গল্পের ম্যাজিক:: মেঘবালিকা ও রহস্যময় উড়ান - দেবব্রত দাশ


মেঘবালিকা ও রহস্যময় উড়ান
দেবব্রত দাশ

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে যে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল শিঞ্জিনীর, এখন আকাশে ছত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় বিমানের মধ্যেও তার থেকে অব্যাহতি পায়নি সে। ‘ভারতী এয়ারলাইন’-এর বৈকালীন উড়ানে মুম্বই থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে খাবারের ট্রলি নিয়ে প্যাসেজে ঢুকে অভ্যাসমতো সে এগিয়ে যায় ধীর গতিতে। যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়, কার কী প্রয়োজন। তেইশের তরুণী শিঞ্জিনী সামন্ত প্রায় প্রতিদিনই উড়ে বেড়ায় মেঘের দেশেউড়তে সে ভালোবাসেশিশুবেলার দিনগুলো থেকেই রঙিন কল্পনার বেলুনে চেপে পাড়ি দেয় দূর নীলিমায়। যখন পিঠে বইভর্তি ঢাউস ব্যাগ নিয়ে মায়ের হাত ধরে যশোর রোডে নিউ ব্যারাকপুর স্টপেজে স্কুল বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াত, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখত আকাশে ওড়ার, বিমানসেবিকা হওয়ার। দিনের মধ্যে বহুবার শিঞ্জিনী তাদের দোতলা বাড়ির ছাদে উঠে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আকাশপানে চেয়ে থাকত। মেঘের সাথে ভেসে আসা দেশবিদেশের রঙবেরঙের উড়োজাহাজগুলো তার শিশুমনে জন্ম দিয়েছিল স্বপ্নের। বড়ো হয়ে লালিত সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টায় ধাপে ধাপে এগিয়ে আজ শিঞ্জিনী সফল। নিজেকে সে পরিচয় দেয় ‘মেঘবালিকা’ বলে। জয় গোস্বামীর কোনও এক কবিতায় বিমানসেবিকা’-র সুন্দর প্রতিশব্দ মেঘবালিকা’-র সন্ধান পেয়ে শব্দটা সে চাউর করে দিয়েছিল বন্ধুমহলেতার অবাঙালি সহকর্মীরা পর্যন্ত এই নামে অভ্যস্ত এখন। শুধু তাই নয়, মেঘবালিকাকে তারা অন্তর দিয়ে আপন করে নিয়েছে। এই চাকরিতে আড়াই বছরেরও কিছু বেশি সময় যুক্ত থেকে আজ ২০১৫-র ২১ সেপ্টেম্বর অন্যরকম একটা দিনআশ্চর্য!  সে যেন আগেভাগেই বিপদের গন্ধ পেয়েছে! এমন অনুভূতি বোঝাতে ইংরেজিতে hunch শব্দটাই যথাযথ। শিঞ্জিনীর চোখেমুখে এমন কিছু ছাপ ফুটে উঠেছিল, যা দেখে তার মা বলেছিলেন, “আজ না হয় কাজে যাসনে তুই শিঞ্জু, ফোন করে জানিয়ে দে তোর অফিস-বসকে যে, অনিবার্য ব্যক্তিগত কারণে যেতে পারছিস নাছুটি চাই।
তুমি কী যে বলো না মা!জবাবে বলেছিল শিঞ্জিনী, “ওরা কি আমার মুখ দেখে মাস গেলে অতগুলো টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়? তা যখন করে না, হুট বলতেই ছুটি চাওয়াও যায় না। আগে বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ দিয়ে তবেই না! তুমি ঠিক বুঝবে না মা কতটা চাপে থাকি আমরা!”
প্যাসেজের মাঝামাঝি পৌঁছে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই শিঞ্জিনীর চোখে পড়ে শরতের বৃষ্টিধোয়া ঘন নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো টুকরো মেঘের দল নিচ দিয়ে ভেসে চলেছে আপন মনে। সামনেই বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গাপুজো। সেকথা মনে পড়তেই মনখারাপ হয়ে গেল তার। মাকে নিয়ে এবারেও মামাবাড়ি যাওয়া হবে না, দেখা হবে না কলকাতার মনমাতানো সব পুজো। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলো খুব মিস করে শিঞ্জিনী। মুম্বইতে আসার পর মাত্র একবারই সে আর তার মা কলকাতায় গিয়েছিল বাংলা নববর্ষে পাঁচদিনের ঝটিকা সফরে। এমনই অদৃষ্ট যে, কাজের সুবাদে কলকাতার মাটি ছুঁতে হয় সপ্তাহে অন্তত তিনবার আর তারপর ফিরে যেতে হয় মুম্বই! যাত্রীদের উদ্দেশে মাইক্রোফোনে বিমানচালক সুনীল গ্রোভারের ঘোষণায় চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শিঞ্জিনীর
এই মুহূর্তে আমরা জামশেদপুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছি। আর মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে যাব কলকাতার নেতাজী সুভাষ বিমানবন্দরের আকাশে।”
আশ্চর্য! বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে শিঞ্জিনীরআবার সেই অস্থিরতাহঠাৎ করে বেড়ে শতগুণ হয়ে গেছে কিন্তু কেন, তা সে জানে না। আসলে, কীসের যে অস্থিরতা, সেটাই তো জানা নেই তার! প্যাসেজের প্রায় শেষপ্রান্তে চলে এসেছিলযার যা নেওয়ার নিয়ে নিয়েছেএবার সে ট্রলির অন্যপ্রান্তে গিয়ে উল্টোমুখী হল আর ঠিক তখনই সামনের দিকের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে নজর গেল তার এবং যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে তার মেরুদণ্ড বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল হিমশীতল শিহরন। কেমন করে সম্ভব হচ্ছে? তাদের বিমানের সম-উচ্চতায় একই অভিমুখে সম-গতিসম্পন্ন আরেকটি বিমান! ডানায় ডানা ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রায়! শিঞ্জিনীর গলা থেকে ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল আর একটু হলেইশেষমুহূর্তে অতি কষ্টে সংযত করল নিজেকে। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারে না সে তেমন ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। তার এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের উড়ান-জীবনেও সে জানালা দিয়ে অনেকবারই দেখেছে ভিন্ন উচ্চতায় এবং নিরাপদ দূরত্বে উড়ে যাওয়া অন্য বিমান – উপরে বা নিচে কিন্তু এখন যা দেখল... ভাবতে গিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আবার চোখ চলে গেল বাইরে এবং যে দৃশ্য দেখল এবার, তাতে তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়ডানায় ডানা ছুঁয়ে যাচ্ছে দুই উড়োজাহাজের! অথচ বিমানচালক দু’জনের কারওরই কোনও প্রতিক্রিয়া নেই! অদ্ভুত কাণ্ড! কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে? ভাবতে গিয়ে শিঞ্জিনীর মাথা কাজ করে না, শূন্য দৃষ্টি মেলে সামনের দিকে তাকায়। ক্যামেরার লেন্স জুম করলে আউট-ফোকাস ছবি যেমন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ঠিক সেভাবেই ফুটে ওঠে অন্য দুই মেঘবালিকা প্রিয়াঙ্কা আর মেঘার অবয়বনিজেদের মধ্যে কথায় মশগুল ওরা! ট্রলি ফেলে রেখে দিয়ে দ্রুত সেদিকে পা বাড়াল শিঞ্জিনী কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই বিমানচালকের ঘোষণা, “কলকাতায় এই মুহূর্তে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দরুন আমরা চলেছি ভুবনেশ্বর অভিমুখে
কী আশ্চর্য!শিঞ্জিনী চিৎকার করে ওঠে, “এ তো সুনীল গ্রোভারের কণ্ঠস্বর নয়! তোরা বুঝতে পারছিস না মেঘা-প্রিয়াঙ্কা?”
প্রায় ছুটে প্যাসেজ অতিক্রম করে ওদের সামনে পৌঁছে যায় সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তোরা কী রে! সুনীলের...
কথা শেষ হওয়ার আগেই ককপিটের দরজা সশব্দে খুলে গিয়ে সহ-চালক উমেশ মঞ্জরেকরের বিশাল দেহ ছিটকে এসে পড়ল ওদের পায়ের কাছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা ভেতরদিক থেকে বন্ধ হয়ে গেল। মাথায় চোট পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে উমেশ। চিত অবস্থায় ঊর্ধ্বমুখী সে, চোখ বন্ধ। বোতল খুলে জল নিয়ে মেঘা উমেশের চোখেমুখে ছেটাতে থাকে। হতচকিত প্রিয়াঙ্কা কী করবে বুঝতে পারে না। ইতিমধ্যে সামনের দিকের আসন থেকে কয়েকজন যাত্রী উঠে আসছে দেখে সে হাতের মাইক্রোফোন চালু করে সবাইকে উৎকণ্ঠিত না হয়ে চুপচাপ নিজেদের জায়গায় বসে থাকতে অনুরোধ করল। বনবন করে মাথা ঘুরে উঠেছিল শিঞ্জিনীরথরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফ্লোরেই বসে পড়ে এখন সে বুঝতে পেরেছে, কেন আজ সকাল থেকেই বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। বিমানচালকের মাইক্রোফোন সরব হয়ে উঠল আবার, “ভুবনেশ্বরেও আবহাওয়া ল্যান্ডিংয়ের পক্ষে অনুকূল নয়। এ.টি.সি-র নির্দেশে এখন তাই চলেছি চেন্নাইআরও কত শত কথাকিছুই কানে ঢোকে না শিঞ্জিনীরসে মেঘা আর প্রিয়াঙ্কার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “এ কণ্ঠস্বর তো পবন পিল্লাইয়ের! অদ্ভুত ব্যাপার! সুনীলের গলা যে নয়, তা বুঝতে পারছিস না তোরা?” বলতে বলতে শিঞ্জিনী দ্রুত চলে যায় সেই জানালার কাছে, যেখান দিয়ে খানিক আগে দেখেছে অন্য এক বিমানের অভাবিত অকল্পনীয় উপস্থিতিআর এখন? এখন কী দেখতে পাচ্ছে সে? তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে থাকে ক্রমশ, অবশ হয়ে আসে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। চিনতে তার ভুল হচ্ছে না একটুওঅন্য বিমানের ককপিটে বসে মুখে নিষ্ঠুর কুটিল হাসি ফুটিয়ে তুলে হিমশীতল দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে আছে পবন পিল্লাই। শিঞ্জিনীর চাকরি-জীবনের একেবারে শুরুতে অর্থাৎ, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারির পর পবনের সঙ্গে শিঞ্জিনীর দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবারবাক্য বিনিময়ও হয়েছে দু’জনের মধ্যে কণ্ঠস্বর তাই খুবই চেনা, অথচ হিসেব মিলছে নাপবন তো ২০১৪-র ৮ মার্চ কুয়ালালামপুর থেকে টেক অফ করে রওনা হয়েছিল বেজিং-এর উদ্দেশ্যেকিন্তু...
মেঘার ডাকে সংবিৎ ফেরে শিঞ্জিনীরকী দেখছিস অমন করে জানালা দিয়ে! চল ওদিকে, উমেশের সেন্স ফিরে এসেছে এইমাত্র।”
মেঘার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে শিঞ্জিনীদ্যাখ দ্যাখ, কে বসে আছে ককপিটে! পবন পিল্লাইকে তুই চিনতে পারছিস না, মেঘা?”
পবন পিল্লাই? ককপিটে! প্লেন কোথায়?”
এই তো আমাদের প্লেনের পাশেই,” জোর দিয়ে বলে ওঠে শিঞ্জিনী, “ককপিটে পবনকে দেখতে পাচ্ছিস না তুই?”
না না, দেখতে পাচ্ছি না আমি।” গলা চড়িয়ে বলে মেঘা, “নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর, শিঞ্জিনী! আসল কথাটা শোন। উমেশ যা বলল তা যদি সত্যি হয়, তবে তো আমরা সবাই ভয়ংকর বিপদের মধ্যে রয়েছি। সুনীল গ্রোভার নাকি কোনও জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের নির্দেশেই আমাদের প্লেন হাইজ্যাক করে নিয়ে চলেছে অন্য কোনও দেশে!”
মেঘার কথাকে পাত্তা না দিয়ে আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায় শিঞ্জিনী“এই তো, এই জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, কী দেখছিস? একটা প্লেন দেখতে পাচ্ছিস তো? আর ককপিটে বসে আছে যে পাইলট মানে পবন পিল্লাই, তাকে তুই দেখিসনি কোনওদিন, নাকি! বেশি আগের ঘটনা তো নয়! ২০১৪-র ৮ মার্চ। মনে পড়ছে? পবন পিল্লাই সেদিন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন’-এর ফ্লাইট নাম্বার ৩৭০-এর পাইলট কুয়ালালামপুর থেকে টেক অফ করে বেজিং যাওয়ার কথা, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে পবন একেবারে অ্যাবাউট টার্ন করে দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের দিকে উড়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল এবং আজও মানে এই সেপ্টেম্বর অবধি বিভিন্ন দেশের তদন্ত কমিটি সবরকমের অনুসন্ধান চালিয়েও সন্ধান পায়নি সে প্লেনের, পায়নি ব্ল্যাক বক্স, ভগ্নাবশেষ বা কোনও যাত্রীর দেহ। আর পবনের অমন অস্বাভাবিক আচরণেরও যুক্তিগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কমিটিগুলো... এসব খবর তুই জানিস না?”
জানি, তবে তোর মতো এরকম বিস্তারিতভাবে মনে রাখতে পারিনি
ওই তো পবন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, দ্যাখ দ্যাখ!
কেউ নেই, কিচ্ছু নেইস্রেফ হ্যালুসিনেশন!বিব্রত বিক্ষুব্ধ মেঘা বলে ওঠে, “তুই এবার থামবি, শিঞ্জিনী?
পড়ি কি মরি করে ছুটে আসে প্রিয়াঙ্কা যথাসম্ভব নিচু গলায় বলে, “দু’জনে মিলে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস বল তো! ওদিকে চল, উমেশের ককপিটে ঢোকাটা খুবই জরুরি। আমাদের মরণ বাঁচন নির্ভর করছে ওর ঢুকতে পারা না পারার ওপরকী যে আছে কপালে!
উমেশ জনা চার-পাঁচ তরুণ যাত্রীর সাহায্যে শেষমেশ বন্ধ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে পারল এবং সুনীলকে সবাই মিলে জাপটে ধরে বাইরে নিয়ে এল আর উমেশও মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বসে পড়ল চালকের আসনে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল থেকে ধেয়ে আসতে লাগল অসংখ্য প্রশ্নবাণ। খুব সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় রইল উমেশ। আর ঠিক তখনই হঠাৎ জ্বলে উঠল লাল আলো এবং সংকেত জানিয়ে বাজতে শুরু করল অ্যালার্ম।
মেঘা মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিয়ে যাত্রীদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে যেতে লাগল বারবার“আপনারা এ সময় প্যানিকি হবেন না, সমস্যা তাতে বাড়বে বই কমবে না। আমরা নিকটতম বিমানবন্দরে দ্রুত অবতরণের চেষ্টা চালাচ্ছি। সবাই শান্ত থাকুন আর সিট বেল্ট বেঁধে ফেলুন চটপট।”
ইন্ডিকেটরের দিকে তাকাতেই উমেশ বুঝতে পারল, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে জ্বালানি আর সেজন্যেই বাজছে বিপদ সংকেত যেটুকু গ্যাসোলিন অবশিষ্ট আছে, তাতে খুব বেশি হলে আধঘণ্টা ওড়া সম্ভব। জি.পি.এস দেখাচ্ছে, প্লেন চেন্নাই ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে প্রায় রামেশ্বরমের কাছে চলে এসেছে। এ.টি.সি’ সবচেয়ে কম দূরত্বের তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে অবতরণের নির্দেশ দিল। জি.পি.এস অনুসরণ করে দ্রুত বিমানের অভিমুখ ঘোরাল উমেশ। এ.টি.সি’কে জরুরি বার্তা পাঠাল – ফুয়েল প্রায় নিঃশেষিত, তলানিতে ঠেকেছে।
তিরুবনন্তপুরমের রানওয়ে ছোঁয়ার একটু আগেই ভাঁড়ার একেবারে শূন্য হয়ে জেট ইঞ্জিনগুলো বন্ধ হয়ে গেল। শুধুমাত্র গতি জাড্যের ওপর ভরসা রেখে উমেশ বিমানটিকে অনুভূমিকভাবে ভাসিয়ে অবতরণের শেষ চেষ্টা করল। কিন্তু মাটি স্পর্শ করবার মুহূর্তে প্রবল ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল বিমানের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সমস্তটা এবং সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করে একদিকে কাত হয়ে পাল্টি খেয়ে গেল।
ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের বিপদ সামলানোর সবরকম ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। ফুয়েল অবশিষ্ট না থাকায় আগুন ধরে যাওয়ার বিপদ এড়ানো গেল বটে, কিন্তু অল্পবিস্তর আহত হল প্রায় সব যাত্রীই। বিমানকর্মীদের মধ্যে একমাত্র প্রিয়াঙ্কার আঘাতই গুরুতর। হেড ইনজুরি। অন্যরা প্রায় অক্ষত। সব মিলিয়ে ১৬৮ জন যাত্রীর মধ্যে ২৩ জনকে রেখে বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পাট চুকিয়ে ছেড়ে দিল হাসপাতাল। নানান মিডিয়ার লোকজনের শত-সহস্র প্রশ্নবাণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে শিঞ্জিনী যখন তিরুবনন্তপুরমের হোটেলের রুমে ঢুকল, তখন সে পুরোপুরি বিধ্বস্ত। শরীরে ও মনে। উড়ান চলাকালীন চাপটাই এখনও সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবুও একটা কাজ তার কাছে প্রায়োরিটি পেল। মুম্বইতে ফোন করা। টেলিভিশন, রেডিও আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া খবর শুনে উদ্বিগ্ন মাকে আশ্বস্ত করতে হিমশিম খেল শিঞ্জিনী। খুব সংক্ষেপে বলল, “আমি একদম ঠিক আছি, একটুও চিন্তা কোরো না আমাকে নিয়ে। তিরুবনন্তপুরম থেকে কাল বাড়ি ফিরে সব খুলে বলব তোমায়, মা।”
ক্লান্ত বিধ্বস্ত শিঞ্জিনী কোনওরকমে মুখে কিছু দিয়ে যখন বিছানায় আশ্রয় নিল, তখনও তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একের পর এক দৃশ্য। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের রূপরেখাও স্পষ্ট দেখতে পেল সে। সুনীল গ্রোভারকে এখনই সাসপেন্ড করা হবে। গঠিত হবে তদন্ত কমিটি। দিন পনেরো কি বড়োজোর মাসখানেক বিভিন্ন সংবাদপত্রের ও অন্যান্য মাধ্যমের প্রতিনিধিরা তাদের প্রতিবেদনে এই রোমাঞ্চকর উড়ান নিয়ে মাতামাতি করবে, কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টও জমা পড়বে শিগগির, কিন্তু তারপর? আর পাঁচটা ঘটনার মতো মানুষ ভুলেও যাবে একসময়, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। ভুলতে পারবে না সে নিজেকেমন করে ভুলবে যা সে দেখেছে স্বচক্ষে বহু সময় ধরে? অবশ্য সে মুখ খোলেনি কারও কাছে, কারণ বিষয়টা যুক্তি-বুদ্ধির গণ্ডির বাইরে, গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা তার জানা নেই। অথচ এই মুহূর্তে এমন ক্লান্ত শরীরে দু’চোখ যখন ঘুমে বুজে আসছে, তখনও শিঞ্জিনী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পবন পিল্লাইয়ের ভয়ংকর হিংস্র দুটি চোখ এবং ব্যর্থ হওয়ার দরুন ক্রমশ যেন হয়ে উঠছে আরও ভয়ংকরমালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের ফ্লাইট নাম্বার ৩৭০-এর মতো অন্য উড়ানেরও একই পরিণতি ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে পবনের বিদেহী আত্মাশিঞ্জিনীর মন একথা বলছে, সে তো ভুল দেখেনিআর সুনীল গ্রোভারের উন্মাদের মতো আচরণ? কোনওটাই মিথ্যে নয়তবে কি সে নিজের মুখ বন্ধ রেখে ভুল করল? নাকি সুনীল এবং সে দু’জনেই সাময়িক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ পুরোটাই মন-ঘটিত? ভাবতে ভাবতে ঘুমের গহিন সায়রে তলিয়ে গেল মেঘবালিকা শিঞ্জিনী।
_____
অলঙ্করণঃ পার্থ মুখার্জী

1 comment:

  1. Meghbalika Sinjini tar choritro te besh maniyeche. Tar jibon er akankha, j se airhostess hobe seta tar kaj e jawa r iccha ( tar maa r mana kora o tar nijer ekta hunch thaka sotteo) te prokash pacche.
    Ebar asi golper asol plot e. Puro golpo tar ghotona gulo emon bhabe sajano o tar britanto eto nikhut bhabe dewa j amar mone holo jeno choker samne pordai action cinema dekhchi. Sotti bhalo.
    Rohoysho golpe onek kichui unexplained thake jodio, ekta beypar ektu sposto hole aro bhalo hoto. Sinjini e kano sudhu Pawan Pillai r tar plane k dekhte pelo? Megha ba onno keo noi. Or ki Pawan Pillai r sathe khub ghonisto somporko chilo? Megha o to chinto Pawan Pillai k. Tobe ki seta Sinjini r sotti moner bhul? Bhul jodi hoi, o bar bar ek e drishyo dekhbe kano?
    Baki j tuku rohoysho golpe suspence thakte hoi etate seta chilo.
    Thriller golpo hisebe eta sarthok amar motey.

    ReplyDelete