গল্প:: ঠাকুরমায়ের পায়ের নীচে - শংকর দেবনাথ


ঠাকুরমায়ের পায়ের নীচে
শংকর দেবনাথ

‘ঠাকুরমায়ের পায়ের নীচে কালো -
কালোর মাঝে লুকিয়ে আছে আলো৷’
শুয়ে শুয়ে বারবার পদ্যটি আওড়াচ্ছে ঋক।
গ্রীষ্মের দুপুর। চারপাশে ঝাঁ ঝাঁ নীরবতা। শুধু মাথার উপর শোঁ শোঁ শব্দে ঘুরছে সিলিং ফ্যান।
পাশের রুমে মা আর দিদি শুয়ে আছে।
ঋক নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল বন্ধ। গ্রীষ্মাবকাশ। অখণ্ড অবসর ৷ তাই আজ কদিন ধরে তার মাথার ভেতর চেপেছে এই ছন্দ ধাঁধাটির রহস্য জানার চেষ্টা। ছোটোবেলা থেকে এতবার ধাঁধাটি শুনেছে যে নিজের অজান্তে কখন যেন মাথায় গেঁথে গেছে। আসলে এটি একটি গুপ্তধনের স্থান নির্দেশক ধাঁধা।
ঋকদের পূর্বপুরুষদের কেউ একজন প্রচুর অলংকার গচ্ছিত রেখেছিলেন। কোনো সুযোগ্য উত্তরাধিকারী যাতে সেগুলি খুঁজে পায় তাই তিনি এই ধাঁধার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ওদের পূর্বপুরুষেরা জমিদার না হলেও প্রচুর জমা-জমি সম্পদের মালিক ছিলেন। তার রেশ হিসেবে এখনও রয়ে গেছে কড়িবরগার ছাদযুক্ত বিশালাকারের প্রাসাদ। আর রয়েছে দেবী ‘মা ঠাকুরে’-র মন্দির।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই চাকরি-বাকরি ব্যাবসার সূত্রে বাইরে বসবাস শুরু করলেও ঋকের বাবা পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যাননি।
ঋকের বড়ো ঠাকুরদার কাছে নাকি সংরক্ষিত ছিল তামার পাতে খোদাই করা ধাঁধাটি। ঋকের বাবা স্বচক্ষে সেটি দেখলেও ঋক কখনও সেটি দেখেনি৷ ওদের বড়ো ঠাকুরদার বংশধরেরা কেউ এখন এখানে থাকে না। বাবা-কাকারা অনেক চেষ্টা করেও ধাঁধার রহস্য উদ্ধার করতে না পেরে একপ্রকার গুপ্তধনের আশা ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু সেই ভূত চেপেছে ঋকের মাথায়। দিদি ঋতু একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। দুজনে মিলে ধাঁধাটির অর্থ উদ্ধারের জন্য সময় পেলেই আলোচনায় বসে যায়।
ধাঁধার পদ্যটি আওড়াতে-আওড়াতে ঋক হঠাৎ থেমে যায়। মনে মনে বলে – তাই তো, ঠাকুরমা মানে কি মা ঠাকুর?
পেয়েছি, পেয়েছি!” চেঁচিয়ে ওঠে ঋক, “দিদি, দিদি!”
দিদি ও মা পাশের ঘর থেকে যুগপৎ বলে ওঠেন, “কী পেয়েছিস?”
একদৌড়ে দিদির কাছে ছুটে যায় ঋক।
“কী রে! কী হয়েছে? কী পেয়েছিস?” দিদির চোখে কৌতূহল।
মা বলেন, “কী রে, কী হয়েছে? অমন করে এই ভরদুপুরে চেঁচাচ্ছিস কেন?”
ঋক এখন রীতিমতো উত্তেজিত।
“মা, দিদি, আমি বোধহয় গুপ্তধনের সেই ধাঁধাটির কিছুটা জট খুলে ফেলেছি।”
“মানে?” দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন।
“‘ঠাকুর মায়ের পায়ের নীচে’ - এটুকু খুলেছে মনে হয়। এর রহস্য বুঝতে পেরেছি৷”
ঋকের গলায় আত্মবিশ্বাসের আভাস।
“তাই? তা কী পেয়েছিস তাতে?” মা কিছুটা মজার ঢঙে বলেন।
দিদি এখন কিছুটা উত্তেজিত। উৎসাহিত। সে জানে তার ভাইটি একেবারে এলেবেলে নয়। স্কুলের মেধাবী ছাত্র। অনেক জটিল অংকের সমস্যা সহজেই সমাধান করে ফেলে। বলে, “বল না, কী বুঝতে পেরেছিস?”
“‘ঠাকুরমামানে ‘মা ঠাকুর’!” সোৎসাহে বলে ঋক, “আমাদের কুলদেবীর নামই তো মা ঠাকুর।”
“হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?” মা বলেন।
“রহস্য তো সব ওখানেই লুকোনো বলে মনে হচ্ছে,” উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়ে ঋক।
দিদি বলে, মানে?”
“চল না দিদি, মন্দির থেকে একবার সরেজমিনে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে আসি,” ব্যস্ত হয়ে ওঠে ঋক।
“এখুনি?”
“হ্যাঁ, এক্ষুনি। ব্যাপারটা একটু না মেলালে বাকিটা উদ্ধার করা যাবে না।”
“চল,” দিদি উঠে বসে।
ওরা মন্দিরের দিকে যেতে থাকে।
মা-ও এখন কিছুটা যেন কৌতূহলী! তিনিও যান পিছু পিছু।
“ঠাকুরের পায়ের নীচে কী আছে দেখতে হবে!”
“কীভাবে দেখবি? ঠাকুর সরাবি কী করে?”
“দেখছি কী করা যায়,” বলে ঋক মন্দিরের দিকে এগিয়ে যায়।
একসময় পুরোহিত নিয়মিত দুই বেলা ঠাকুর পুজো করতেন। কিন্তু সেদিন আর নেই। এখন মা-ই সকাল-সন্ধ্যা পুজো করেন।
সকালবেলায় মায়ের দেওয়া ফুল-পাতা ঠাকুরের পায়ের নীচ থেকে ধীরে ধীরে সরাতে থাকে ঋক। দিদি আর মা অদম্য কৌতূহল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন।
জায়গাটা ভালো করে পরিষ্কার করে ঋক।
“না, তেমন কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না।”
আশপাশ, ঠাকুর আসনের নীচে যতটা দেখা যায় ভালো করে নিরীক্ষণ করেও কোনো কিছু পায় না সে।
মা বলেন, “কই কিছুই তো দেখছি না।”
ঋক সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। তুখোড় গোয়েন্দার মতো সবকিছু তন্নতন্ন করে দেখছে সে। ঠাকুরের পায়ের পাতা যেখানে, ঠিক তার নীচে মেঝেতে হাতের টোকা দিতে থাকে। তারপর কী বুঝে বলে ওঠে, “এখানে এই মেঝের নীচে কিছু একটা ব্যাপার আছে।”
দু-চার মিনিট ধাঁধাটি আবার আওড়ায়।
“‘পায়ের নীচে কালো’! মানে অন্ধকার। তাহলে – তাহলে - মেঝের ভেতর কি কোনো গোপন অন্ধকার কুঠুরির ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে? ‘কালোর মাঝে আলো’ - তবে কি আলো মানে উজ্জল সোনার রং-কে বোঝানো হচ্ছে?”
এবার ঋক দিদিকে ডাকে, “দিদি, এদিকে আয় তো৷”
“কেন রে?”
“মেঝের এই জায়গাটা হাত দিয়ে ঘা মেরে দেখ!”
মা দিদি দুজনেই এগিয়ে আসেন। ভালো করে বারবার পরীক্ষা করে দেখেন – তাই তো - নীচে কিছু একটা আছে মনে হচ্ছে৷ কেমন যেন ঢপঢপ করছে।
বাবা কাজের লোকদের চাষের কাজ দেখাশোনার জন্য মাঠে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে মন্দিরে কথাবার্তা শুনে তিনিও এসে হাজির হলেন এবং ব্যাপারটি বুঝে ক্ষীণ হলেও কৌতূহলী ও আশান্বিত হলেন। পরীক্ষা করতে লেগে গেলেন।
হাতুড়ি আনা হল। আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ মেঝের উপর আঘাত করতেই সরলরেখা মতো একটা ফাটল দেখা গেল।
সকলে এখন প্রচণ্ড উত্তেজিত। আরও কিছুক্ষণ ঠোকাঠুকির পর বোঝা যায় নিশ্চয়ই এখানে নীচে গর্ত আছে।
শাবল আনা হয়। জোরে জোরে আঘাত দিতেই ভেঙে যায় মেঝের উপরের অংশ। ইতিমধ্যে দিদি ঘর থেকে এক দৌড়ে টর্চও নিয়ে এসেছে।
“নে ধর,” দিদির কণ্ঠে আনন্দ আর উৎকণ্ঠা।
মেঝের উপরকার ভাঙা চাঁইটা তুলে ভেতরে টর্চের আলো ফেলে ঋক৷
সব কটা চোখ ঝুঁকে পড়ে।
কালোর ভেতর যেন সোনার আলো ঝিকমিক করে ওঠে।
মা বিস্ময়াভিভূত আনন্দে বলেন, এত অলংকার!”
ভাইয়ের বুদ্ধিদীপ্ততায় দিদির মন গর্বে ভরে ওঠে ৷ আনন্দ উচ্ছ্বাসে তার চোখে জল এসে যায়৷
“আমি জানতাম, আমার ভাই-ই একমাত্র পারবে গুপ্তধন খুঁজে বের করতে৷”
এতগুলো পুরুষ চলে গেল, কেউই পারল না যে গুপ্তধন উদ্ধার করতে, কত সহজে বের করে ফেলল তাদের ছোট্ট ছেলেটা - এ কথা ভেবেই মা-বাবা দুজনের মনে এক আনন্দ মিশ্রিত গর্ব অনুভব হল।
মা ছেলের মাথায় স্নেহের পরশ রেখে গদগদ কণ্ঠে বলেন, “শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের হাতেই ধরা দিল গুপ্তধনের রহস্য৷ কী বলো!”
বাবাও উচ্ছ্বসিত আবেগে বলেন, “তুই হলি আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রকৃত যোগ্য উত্তরাধিকারী৷”
এত পুরোনো দিনের একটা রহস্যের জট খুলতে পারার আনন্দে আত্মহারা হয়ে এক বিজয়ী বীরের মতো মেঝের অভ্যন্তরের সেই ছোট্ট কুঠুরির ভেতর থেকে একে একে অলংকারগুলো তুলতে থাকে ঋক। আর এক অনির্বচনীয় তৃপ্তির সোনালি আভা যেন ছড়িয়ে পড়ে তার সারা মুখমণ্ডলে।
----------
ছবি - শ্রীময়ী

No comments:

Post a Comment