গল্পের ম্যাজিক:: রাজবল্লভপুরের বাগানবাড়ি - বিভাবসু দে


রাজবল্লভপুরের বাগানবাড়ি
বিভাবসু দে

(১)

সবে ফার্স্ট হাফের ক্লাস শেষ হয়েছে, লাঞ্চব্রেক দিনের এই সময়টা কলেজ-ক্যান্টিন বেশ সরগরম থাকে একটা টেবিলে বেশ খোশমেজাজে আড্ডার আসর জমে উঠেছে - তন্ময়, ঋষি, কৌশিকী আর সাথে দেবুদা দেবুদা, মানে প্রফেসর দেবেন্দ্র চৌধুরী, বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও মনে একফোঁটাও বয়সের ছোঁয়া লাগেনি, একেবারে তরতাজা তরুণ আর তাই তার সঙ্গতটাও ছাত্রদের সাথেই জমে ভালো তন্ময়রা ওঁর ক্লাসেরই ছাত্র ক্লাসে স্যার হলেও বাইরে উনি দেবুদা
গরম চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বেশ মন দিয়ে খবরের কাগজটা দেখছিলেন দেবুদা“ঋষি, এই দেখ কাগজে কী লিখেছে
হঠাৎ দেবুদার কথায় আড্ডা থামিয়ে তিনজনেই তাকাল
“কী ছেপেছে?
“তিনের পাতায় বেশ বড়ো করে হেডিং দিয়েছে বুঝলি, ‘রাজবল্লভপুরের অভিশপ্ত বাগানবাড়ি’ বিষয়বস্তু পড়ে যা বুঝলাম, গ্রামের মানুষের ধারণা বাড়িটিতে ভূত আছে দিনে-রাতে যখন তখন নাকি খ্যানখ্যানে গলায় কান্নার সুর শোনা যায়, বহুবছর ধরেই নাকি চলছে ব্যাপারটা গায়ের দুয়েকজনের নাকি প্রেতদর্শনও হয়েছে ওই বাড়িতে, আর তাই এখন সাহস করে কেউই ঢোকে না সেখানে
তিনজনের মুখেই একটা ছোট্ট বাঁকা হাসি দেখা দিল তন্ময় একটু ঘাড় নুইয়ে বেশ সরস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “দেবুদা, কিছু গন্ধ-টন্ধ পাচ্ছ নাকি?
চশমাখানা নাক বরাবর একটু নামিয়ে তার ওপরের ফাঁক দিয়ে একবার তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেবুদা বললেন, “কী বলিস, হয়ে যাক তবে রাজবল্লভপুর?
চারজনের মুখের হাসিটাই বেশ চওড়া হয়ে উঠল উৎসাহের তোড়ে কৌশিকী প্রায় টেবিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “কবে বেরোচ্ছি, দেবুদা?
“রোসো বাপু রোসো, আগে একটু সব খোঁজখবর নিয়ে নিই তবে তোরা তৈরি থাকিস, ইচ্ছে আছে এ-সপ্তাহের মধ্যেই যাব
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, এদের চারজনের একটা উদ্ভটরকম শখ আছে, ভূতের শখ! যেখানেই ভৌতিক কোনও কাণ্ডের খোঁজ পায়, অমনি চারজনে বেরিয়ে পড়ে ব্যাপারটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেবুদার প্রশ্রয়েই মূলত শখটা গজিয়ে উঠেছে ওদের মধ্যে - কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, কিছুটা সত্য খোঁজার অনুসন্ধিৎসা আর এই নেশার তাগিদেই অনেক জায়গায় ঘুরেছে ওরা দেবুদার সঙ্গে - কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে ভানগড় ফোর্ট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভৌতিক রহস্যগুলো গুজব বা অজ্ঞতার ফল, কিন্তু দেবুদার মতে সবদিকই মাথায় রাখা উচিত ভূতেদের স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ না থাকলেও বিপক্ষেও কিন্তু কোনও ধ্রুবসত্য প্রমাণ এখনও অবধি নেই যার জোরে একেবারে বুক ঠুকে বলা যাবে যে ভূত বলে কখনওই কিছু সম্ভব না
এরা তিনমূর্তি আবার তিনমতের লোক ঋষি ভূত সম্পর্কে চরম নাস্তিক, আবার কৌশিকীর ভূতেদের ওপর বিশাল ক্রাশ! সামনাসামনি ভূত দেখবার ইচ্ছে ওর চিরকালের, যদিও এখনও অবধি তা পূর্ণ হয়ে ওঠেনি প্রায়ই তর্ক বেধে যায় এদের মধ্যে ভূত নিয়ে তন্ময় আবার এদের দু’জনের মাঝামাঝি রহস্য ফাঁস করার রোমাঞ্চটাই ওর কাছে বড়ো তাগিদ আর এদের দলনেতা হলেন দেবুদা - শান্ত প্রকৃতির সাহসী বিচক্ষণ লোক, তাছাড়া এসব ভৌতিক রহস্যের ব্যাপারে বেশ খোঁজখবরও রাখেন
বাগানবাড়িটি নিয়ে কথা বলতে বলতে মিনিটের কাঁটা প্রায় বারোর ঘরে গিয়ে ঠেকল দুটো বাজে, লাঞ্চব্রেক শেষ, এবার উঠতে হবে তন্ময়দের একটা ক্লাস আছে, দেবুদার আজ আর কলেজে কাজ নেই
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে কলেজের গেটের দিকে এগোতে এগোতে দেবুদা বলে গেলেন, “কাল হয়তো আসব না, পরশু দেখা হবে এরমধ্যে তোদের বাড়িতে যার যা গল্প ফাঁদার আছে সব করে রাখিস
তিনজনের মুখেই একটু হালকা হাসি দেখা দিল আসলে এদের এসব ভৌতিক কীর্তিকলাপের কথা বাড়িতে কেউই জানায় না সাধারণত কলেজ-ট্যুরের নাম করেই বেরিয়ে পড়ে ওরা

(২)

দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল, শুক্রবার হাওড়া থেকে দুপুর দেড়টার ট্রেনে চাপল ওরা, হাওড়া-ভুবনেশ্বর জনশতাব্দী এক্সপ্রেস রাজবল্লভপুর গ্রামটি প্রায় বাংলা-ওড়িষ্যার সীমান্ত লাগোয়া, যদিও মানচিত্রগতভাবে ওড়িষ্যাতেই পড়ে দুটো নাগাদ ট্রেন ছাড়ল চারজনেই জিনিসপত্র রেখে বেশ আরাম করে জাঁকিয়ে বসেছে, সাথে একেক ঠোঙা ঝালমুড়ি
দেবুদা চশমাখানা বুকপকেটে রেখে বললেন, “ঝালমুড়ি খেতে খেতে তোদের রাজবল্লভপুরের কাহিনিটা বলি, মন দিয়ে শুনে রাখ
তিনজনেই বেশ আগ্রহে একটু এগিয়ে এসে বসল
দেবুদাঃ গ্রামখানা ওড়িষ্যায় হলেও একসময় বেশ কিছু বাঙালি পরিবার থাকত বলতে গেলে অধিকাংশ বাসিন্দাই বাঙালি ছিল সে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা
তন্ময়ঃ মানে, চৈতন্য মহাপ্রভুর আমলের?
দেবুদাঃ হ্যাঁ, একদম ঠিক নদিয়ায় তখন শ্রীচৈতন্য আর বাংলায় নবাবদের শাসন কৃষ্ণনগরের রাজার সাথে তখন প্রায়ই ছোটোখাটো রেষারেষি চলছে নবাবের হঠাৎ একদিন নবাব-সৈন্য কৃষ্ণনগর আক্রমণ করে অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা তার বিশ্বস্ত মন্ত্রী রমণীমোহন চাটুজ্জ্যেকে রাজপরিবারের অতি মূল্যবান দুটি জিনিস দিয়ে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেন হয়তো ভেবেছিলেন, সব ঠিক হয়ে গেলে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন, কিন্তু সে ভাগ্য রাজার জীবনে আর হয়ে ওঠেনি সেই রমণী চাটুজ্জ্যেই পালিয়ে আসেন রাজবল্লভপুরে রাজার দেওয়া ধনসম্পত্তি দিয়ে বেশ সুন্দর একখানা বাগানবাড়ি খাড়া করেন। ছোটোখাটো রাজবাড়ি বললেও ভুল হবে না
তারপর প্রায় দু’শো বছর ধরে রমণী চাটুজ্জ্যের বংশধররা বেশ জমিদারী মেজাজেই জীবন কাটিয়েছে ওই গাঁয়ে কিন্তু হঠাৎ এক মহামারীতে পুরো গ্রাম উজাড় হয়ে যায় তারপর বহুবছর সেই গ্রাম প্রায় জঙ্গল হয়েই পড়েছিল, কেউ সাহস করে থাকতে যেত না কারণ, স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস কোনও এক নাগা সাধুর অভিশাপে সেই মড়ক লেগেছিল কিন্তু গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে আবার ধীরে ধীরে লোক থাকতে শুরু করেছে সেই গ্রামে আর তখন থেকেই নাকি ওই ভৌতিক কান্নার শুরু প্রায়ই বাগানবাড়ি থেকে ভেসে আসে
ঋষিঃ বাপ রে, সবই তো জেনে বসে আছ! তা এত খবর পেলে কোত্থেকে?
দেবুদা ঘাড় বেঁকিয়ে বেশ একটা বিজ্ঞ হাসি হেসে বললেন, “এতদিন ধরে এসবই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি ইন্টারনেট আর তার সাথে লাইব্রেরিতে পুরনো পুঁথিপত্তর ঘেঁটে বের করেছি শুধু হুট করে বেরিয়ে পড়লেই চলবে? খোঁজখবরও রাখতে হয়, বাছা!”
কৌশিকী বেশ গম্ভীরভাবে বলল, “সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ওই মূল্যবান জিনিসদুটো কী তা তো বললে না?
দেবুদাঃ সেখানেই তো রহস্যটা! ওই দুটো জিনিসের ব্যাপারে কোথাও কিছুই পেলাম না তেমন শুধু একটা বেশ পুরনো বৈষ্ণব পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে যে কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারে বহু বছর ধরে একটি সোনার কৃষ্ণমূর্তি পূজিত হত আর তার পায়ের কাছে ‘সম্যন্তক মণি’ নামে একটি বেশ বড়ো হিরে রাখা থাকত অথচ নবাবের কৃষ্ণনগর আক্রমণের পরবর্তীকালে লেখা কোনও বইতেই ওই দুটো জিনিসের আর কোনও উল্লেখ নেই তাই আমার যথেষ্ট ধারণা যে এই দুটোই সেই অতিমূল্যবান জিনিস যা রাজা রমণী চাটুজ্জ্যেকে দিয়েছিলেন
প্রায় সাড়ে ছ’টা নাগাদ ট্রেন সোরো স্টেশনে ঢুকল ওখানেই নামল ওরা আজ রাতটা একটা লজে কাটিয়ে কাল ভোরেই রাজবল্লভপুর যাবার প্ল্যান সোরো থেকে বাসে আধঘন্টার রাস্তা

(৩)

পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ রাজবল্লভপুরে পৌঁছল ওরা লোকাল থানার ওসি দেবুদার পরিচিত আগেই জানানো ছিল সব, তাই উনি নিজেই বাসস্ট্যান্ডে হাজির ছিলেন
ওসিঃ নমস্কার দেবেন্দ্রবাবু, আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম
দেবুদা সহাস্যে প্রতিনমস্কারসহ বললেন, “আসুন, আলাপ করিয়ে দিই এরা আমার ছাত্র-কাম-বন্ধু - কৌশিকী, ঋষি, তন্ময় আর ইনি হলেন এখানকার ওসি মিস্টার সুরেশ মহাপাত্র
ওসি ওদের সাথে করে নিয়ে গেলেন বাগানবাড়ি অবধি বাড়ির সামনে যেতেই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া, আর তারই সাথে সেই হাড়হিম করা কুখ্যাত নাকি কান্নার বিকট সুর
ওসিঃ ওই শুনলেন তো? তারপরও যদি সাহস থাকে তো ঢুকতে পারেন, আমার দৌড় এই গেট অবধিই হাজার হোক, বন্দুক দিয়ে তো আর ভূতের সাথে লড়া যায় না
দেবুদা একটু মুচকি হেসে ওসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে, সাথে তিনমূর্তি
বেশ পুরোনো ভারী লোহার জং-ধরা গেট আগাগোড়া জড়িয়ে আছে লতাপাতার চাদরে পাশের দেওয়ালটাও জায়গায় জায়গায় ধ্বসে পড়েছে গেটখানা বেশ জোরেই ঠেলতে হল ভেতরে প্রায় চারদিকেই ঝোপঝাড়ে ভরা প্রকান্ড দোতলা বাড়ির দেওয়ালে বেশ জাঁকিয়ে শেকড় ছড়িয়ে বসেছে গাছগাছালি, জানালার রঙিন কাচগুলো সবই প্রায় ভেঙে গেছে আজ বহু শতাব্দীর অভিশাপে জরাজীর্ণ হয়ে পড়লেও দেওয়ালের কারুকার্য, কার্নিশের বাহার দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে এককালে জৌলুস কিছু কম ছিল না এই বাগানবাড়ির
আধভাঙা কাঠের সদর দরজাটা ঠেলে খুলতে গেল তন্ময় এক ধাক্কা দিতেই ধড়মড় করে ভেঙে পড়ল একটা কপাট ভেতরেও ঝোপঝাড়ের ছড়াছড়ি পাথরে বাঁধানো চওড়া উঠোনের মাঝে বেশ বড়ো একখানা তুলসীবেদি এখন আর তুলসীগাছ নেই, শুধুই আগাছায় ঢাকা
দেবুদাঃ সাবধানে পা ফেলে চলিস ভূত থাক বা না থাক, সাপখোপ অবশ্যই থাকতে পারে
চারদিকের প্রায় সব ঘরেই দরজাগুলো ভেঙে পড়েছে, ভেতরে আগাছারা জবরদখল করে বসেছে বহুকাল ধরে আসবাবপত্র কিছুই আর আস্ত নেই বেশ কয়েকটি ঘরে কিছু সাপও চোখে পড়ল ওদের এ-ঘর সে-ঘর ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় একটা বেজে গেল বেশ খিদেও পেয়ে গেছে সবার ঋষি সবে ব্যাগ থেকে পাউরুটির প্যাকেটটা বার করতে যাচ্ছিল তখনই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এল আর তারই সাথে দোতলার ঈশানকোণ থেকে ভেসে এল সেই কান্না! অ্যাড্রিনালিনের ফোয়ারা ছুটল সবার রক্তে এমন মুহূর্তের অনুভূতি বলে বোঝানো শক্ত ধীরে ধীরে কান্নাটা মিলিয়ে গেল বাতাসের সঙ্গে কৌশিকী ভয়ে আর উত্তেজনায় মেশানো এক কাঁপা গলায় বলল, “এবার নিশ্চয়ই ভূতের দেখা পাব
ঋষি পালটা একটা কিছু বলতেই যাচ্ছিল, মাঝে দেবুদা বললেন, “কৌশিকী, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? তোর ভূত কিন্তু বাতাসের সাথে কাঁদে! মানে, যখনই বাতাস দিচ্ছে তখনই শুরু হচ্ছে আর বাতাস থেমে গেলেই কান্নাও থেমে যাচ্ছেএখানেই আছে রহস্যখানা
তন্ময়ঃ আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলে? শব্দটা আসছে দোতলার ওইদিকটা থেকে ওখানেই কিছু একটা গোল আছে
দেবুদাঃ হুম, ঠিক বলেছিস চল, ওপরে গিয়েই দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা
অনেক খোঁজাখুঁজির পর ঝোপঝাড় সরিয়ে দোতলায় যাবার সিঁড়ি পাওয়া গেল শ্বেতপাথরে বাঁধানো সিঁড়ি, যদিও ধুলোর গাঢ় জমাট আস্তরণে শ্বেতপাথর বলে বোঝা দায়
দোতলার ঈশানকোণের দিকে এগোতেই ওদের চোখে পড়ল কষ্টিপাথরের তৈরি প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু এক যক্ষমূর্তি বেশ ভয়ানক দেখতে সাথে বিকট হাঁ করা এক মুখ, ধারালো দাঁতের ফাঁকে লকলক করেছে জিহ্বাটা হঠাৎ দেখলে বেশ গা ছমছম করে ওঠে দেবুদা প্রায় মিনিট পনেরো ধরে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন পুরো মূর্তিটা কৌশিকীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কী এত দেখছ, দেবুদা?
দেবুদাঃ অ্যাই, চট করে একটা বেশ লম্বা ঘাসের ডগা নিয়ে আয় তো
আগাছায় ভরা বাড়ি, ঘাসের ডগা আনতে বেশি বেগ পেতে হল না সেটি হাতে নিয়ে দেবুদা খুব আস্তে আস্তে মূর্তির বাঁ কানে ঢোকালেন একটু ঠেলতেই মূর্তির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ডগাখানা দেবুদার মুখে একটা হালকা হাসি দেখা দিল ব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি টর্চটা বের করে মূর্তির মুখের ভেতর আলো ফেলে তাকিয়ে দেখলেনএবার হাসিটা আরও চওড়া হয়ে উঠল
“কেল্লা ফতেহ!” বেশ একখানা গর্বের হাসি মুখে নিয়ে দেবুদা তাকালেন তন্ময়দের দিকে, “কী রে, কিছু বুঝলি?
সবার চোখেই বিস্ময়ের চাউনি ঋষি বলল, “এটুকু বুঝলাম যে বাঁ কানের ফুটোটা মুখে এসে খোলে
দেবুদাঃ “একদম ঠিক যখন দেখলাম মূর্তিটার বাঁ কানে ফুটো আছে অথচ ডান কানে নেই তখনই সন্দেহ হল ঘাসের ডগাটা ঢুকিয়ে বুঝলাম, সন্দেহটা ভুল নয় আর তারপর মুখের ভেতর আলো ফেলতেই সব খোলসা হয়ে গেল এবার কিছু ধরতে পারলি?
তন্ময় একটু মাথা চুলকে বলল, “তোমার কথা শুনে যা আন্দাজ করতে পারছি, ওই কানের ফুটো দিয়ে বাতাস ঢুকে মুখ দিয়ে বেরোয়, আর এর মুখের ভেতরই কান্নার রহস্যটা লুকিয়ে রয়েছে
দেবুদা বেশ উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বললেন, “সাব্বাশ, ঠিক ধরেছিস! এর মুখের ভেতর একখানা লোহার নলের মতো কী যেন বসানো, খুব সম্ভবত কোনও বিশেষ কায়দায় তৈরি বাঁশি কানের ফুটো দিয়ে বাতাস ঢুকে যখন এই বাঁশির মধ্য দিয়ে বেরোয় তখন সেই শব্দই কান্নার সুরের মতো শোনায়, আর বাকি কাজ করে এই ফাঁকা বাড়ির দেওয়ালগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে সেই কান্না আরও বিকট হয়ে শোনা যায়
কৌশিকী একটু দমে গিয়ে বলল, “তাহলে ভূত নেই?
ঋষিঃ না রে বোকা, সবই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কেরামতি
এরই মাঝে তন্ময় মূর্তির মুখে হাত ঢুকিয়ে বাঁশিটা ধরার চেষ্টা করছিল হঠাৎ একটু জোরে টান দিতেই বাঁশিখানা খুলে এল আর তারই সাথে এক বিকট ঘড়ঘড় শব্দ, বাড়ির উঠোন থেকে! চমকে তাকাল ওরা নিচের দিকে আজব কান্ড! পাথরের তুলসীবেদিখানা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে! চারজনেই ছুটে নিচে নামলতুলসীবেদি সরে গিয়ে তার নিচে এক গভীর সুড়ঙ্গপথের মুখ খুলে গেছে সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে নেমে গেছে অতল অন্ধকারে, মাটির তলায়
সবাই হতবাক এই কান্ড দেখে এ যে তাদের কল্পনার বাইরে কৌশিকী বলল, “এ তো বিশালরকম কলকব্জা গো দেবুদা, ওই বাঁশি আসলে এই সুড়ঙ্গের চাবি!”
দেবুদাঃ সবাই জলদি টর্চগুলো বের কর কৌশিকী, কার্বলিক অ্যাসিডের বোতলটা এনেছিস? আমায় দে ওটা আমি আগে ঢুকব, তোরা খুব সাবধানে একে একে আমার পেছনে আয়
ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল ওরা সিঁড়িগুলো বেশ নিচে নেমেছে অনেকটা নামার পর শেষ হল ব্যাগ থেকে নিয়ন ল্যাম্পখানা বের করে জ্বালাল ঋষি নিয়ন আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল, ভূগর্ভে কয়েকশো বছর ধরে লুকিয়ে থাকা সেই গুপ্ত কুঠুরিটি হঠাৎ ওদের চোখ পড়ল সামনের বেদিতে আনন্দে, উত্তেজনায় চকচক করে উঠল ওদের চোখমুখ দেবুদা চিত্কার করে উঠলেন, “ইউরেকা, পেয়ে গেছি রাজার ধন!”
বেদির ওপর রাখা ছিল শ্রীকৃষ্ণের সেই সোনার মূর্তি কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল ওরা মূর্তিখানা সোনার ওপর এমন অসাধারণ সূক্ষ্ম কাজ আগে কখনও দেখেনি ওরা কেউই
দেবুদা বললেন, “মূর্তি যখন পেয়েছি ওই হিরেটাও এখানেই থাকবে
কিন্তু মূর্তির পায়ের কাছে যেখানে হিরেটা থাকার কথা সেখানে বেশ গভীর এক ছিদ্র!
দেবুদা তীক্ষ্নদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন ওটার দিকে“কী হবে জানি না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখি, জয় শ্রীকৃষ্ণ!” বলেই বাঁশিখানা ওই ছিদ্রে পুরে দিলেন বেশ খাপে খাপে ঢুকেও গেল বাঁশিটা আর সঙ্গে সঙ্গে বেদির সামনের একটু অংশ ফাঁক হয়ে গেলজ্বলজ্বল করে উঠল সম্যন্তক মণি!

(৪)

রাত ন’টার ট্রেনে উঠল ওরা হাওড়া পৌঁছতে বেশ রাত হবে
তন্ময়ঃ দেবুদা, ওসিকে কী বললে?
দেবুদাঃ বলেছি ওই কান্না আর শোনা যাবে না তবে মূর্তি আর হিরের কথা বলিনি বললেই শুধু শুধু একটা বিশাল হৈচৈ পড়ে যেত কাল সকালেই ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গিয়ে জমা করে দেব এই ঐতিহাসিক জিনিসদুটো তোরাও আসবি কিন্তু সঙ্গে
ঋষি একগাল হেসে বলল, “তা আর বলতে!”
কৌশিকী একটু কৌতূহলের সুরেই বলল, “আচ্ছা দেবুদা, বাঁশিটা দেবে না মিউজিয়ামে?
হালকা একটা হাসির ঝলকানি দেখা দিল দেবুদার মুখে “না রে, ওটা আমাদের কাছেই থাকবে রাজবল্লভপুরের স্মৃতিচিহ্ন
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়

1 comment: