুরতে ঘুরতে লিরিক হয়ে গিয়েছে। ওই
ছেলে যে জনগণের দেওয়া ছন্দময় নামের
প্রতি সুবিচার করেছে, সন্দেহ নেই!
লিরিকদার প্রতিভার প্রথম
প্রকাশ ১৯৯৬ সালে। আমরা তখন সবে পৃথিবীতে এসেছি বা
আসব-আসব করছি। লিরিকদার বয়স বারো কী তেরো। দেশের মাঠে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ইডেনে উদ্বোধন।
মহম্মদ আজহারউদ্দিনের টিমকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা। লিরিকদা ক্রিকেট পাগল। আজহারের
ফিল্ডিংয়ের আরও বেশি। আমাদের হাউজিংয়ের পিছনে রয়েছে
একটা হাইস্কুল। তার পরেই সাঁওতাল পাড়া। তারা হাউজিংয়ে
সাফাইয়ের কাজ করে। সেখান থেকে প্রায়ই মুরগি চুরি যেতে লাগল। দল বেঁধে হাউজিং
সোসাইটির সেক্রেটারির কাছে ধরনা দিল ওরা। বলল, ‘আমাদের ঘর থিক্যা মুরগি চুরি যাইনছে। তুরা কিছু কর।’
হাউজিংয়ে চুরি হচ্ছে।
ব্যাপারটা চিন্তার। কয়েকদিন পর চোর ধরা পড়ল। আর কেউ নয়, আমাদের লিরিকদা! সোসাইটির
অফিসঘরে থিকথিকে ভিড়ের মাঝে লিরিকদা দাঁড়িয়ে। ছেলের এ হেন কাণ্ডে সুশান্তজেঠুর মুখ
চুন। প্রচন্ড রেগে গেছেন। তিনি জানতে চাইলেন, ‘মুরগি চুরি করলি কেন? তুই কি খেতে
পাস না?’
তোতলা লিরিকদা চন্দ্রবিন্দু
দিয়ে ল আর ক মিলিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘লাঁকি লুঁকি লঁকিঁকি!’ মানে, ‘আমি চুরি করিনি।’
‘তাহলে লোকে তোর নামে
মিথ্যে বলছে?’ চেঁচিয়ে উঠেছিলেন সুশান্তজেঠু।
লিরিকদা ভয় পেয়ে বলেছিল, ‘আমি
ফিল্ডিং প্র্যাক্টিসের জন্য নিয়ে এসেছিলাম মুরগিগুলো।’
উপস্থিত জনতা অবাক। এ কী
ধরনের ফিল্ডিং প্র্যাক্টিস যাতে মুরগি লাগে!
‘মিথ্যে কথা বলবি না,
লিরিক!’ ঘরের ইঁট কাঁপিয়ে
বলেছিলেন সুশান্তজেঠু।
মিনমিন করে লিরিকদা জবাব
দিয়েছিল, ‘টিভিতে আজহারউদ্দিনের বিজ্ঞাপন দেখোনি!’
বিশ্বকাপ প্রোমোশনের জন্য টিভিতে
সে সময় একটা পানীয় সংস্থার বিজ্ঞাপন খুব
দেখানো চলত — আজহার,
জাডেজা, মোঙ্গিয়া সহ ইন্ডিয়া টিমের কয়েকজন মুরগি নিয়ে ফিল্ডিং প্র্যাক্টিস করছে। রিফ্লেক্স আর স্কিল বাড়ানোর জন্য। লিরিকদাও ওইভাবে প্র্যাক্টিস শুরু করে। কিন্তু মুরগি কেনার টাকা নেই। বললেও
সুশান্তজেঠু দেবেন না। উলটে নানা প্রশ্ন করবেন। তাই ওর নজর গেছিল সাঁওতাল পাড়ার
দিকে।
লিরিকদার ব্যাখ্যা শুনে সোসাইটির
অফিসঘরের জটলা নিমেষে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এটাকে আর যাই হোক চুরি বলা যায় না। বটগাছের
কোটর থেকে চারটে মুরগি উদ্ধার হল। সাঁওতালদের মোড়ল লিরিকদাকে বলেছিল, ‘বাবু, তুর
ইচ্ছ্যা হলে মুকে কোইনদিস। মুরগি দিয়্যানযিব তুরে।’
সেই শুরু। একের পর এক ঘটনা
ঘটতে থাকল লিরিকদাকে কেন্দ্র করে। ভারতে বারো বছর আগে শুরু হয়েছে আইপিএল। আমাদের হাউজিং
তার অনেক আগেই রঙিন পোশাক, নৈশালোকে ক্রিকেট ডিজে ও চিয়ারলিডার সহ দেখে ফেলেছে। লিরিকদার সৌজন্যে। পাড়ার মেয়েদের নিয়ে ফ্যাশন
শো। বয়স্কদের মিনি ম্যারাথন। এমন অনেক অভিনব কাণ্ড ঘটিয়েছে ও। মুশকিল হল, লিরিকদার
সব পরিকল্পনার শেষটা বড্ড নাটুকে। মানে দারুণ শুরু করে কেঁচে যাওয়ার গল্প!
বর্ধমানের মতো ছোটো শহরে লিরিকদাকে সার্বিক পরিচিতি এনে দিল দুর্গাপুজোর ভাবনা। ওর বয়স পঁচিশ। আমরাও সবে নাম লেখাতে শুরু করেছি লিরিকদার টিমে। হাউজিংয়ের
আরও দুটো বড়ো ক্লাব আছে। তারাও বড়ো করে দুর্গাপুজো করে। লিরিকদার মাথায় ভূত চাপল, দুর্গাপুজো করবে।
চাইলেই তো হল না — প্রতিমা, প্যান্ডেল, লাইটিংয়ের
খরচ যোগাবে কে? সবচেয়ে বড়ো কথা,
আমাদের তো কোনও ক্লাবই নেই। পুজোটা হবে কার ব্যানারে? প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জন্ম
নিল ‘দিনরাত’। তখন ক্লাবঘরের দেওয়ালের জন্য প্লাইউডও জোটেনি। বাড়ি থেকে বিছানার
বাতিল চাদর এনে তাঁবুর মতো ঘিরে দিয়েছিল লিরিকদা।
আমাদের ‘দিনরাত’-এ মেরেকেটে পঁচিশজনের মতো মেম্বার। সব ক্লাবেরই কোর কমিটি বা পরিচালন সমিতি
থাকে। আমাদেরও রয়েছে। বাপ্তু, বাপন, সুবায়ু, সামু, কচা, অরি আর আমি — এই সপ্তরথী মিলে ‘দিনরাত’-এর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। মাথার ওপর লিরিকদা। ওখানে বসেই
দুর্গাপুজোর পরিকল্পনা হল। ক্লাবের অর্থ নেই। কিন্তু অভিনব ভাবনা
থাকলে, দুর্গাপুজো হিট।
আমার নাম রিন। আমার ডাকনাম
রিন কেন, তার পিছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। নামটায় শুরুতে কাপড়কাচার সাবানের গন্ধ
ছিল না। নামটা ছিল রিন্টু। চারবছর বয়সে সিএমএস স্কুলে কেজি-ওয়ানের অ্যাডমিশন
টেস্টে সেকেন্ড হয়েছিলাম। আমার বাবা বলেছিল, ‘ভুলটা তোর নয়, আমার। তোর ডাকনামটা
ঠিক দিইনি।’
আমি তখন অত কিছু বুঝিনি। নামের আবার দোষ কি, কে জানে! বাবা বলল, ‘রিন্টুকে ভাঙলে হয়, রিন টু! এমন নাম হলে, চিরকালই সেকেন্ড হবি!
আমার ছেলে দু’নম্বর হতেই পারে না!’ ব্যস, রাতারাতি আমার রিন্টু থেকে ‘টু’-টা ছেঁটে
দিল বাবা। হয়ে গেলাম রিন! তবে এই নাম-বিপ্লবের প্রভাব আমার রেজাল্টে কখনওই পড়েনি!
ফার্স্ট তো দূরের ব্যাপার, সেকেন্ডও আর জীবনে হইনি। মজার ব্যাপার হল, লিরিকদা ল আর
ক-এর বর্ণ ওর কথায় ব্যবহার করে। সেটা ই আর ন। আর সেটা শুধু আমাকে ডাকার সময়। ওর
কাছে আমি রিন নই, ‘ইন’!
লিরিকদা বলল, ‘রিন, আমি
জানি প্রতিমা বানানোর অনেক খরচ। আমরা জীবন্ত প্রতিমা দিয়ে পুজো করব!’
আমরা অবাক। এ আবার হয়
নাকি! কচা বলল, ‘লিরিকদা ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না?’
লিরিকদা গম্ভীর মুখে চন্দ্রবিন্দু
সহকারে ল ও ক মিলিয়ে বলল, ‘লুঁকি লিঁসেঁক?’ অর্থাৎ, ঝুঁকি কীসের?
সামু বাজখাঁই গলায় বলল,
‘ঝুঁকি নয়তো কী? জীবন্ত ঠাকুর দিয়ে পুজো হতে দেখেছ কখনও?’
লিরিকদার পালটা যুক্তি, ‘ঝুলন পূর্ণিমার মেলা দেখিসনি তোরা?’
বর্ধমানে ঝুলন পূর্ণিমা বড়ো উৎসব। পাড়ায় পাড়ায় ঝুলনে সাজে অনেক বাচ্চা। আমরাও কখনও না কখনও সেজেছি। বড়ো ঝুলনমেলা হয় সর্বমঙ্গলা পাড়ায়। সাতদিন ধরে চলে।
রাধাকৃষ্ণ, রামসীতা, শিবপার্বতী থেকে শুরু করে অনেক কিছু সাজে। শুরু হয় সন্ধে থেকে। রাত দশটার মধ্যে শেষ। ঘণ্টা চারেক সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে
হয়। দুর্গাপুজো
চারদিনের। আগে-পিছে আরও দুটো করে দিন ধরলে আরও চার। স্নান, ঘুম,
খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব।
লিরিকদা যদি কিছু ভেবে
নেয়, সেখান থেকে সরানো অসম্ভব। এক্ষেত্রেও তাই হল। ও বলল, ‘না-না, ঝুলনের মতোই হবে
ব্যাপারটা। আমরা সময় বেঁধে দেব, জীবন্ত ঠাকুর দেখতে হলে সন্ধে ছ’টা থেকে রাত দশটার
মধ্যে আসতে হবে দর্শনার্থীদের। বাকি সময় দুর্গার ছোট্ট প্রতিমার পুজো হবে।’
অরি, সুবায়ু আর বাপ্তু প্রবল
উৎসাহে বলে উঠল, ‘যা বলছো, সেটা যদি করা যায়, দারুণ হবে!’
এরপর আমার আর ‘না’ বলার
কোনও জায়গা নেই। লিরিকদা আমার দিকে তাকাতেই সব ক’টা দাঁত বের করে দিলাম।
ঠিক একমাস পর পুজো। আমরা
নাওয়াখাওয়া ভুলে গেলাম। প্যান্ডেল হবে খড় দিয়ে। খরচ বেশি নয়। লাইটিংয়েও বেশি নজর
দেওয়া হল না। প্যান্ডেলকে ফোকাস করে চার কোণ থেকে চারটে হ্যালোজেন জ্বলবে। ভিতরে আরও চারটে। আসল হল, কারা সেজেগুজে দাঁড়াবে প্যান্ডেলে। মৌদিকে ধরল
লিরিকদা। মৌদিকে সত্যি দুগ্গা ঠাকুরের মতো দেখতে। পান পাতার মতো মুখ। কাজল কালো বড়ো বড়ো চোখ। টিকালো নাক। হাসলে গালে টোল
পড়ে। কোমর পর্যন্ত চুল। মৌদিও ছেলেবেলা থেকে চেনে লিরিকদাকে। জানে, কতটা নাছোড়বান্দা
ও। তাই রাজিও হয়ে গেল। আমরা
সবাই মিটিংয়ে বসলাম ‘দিনরাত’-এ।
‘অসম্ভব গোপনীয়তা রাখতে
হবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। কেউ জানতে পারলে প্ল্যান হাইজ্যাক হয়ে যাবে। ভাবনা-চোরেরা
ঘুরে বেড়াচ্ছে!’ ফিসফিস করে বলল লিরিকদা।
দুর্গা তো পাওয়া গেল। বাকি
কে কী সাজবে? লিরিকদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই গণেশ!’
আমি গোলগাল। ছোটো একটা ভুঁড়িও আছে। আমার ইচ্ছে ছিল কার্তিক সাজার। কিন্তু লিরিকদার মুখের
ওপর না বলা যায় না। অরিকে সুন্দর দেখতে। ও কার্তিক। মেয়েলি চেহারার জন্য কচা
লক্ষ্মী। মৌদির বোন সুমি সরস্বতী। সবই হল, অসুর পাওয়া যাচ্ছে না।
মৌদি বলল, ‘লিরিকদা তুমিই
অসুর সাজো না?’
লিরিকদাকে মোটেও অসুরের
মতো দেখতে নয়। চেহারাটা তাগড়াই। দেখতে ছিমছাম। ফরসা গায়ের রং। একমাথা চুল।
মুখে ফিনফিনে কার্তিকমার্কা একটা গোঁফ। লিরিকদা রাজি হল না। প্রস্তাব শুনেই ‘লাঁ, লাঁ’ মানে না-না বলে উড়িয়ে দিল।
ওর যুক্তি হল, ‘আরে, আমাকে
তো পুরো ব্যাপারটার দিকে নজর রাখতে হবে। কোনও সমস্যা হলে ম্যানেজ করবে কে?’
মৌদি উড়িয়ে দিল লিরিকদার
কথা। ‘কোনও সমস্যাই হবে না। ঘণ্টাচারেকের তো ব্যাপার। তাছাড়া বাপ্তু, বাপন,
সুবায়ু, সামুরা তো রইলই। ওরা সামলে দেবে।’ লিরিকদা
অগত্যা রাজি হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।
ষষ্ঠীর সকালে সারা বর্ধমান ঘুরে মাইকে প্রচার করা হল — দিনরাত ক্লাব অভিনব জীবন্ত দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে। সপ্তমী থেকে দর্শন মিলবে ঠাকুরের। সন্ধে
ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। রীতিমতো
হইহই কাণ্ড। কেউ এমনটা
শোনেনি। ফলে ষষ্ঠী থেকেই লোকজন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল দিনরাতের পুজো
প্যান্ডেলে। বল গড়ানোর আগেই সুপারহিট লিরিকদার ভাবনা।
সপ্তমীর বিকেল থেকে ভিড় উপচে পড়তে
লাগল। নাটক-থিয়েটারে যেমন শোয়ের আগে পর্দা ফেলা থাকে, আমাদের প্যান্ডেলের সামনে তাই
রয়েছে। ভিতরে সোজগোজ চলছে। একটা নাট্য কোম্পানিকে ধরে ড্রেস ও নানা অনুষঙ্গ জোগাড় করেছে লিরিকদা। কার্তিক হিসেবে দিব্যি লাগছে অরিকে। শুঁড়টা লাগাতে আমার প্রচুর
সময় লাগল। শোলার প্যাঁচাসমেত
কচাকে সত্যিই লক্ষ্মী মনে হচ্ছে। আমি তো
ভেবেই রেখেছি, ওকে এবার থেকে কচি বলে ডাকব!
মৌদির পিঠে বেঁধে দেওয়া
হয়েছে আটটা হাত। দু’হাতে ত্রিশূল ধরে। চমৎকার
মানিয়েছে মৌদিকে। আর মেকআপের পর ভয়ঙ্কর লাগছে লিরিকদাকে। আফ্রিকানদের
মতো মিশমিশে কালো করে দেওয়া হয়েছে ওর ফরসা গায়ের রং। তার ওপর জবজবে করে মেখেছে
নারকেল তেল। যাতে চকচকে দেখায়। ঠোঁটে লাল
লিপস্টিক, চোখের তলায়
আলতা। সত্যিই অসুর মনে হচ্ছে!
যথাসময়ে পর্দা উঠল। জীবন্ত
দুর্গাঠাকুর দেখে দর্শনার্থীরা খুশি। অনেকে কপালে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। বাক্সে, থালায় প্রণামী পড়ছে
ঠনঠন শব্দে। এইমাত্র কচার ঠাকুমা ঘুরে
গেলেন। তবে কচাকে চিনতে পারেননি। সামু, সুবায়ুদের দেখে বলেছেন, ‘তোমাদের ঠাকুর খুব
ভালো হয়েছে। প্রতিমা একেবারে জীবন্ত!’ ভক্তি ভরে প্রণামের পর জিজ্ঞেস করেছেন,
‘কচাকে দেখছি না! বাকিরা গেল কোথায়?’ আমরা নিশ্চল হয়ে সব লক্ষ করছি। লক্ষ্মীর মুখে
হাসিটা এসেই মিলিয়ে গেল।
লিরিকদার ভাবনা সত্যিই জমজমাট।
সপ্তমীতেই বাজিমাত। খবর পেলাম, আমাদের হাউজিংয়ের দুটো ক্লাবের পুজো তো বটেই,
আশপাশের অনেক প্যান্ডেল মাছি তাড়াচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ হাল নবারুণ সঙ্ঘের। বিশাল
বাজেটের পুজো ওদের। হাউজিংয়ের ঠিক বাইরে ওদের ক্লাব।
কিন্তু আমাদের জীবন্ত ঠাকুরের চাপে নবারুণ সঙ্ঘও ফাঁকা। অসুর সাজে
লিরিকদা পুরো ব্যাপারটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। আমাদেরও কি কম গর্ব হচ্ছে?
সেপ্টেম্বরের শেষে পুজো। গরমটা
এখনও কাটেনি। ছোট্ট প্যান্ডেলে ভিড়ের ঠেলায় আরও গরম লাগছে। ভেতরের চারটে হ্যালোজেন উত্তপ্ত করে তুলেছে জায়গাটা। দুর্ঘটনাটা ঘটল তখনই।
প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল সরস্বতী। মানে সুমি। আমাকে চোখের ইশারায় ও কিছু একটা দেখাল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, এতক্ষণ
যে দর্শনার্থীরা আকুল দৃষ্টি নিয়ে দেখছিল জীবন্ত ঠাকুর, তারা মুখ টিপে হাসছে। ভালো
করে তাকিয়ে দেখি, গন্ডগোলটা লিরিকদাকে নিয়ে। ওর মিশকালো রংয়ে সাদা-সাদা ছোপ। তেল
আর কালো রং গলেগলে পড়ছে গরমে। পেল্লাই গোঁফটারও একদিক ঝুলে গিয়েছে। অসুরের বদলে ক্রমশ বেরিয়ে পড়ছে আমাদের চেনা লিরিকদা। তাই
নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয়েছে।
‘দিনরাত’-এর
জীবন্ত ঠাকুরের জন্য যেসব পুজো কমিটিগুলো হা-হুতাশ
করছিল, খবর পেয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। নবারুণ সঙ্ঘের একদল ছেলে দেখতে পেলাম ভিড়ে। পেনাল্টি
বক্সে গোল দেওয়ার এমন সোনার সুযোগ পেলে কেউ হারায়? কার্তিক-লক্ষ্মী এমনকি দুর্গার
মুখটাও শুকিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে হট্টগোল শুরু হল। আমরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি। মৌদির
বর্শার ফলা টেনশনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এবার সত্যি সত্যিই না অসুররূপী লিরিকদাকে বধ
করে বসে! বাপ্তু, বাপন, সুবায়ু, সামুরা বিপদ বুঝে কেটে পড়েছে নাকি?
এমন সময় কে একজন যেন
‘ব্রেক-ব্রেক’ বলে চেঁচাতে লাগল। তাকিয়ে দেখলাম ইন্দ্রদা। পার্কের উলটোপারে ওর সাইকেল স্ট্যান্ড। আমাদের
সবকিছুতে প্রশ্রয় দেয়। লিরিকদার কাছের বন্ধু।
চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এসেছে। তারপর
লিরিকদাকে দেখে সব বুঝে গেছে।
কিছু দর্শনার্থী খোরাক করে
বলল, ‘ঠাকুরের আবার ব্রেক কীসের?’
রেফারির ফাউল দেওয়ার মতো
হাতটা মাথার ওপর তুলে ইন্দ্রদা বলল, ‘জীবন্ত ঠাকুর, তাই ব্রেক। সবাই মণ্ডপ ছেড়ে
বাইরে যান।’ প্যান্ডেল খালি করে পর্দা নামিয়ে দেওয়া হল।
বাইরের চিৎকারটা বাড়ছে
ক্রমশ। ইন্দ্রদা তার মধ্যেই বলল, ‘লিরিক,
আবার মেকআপ করে নে।’
লিরিকদা বলল, ‘পল্টু তো
ছিল। কিন্তু ওকে অনেকক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।’
‘পল্টু! মানে বীরহাটা
বাজারের শ্রীময়ী ডেকরেটার্সের পল্টু?’ আঁতকে উঠল যে ইন্দ্রদা।
লিরিকদা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ,
ওই তো!’
‘তোর কি মাথা খারাপ? ও তো
নবারুণ সঙ্ঘের ট্রেজারার। এখন বুঝতে পারছি ও-ই পুরো ব্যাপারটা ভন্ডুল করেছে। ইচ্ছে
করে রং আর তেল মিশিয়েছে, যাতে একটু গরমেই গলতে শুরু করে।’
এমন সময় প্যান্ডেলের ভেতরের
আলোটা ঝপ করে নিভে গেল। লোডশেডিং নাকি?
এমন সময় সামুর মৃদু গলা
পেলাম। প্যান্ডেলের পিছনের দিককার ত্রিপলটা তুলে ফিসফিস করে ও বলল, ‘লিরিকদা
পালাও। জনতা ঠাকুর না দেখতে পেয়ে ক্ষেপে যাচ্ছে।’
লিরিকদা ওই অন্ধকারে ল আর
ক মিলিয়ে কী বলল, শোনার মতো অবস্থা নেই আমাদের। পর্দা তুলে প্যান্ডেলে ঢুকে পড়েছে ক্ষিপ্ত
জনতা। কে যেন বলল, ‘ওই দ্যাখ, অসুর পালাচ্ছে!’
আলো-আঁধারিতে পুকুরের পাড়
দিয়ে তখন প্রাণপণে দৌড়তে
শুরু করেছি আমরা ছ’জন। দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক। আর পিছন পিছন
অসুর। ‘ধর-ধর’ চিৎকারটা তবুও ক্রমশ কাছে, আরও কাছে চলে আসছে!
_____
অলংকরণ - পার্থ
মুখার্জি
excellent! erom aro golpo chai!
ReplyDeleteThank you Sneha...
Deleteবাঃ
ReplyDeleteThank you
Deleteদারুন গল্প।
ReplyDeleteThank you Nil..
Deleteঅসুরের পলায়ন
ReplyDeleteপালিয়ে বাঁচল বলতে পারেন
Deleteমজারু!
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদারুন লিখেছিস
ReplyDeleteরুমেলা, তুই তো আমার বন্ধু। তাই আমার খারাপগুলোও তোর ভালো লাগে। এভাবেই থাকিস
DeleteOnek din por erokom ekta mojar golpo porlam... khub valo laglo😂😂
ReplyDeleteধন্যবাদ। আপনাদের এই কথাগুলোই সাহস বাড়ায় আমার মতো অ-লেখকের
Delete