আংটি রহস্য
শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জী
শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জী
প্রতিবারই বাবাদের অফিস স্টাফদের
নিয়ে একটা শীতকালীন পিকনিক হয়। তা এবারও হচ্ছে, এবং সেটা আমাদের জনাইয়ের বাগানবাড়িতে।
এই বাড়িটা দাদু কবে কী মনে করে কিনে রেখেছিলেন কে জানে? বাঁ দিকে জনাইয়ের রাজবাড়ি,
ডানে মজা সরস্বতী নদী, পিছনে বিশাল সর্ষে ক্ষেত
সব মিলিয়ে একদম পিকনিকের পক্ষে আদর্শ জায়গা। পাশে একটা টলটলে পুকুরও আছে। বাড়িটা প্রথম
প্রথম ফাঁকা ফাঁকাই পড়ে থাকত, তবে বেশ কিছু বছর ধরে বাবা শীতকালে বাড়িটা পিকনিক পার্টিদের
জন্য ভাড়া দিচ্ছেন।
হুজুগে বাঙালিরা শীতকাল পড়তেই
সবাই ঘর ছেড়ে বেরোবার জন্য হাঁকুপাকু করে। আমরা ছুটিছাটা পেলে মাঝে মাঝে এই বাড়িতে
এসে কদ্দিন থেকেও যাই। তবে বাড়িটা দেখাশুনো কিন্তু করে দাশুকাকা আর মানুপিসি। বাড়ির
সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে শাল সেগুন গাছ লাগিয়েছিলেন দাদু। তারা আজ মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুকুরপাড়ের সামনের জায়গাটাতে দাশুকাকু আর মানুপিসির মাটির বাড়ি। যদিও মানুপিসি দাশুকাকুর
বউ তবু ছোটোবেলা থেকে মানুকাকিমা না বলে পিসি বলেই ডাকি আমরা,
মানে আমি বিল্টু আর আমার ভাই রন্টু। দাশুকাকুর কোনও ছেলেপিলে নেই, এই বাগান বাড়িই
সব। বাবা দাশুকাকুর হাতে সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। দাশুকাকুও পুকুরে মাছ চাষ করে আর
শীতের পিকনিক পার্টি সামলিয়ে ভালোই থাকে। তা আজ সকালের সব দায়িত্ব বাবা দাশুকাকুর ঘাড়েই
ছেড়েছে। কাল রাত্তিরেই গুপিকাকু আমাদের বাড়ি চলে এসেছেন, উনিই পিকনিকের মেইন উদ্যোক্তা।
খুব মজার মানুষ গুপিকাকু। সবাইকে
হাসাতে আর নিজে হাসতে ওনার জুড়ি মেলা ভার। সকালবেলা আমরা চারজনে শালবনে গার্ডেনচেয়ার
আর ছাতা লাগিয়ে ফেলেছি। রন্টু সকাল সকাল ডিভিডি-তে জোরসে গান লাগিয়েছে। ওর বক্তব্য
এই গানের আওয়াজ আগত পিকনিক যাত্রীদের স্পট চেনাতে হেল্প করবে। আজ আবার একটু স্পেশাল
ব্যাপারও আছে; এই প্রথমবার গুপিকাকুর অনেক অনুরোধে কোম্পানীর এমডি সস্ত্রীক পিকনিকে
যোগদান করতে রাজি হয়েছেন। উনি হাইডায়াবেটিক রুগি। তাই পিকনিকে যান-টান না বা
বাইরে খান না। কিন্তু গুপিকাকু এই বছর রিটায়ার করছেন, তাই তাঁর বিশেষ অনুরোধেই আসছেন।
যদিও আজ ওনার মেনুটা আলাদা হচ্ছে। আটটা বাজতেই গুপিকাকু, আমি আর দাশুকাকু মিলে একগাদা
তরিতরকারি, মুরগি, খাসির মাংস আর জনাইয়ের স্পেশাল মনোহরা, সব কিনে কেটে ফেলেছি।
মানুপিসি আর আরেকটা কাজের বউ দুজনে মিলে ময়দা মাখছে আর তরকারি কাটছে। রাঁধুনিও কোমরে গামছা বেঁধে
রেডি জলখাবার বানাতে। তা রন্টুর গানের আওয়াজ আর বাবার দেওয়া ডিরেকশন ফলো করে প্রায়
একে একে সব্বাই হাজির হয়েও গেছে। খুদেগুলোর হই-হট্টগোলে আর মা-কাকিমাদের
হাহাহিহি-তে একমুহূর্তেই পিকনিক জমজমাট। কিছুক্ষণ বাদে টেবিলে
টেবিলে গরম গরম লুচি, আলুরদম আর জনাইয়ের মনোহরাও হাজির। জলখাবার খাওয়া সবে শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই এমডিকাকু
সস্ত্রীক হাজিরা দিলেন। বেশ দামি গাড়ি চড়ে, পরনে দামি স্যুট। গিন্নিও কম
যান না। গয়নার দোকানের শো কেস হয়ে উনিও নিজেকে দামি শাড়িতে
মুড়ে এনেছেন। আমাদের বাড়ি, তাই অতিথি আপ্যায়নের ভার আমাদের উপরেই পড়েছে। মা, আমি, বাবা
সবাই দৌড়ে গেলাম। পথে আসতে অসুবিধা হয়েছে কিনা? কখন বেরিয়েছিলেন? এই
সব আর কী? রন্টু বাচ্চা ছেলে, তার ওপর মহাবিচ্ছু। টাকমাথার
মোটা এমডিকে দেখে দুম করে বলে বসল, “বাব্বা! কী মোটকা গো তোমাদের এমডিস্যার! এই জন্যই কাল
গুপিকাকু বলছিল আমাদের এমডিস্যার হেভিওয়েট পার্সন। হি হি এখন বুঝতে পারছি সেটা।”
“এইইইই! চুপ কর তুই!” জোর ধমকে বাবা
ওকে চুপ করাল। “স্যার কিছু মনে করবেন না, আমার ছেলেটা মহাপাজি। কোথায়
কী বলতে হয় সেটা জানে না। তুমি যাও এখন এখান থেকে! আসুন স্যার, আসুন ম্যাডাম আসুন,
এই আমার ছোট্ট বাগানবাড়ি।”
এমডি প্রথম অভ্যর্থনাতেই নিজের
প্রতি এই বিশেষণ প্রয়োগ হবে সে আশা বোধ হয় করেননি, তাই মুখখানা অবাক হয়ে একখানা বড়ো হাঁ হয়ে গেছিল।
সামনে সর্ষেক্ষেতের একটা মেরী পোকা ফস করে মুখে ঢুকে যেতে মুখ থেকে একদলা থুতু ছিটিয়ে
মুখের হাঁ বন্ধ করলেন। এমডিগিন্নি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “কী ত্যাঁদড় ছেলে রে বাবা! কী
ট্যাঁকোস ট্যাঁকোস কথা এইটুকু ছেলের মুখে।” জানি কথাটা মা’র শুনতে খারাপ
লাগল, তবু মা একহাত বাড়িয়ে ওনার হাত ধরে বলল, “ছাড়ুন না
দিদি, আসুন আমার সঙ্গে।”
হাত ধরে টেবিলে বসিয়ে দু’থালা লুচি
তরকারি মা নিজেই এগিয়ে দিল দুজনের হাতে। এমডিকাকু লুচির থালা ধরতেই চেঁচিয়ে উঠলেন ওনার
গিন্নি, “কী গো! তুমি যে ভারি লুচির থালা টানছ, তোমার না সুগার
হাই! তুমি এগুলো এখন খাবে নাকি?”
গুপিকাকু স্যারের কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে
কিছুটা সামাল দেওয়ার জন্য বললেন, “তা ম্যাডাম, আজ তো পিকনিক, আজ না হয় স্যারের
জন্য নিয়মগুলো কমই হল। বেশি নয়, এই দুটো অন্তত যদি খেতে দেন তবে...।” কথা শেষ করতে
দিলেন না উনি, “না না, একটাও নয়। কেন, ওনার যে আলাদা রান্না করার কথা
ছিল, ওকে সেইগুলোই দিন।”
এমন দাপুটে এমডি, বাড়ির গিন্নির কাছে ধমক
খেয়ে কেমন লক্ষ্মীমুখ করে মুড়ি শসা চিবোন, এটা দেখাও পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের কিছু কম নয়।
যাই হোক, এরপর প্রতিপদে গিন্নির ধমকে তিনি পকোড়া, মাছভাজা এইসব
খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন, তা দেখে সত্যি সবারই খুব খারাপ লাগছিল। এরমধ্যেই মিঠি মিঠি
সূর্যের আলো শাল সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে উঠোনে সবার গায়ে শীতের নরম আদর বুলিয়ে দিচ্ছে।
মা-কাকিমারা সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। বাবা আর গুপিকাকু
এমডিসাহেব-সহ বাকিদের নিয়ে পুকুরের পাড়ে গিয়ে জেলেদের মাছ ধরা
দেখছেন, আজ আমাদের পুকুরের মাছও মেনুতে আছে কিনা। বাতাসে ম ম করে ভাসছে পাঁঠার
মাংস কষার গন্ধ। রন্টু দেখি রান্নার আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী মতলব কে জানে? আমিও পা বাড়ালাম
ওই দিকেই।
“এই রন্টু, এখানে কী করছিস
তুই?”
“যাব্বাবা! কী করব! এমনি
ঘুরছি,” রন্টু রেগে বলে, “তোদের না সবেতেই বাড়াবাড়ি।” রেগে গিয়ে
দুমদুম করে পা ঠুকে রন্টু বাড়ির দিকে চলে গেল। বেলা বাড়ছে, রাঁধুনির রান্না শেষ। এখনও খেতে দেরি আছে দেখে আমাদের পিকনিকে প্রতিবার যেমন হয় এবারও তেমনি ছোটোখাটো গেম শো খেলা শুরু হল।
বাড়ির পিছনের মাঠে দুটো গাছে আড়াআড়ি করে একটা বাস্কেট বসানো আছে। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব
থেকে বল এক হাতে ছুঁড়ে বাস্কেটে ফেলতে হবে। তিনটে করে চান্স পাবে সব্বাই। বেশ মজার
খেলায় সবাই হইহই করে মেতে উঠলাম। খেলা প্রায় মাঝামাঝি পর্যায়ে এসেছে, এমন সময় উত্তেজিত হয়ে
এমডিকাকুকে মাঠে আসতে দেখে আমরা অবাক হলাম। এতক্ষণ যে উনি মাঠে ছিলেন না সেটা বোধ হয়
কেউ খেয়াল করেনি। কী ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতে
জানা গেল, উনি ওনার ডান হাতের অনামিকাতে একটা দামি হিরের আংটি পরতেন। কিছুক্ষণ আগেই
বাথরুম থেকে বেরিয়ে খেয়াল করেন, সেটা তাঁর হাতে নেই। পুরো বাথরুম খুঁজে
দেখেছেন কোথাও নেই সেটা। খেলা তো এবার সবার মাথায় উঠল। একে এমডি স্যার, আবার
তেনারই হাতের আংটি খোয়া গেছে! ব্যস, অমনি সক্কলে মিলে খোঁজ খোঁজ। পুরো উঠোনের কোনও কোণ বাকি রাখলাম
না আমরা। কিন্ত কোথায় কী? কোনও আংটির টুকরোও চোখে পড়ল না। এমডি স্যারের গিন্নি
রেগে কাঁই হয়ে বললেন, “হুঁ! আংটি যদি কেউ পেয়েও থাকে এখানে কেউ কি ফেরত দেবে
ভেবেছ! এখানে অমন কত লোক আছে।”
স্পষ্টতই কথাটা কাদের লক্ষ্য
করে বলেছেন সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হল না। বাবা সেটা বুঝতে পেরে বলল, “দেখুন ম্যাডাম, আপনার ভুল
হচ্ছে। এখানে যারা কাজ করে তারা আমার বাবার আমল থেকে আছে।
দাশুদা আর মানুদি একটা সামান্য আংটি পেলে সেটা লুকিয়ে রাখবে, এইটা আমাকে ভগবান এসে বললেও আমি
বিশ্বাস করব না।”
“তাহলে আংটিটার কি পাখা গজাল? সে নিজেই উড়ে
গেল বলছেন বিশ্বাসবাবু?” এমডির এমন প্রশ্নে বাবার মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল। এমন
আনন্দময় সুন্দর পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে তছনছ। সবাই মুখ থমথমে
করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু এমডিগিন্নি বিড়বিড় করে বকে চলেছেন আপন মনে।
“সবাই যখন মাঠে গেছিল তখন তুমি
কী করছিলে কাকু?”
পিন ড্রপ সাইলেন্স কাটিয়ে রন্টুর
গলার গম্ভীর প্রশ্ন শুনে চমকালাম। এই পরিস্থিতিতে কী উলটোপালটা প্রশ্ন করছে রন্টু?
“তুমি আমায় প্রশ্ন করছ?” এমডিকাকু এবার
অবাক।
“হুমম্! তোমাকেই প্রশ্ন করছি?”
“এই রন্টু চুপ কর তুই।”
“উফফ বাবা। দাঁড়াও তো।”
কোমরে হাত দিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলুদার
স্টাইলে আবার প্রশ্ন করল কাকুকে।
“হুমম্, কাকু এবার বলো, সবাই যখন মাঠে
গেম খেলছিল তখন তো তুমি সেখানে ছিলে না, তুমি কোথায় ছিলে তখন?”
“কেন রে ডেঁপো ছেলে, তোকে কেন বলবে
সে কথা?” এমডিগিন্নির কথাতে রন্টু বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বলল, “উফফ! কাকিমা,
সারাদিন কি শুধু সাজগোজ করতেই কাটিয়ে দাও? জানো না গোয়েন্দা গল্পে কোনও কিছু হারালে
ভিকটিমের হোয়ারএবাউট সম্পর্কে আগে জানতে হয়? তবে তো হারানো
জিনিসটাকে ট্রেস করা যায়, নাকি?”
এবার বাবা দাবড়াল, “তুই কি গোয়েন্দা
নাকি? এই সব খোঁজে তোর কী দরকার?”
“বাবা, তোমরা তো এতক্ষণ খুঁজলে? এবার প্লিজ
আমাকে চান্স দাও।”
“কী হল কাকু, বলো এবার, কোথায় ছিলে?”
“মানেএএএএ....,” হতবাক এমডিকাকু
তুতলে গেলেন একটু। এইটুকু পুঁচকের কথার জবাব দেওয়া উচিত হবে কিনা ভাবলেন। তারপর কিছু
পরে বললেন, “আমি ডায়াবেটিক রুগি। তাই আমাকে ঘন ঘন বাথরুম যেতে
হয়। তাই তোমরা যখন মাঠে গেলে তখন আমি এখানেই ছিলাম। সবাই চলে যেতে বাথরুম গেলাম। তারপর
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পুকুরের দিকটাতে দাশুর সঙ্গে গেছিলাম। দাশুর
সঙ্গে সরস্বতী নদীর ধারটায় গেলাম, তোমাদের দাশু ওর ক্ষেতখামার দেখাল আমাকে, তারপর আবার
ওর সঙ্গেই ফিরে আসার সময় বাথরুম যাবার প্রয়োজন হওয়াতে আবার বাথরুম গেছিলাম।
আর দাশু তখন মাঠে যেখানে খেলা হচ্ছিল সেখানে ফেরত গেছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়েই খেয়াল
হল হাতের আংটিটা নেই! আর তখনই সবাইকে মাঠে গিয়ে কথাটা বললাম।” প্রশ্নের উত্তর শুনে বুঝদারদের
মতো মাথা নাড়াল রন্টু।
“হুম! দাশুকাকু - যা বলছে কাকু
ঠিক বলেছে?” দাশুকাকু ঢক করে মাথা নাড়ল রন্টুর কথাতে। চোখমুখ দেখে
বুঝতে পারছি দাশুকাকুও রন্টুর এ হেন ভূমিকায় আমাদের মতন অবাক হয়ে গেছে।
“এ থেকে তুমি কী বুঝলে?” আবার এমডিগিন্নির
প্রশ্ন? চোখটা কেমন সরু করে রন্টু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকাল
ওনার দিকে। এবার একপাক ঘুরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আংটি রহস্যের সমাধান আমি করে
ফেলেছি। তবে আমার একটা শর্ত, এখন এখানে আমাকে আর এমডিকাকুকে একলা ছেড়ে তোমরা সবাই
পিছনের মাঠে যাও। আমি না ডাকলে আসবে না। আংটি আমি তবেই খুঁজে দেব।”
কী জানি কেমন বিশ্বাসের সুরে
কথাটা ও বলেছিল, তাই আর কেউ আপত্তি করল না। এমনকি বাবাও না।
সবাই উঠোন ফাঁকা করে চলে গেলেও, আমি তো রন্টুর দাদা! মাঠের দিকে যেতে গিয়েও কী খটকা যে লাগল
মনে, আবার ফিরে এসে সিঁড়ি দিয়ে চটপট উঠে গেলাম ছাদে। রন্টুর
মাথায় এত বুদ্ধি যে ওইটুকু উত্তর শুনে আংটি খুঁজে বার করে ফেলল!
ছাদের কোণাটা থেকে উঠোনটা স্পষ্ট
দেখতে পাচ্ছি। রন্টু আর এমডিকাকু কী কথা বলছে, এমডিকাকু কাতর হয়ে রন্টুর হাত জড়িয়ে
ধরলেন। রন্টুর মুখে লেগে আছে মিচকে হাসি। এত দূর থেকে শুনতে না পেলেও দেখতে পাচ্ছি
সব কিছুই। এবার রন্টু নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। কী যেন বার করে আনল। রোদের ছটায় চিকচিক
করতেই বুঝতে পারলাম এই তো সেই হারানো আংটি। আংটিটা তার মানে রন্টুর পকেটেই ছিল। কিন্তু
তাহলে এতক্ষণ গোয়েন্দাগিরির নাটক করছিল কেন? তার মানে ওই ব্যাটাই কুড়িয়েছে। আর এমন
ঢং করছে যেন বুদ্ধি করে খুঁজে বার করেছে ও। উফফ! কী বিচ্ছু শয়তান রন্টুটা!
কিন্তু তাই যদি হবে তবে এমডি কাকুর তো রেগে যাবার কথা? উনি এত হাসছেনই বা কেন? ও বাবা এবার
যে দেখি রন্টুকে জড়িয়েও ধরলেন। উঁহু, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এ যে রহস্যের ধাঁধাঁয় ফেলে দিল
রন্টু। কিছুক্ষণ বাদে রন্টুর ডাকে উঠোনে সকলে ফিরে এল। আমিও ফিরলাম। এমডিস্যার বাবার
হাত ধরে গদগদ স্বরে বললেন, “বিশ্বাসবাবু,
আপনার ছোটো ছেলেটি বড়োই বুদ্ধিমান। খেয়াল রাখবেন ওর দিকে। কী সুন্দর
আমার হারানো আংটি ফিরে পেলাম। ওর জন্য আমার তরফ থেকে কাল পুরস্কার পাঠিয়ে দেব আপনার
হাতে।”
“সবই তো হল স্যার, কিন্তু ও আংটিটা পেল
কোথায়?” বাবার কথায় মুচকি হেসে বললেন, “সেটা না হয়
ওর কাছে পরে শুনবেন বিশ্বাসবাবু। এখন যে আংটি খুঁজতে বেলা চারটে বাজতে চলল। আমরা আর লাঞ্চ করব কখন? কই আমার চিকেন স্টু আর মাছের
ঝোল আনুন, খেতে বসি এবার, কী বলেন সব্বাই?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ” - সব্বাই হইহই
করে উঠল। সত্যি পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে সব্বার।
পিকনিক শেষে বিকেলে ফেরার সময়
আরেকবার রন্টুকে আদর করলেন এমডিকাকু। আর কাকিমা, যিনি কিনা রন্টুকে ত্যাঁদড় ছেলে বলেছিলেন, তিনিও দেখি গাল
টিপে মাথা ঘেঁটে রন্টুকে আদর করে আংটি খুঁজে দেওয়ার জন্য থ্যাংক ইউ বলে গেলেন মিষ্টি
করে। সবাই চলে যেতে বাবা রন্টুকে আদর করে বলল, “তুই আজ আমার মান বাঁচালি রন্টু। নইলে আমার
বাড়িতে আংটিটা না পাওয়া গেলে সত্যি খুব খারাপ হত।”
সারা দিনের পিকনিকের ধকলে আজ
সবাই ক্লান্ত, তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছি আমরা। আমি আর রন্টু
একসঙ্গেই শুই। সবাই ভুলে গেলেও সেই খটকা কিন্তু আমার মন থেকে
যায়নি। রন্টুকে সোজা চেপে ধরলাম, “রন্টু, বল আংটিটা তুই কোথা থেকে
পেলি?”
রন্টু আমার দিকে ফিরে মিচকে হেসে
বলল, “আমি জানি দাদাভাই তুই ছাদ থেকে লুকিয়ে সব দেখেছিস। আসলে কী জানিস
তো, আজ পাঁঠার মাংসটা এত ভালো হয়েছিল না - কষার সময় গন্ধে
পুরো পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্ত রাঁধুনির কাছে চাইতে গেলে ব্যাটা দিল
না একটু চাখতে, তাই রান্না হয়ে গেলে রাঁধুনি চলে যেতেই
তোরাও মাঠে গেলি সবাই খেলতে। উঠোন ফাঁকা দেখে ভাবলাম এই সুযোগ। একটা বাটি নিয়ে মাংসের
কড়া থেকে দুটো তুলে দিব্যি চাখা যাবে। আর কেউ দেখতেও পাবে না। ও বাবা! এই ভেবে যেই না উঠোনে ঢুকেছি ওমনি দেখি এমডিকাকু
চুপি চুপি বাটি হাতে এগুচ্ছে ওই গামলার দিকে। ডায়াবেটিক রুগি, সকাল থেকে
এত ভালো ভালো রান্নার গন্ধ পেয়েও কিচ্ছু খেতে পারছেন না দজ্জাল বউয়ের ভয়ে। আর এই সুযোগ!
কেউ দেখবারও নেই। তাই ফাঁকা মাঠে গোল দেবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে! গামলা থেকে হাত ডুবিয়ে
মাংস তুলে দিব্যি আয়েস করে খেলেন। তারপর ওখানেই রুমালে ঘষে ঘষে হাত মুছে রুমাল পকেটে রেখে বাথরুমে
গেলেন। সেই সময় আমিও মাংস চুরি করে খেতে গিয়ে দেখি গামলার পাশে ঘাসে কী যেন চকচক করছে।
তুলে দেখি আংটি। ওটা পেতেই বুঝলি, মাথায় আমার ফন্দি এল। আমাকে কিনা ত্যাঁদড় বলা! একটু
মজা দেখাব বলেই ওটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আর সঠিক সময় কায়দা করে কেমন বার
করে সব্বার বাহবা নিলাম বল?”
মিটমিটে দুষ্টু ভাইটার চোখে
দুষ্টুমির হাসি। আমি আর চেপে থাকতে পারলাম না। হো হো করে হেসে গড়িয়ে গেলাম ওর গায়।
“আচ্ছা, যখন উনি মাংস
খাচ্ছিলেন তখন কেন তুই চমকে দিলি না? তাহলে উনি চুরি করে খেতে গিয়ে
হাতেনাতে ধরা পড়তেন, কেমন মজা হত বল? এত বড়ো কোম্পানির এমডি কিনা
চুরি করে খাচ্ছেন!”
“না! রে!” উদাস হয়ে বলল
রন্টু, “ওই চুরি করে খাওয়ার সময় কাকুর মুখে যে তৃপ্তির ছায়া
দেখেছিলাম সেটা কেন জানি নষ্ট করতে ইচ্ছা করছিল না রে। কাকুও এই এক কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি এইটাই
বলতে, উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। তা ছাড়া যা দজ্জাল বউ ওনার, এত বারণেও চুরি করে মাংস খেয়েছে
জানলে ওনার অবস্থা কী হত ভাব!”
“উফফ! কী নাটুকে বাব্বা তুই! এই সামান্য
ব্যাপারে এত কিছু করে ফেললি, হ্যাঁ? আমাদের রন্টু গোয়েন্দা দি গ্রেট!”
“হুম! কী করি বল সব কাহানিতেই তো একটু
ট্যুইস্ট লাগে,” আবার সেই মিচকে
হাসিতে রন্টুর দুষ্টু মুখটা আজ বড়োই উজ্বল দেখাচ্ছে।
_____
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জি
বুদ্ধিমান রন্টুর আরো এমন কাণ্ডকারখানা পড়তে চাই।
ReplyDeletechesta korbo bondhu
Deleteভারি সুন্দর ছোট্ট ছেলের ছোট্ট গল্প।
ReplyDeleteonek dhonyobad
DeleteDarun next Ar asa a roelam
ReplyDelete