গল্পের ম্যাজিক:: মেঘনাদবধ - বিভাবসু দে


মেঘনাদবধ
বিভাবসু দে

আমাদের আর্যদা, লোকটা ভালো কিন্তু বেজায় হুজুগে হঠাৎ হঠাৎ যখন একেকটা শখ মাথায় চাপে তখন সেটা না করা অবধি শান্তি নেই এই তো মাস দেড়েক আগের কথা, কমনরুমে বসে আমরা চার-পাঁচজন ক্যারাম খেলছি, হঠাৎ বলে উঠল, "এই পল্টু, বলছি আর দু'হপ্তা পরেই তো কলেজ ফেস্ট, পার্টিসিপেট করলে কেমন হয়?"
শুনে তো আমরা ! ফেস্টে পার্টিসিপেট করব আমরা! সাংস্কৃতিক কাজকর্মে আমরা সকলেই যে কত বড়ো মাপের কৃতবিদ্য সে আস্ত কলেজে কারোরই অজানা নয় একেকজনের যা গলা, গান ধরলে নির্ঘাত প্রিন্সিপাল স্ট্রোক করবেন এই তো সেবার পুজোর আগে পল্টুর শখ হয়েছিল গান শিখবে, রীতিমতো হারমোনিয়াম কিনে রেওয়াজও শুরু করে দিয়েছিল প্রথমদিন যখন হারমোনিয়ামখানা নিয়ে সপ্তমে গলা ছাড়ল, এই ধরুন মিনিট পাঁচেক হবে গলা সাধা শুরু করেছিল, বাড়ির উঠোন লোকে লোকারণ্য! সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, "দাদা কিছু হয়েছে? এত কান্নাকাটি কিসের?"
ওদের বোঝাতে গিয়ে পল্টুর বাবার সেকি নাজেহাল দশা! লোকজন প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে বাড়িতে কেউ মারা গেছে, তাই এমন কান্নার রোল উঠেছে পরে যখন জানাজানি হল যে পল্টুবাবু সংগীত-সাধনা করছিলেন তখন যে কী হাসির ঢল নেমেছিল তার পাড়ায়, সে আর কী বলব! লোকে প্রায় হেসে গড়াগড়ি যায় আর কিদুয়েকদিন তো পল্টুর বাড়ি থেকে বেরোনো দায় হয়ে পড়েছিল, যে দেখে সেই জিজ্ঞাসা করে, "কি হে 'সা রে গা মা পা'- অডিশনে কবে যাচ্ছ?"
যদ্দূর জানি তারপর পল্টু আর এ জন্মে হারমোনিয়াম ছোঁয়নি
আমরাও ওই একই গোয়ালের গরু! সংগীতের সঙ্গে ইহজন্মে আমাদের সঙ্গত হওয়ার কোনও আশা নেই, আর রইল বাকি নাচ.... ভাসানে একশো লোকের ভিড়ে উদ্দাম লাফানোকে যদি নাচ বলা যায় তবে সেটা একটু আধটু পারি বটে, কিন্তু হলপ করে বলছি ভাই সে জিনিস স্টেজে উঠে করলে পাবলিক পচা ডিম, টমেটো, জুতো যা পাবে তাই ছুঁড়ে মারবে
কথাটা আর্যদাকে বললাম কিন্তু উনি হলেন আর্যদা, মাথায় যখন ভূত চেপেছে তখন রেহাই নেই কারও। টকাস করে ক্যারামের একটা ঘুঁটি পকেটে ফেলে বেশ স্লো-মোশনে সোজা হয়ে দাঁড়াল, মুখে বেশ একখানা বিজ্ঞ হাসি বুঝলাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘুরছে লোকটার মাথায়
"বলি ফেস্টে কি শুধু গান আর নেত্তই হয়? আর কিছু হয় না?"
আর্যদার প্রশ্নে বেশ গম্ভীরভাবে কেল্টু বলল, "আবৃত্তি করতে বলছ নাকি?"
"দূর পাগল, এই বয়সে আবৃত্তি কেন করতে যাব, ওসব তো স্কুলের বাচ্চারা করে! আমরা নাটক করব"
আর্যদার কথায় আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ! বলে কী, নাটক! আমি কাতরস্বরে বললাম, "আর্যদা, লক্ষ্মীটি, শুধু শুধু পাবলিকের মার খেয়ে লাভ কী বল? আমরা নাটকের - জানি না"
আমার কাঁধে হাত রাখল আর্যদা, "শোন, স্বামীজী বলেছেন, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা মানে যে বীর এই বিশ্ব তার, আর তুই কিনা আগেই হার মেনে নিচ্ছিস জানিস না তো কী হল, আমি শিখিয়ে দেব, এখনও তো পুরো দু'সপ্তাহ বাকি"
পল্টু বলল, "তুমি শিখিয়ে দেবে মানে? তুমি আবার কোনকালে নাটক করতে?"
আবার গালভরা বিজ্ঞমার্কা হাসি নিয়ে আর্যদা বলল, "শম্ভু মিত্তিরের নাম শুনেছিস? বাংলা নাটকের প্রবাদ পুরুষ"
"হ্যাঁ, কিন্তু উনি তো অনেক আগেকার লোক তুমি আবার কবে তাঁর কাছে নাটক শিখলে?"
"নাটক শিখতে হয় না রে বোকা, রক্তে থাকা চাই শম্ভু মিত্তিরের একমাত্র শ্যালকের বোনের ছেলের মামাশ্বশুর যিনি ছিলেন তিনি হলেন গিয়ে আমার দাদুর মামাতো ভাইয়ের মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাই"
আর্যদার সঙ্গে শম্ভু মিত্রের রক্তসম্পর্কটা যে একেবারে জলের মতো স্পষ্ট তা বুঝতে আর কারও বাকি রইল না বার দুয়েক মাথা চুলকে বুম্বা বলল, "আচ্ছা, তুমি না হয় শম্ভু মিত্রের আত্মীয় হলে, নাটক একেবারে তোমার রক্তে চনমনিয়ে বয়ে চলেছে, কিন্তু আমরা তো কোনোকালে নাটকের ত্রিসীমানা মাড়াইনি"
"তুই কি ভাবিস যারা নাটক বা সিনেমা করে খুব বেজায় রকম ভালো অভিনয় জানে? ওসব কিস্যু না, লুক-টাই আসল চিজ কাকা! অভিনয় না জানলেও হিরো-হিরো ভাবটা থাকা চাই, ওটাই আসল আর তুই তো নামেও হিরো, একেবারে বুম্বাদার নামে নাম, তোর জন্মই হয়েছে স্টেজের জন্য আর রইল পড়ে ডায়লগ, সে রোজ বাড়ি বসে মুখস্থ করবি আর কলেজের পরে একবার করে সবাই রিহার্সেল করব ব্যস, দু'সপ্তাহে একেবারে রেডি"
নিজের প্রশংসা শুনে মজে না এমন লোক বিরল প্রসেনজিতের সঙ্গে নিজের যে একটা ভীষণরকম সাযুজ্য রয়েছে সেটা শুনে বুম্বাও নাটকের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠল আর্যদার এটা একটা বিরাট গুণ, যে কোনও বিষয়ে লোককে রাজি করাতে একেবারে ওস্তাদ এবারও তাই হল একে একে বুম্বা, পল্টু, কেল্টু সবাই রাজি হয়ে গেল, আর অগত্যা আমাকেও নাটকে সামিল হতে হল
আমি বললাম, "তা আর্যদা সবই তো বুঝলাম, কিন্তু কী নাটক করবে কিছু ভাবলে?"
হাত থেকে ক্যারামের পাউডার ঝাড়তে ঝাড়তে বেশ সরস ভঙ্গিতে উনি বললেন, "আর্য চৌধুরী হাওয়ায় কথা বলে না নাটক আগেই ভেবে রেখেছি, ডায়লগ তো স্বয়ং মধুদা লিখেই দিয়েছেন, ব্যস এবার কাল থেকে রিহার্সেল"
"কোন নাটক? আর এই মধুদা আবার কে? থার্ড ইয়ারের মধুময়-দা?"
"হাসালি তুই! আমি বলছি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা আর ইনি বলেন কিনা মধুময়-দা! 'মেঘনাদবধ' করব, একেবারে জমে ক্ষীর হয়ে যাবে"
পল্টু বলল, "মেঘনাদবধ? মানে ওই ক্লাস নাইনে না টেনে যেন পড়েছিলাম, সেটা?"
"হ্যাঁ রে, ওটাই করব দারুণ নাটক একে তো মাইকেলের লেখা, একটা ট্রেডিশানাল বাঙালি সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে, তার উপর আরেকটা প্লাস পয়েন্ট হল ব্যাপারখানা রামায়ণ নিয়ে তাহলে একটা রিলিজিয়াস আঙ্গিকও রইল; আজকাল এমনিতেও প্রচুর রামভক্ত লোকজন আছে তোদের কোনও চাপ নেই, আমি ডিরেক্টর কাম মেঘনাদ হচ্ছি পল্টু হবে বিভীষণ আর কেল্টু রাবণ আর বুম্বা, তুই হবি স্বয়ং লক্ষ্মণ আর তোকে ভাবছি..........."
আমার দিকে তির এগোচ্ছে বুঝেই প্রায় আর্যদার কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, "প্রোডাকশন ম্যানেজার সবাই স্টেজে গেলে চলে নাকি? আমি না হয় নেপথ্যখানা সামলাই"
আর্যদা একটু ভেবে বলল, "বলছিস? আচ্ছা, ঠিক আছে তবে তুই প্রোডাকশন আর স্টেজ ডেকোরেশনটা সামলে নে"
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আর্যদার এসব হুজুগে যতবার জড়িয়েছি শেষ অবধি কিছু না কিছু কেলো হয়েছেই তবু সবার চাপে পড়ে থাকতেই হয়; কিন্তু এবার আমি নেপথ্যে, নো টেনশন
পরদিন সকালেই স্ক্রিপ্টের একেকটা কপি এনে পল্টুদের হাতে ধরিয়ে দিল আর্যদা কলেজ ছুটির পর শুরু হল আলোচনা সবাই স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসল, কিন্তু পড়তে গিয়ে তো বেহাল দশা আর্যদা একেবারে সোজা মেঘনাদবধ কাব্যের বই থেকে ফটোকপি করে নিয়ে এসেছে মাইকেলের কবিতা, দেখে দেখে পড়তেই দাঁত ভাঙে আর এসব কিনা স্টেজে মুখস্থ বলতে হবে!
কিন্তু আর্যদা কি ছাড়ার পাত্র! "পারবি তোরা, চেষ্টা কর, আলবাত পারবি এই দেখ, আমি প্রথম দৃশ্যের মেঘনাদের ডায়লগ বলছি," বলে স্ক্রিপ্ট ছাড়াই উঠে দাঁড়িয়ে দু'হাত নেড়ে বলতে শুরু করল....
"হে দক্ষ-কুল-পতি,
শুনেছি, মরিয়া নাকি নাচিয়াছে পুনঃ
রাঘব-বোয়ালে? মায়া, পিতঃ......"
মাঝপথে হঠাৎ আমি বাদ সাধলাম, "এসব কী পড়ছ আর্যদা? দক্ষ, রাঘব-বোয়াল এসব আবার কোথায় পেলে?"
বেশ কটমটিয়ে একবার তাকাল আমার দিকে, "তোর সবেতেই ওস্তাদি! প্রথম সর্গের সাত নম্বর পাতার নিচদিকে তাকিয়ে দেখ"
স্ক্রিপ্ট খুলে তো আমার চোখ ছানাবড়া, বললাম, "পুরোই তো ভুলভাল বলছ এতে লেখা আছে..... হে রক্ষ-কুল-পতি/ শুনেছি, মরিয়া নাকি বাঁচিয়াছে পুনঃ/ রাঘবে? মায়া, পিতঃ বুঝিতে না পারি!"
কিন্তু আর্যদাকে বোঝায় কার সাধ্যি, বললে, "দেখ কেউ যদি মরে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে তাহলে সে তো নাচবেই তাই 'বাঁচিয়াছে' আর 'নাচিয়াছে' এখানে সমার্থক হল আর যাহা রাঘব তাহাই রাঘব-বোয়াল ওই রাগের মাথায় মেঘনাদ রাঘবকে রাঘব বোয়াল বলছে আর কি!"
"চমৎকার যুক্তি বটে, কিন্তু সেটা পাবলিককে বোঝাতে পারবে?"
আর্যদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মাঝে পড়ে পল্টু বলল, "ডায়লগগুলো বেজায় কঠিন হয়ে যাবে আর্যদা তার চেয়ে বরং এমনটা করলে হয় না, যে কাহিনিটা ঠিক রইল শুধু ডায়লগগুলো আমরা নিজেদের মতো করে নিলাম আর সহজ ভাষায় বললে লোকেরও বুঝতে সুবিধে"
"কথাটা কিন্তু মন্দ বলিসনি পল্টু," কেল্টুও সায় দিল
একটু সময় কি যেন ভেবে আর্যদা বলল, "ঠিক আছে, তোরা যখন বলছিস তবে তাই হোক, নইলে আমি কিন্তু প্রায় মুখস্থ করেই ফেলেছিলাম"
আমি বললাম, "তাহলে এবার ডায়লগ কোথায় পাবে?"
নাকের ডগায় একবার আঙ্গুল বুলিয়ে আর্যদা বলল, "লাগবে না আমি তোদের সবার স্ক্রিপ্টে তোদের পার্টগুলো মার্ক করে দিয়েছি, তোরা সেগুলো একবার পড়ে নে তারপর আর কী, নিজের মতো করে যা মনে হবে বলে দিবি মনের গভীর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা আসে তাই তো সর্বোত্তম শিল্প"
"যে যা মনে আসবে তাই ডায়লগ বলবে? ভুলভাল কিছু বলে বসলে?"
"আরে রিহার্সেল হবে তো, তাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই চিন্তা করিস না আর হ্যাঁ, এই নে জিনিসপত্রের ফর্দ, আজকেই এগুলোর অর্ডার দিয়ে আয় আর ছোটোখাটো জিনিসগুলো পরদিন কলেজে নিয়ে আসবি এই যেমন ধর রাবণের খড়গ, লক্ষণের তির-ধনুক এসব আর কি"
মাঝে শনি-রবি কলেজ ছুটি আর সোমবার কার কী যেন একটা জন্মজয়ন্তী ছিল তাই মঙ্গলবার কলেজের পরে আবার বসল রিহার্সেলের আসর আমিও হাজির হলাম তির-ধনুক কাঁধে নিয়ে আমরা একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে গিয়ে বসেছিলাম, সেখানেই হবে রিহার্সেল আর্যদা বলল, "প্রথম দৃশ্য দিয়েই শুরু হোক রাবণের রাজসভা, মেঘনাদ এসে রাবণের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইছে তাহলে কেল্টু তুই তো রাবণ, তুই ওই বেঞ্চটার উপর চড়ে বোস, মনে কর ওটা সিংহাসন আমি মেঘনাদ এসে রাজসভায় ঢুকছি"
এই বলেই সামনের দরজা দিয়ে কোমরে তলোয়ার গুঁজে কেল্টুর দিকে এগিয়ে এল আর্যদা, চোখে-মুখে বেশ একটা মারব-কাটব ভাব, যেন রামকে পেলে এখনই দু'টুকরো করে ছাড়বে আর কি!
কেল্টুর দিকে দু'হাত তুলে গর্জে উঠল আর্যদা, "হে পিতঃ, আমি থাকিতে কেমনে জীবিত ভ্রমে সে বনচারী রাম? আদেশ দিন লঙ্কাপতি বধিব দাশরথি পামরে নরাধম সেই দশরথ নন্দন কাপুরুষ অতি ঘোর, নাশিব পাষণ্ড রাঘবে"
আরও কী একটা যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কেল্টুর চোখের ইশারায় ফিরে তাকাল আর্যদা; দরজায় দাঁড়িয়ে রাঘব স্যার, কলেজের বাংলার প্রফেসর, বেজায় বদরাগী লোক
দরজায় দাঁড়িয়েই ধমকে উঠলেন, "এসব কী ইয়ার্কি হচ্ছে শুনি? তোরা কি ভাবিস, আমি কিছুই বুঝি না?"
কাঁপা কাঁপা গলায় আমি বললাম, "স্যার, আমরা মেঘনাদবধ নাটকের রিহার্সেল করছিলাম"
"চোপ হতচ্ছাড়া কোথাকার মেঘনাদবধ আমার আগাগোড়া মুখস্থ, সেখানে কোথাও এমন কোনও লাইন নেইনাটকের নাম করে আমায় পাষণ্ড বলা, 'নাশিব পাষণ্ড রাঘবে'! এমনকি তোরা আমার বাবাকেও ছাড়িসনি, এত বড়ো সাহস!"
"স্যার স্যার, সত্যি বলছি আমরা নাটক করছিলাম আর আপনার বাবাকে কিচ্ছু বলিনি স্যার, বিশ্বাস করুন"
আর্যদার কথায় আরও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন স্যার, "হতভাগা, আমার বাবার নাম দশরথ রায় তুই বলিসনি 'নরাধম সেই দশরথ নন্দন'? আমি নিজের কানে শুনেছি আজ হচ্ছে তোদের, এই আমি চললুম প্রিন্সিপালের কাছে"
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন স্যার
আমাদের তো গলা শুকিয়ে কাঠ! আর কীসের রিহার্সেল, যে যার মতো দৌড় লাগালাম বাড়ির পথে প্রায় একসপ্তাহ আর কেউ কলেজের ছায়াও মাড়াইনি আমরা
কিন্তু বিধির লিখন খণ্ডায় কে! সেই যে বলেছিলাম আর্যদার মাথায় কোনও হুজুগ চাপলে সেটা না করে ছাড়বে না আমরা সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম যে নাটকটা আর হচ্ছে না কিন্তু হঠাৎ কলেজ ফেস্টের দু'দিন আগে আর্যদার ফোন; সব নাকি রেডি আছে, নিজেই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে, জিএস সন্তুদার সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে ফেস্টের দিন নাটকটা করা হবে, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের নাটক, তিনটে দৃশ্য থাকবে
শুনে তো আমি প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম, "একটি বারও রিহার্সেল হল না, আর এই দু'দিন আগে বলছ নাটক হবে?"
কিন্তু আর্যদা তো আর্যদা, ফুল কনফিডেন্সে বলল, "একদম চাপ নিস্ না, সব হয়ে যাবে এখানে তো আর ডায়লগ মুখস্থ রাখার কোনও ব্যাপারই নেই, শুধু কাহিনিটা জানা থাকলেই হল বাকি আমি তো আছিই, সব সামলে নেব"
"কী যে হবে কে জানে!" দুরু দুরু বুকে কলেজে পা রাখলাম ফেস্টের দিন কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে আমার কপালে আরও কত দুর্ভোগ বাকি! কলেজে ঢুকতেই দু-তিন পাতা কাগজ হাতে ছুটে এল আর্যদা, "নে, চটপট এগুলো একবার পড়ে ফেল"
"কী এগুলো?"
"তুই রামচন্দ্র হবি বেশি ডায়লগ নেই, শুধু দ্বিতীয় দৃশ্যে লক্ষ্মণকে ওই একটু আশীর্বাদ-ফাদ করবি আর কি, ব্যস ওটুকুই"
আমাকে কাগজ ধরিয়ে দিয়েই লোকটা বেপাত্তা, যেতে যেতে বলে গেল, "বারোটায় নাটক, সাড়ে দশটার মধ্যে গ্রিনরুমে হাজির থাকবি আমি স্টেজটা দেখে আসি, তুই জলদি বুঝে নে তোর রোলটা"
অগত্যা বিষণ্ণবদনে আমিও রামচন্দ্র হবার পথে পা বাড়ালাম
বারোটা প্রায় বাজে, স্টেজের পর্দা উঠব উঠব করছে, অডিটোরিয়াম ভর্তি লোক সামনের সারিতেই প্রিন্সিপাল স্যার অন্যান্য স্যার, ম্যাডামরা বসে আছেন
পর্দা উঠল, শুরু হল প্রথম দৃশ্য রাবণের রাজসভা, প্লাস্টিকের চেয়ারের ওপর রঙিন কাগজ সেঁটে বানানো হয়েছে সিংহাসন, তাতেই বসে আছেন রাবণরাজ কেল্টু 'দিন আগেই যুদ্ধে কুম্ভকর্ণ মরেছে কিনা, তাই মনের দুঃখে গালে হাত দিয়ে ঝিমোচ্ছেন স্টেজের ডানপাশের পর্দা ঠেলে এবার সভায় ঢুকবেন মেঘনাদ, মানে আর্যদা ঢুকতে গিয়েই হোঁচট, প্রায় উলটে পড়তে যাচ্ছিল আর কি, সামলে নিল কোনোক্রমে
এবার শুরু হল মেঘনাদের মেঘগর্জন
"হে পিতঃ, হে যক্ষ-কুল-পতি, কী দুঃখ বিঁধিছে আপনার প্রাণে?"
পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, "যক্ষ কোথায় পেলি ভাই? রাবণের প্রেস্টিজ ডুবিয়ে ছাড়লি তো!"
আর্যদা একবার কটমটিয়ে তাকাল, স্টেজের উপর না থাকলে নির্ঘাত কিল-ঘুসি কিছু একটা মেরে বসত ছোঁড়াটাকে
এবার কেল্টুর লাইন
"কি আর কহিব পুত্র বেদনার কথা সেই যে সুন্দরী নারী, রামের ঘরনি, করিনু কিডন্যাপ তারে, জান তো সকলই। তার স্বামী সেই এক বনচারী রাম, বীর কুম্ভ যার বাণে ত্যাজিল ধরাধাম"
পেছনে আবার হাসির রোল উঠল, "এই রাবণ ইংরেজি বলছে রে!"
কেল্টু প্রায় সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল স্টেজের মাঝখানে, "তোর তাতে কোথায় ফোস্কা পড়ছে রে হতভাগা? রাবণ ইংরেজি জানত না তা তোর কোন শাস্ত্রে লিখেছে?"
সারা অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল হাসিতে, প্রিন্সিপালও ঠোঁট চেপে হাসছেন কেল্টুর পারদ একেবারে সপ্তমে চড়ে গেল, আরেকটু হলেই স্টেজ থেকে লাফিয়ে নেমে একটা কিছু হুলুস্থূল কাণ্ড বাঁধাত আর কি! কিন্তু তার আগেই পর্দা নামিয়ে প্রথম দৃশ্য সেখানেই শেষ করা হল অবস্থা বেগতিক দেখে ঠিক হল যে দ্বিতীয় দৃশ্যও বাদ, সোজা তৃতীয় দৃশ্য দেখান হবে, মানে যেখানে মেঘনাদের যজ্ঞের মাঝে লক্ষ্মণ আর বিভীষণ গিয়ে ঢুকে মেঘনাদ বধ করল
পাঁচ মিনিট পর আবার পর্দা উঠল স্টেজে মেঘনাদের যজ্ঞগৃহের সাজ, থার্মোকলের দেবী মূর্তির সামনে যজ্ঞবেদি সাজানো, মেঘনাদ তাতে আহুতি দিচ্ছেন
পেছন থেকে স্টেজে ঢুকলেন বিভীষণ আর লক্ষ্মণ, মানে পল্টু আর বুম্বা লক্ষ্মণ তলোয়ার বের করে আস্ফালনের ভঙ্গিতে বললেন, "ওহে কাপুরুষ মেঘনাদ, মেঘের আড়াল ঘুচিয়াছে আজ, মুছিয়াছে সব বাঁধ, এবার তোমারে তিরের আঘাতে করিব হে কুপোকাত"
যজ্ঞ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেঘনাদ
"চোরের মতো পেছন দিয়ে ঢুকল আমার ঘরে, আবার ব্যাটার সাহস কত, বৃথাই নৃত্য করে আর ওহে কুলঘাতী কাকা বিভীষণ, তোমারও দেখছি এসেছে মরণ, শমন নাচিছে শিরে, আজকে তোমার বক্ষ আমি বিঁধিব আমার তিরে"
"ওরে দুরাচার পাষাণ পামর, শোন নরাধম ইতর বাঁদর, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে তুমি তিরটি মেরেই চুপ, তাই তো এবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বুঝবে মজা খুব"
ওদিকে বুম্বার মুখে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক শুনে অডিটোরিয়ামে আবার চাপা হাসির দমক উঠল, আর আমি এদিকে স্টেজের পেছনে দাঁড়িয়ে বারবার কপালের ঘাম মুছছিলাম
দু’পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ এমন মৌখিক আস্ফালন চলতে লাগল, এবার তলোয়ার হাতে মেঘনাদ আর লক্ষ্মণ দু’জনেই রেডি, এই যুদ্ধ লাগল বলে আমিও একটু নিশ্চিন্ত হলাম, ভাবলাম যাক এখন তো আর কোনও ডায়লগ নেই, শুধু যুদ্ধটা হলেই মেঘনাদ মরবে আর মানে মানে নাটকটাও শেষ হবে কিন্তু বিধি যদি বাম, কী করিবে রাম!
মেঘনাদ তলোয়ার হাতে গর্জে উঠল, "আয় দেখি হীনবল ওরে লক্ষ্মণ, যুদ্ধ-সাধ মিটাইব তোর, করিলাম পণ"
আর যায় কোথা, "হা রে রে রে" বলে এক লাফে যেই না তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল লক্ষ্মণ, সারা অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে লোকজন প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে হাসির ঠেলায় লক্ষ্মণ মেঘনাদ দু’জনেই বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে স্টেজের উপর, এত হাসির যে ঠিক কী ঘটল কেউ বুঝতে পারছি না আমরা হঠাৎ পর্দার আড়াল থেকে আমার চোখে পড়ল বিভীষণের পায়ের কাছে লক্ষ্মণের সিনথেটিক ধুতিখানা খুলে পড়ে আছে আর লক্ষ্মণবাবু হাফপ্যান্ট পরে প্রায় অর্ধনগ্ন দশায় তলোয়ার হাতে মঞ্চে দাঁড়ানো কখন যে লাফ দেবার সময় বিভীষণের পায়ে আটকে ধুতি খুলে গেছে বুম্বা টেরই পায়নি
শিগগির পর্দা নামিয়ে অবস্থা সামলানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকের হাসি কি আর থামে! লাফিং গ্যাসেও বোধহয় এমন হাসির ফোয়ারা ছোটে না
অতঃপর এইভাবেই সমাপ্ত হল আমাদের মেঘনাদবধ নাটক; মেঘনাদ তো মরল না, কিন্তু বেচারা বুম্বার মানসম্মান একেবারে মাঠে থুড়ি মানে স্টেজে মারা গেল
_____
অলঙ্করনঃ পার্থ মুখার্জী

2 comments:

  1. হি হি হা হা , পেটে ব‍্যাথা....

    ReplyDelete