রাজা হওয়া
সোজা নয়
অরিজিৎ চক্রবর্তী
যোগের সঙ্গে তেমন একটা
যোগাযোগ ছিল না দাদার, বরং যোগ-বিয়োগ নিয়েই তার যত মাথাব্যথা
এবং সেই নিয়েই কাজ-কারবার। তাই দুর্যোগ ঘনিয়ে এল যখন জটলা তান্ত্রিক বাড়িতে মাসিক চাঁদা
আদায়ের পর ফিরে যাবার সময় মনোযোগ দিয়ে দাদাকে বেশ কিছুক্ষণ আপাদমস্তক দেখে বলে উঠল, “মুখের দক্ষিণভাগে তিল, অর্থাৎ
রাজযোগ!”
চমকেই উঠেছিলাম প্রায় সক্কলে।
এমন চমকে, চমকে ওঠাটাই
দস্তুর। আমাদের একতোলা ঘরে; যেখানে আমি, রিনি,
দাদা ইত্যাদি সব ও খাট আলমারি নিয়ে তিলধারণের
জায়গাটুকু নেই, সেইখানে এমন ধরনের তিল নিয়ে দাদার
ধারণ নিয়ে রীতিমতো ভাবনায় পড়ি।
দাদা অবশ্য জ্যোতিষে
অবিশ্বাসী, আগেই বলা আছে। জটলা
তান্ত্রিকের মতো এমন পার্টটাইমার জ্যোতিষের জ্যোতিষগিরিতে তো বটেই।
সেবার জটলা তান্ত্রিক দাদার দুই বছরের জন্য বাইক চালানো ও দেড়মাস বিরিয়ানি
খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই বোধ হয়।
তবে এহেন সু-যোগে দাদাসহ সবার মনেই একটা খটকা লাগে। নিজেরাই
পঞ্জিকা খুলে বসি সকাল সকাল। আমি,
রিনি ও দাদা তিনজন মিলেই তিলতল্লাশি চালাই একরকম।
সূচীপত্রহীন পঞ্জিকায় তিলবিবরণী খুঁজে না পাওয়ায়, তিনজন
মিলে বেণীমাধব শীলের সিল দেওয়া পঞ্জিকাকে ছিঁড়ে তিনখান করে খুঁজতে থাকি।
তিনখন্ড পঞ্জিকাতেই এক খন্ড তিলতত্ত্ব খুঁজি।
আমার ভাগে অবশ্য টিকটিকি
পতনের ফলাফল, কম্পন বৃত্তান্ত ইত্যাদি
সব জোটে। তাই শেষমেষ রিনিই খুঁজে পায়।
সত্য কথা - হ্যাঁ সত্যি কথাই বলেছে জটলা তান্ত্রিক। স্পষ্ট
লেখা আছে পঞ্জিকায়। বড়ো বড়ো হরফে একদম।
তাহলে সত্যি কি দাদার রাজযোগ!
যাই হোক
যোগ নিয়ে হুজুগ তখন আর তেমন একটা জাগেনি। তবে সেদিন
সকালে তা আবার ঘনিয়ে এল। ভোর-ভোর আমার ঘুম ভেঙেছে কি ভাঙেনি,
ঠিক সেই সময় আনন্দবাজার হাতে দাদা আমার ঘরে ঢোকেন। তারপরেই
প্রথম পাতাখানা আমার সামনে মেলে ধরে বলেন, “এই
দেখ, কী দিয়েছে আজকের পেপারে।”
আমার আধঘুমে চটকা লাগে।
আনন্দবাজার হাতে নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করে নিরানন্দ হয়েই শুধোই, “কী হয়েছে? কে আবার মরল? নাকি সীমান্তে আবার গোলাগুলি শুরু হয়েছে?”
“চোখ খুলে একবার খবরটা পড় না!”
দাদা আনন্দের সীমা অতিক্রম করেন এবার। তাই উৎফুল্ল
হয়ে বলেন, “রাজযোগ আর আটকায় কে!
শুধু জিনিসটা একবার জোগাড় করে ফেললেই হয়।”
ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে খবরখানা
পড়ি। তা খবরটা হল এরকম -
উত্তরপ্রদেশের কোনও এক গ্রামে
লোকেরা হাতির লেজ থেকে রোম ছিঁড়ে নিয়ে মাদুলি বানিয়ে হাতে পরছে।
একবার সেই রোম হাতে এলেই নাকি রাজযোগ হাতে নাতে।
সেই নিয়েই হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ
ব্যাপার-স্যাপার। তাই হট্টগোলে রেগে গিয়ে হাতিবাবু
একখান গোল বাঁধিয়ে বসেছেন। এক লোককে শুঁড়ে
পেঁচিয়ে মেরে ফেলেছেন আর কি, বেশি কিছু
না।
হাতিবাবু যে হিংসে করেই এ কাণ্ড
বাধিয়েছেন, তাই আমার ধারণা।
নিজে থাকতে অত সহজে অন্য কাউকে রাজা হতে দেওয়া যায়! এ যুগে
মানুষ কি মানুষের ভালো চায় নাকি মশাই! তাহলে হাতিই
বা তা চাইবে কেন? হাতি বলে কি আর মানুষ না!
কাগজ পড়া শেষ হলে দাদা আমার
হাত থেকে তা কেড়ে নেন। তারপর রোল করে বাম হাতের তালুতে
মারতে মারতে পায়চারি শুরু করেন। ঘরজুড়ে এহেন
পদক্ষেপে তাঁর ক্ষেপে যাবার সমূহ সম্ভাবনা দেখা
দেয়। তাই শেষে আমিই প্রশ্ন করি, “তা এই জিনিসটা জোগাড় কোথায় করা যায়?”
“সে কথাই ভাবছি।
কাছাকাছি কারও ঘরে হাতি আছে বলে তো জানা নেই। হাতি
পোষার শখও নেই বোধহয় কারোর।
কাশীপুরের রাজবাড়িতে একটা হাতিশাল আছে বলে জানি। তবে
কি সেখানেই একবার খোঁজ করা যায়?”
“না না! তার
দরকার নেই!" দাদাকে দমিয়ে দিয়ে বলি, “সেই হাতিশালে আর হাতি নেই শুনেছি, বরং
গাছ-টাছ কেটে হাতিশালে কাঠ বোঝাই করে রাখা আছে। সেই
নিয়েই তাদের ব্যবসা কিনা। তাই তাকে
হাতিশাল না বলে শালশাল বলাই ভালো। খোঁজ করলে
দু-চারটা শালগাছ পাওয়া যেতে পারে।”
দাদার পায়চারির ফ্রিকোয়েন্সি
আরও বেড়ে যেতে থাকে। রাস্তায় চললে এতক্ষণে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে যেতেন হয়তো।
দেওয়ালেই বাধা পড়েছেন এই যা। চলতে চলতে হঠাৎ
থেমে পড়েন, তারপর আবার খবরখানা পড়তে পড়তে থেমে
যান। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থামা-পড়ার পর
ধীরকন্ঠে বলেন, “তবে চিন্তার কারণ নেই।
হাতে টাকা যখন আছে তখন জিনিসটাই বা আর হাতছাড়া হয়ে যায় কোথায়? কথায় আছে, পয়সা ফেললে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।
আমি তো আবার পয়সার বদলে টাকা ফেলব।”
“পাওয়া তো যায়,
কিন্তু কথাতে তো আর কোথায় পাওয়া যায় তা বলা নেইকো। সেইখান
নিজেই খুঁজে-টুঁজে নিতে হবে,” আমি বলি।
“সেও একখান কথা বটে!”
দাদা আবার পায়চারি শুরু করেন। তারপর আবার
থেমে গিয়ে বলেন, “আচ্ছা,
ড্রেস হাউসে খোঁজ করা যায় না! নকল চুল
হিসাবে যদি সে জিনিস থেকে থাকে?”
“হাতির রোম নিয়ে ড্রেস হাউস কী
করবে? তাছাড়া যদি থাকতই তাহলে সে বড়োলোক
হয়ে পড়ত না! তখন দোকানের নাম পালটে রাজা ড্রেস
হাউস হয়ে যেত। কই সেরকম সাইনবোর্ড তো কোথাও চোখে
পড়েনি।”
সত্যি একখানা ভাবনাই বটে। ইসকুলেও
হাতির ব্যাপারে কোনও রচনা পড়ায়নি। পড়িয়েছে
খালি গরুর রচনা। দুধ থেকে মাখন, পনীর
হয়। গোবর থেকে ঘুঁটে হয়।
কই হাতির রোম থেকে যে রাজা হয় সে কথা তো পড়ায়নি, যে
ব্যাপারখানা জানব? এ জন্যই বড়ো বড়ো লোকেরা ইসকুল
ছেড়েছিলেন বোধহয়। আগেভাগেই টের পেয়ে গেছিলেন
ব্যাপারখানা। এদিকে আমাদের রাজা না করে গরু
বানাবার মতলবেই হয়তো ইচ্ছে করে এমন কিছু বইয়ে ছাপেনি তারা।
বেশ খানিকক্ষণ দুই ভায়ে
চুপচাপ বসে থাকি। দাদা বারকয়েক খবরটা পড়েন।
আমিও মাথা চুলকে চিন্তা করতে থাকি। অনেক চিন্তা
ও ভাবনার পর আমিই উপায়টা বাতলাই, “একবার দশকর্মা ভাণ্ডারে যাওয়া যাক।
ওখানেই পাওয়া যাবে বোধহয়।”
“কেন, দশকর্মা কী জন্য?”
দাদা রীতিমতো প্রতিবাদ করে ওঠেন, “তাহলে
তারাও তো রাজা হয়ে যেত। দোকানের আগেও রাজা যোগ হত।”
আমি দাদাকে আশা দিই, “আহা!
দশকর্মা দোকানের লোকের লোভ থাকে না যে। নইলে তাদের
দোকানে এত পুজোসামগ্রী! পুজোআচ্চা
করেই রাজা হয়ে যেত না তারা! লোভহীন
বলেই তো লাভহীন একরকম। তাই তো রাজা হয়ে ওঠা হয়নি আর।”
“তবে দশকর্মার দোকানেই সে
জিনিস থাকবে কেন! পাড়ার পানগুমটিতেও তো থাকতে পারে। সেও তো লাভ
ও লোভ দুইই হীন। নইলে
এ যুগে কে-ই বা পানের সঙ্গে চুন ফ্রি দেয়? চুন খসলেই তো খুন এক্কেবারে।”
“তা কেন হবে,
তা কেন!” আমি দাদাকে বোঝাই, “যেমন দশে দিক, প্রথম
ক্লাসে নামতা এক থেকে দশ। অংকতে দশে
দশ। একশোতে একশো ক’জন পায়? দশে দশই সবাই পায়। এদিকে মা
দুর্গার দশটি হাত বলে, মা দশভূজা। সেই
দশ-সূত্রেই দুর্গাপুজো শ্রেষ্ঠ উৎসব।
ওদিকে আবার হরেকমাল দশ টাকা। সবই দশ, দশই সব।”
“সব দশ হলেই বা,
দশকর্মা ভাণ্ডারে সব কিছু পাওয়া যাবে এ কেমন কথা! সে
জিনিস ওখানে পাওয়া যাবে তার গ্যারান্টি আছে নাকি!”
“ধ্যের! শোনো না কথাটা!”
দাদাকে দাবড়ে দিয়ে খানিক বিরক্ত হয়ে বলি, “আরে
সব দশ করার জন্যই তো নামখানা হল দশকর্মা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে এর যোগ নেই তেমন।
মায়ের কাছেই অনুরোধ একরকম দশ কর মা। সেই
থেকেই মুখে মুখে কথাটা দশকর্মায় এসে ঠেকেছে।”
দাদা একটু বোঝেন হয়তো।
পুরোপুরি তখনও ঠিক বুঝে ওঠেননি।
তাই এমন জ্বলজ্যান্ত উদাহরণও যখন বিফলে যায় তখন শেষ চেষ্টা করি, “আরে পৈতার সময় হরিণের চামড়ার টুকরোও তো দশকর্মার ভাণ্ডারবাবুর
কাছ থেকেই আনা হয়েছিল। তাইলে হাতির লেজের রোমই বা তার কাছে
পাওয়া যাবে না কেন!”
শেষ উদাহরণে গিয়ে দাদা বোঝেন।
চোখ জ্বলজ্ব্ল করে উঠে। অর্থাৎ আমাদের গন্তব্য যে দশকর্মা ভাণ্ডার
তা ঠাউরে নিয়েই একটি কথা বলেন, “দশকর্মাতেই
দেখা যাক তাহলে।”
দুই ভাই মিলে দশকর্মার দিকেই
পা বাড়ালাম। দশকর্মা যখন মোটামুটি আর দশ কদম দূর,
দোকানের ভেতরে বেশ একটা গণ্ডগোলের আওয়াজ পাওয়া যায়।
হাতাহাতি না হলেও বেশ একটা কথা কাটাকাটি যে চলছে তা এখান থেকেই টের পাওয়া যায়।
তাহলে কি জিনিসটার খোঁজ পেয়ে লোকে দশকর্মায় হামলে পড়ল নাকি? মনে মনে ভাবি।
দাদাও থমকে দাঁড়ান। জিনিসটার প্রাপ্তিস্থান নিয়ে যে
রহস্য আমরা ভেদ করেছি, সেই সমাধানসূত্র আগেই লোকে প্রাপ্ত
করেছে নাকি! সেই ভেবেই দাঁড়ান হয়তো। তবে একটু
কান পেতে শোনা যাক! নাহ! সেরকম
কোনও ব্যাপার নেই। কারও
কথাতেই হাতি বা সেই ব্যাপারে আতিপাতি কোনো বার্তা নেই তেমন। অর্থাৎ,
ভয়েরও কিছু নেই। আমরাই রহস্যভেদী!
দশ বারোজনের বেড়াজাল ভেদ করেই
দোকানে ঢুকতে হয় আমাদের। দশকর্মার ভাণ্ডারবাবুর সঙ্গে
লোকগুলোর বেশ একটা তর্কাতর্কি চলছে তখন। খানিক চুপ
করে আমি আর দাদা সেসব কথা শুনি।
লোকগুলো নিতান্তই শ্মশানী।
অর্থাৎ শ্মশান থেকেই মড়া পুড়িয়ে আসা। অন্তিমযাত্রায়
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের গরমিল হওয়াতেই দশকর্মায় হামলা তাদের। ভাণ্ডারবাবুর
নামে এরকম বদনাম আগে কেউ দেয়নি অবিশ্যি। সব কিছু
লিস্ট মিলিয়ে ঠিকই দিয়েছেন। শ্মশানীদের
কথা ভেবে দু’প্যাকেট এক নম্বর বিট্টু বিড়িও ফ্রিতে
দিয়েছেন। ঝামেলাটা স্রেফ দেশলাই না দেওয়া
নিয়ে।
না না! বিড়ি
না খেতে পাওয়ার জন্য ঝামেলা নয় মোটেই। শ্মশানীদের
কাছে লাইটারের মতো বিকল্প বন্দোবস্ত থাকে সর্বদাই। কারও
না কারও কাছে তা থাকেই। ঝামেলাটা হল চিতায় আগুন দেওয়া নিয়ে।
দেশলাই কাঠি না পাওয়ায়, লাইটার
দিয়েই মুখাগ্নি করা হয়েছে কোনওমতে,
এবং সেই নিয়েই মেলা ঝামেলা আর কি!
বেশ খানিকক্ষণ ঝামেলাঝাটি-লাঠালাঠির
পর শ্মশানীরা হালকা হন ভাণ্ডার থেকে। যখন ভাণ্ডার
প্রায় শ্মশানীশূন্য, তখন ভাণ্ডারবাবুর আমাদের দিকে খেয়াল
হয়। রুমাল দিয়ে কপালে ঘামটাম মুছে দাদার
দিকে চেয়ে বলেন, “বুঝলে হে চক্কত্তি, দশকর্মার এই এক বিপদ। একটু
গরমিল হলেই রাগে গরগর করতে করতে আসা লোকের দেখা
মেলে এখানে। লিস্টির সঙ্গে না মিললে তাদের সামলে ওঠাই দায়। পুজোআচ্চায়
ত্রুটি থাকলে অনর্থ কিনা! আবার সে সবে
ফলাফল না মিললেও দোষ দশকর্মার এই শর্মার। ভাণ্ডারবাবু
ভেজাল মাল দেন বলে লোকে বাজারে বদনাম রটায় আর কি!”
দাদা ভাণ্ডারবাবুর কথায় সায়
দেন, “হ্যাঁ বটেই তো,
বটেই তো। এই দুনিয়ায় লোকের খারাপ করার কি আর
জো আছে!”
ভাণ্ডারবাবু হয়তো দাদার
কথাখানা অতোটা মন দিয়ে শোনেন না। ভাণ্ডারের
আন্ডারে থাকা জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যান। তারপর
বেশ গুছিয়ে-টুছিয়ে দাদাকে শুধোন, “তা তোমার কী লাগবে যেন?”
“আজ্ঞে একটা জিনিস চাই।
মানে ওই আপনার ভাণ্ডারে পাওয়া যাবে কিনা! মানে
বেশি কিছু না, হাতির লেজের রোম চাই আর
কি! একখানা হলেই চলে।”
ভাণ্ডারবাবুর চোখ কপালে উঠে।
দাদা পাগল হয়ে গেছেন কিনা তাই নিয়েই ভাবেন বোধহয়। তারপর
কোনওক্রমে বলেন, “সে
কী জিনিস! হাতির লেজের রোম নিয়ে কী হবে বাপু!
বাঘের রোম, হরিণের রোম হলেও একখান কথা ছিল।”
“তেমন কিছু না,
এই কবরেজমশাই জোগাড় করতে বলেছিলেন আর কি! এক
রোগের দাবাই বানাতেই তার এই দাবি। ভাইয়ের
সাংঘাতিক রোগ কিনা!” আসল কথাটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই দাদা
মিথ্যে বলেন।
আমি
ও ভাণ্ডারবাবু দুজনেই রীতিমতো অবাক হই। কমবেশি
না, একদম সমানে সমানে অবাক হই।
“সে কী রোগ হে! ছোঁয়াচে-টোঁয়াচে নয়তো?” ভাণ্ডারবাবু শুধোন।
“না না! ছোঁয়াচে
নয় তেমন,” দাদা ভাণ্ডারবাবুকে আশ্বস্ত করেন, “এই তো আমিই ছুঁয়ে-টুঁয়ে এলাম। সাংঘাতিক
রোগ বটে, তবে সঙ্গ-ঘাতী নয় কোনোমতেই।
সুদূর আফ্রিকা থেকে এয়েছে কিনা। নাম হল গিয়ে
ইপিইটোফুলোসিস, না কী একখান। দূরের
রোগেরা তো বদ হয় না তেমন। দেখতে
পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়া স্বভাব তাদের নেই।”
দাদার কথায় আমিও সায় দিই, “সে স্বভাব তো কেবল বাঙালীদের। তাই
এদেশের রোগেদেরও সেই অবস্থা। দেখলেই
ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে। এই তো গেলবারেই আমদানি হল রোগখানা।”
ভাণ্ডারবাবু আরও অবাক হন।
ভয়ও পান খানিক। আমাদের কথায় তেমন বিশ্বাস হয় না
বোধহয় তার। তাই দোকান থেকে তাড়াবার জন্য
তাড়াহুড়ো লাগান, “না না! সে
জিনিস নেই এখানে। এই তল্লাটেও নেই।
বিদেশের রোগ যখন, তখন সেটা বিদেশ থেকেই আমদানি করো
বরং। খাঁটি মাল পাবে।”
দশকর্মার ভাণ্ডারবাবুর উপর আর
কথা বলতে সাহস হয় না আমাদের। দোকান
থেকে এইভাবে খেদিয়ে দিলে কিছু বলাও যায় না তেমন। দশে
দশভূজা, হরেকমাল দশটাকা যেমন,
রাবণের দশটি মাথাও তেমন। সেটা তো
হিসাবের বাইরেই ছিল, এখন মনে পড়ে। তাই
রাবণ যখন, তখন দশে লঙ্কাকান্ডও বটে।
তাই খান্ডবদহনের আশাও করাই যায়।
দশকর্মা ভাণ্ডার আমাদের কোনও কম্মের না হওয়ায় সেখান থেকে
বেরিয়ে আসি। এমন সময় পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের বেশ
একটা হট্টগোল চোখে পড়ে। আরও কয়েক কদম এগিয়ে বেশ একখানা বড়ো বস্তু নজরে আসে।
“হাতিইইইই!”
দাদা চেঁচিয়ে ওঠেন।
হ্যাঁ! বস্তুটি,
থুড়ি জীবটি হাতিই। যে জিনিস খুঁজতে খুঁজতে আমরা হন্যে
হয়ে পড়েছি, সে-ই দশকর্মা ভাণ্ডারের মুখোমুখি এসে
আমাদের ধন্য করেছে। আমি আর দাদা দুজনেই একদৌড়ে হাতির
কাছে যাই। সামনের বাচ্চাকাচ্চাদের দেওয়াল ভেদ
করে, কাউকে বা ডিঙিয়েই, দাদা সোজা চলে যান
হাতির লেজের কাছে। রোম নিতে ঠিক যাবেন
এমন সময় মাহুত এসে খুঁত ধরে, “বাবু! এ কী করছেন? গরুর লেজ
পেয়েছেন, যে ঘুরিয়ে ছেড়ে দেবেন?”
সত্যি গরুর লেজ নিয়ে খেলা
করলে সে তেমন রাগ করে না। নিতান্তই
গরু বলেই বোধহয়। কিন্তু হাতির বেজায় রাগ।
রাগেরই অপর নাম হাতি হওয়া উচিত ছিল। একবার সে
ক্ষেপলেই মুশকিল। গরু তো ক্ষেপলে শুধু বাড়ির বাগান
নষ্ট করে। সবজিপাতি, গাছপালা খেয়ে ফিরে যায়।
তবে হাতি ক্ষেপলে সে বালাই নেই। বলাই যায় সে
বাগানের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িও ভেঙ্গেচুরে দেবে। অতএব
সে বীরত্ব না দেখিয়ে, সে কাজে বিরত থাকাই শ্রেয়।
“আরে নাহ!
সে না!” দাদা
মাহুতকে বোঝান, “লেজ ঘুরিয়ে ছাড়ব কেন শুধু
শুধু? এই লেজ থেকে রোম নিয়েই চলে যাব।”
“কেন, কেন?
রোম কেন?” মাহুত শুধোয়।
“দাবাইয়ের কাজে লাগবে যে!
ভাইয়ের ভীষণ অসুখ কিনা!”
মাহুত হাতমুখ নেড়ে বলে, “না না, তা চলবেনি
বাবু। হাতি গোটা থাকতে তার থেকে রোম আলাদা
করা যাবে না।”
“রোম যে আমার চাই-ই। মানে না
পেলে মরে যাই যেন!” দাদাকে
ভীষণ চিন্তিত দেখায়।
“গোটা হাতিই কিনে ফেলুন না
হয়!” মাহুত তাচ্ছিল্যভরে জবাব দেয়।
দাদা হতচকিত হয়ে ওঠেন।
হাতি কেনার আইডিয়াটা মন্দ ঠেকে না তেনার।
রোম নাই বা এল, হাতিসমেত
রোম বাড়িতে থাকলেই হল। তাহলে বাড়িসুদ্ধ সবার রাজা হয়ে যাওয়া
যায় এক্কেবারে। বাড়িটারও
রাজবাড়ি হয়ে যাওয়া যায়। টাকা
থাকতে অবশ্য হাতি কী জিনিস! টাকার লোসকান আবার লোসকান নাকি! এইসব লসেই তো রাজা হবার খবর কান-কান ভেসে বেড়ায়।
হাতি থেকে রোম আলাদা করা যাবে
না সে শর্তে, নগদ টাকা গুণে
দাদা মাহুত সমেত হাতি কিনে ফেলেন।
মাহুতই তার দেখাশুনো করুক বরং। হাতির
হুজ্জুতি বাড়ির কাউকে সহ্য করতে হয় না আর।
সত্যি একখান হাতি কিনেছেন দাদা। দেখলে চোখ
জুড়িয়ে যায়। দু’চোখ জুড়েও একবারে সে হাতিকে
পুরোপুরি দেখে ওঠা সম্ভব নয়। এ
তল্লাটে এমন হাতি আর বোধ করি হয়
না। এদিক-ওদিক ঘুরে দাদা হাতিকে
পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তারপর আমাকে বাড়ি থেকে হাতির খাবার
জন্য কলা আনতে বলেন। অমন বিশাল হাতি যখন,
তখন হঠাৎ করে ক্ষিদে পেয়ে যাওয়া আর আশ্চর্য কী!
না পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই আমি
কলাগাছে ধরা কলার কাঁদিখানাই কেটে আনি। বিশাল হাতি
যখন, একটা কলায় কি আর হয় তখন!
কাঁদিখানাই তার কাছে নস্যি। দাদা
কাঁদিখানা হাতির শুঁড়ের সামনে মেলে ধরে আদুরে গলায় ডাক দেন, “আয়, চুক চুক,
আয় আয়!”
এতক্ষণে হাতির খেয়াল হয় দাদার
দিকে। শুঁড় দিয়ে দাদাকেই জাপটে ধরে সে।
কলাগাছ ভেবেই ধরে হয়তো। কলার কাঁদি
যখন কাঁধে, তখন কলাগাছ হলেই হয়।
দাদার এমন অবস্থা দেখে আমরা হইহই করে তেড়ে আসি। আমাদের
চেঁচামেচিতে হাতিও ভয় পেয়ে দৌড় দেয়। হাতিসুলভ দৌড় নয় তেমন, তবে সঠিক
প্রাইজ পেলে মোটারাও যে দৌড়োদৌড়িতে রোগাদের হারিয়ে দেয় তাই প্রমাণ করে।
আমি, মাহুত
প্রায় সক্কলেই খোঁজাখুঁজি শুরু করি। পাড়াময়
চুলচেরা তল্লাশি চালাই। দাদাসমেত হাতি তো দূর,
হাতি বা দাদা কাউকেই আলাদা করেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
কলার কাঁদিখানাও না। অবশ্য সেই কাঁদি রাস্তায় পড়ে থাকলে
কুড়িয়ে নেবার লোকের অভাব হয় না।
হাতি বা দাদা কেউ একজন পড়ে থাকলেই যা দেদার অভাব-অনটন।
সন্ধে নাগাদ দাদা নিজেই বাড়ি ফিরে আসেন। সিল্কের
পাঞ্জাবি বলে আর কিছু নেই বোধহয়। দাদার সারা গায়ে
কাদা লেপটে রয়েছে। বাকি অবস্থাও কহতব্য নয়।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সেই বাকি ঘটনাখানা জানান। হাতি শুঁড়ে পেঁচিয়ে দাদাকে নিয়ে বেশ কয়েক মাইল পাড়ি
দিয়েছিল। তারপর কাঁদিসমেত দাদাকে খেতে যায়।
তবে দাদা বিস্বাদ ঠেকায় স্রেফ জিভে চেটে
ডোবায় ছুঁড়ে ফেলে। তারপর কাঁদি নিয়ে পগার পার হয়।
এদিকে বিকেলবেলায় জ্ঞান ফিরলে দাদা বাড়ি ফিরে আসেন কোনওক্রমে।
আমরা সবাই গোল হয়ে চুপচাপ বসে
থাকি। অর্থক্ষতি বড়ো ক্ষতি।
দাদার হাতিও গেল, টাকাও গেল, এমনকি কলার
কাঁদিটাও গেল। কাঁদিটার কথা ভেবে রিনি কেঁদেই ফেলে।
কলার মোচাটা বেশ ফুটে উঠেছিল বরং। তাড়াহুড়োয় তা
আর আলাদা করে কেটে নেওয়া হয়নি। লোভ করলেই
লাভহীন হতে হয় বরং বুঝতে পারি। রাজা হওয়া
সোজা নয় - সত্য কথাই বটে!
______
(লোসকানঃ পুরুলিয়া অঞ্চলে কথ্য ভাষা হিসেবে লোকসান এর পরিবর্তে লোসকান শব্দ
প্রচলিত আছে। - লেখক)
_____
অলংকরণঃ সুমিত রায়
দুর্দান্ত! হেসে অস্থির হয়ে গেলুম।
ReplyDeleteKhub bhalo laglo.. Hese kutipati holam... Ki jhorjhore lekha...
ReplyDelete