গল্প:: পরমা - মধুবন্তী রুদ্র


পরমা
মধুবন্তী রুদ্র

ছাতিমতলার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা ব্রিজ পেরিয়ে সোজা ট্রেনলাইনের দিকে চলে গেছে, সেটা ধরে কিছু দূর এগোলে বাঁ হাতে পড়ে দত্তদের বিশাল আমবাগান লোকে বলে, বাগানের লাগোয়া ইট বার করা, শ্যাওলাধরা বাড়িটাতে এক খুনখুনে বুড়ি মানুষ একলাটি থাকেন কোলকুঁজো চেহারা, শনের নুড়ির মতো চুল আর শিরা-বার-করা লিকলিকে হাত-পা বুবাই-টুটুল-শান্টু-মিন্টুদের বাবা-জ্যাঠারা দাবি করেন, জন্মাবধি ঐ বৃদ্ধাকে নাকি ওঁরা এরকমই দেখে আসছেন স্মরণকালের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো মানুষকে বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখা গেছে বলে কখনও শোনা যায়নি হাতফেরতা হতে হতে, এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা কার কাছে গেছে কেউ জানে না মাথাও ঘামায় না মালিক কাদের সঙ্গে যেন বছরকার মতো বন্দোবস্ত করে রেখেছে - তারাই শুধু বছরে একবার করে আসে বৈশাখের গোড়ার দিকে কিছুদিন থেকে সব আম-টাম পেড়ে নিয়ে চলে যায় বাকি সময় জায়গাটা একদম খাঁ খাঁ করে ছেলেবুড়ো কেউই ভূতুড়ে চেহারার এই বাগানটার ধারে কাছে বড়ো একটা ঘেঁষে না সতীশ উকিল বা পঞ্চানন মাস্টারের মতন ভীতু লোকেরা তো বাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রীতিমতন রাম নাম জপ করতে করতে যায়
কিন্তু সেদিন বাইরে থেকে একজন এসেছিল

প্ল্যানটা আসলে বুবাইয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ নতুন ক্লাশ শুরু হতে এখনো প্রায় একমাস দেরি সবার মধ্যেই একটা কী করি কী করি ভাব বাবা-মায়ের নজরদারিতেও ঢিলেমি তাই বুবাই যখন দত্তদের আমবাগানে অ্যাডভেঞ্চারের প্রস্তাবটা তাদের হোয়াটস-অ্যাপ গ্ৰুপে পেশ করল, সবাই মিলে হই হই করে সেটা পাস করে দিল ঠিক হল, এই সোমবার দিন সবাই মিলে বুবাইয়ের বাড়ি ডে স্পেন্ড করতে যাবে কাকু কাকিমা দুজনেই নটার মধ্যে যে যার অফিস আর কলেজের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন বাড়িতে তখন শুধু বুবাই আর জ্যোৎস্নামাসি সংসারের ঊনকোটি চৌষট্টি রকম কাজ সেরে সে দুপুরের দিকে ঘণ্টা দুয়েক নাক ডাকিয়ে ঘুমায় কানের কাছে কামান দাগলেও বিকেল পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটার আগে তার সে ঘুম ভাঙে না
চারমূর্তি ঠিক করল, মাসি ঘুমিয়ে পড়লেই ওরা চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে বুবাইদের বাড়ি থেকে সাইকেল চেপে ওদের ডেস্টিনেশনে পৌঁছোতে লাগবে মিনিট দশেক পাঁচিলের ফুটো গলে ভেতরে ঢুকে, আম-টাম পেড়ে ওরা মাসি জাগার আগে আরামসে বাড়ি ঢুকে পড়তে পারবে পাঁচিলের ধারের দিকের গাছগুলো টার্গেট করার প্ল্যান করল ওরা, যাতে বাগানবুড়ি হঠাৎ করে বাড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলে ওরা চটপট পালাতে পারে শান্টুর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হল কয়েকটা চটের ব্যাগ জোগাড় করার

আজ সোমবার শেষ চৈত্রের দুপুরে রাস্তাঘাট শুনশান কয়েকটা নেড়ি শুধু শুয়ে শুয়ে জিভ বার করে হাঁফাচ্ছে মাঝে মাঝে হাইওয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা আধটা দূর পাল্লার বাস বা লরি-টরি প্ল্যানমাফিক চারমূর্তি আমবাগানে ঢুকে অপারেশন স্টার্ট করেছে
বলতে নেই কালেকশান বেশ ভালোই হচ্ছিল ডানপিটে বুবাই আর ল্যাকপ্যাকে টুটুল তরতরিয়ে উঠে গেছে পাশাপাশি দুটো গাছের মগডালে হাতের কাছে যা পাচ্ছে - ছোটো, বড়ো, একদম কাঁচা, আধপাকা - ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুজনে ছুড়ে দিচ্ছে নীচের দিকে শান্টু আর মিন্টু স্যাটাস্যাট সেগুলো ভরে ফেলছে ব্যাগে দুটো ব্যাগ প্রায় ভরে এসেছে
হঠাৎ সব ক’টা নেড়ি একসঙ্গে ডেকে উঠল খানিকক্ষণ একটানা ঘেউ ঘেউ করে আচমকাই থেমে গেল আবার চারদিক আগের মতন নিঃঝুম
চার ডানপিটে মুহূর্তে অ্যালার্ট
- নেমে আয় কুইক কুইক হাওয়া ভালো নয় শান্টু নীচ থেকে নির্দেশ পাঠায়
অতঃপর চার বন্ধু আর দেরি না করে চটপট ব্যাগ-ফ্যাগ গুছিয়ে নিয়ে যে পথে এসেছিল, সেই পথে সোজা বাইরে সামান্য দূরে একটা ঝোপের আড়ালে ওদের সাইকেলগুলো পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো ছিল তাড়াতাড়ি ওরা সেখানে পৌঁছে যে যার সাইকেলে চড়ে বসতে যায় আমভরা থলেগুলো ক্যারিয়ারে রেখে শক্ত করে বাঁধতে থাকে
টুটুল এসব কিছুই করে না চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে হঠাৎ করে টুটুল মেন গেটের দিকে এগিয়ে যায়
পিচের রাস্তা থেকে একটা ডার্ট রোড ঢালু হয়ে নেমে সোজা গেট অবধি পৌঁছেছে আর সেই রাস্তায় স্পষ্ট চাকার দাগ টাটকা কোনো দ্বিচক্রযান
টুটুল নীচু হয়ে বসে চাকার দাগটা দেখতে দেখতে মন্তব্য করে, বেশ ভারী বাইক
ওরা একে অপরের দিকে অপলকে তাকায় সবাই জানে অন্যরা কী ভাবছে আজ থেকে ঠিক দু-দিন আগে ওরা দেখেছে একটা কাওয়াসাকি কদমতলায় যে মল কমপ্লেক্সটা নতুন তৈরি হয়েছে, সেখানে বাইকের আরোহীর মুখ হেলমেটে ঢাকা ছিল হাতের মধ্যে অদ্ভুতদর্শন একটা ফোনে কী দেখছিল যেন ওরা মুগ্ধ হয়ে বাইকটাকে দেখছিল... মিনিটখানেকের মধ্যেই আরোহী স্টার্ট দিয়ে ভোঁ করে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়
- ব্যাপারখানা কী বল দেখি? বুবাই কথাটা মুখে বললেও সবার মনেই একই প্রশ্ন
গেটের গায়ে আজীবনকাল ঝুলতে দেখা মরচেধরা গোবদা তালা দুটো উধাও আলতো হাতে বুবাই চাপ দিল দরজায় - বিশ্রী একটা ঘড়াং শব্দ করে খুলে গেল গেটটা
এই ভরদুপুরেও বাগানের ভেতরটা ঝুপসি অন্ধকার ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে তাও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না - পাঁচিলের ধার ঘেঁষে একটা বাইক শোয়ানো রয়েছে
- ব্যাপারটা সুবিধার ঠেকছে না... চল কেটে পড়ি
চারজনে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই একজনের মূখোমুখি পড়ে গেল

গেটের বাইরে একটু দূরে, তাদের দিকে মুখোমুখি তাকিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার লম্বা হিলহিলে চেহারা পরনে জিনস আর টিশার্ট পিঠে ব্যাকপ্যাক চোখে রোদচশমা মাথায় টুপি মুখ ওদের দিকে পিছনে গরমে খেঁকিয়ে থাকা কুকুরগুলো ভারি বিগলিতভাবে ল্যাজ নেড়ে চলেছে ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকায় এই ধুধু জায়গায় হঠাৎ করে কোথা থেকে উদয় হল মানুষটা? ওরা কী করবে ভেবে পায় না অপর প্রান্ত থেকে তখন অচেনা মানুষটা ওদের দিকে হেঁটে আসছে
লম্বা লম্বা পা ফেলে সোজা হেঁটে এসে যে এখন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সে পুরুষ নয় মহিলা বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে কোনো স্ত্রীলোককে এরকম কদমছাঁট চুলে কখনও দেখেনি ওরা সবাই মিলে হাঁ করে চেয়ে আছে ওর দিকে
- হাইইই! আমি পরমা
ফরসা হাতটা এগিয়ে গেছে ওদের দিকে
এতক্ষণে ওর হারিয়ে যাওয়া স্মার্টনেসের কিছুটা ফিরে পেয়েছে বুবাই বাড়িয়ে দিয়েছে নিজের হাত
- হাই! আমি বুবাই আর এরা হল আমার বন্ধু - শান্টু, মিন্টু আর টুটুল তুমি এই ভরদুপুরে এই জায়গায় কী করছ?
- তোমরাই বা এখানে এই সময়ে কী করছিলে? গেট দিয়ে না বেরিয়ে পাঁচিল ভেদ করে বেরোলে কেন? পরমা মিটি মিটি হেসে প্রশ্ন করে
- না মানে... আমরা মানে ইয়ে... একটু অ্যাডভেঞ্চার - সবাই একটু তোতলায়
- পরীক্ষা শেষ পড়ার চাপ নেই বোরডম কাটানোর জন্য তাই পরের বাগানে হানা তাই তো? সঙ্গে লুটের মালও আছে দেখছি মিটিমিটি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে মেয়েটা
যাঃ বাবা! এ তো উলটো চাপ অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স খেলছে দেখি
বুদ্ধিমান টুটুল তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কই, তুমি তো বললে না, তুমি এইসময় এইভাবে এইখানে কেন এসেছ?
- আমি আসলে আমার ফ্যামিলি হিস্ট্রির ওপর বেস করে একটা উপন্যাস লিখছি সেই সূত্রে এখানে আমার এক আত্মীয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি
পরমার উত্তর শুনে ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে
- মনে হচ্ছে খুব অবাক হলে! কী ব্যাপার বলো তো? পরমা জিজ্ঞেস করে
একটু ইতস্তত করে শেষমেষ মিন্টু বলে ফেলে, আসলে বাড়িতে তো একজন বুড়ি মানুষ ছাড়া আর কেউই থাকে না উনিই কি তোমার সেই আত্মীয়া?
- হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন - মেয়েটি কাঁধ শ্রাগ করে জবাব দেয়
- মানে?
- আসলে আমি যাঁর খোঁজে এসেছি, সত্যি কথা বলতে, তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেকদিন যাবৎ কোনো যোগাযোগ নেই ইন ফ্যাক্ট, আমি কোনোদিন তাঁকে চোখেই দেখিনি আমি আমার পরিবারের কিছু ইতিহাস ওঁর কাছ থেকে জানতে চাই সেই উদ্দেশ্যেই এখানে আসা তোমরা কি ওঁর সম্বন্ধে আমায় কিছু বলতে পারো?
কী বলবে ওরা বুঝে উঠতে পারে না ওকে ঠেলে, একে শেষমেশ মিন্টু বলতে শুরু করে এই বাগানবাড়ি আর তাতে বসবাসকারী রহস্যময় বৃদ্ধার ইতিবৃত্ত

- সবাই বলে, এ বাড়িতে নাকি এক খুনখুনে বুড়ি থাকে যার বয়সের গাছপাথর নেই কিন্তু ওঁকে চাক্ষুষ দেখেছে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম আমাদের চেনাশোনার মধ্যে কেউ কখনো বাড়িতে গেছে বা বুড়ির সঙ্গে কথা বলেছে বলে শুনিনি অত বৃদ্ধ একজন মানুষ একা একা কারোর সাহায্য ছাড়া কীভাবে জীবন কাটান এটা একটা রহস্য আগে আগে নাকি মুরুব্বিরা ওঁর খোঁজ করতে লোক পাঠাতেন কিন্তু উনি কারোর সঙ্গে দেখা করতেন না, তাই সে পাট আস্তে আস্তে চুকে যায়
- হুমম এটা কতদিন আগের কথা?
- আমাদের জন্মেরও আগে, মিন্টু একটু ভেবে উত্তর দেয় অন্যরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়
টুটুল এবার বলে ওঠে, আমাদের পাড়ার এক দাদার মুখে শুনেছি, বুড়ির নাকি দুর্ধর্ষ গুলতির টিপ গতবছরই আমপাড়া শুরু হওয়ার আগে আগে ওরা দলবেঁধে বাগানে ঢুকেছিল আম চুরি করবে বলে বুড়ি পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ওদের এয়সান নাকাল করেছিল যে ওরা আর পালাবার পথ পায় না আসলে... টুটুল থেমে যায়
পরমা ভুরু কুঁচকে, মনোযোগ সহকারে ওদের কথা শুনছিল টুটুল থেমে যেতে খুব আগ্ৰহভরে জিজ্ঞাসা করে, আসলে কী? বলো বলো প্লিজ কিছু লুকিয়ো না
টুটুল ঢোঁক গিলে বলে, আসলে অনেকেই মনে করে, বাড়িতে যে থাকে, সে কোনো মানুষ নয় - অশরীরী
- আচ্ছা! তাই নাকি? তা তোমাদের ভয় করল না, এই ভূতুড়ে জায়গায় পা রাখতে? আমের থলির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে পরমা জিজ্ঞেস করে
- আমরা ভূতে বিশ্বাস করি না, এবার চারজন একসঙ্গে বলে ওঠে
- আর তাছাড়া আমরা ইচ্ছা করেই এমন স্পট বেছেছিলাম, যেখান থেকে বিপদে পড়লে খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসা যায়
- ওঃ আচ্ছা, আটঘাট বেঁধেই কাজে নামা হয়েছে দেখছি
ওরা আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে
ওদের হাবভাব দেখে পরমা খুব একচোট হাসে বলে, আচ্ছা এই নিয়ে পরে কথা হবে ’খন এখন যাই বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে নিই গিয়ে
- আমরা তোমার সঙ্গে আসতে পারি?
- সে কী, কেন?
- তোমাকে প্রোটেক্ট করার জন্য চার খুদে বুক ফুলিয়ে উত্তর দেয়
- এই যে এই শান্টুকে দেখছ, দারুণ ক্যারাটের প্যাঁচ জানে মিন্টু পাঁইপাঁই দৌড়াতে পারে আর টুটুলের মাথায় এত কূটবুদ্ধি যে বলে বলে শত্রুপক্ষকে ঘোল খাইয়ে দিতে পারে আর আমি হচ্ছি এই দলটার লিডার আর চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট, একটু লাজুক হেসে বলে বুবাই
হাসি হাসি মুখে ওদের কথা শোনে পরমা বলে, তোমাদের প্রস্তাবের জন্য অনেক ধন্যবাদ তবে এই দিনদুপুরে তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে বলে মনে হচ্ছে না আমি ভেতরে যাব, বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলব, বেরিয়ে আসব আমার জন্য তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না
ওরা তবুও ইতস্তত করছে দেখে, পরমা নিজের রুকস্যাকের দিকে ইশারা করে ওদের বলে, এই যে ব্যাগ দেখছ, এতে খাবারদাবার থেকে শুরু করে সমস্তরকম আত্মরক্ষার উপকরণ আছে সাপ, ছুঁচো, ভূত, পেতনি যাই আসুক ঠিক হ্যান্ডল করে নিতে পারব কিন্তু তোমরা এবার এসো অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে কথা বলছ, আর না
পরমার গলার স্বরে কী ছিল, ওরা আর কথা বাড়াবার সাহস পায় না অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে যার সাইকেলে চড়ে বসল
- আমরা কিন্তু চিন্তায় থাকব তুমি আমাদের কারোর ফোন নম্বর নিয়ে রাখো দরকার হলে খবর দিতে পারবে
- আমি তো মোবাইল ব্যবহার করি না
ওরা আরও একটু অবাক হয় এতক্ষণে বুঝেছে, মেয়ে সাধারণের থেকে আলাদা
- তাহলে তোমার খবর পাব কী করে? তোমার কোনো বিপদ আপদ হল কিনা জানব কী করে? আমাদের কিন্তু তোমার জন্য ভীষণ চিন্তা হবে মিন্টু বলে ওঠে
বাচ্চা ছেলেগুলোর আন্তরিকতা ভালো লাগে পরমার সে বলে, আমি তোমাদের সঙ্গে ঠিক যোগাযোগ করে নেব
- আমাদের বাড়ির ঠিকানাগুলো লিখে নাও তবে?
- লাগবে না আমি ঠিক পৌঁছে যাব কিন্তু তোমরা প্রমিস করো, আমার কথা কারোকে জানাবে না? কারোর সঙ্গে আলোচনা করবে না?
- সে কী, কেন?
- কারণ আছে আবার যখন আমাদের দেখা হবে তখন সব বলব
অতঃপর ওরা পরমাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরে মনটা সবারই একটু খচখচ করে - পরমাকে চেনা ছকের মধ্যে কোনোভাবেই ফেলা যায় না কেমন যেন রহস্যময় তবে এটাও ঠিক যে, অল্প পরিচয়েই এই দিদিটাকে ওদের ভীষণ ভালো লেগে গেছে

বিস্ফোরণের শব্দে ছোট্ট শহরটা যখন কেঁপে উঠল, তখনও ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি হু হু করে খবর ছড়িয়ে পড়ল - দত্তদের আমবাগানে বম্ব ব্লাস্ট বেশ শক্তিশালী বিস্ফোরণ পোড়ো বাড়িটা নাকি মাটিতে মিশে গেছে চার মূর্তির একগাল মাছি কোনোমতে নাকেমুখে গুঁজে ব্রেকফাস্ট খেয়ে চারজনে ছুটেছে স্পটে পুলিশ পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে টিভি-প্রেসের লোকজন তাদের লটবহর নিয়ে হাজির ওরা একটু উঁকিঝুঁকি মারতে যেতেই জোর ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল
একপাশে রোগাভোগা এক কনস্টেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুর তাড়াচ্ছিল বুবাই তার সামনে গিয়ে খুবই সহবতের সঙ্গে প্রশ্ন করে, স্যার, কোনো বডি পাওয়া গেছে? বাড়িতে যে বুড়ি থাকত তার বডি কি পাওয়া গেছে? বা অন্য কারোর? এই যেমন কোনো অল্পবয়সি মেয়ের?
- নেহি নেহি হঠো হিঁয়াসে কারও বডি-ভডি কুছু নেহি মিলা না কোই বুডঢি কি না কোই ছোড়িকি
আরও বেফাঁস কিছু বলে ফেলার আগে বুদ্ধিমান টুটুল তাড়াতাড়ি বুবাইকে সরিয়ে নিয়ে আসে জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি বন্ধুদের নিয়ে জায়গা থেকে সরে পড়ে
কিন্তু শেষরক্ষা হয় না
ছোটো শহরে কোনোকিছুই গোপন থাকে না কী করে যেন পুলিশের কানে গেছে, চার বন্ধুকে কাঠফাটা রোদে, আমবাগানের সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বড়োবাবু ওদের সঙ্গে নিজে এসে কথা বলে গেছেন ওরা আমচুরির ব্যাপারটা গোপন করেনি আর জানিয়েছে একজন ওদের দত্তদের আমবাগানটা কোথায় দেখিয়ে দিতে বলেছিল চেহারার বর্ণনা? রোগা, মাঝারি হাইটের মধ্যবয়স্ক পুরুষ পুলিশ আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে গিয়েছে বাড়ির লোককে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে ওদের কোনো ঝামেলায় জড়ানো হবে না বাবা-মায়েরা তাও চিন্তায় আছেন

আজ রাতটা সবাই মিলে শান্টু-মিন্টুদের বাড়িতেই কাটাচ্ছে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ছেলেরা শোওয়ার তোড়জোড় করছিল মন ভালো নেই কারোর মনে প্রচুর প্রশ্ন আর সন্দেহ
সবার মনের ভাবনাটা মিন্টুর মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসে শেষমেশ
- আচ্ছা, পরমাদির কেসটা কী বল তো? দুপুরবেলা বাড়িতে ওর পা রাখা আর ভোররাত্রে সেই বাড়ির বোমা ফেটে ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়া - এই দুটো ঘটনা কি একেবারেই কাকতালীয় না দুটো ঘটনার মধ্যে রয়েছে একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক যেটা আমরা ধরতে পারছি না?
- সেদিন দুপুরে মলের সামনে কাওয়াসাকি বাইক চড়ে যে ব্যক্তি নিজের মোবাইল দেখছিল, সেই পরমাদি আমি শিওর মুখ দেখা না গেলেও, চেহারার এক ধাঁচ - টুটুল বলে
- অথচ দেখ, আমাদের বলল নাকি মোবাইল ব্যবহার করে না বুবাই মনে করিয়ে দেয়
- ওটা কোনো সাধারণ মোবাইল ফোন নয় রে স্টার্ট দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমি একঝলক দেখতে পেয়েছিলাম ওটা আরও অনেক আ্যডভান্সড কোনো ডিভাইস টুটুল বলে
কেউ উত্তর দেয় না মনে মনে সবাই নিজের নিজের মতো উত্তর খুঁজছে
সারা শহর থমথম করছে কারোর মাথায় আসছে না, দত্তদের আমবাগানের মতন জনমানবশূন্য, যাকে বলে যারপরনাই ইনসিগনিফিক্যান্ট একটা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কার কী লাভ? এর ওপর গুমোট একটা গরম গাছের একটা পাতাও নড়ছে না শান্টু মিন্টুদের বিরাট বড়ো, খোলামেলা, একশো বছরের পুরোনো বাড়ি বিরাট ঝুলবারান্দার কোলে দুই যমজ ভাইয়ের ঘর কত রাত ওরা কাটিয়েছে একসঙ্গে ঘরে অথচ আজ কেউ যেন স্বস্তিতে নেই কৃষ্ণপক্ষের নিরেট অন্ধকার আর নৈঃশব্দ যেন গিলে খেতে আসছে এই গরমে সব জানালা খোলা বারান্দার দরজাটা শেষবারের মতন চেক করে নিয়ে, চার বন্ধুতে দুটো খাটে ভাগাভাগি করে শুয়ে পড়ল
মাঝরাতে সবার আগে টুটুলের ঘুমটা ভাঙল ঘামে গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে গেছে গলা শুকিয়ে কাঠ চোখটা খুলতেই হৃদপিন্ড সোজা গলার কাছে - ঘরের ঠিক মাঝখানটায় এক ছায়ামূর্তি আর ঠিক তখনই ঝড়টা উঠল জানলার একটা পাল্লা দমাস করে পড়ে বাকি সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিল সবাই দেখেছে ব্যাপারটা সবারই মনে হচ্ছে, বুকের মধ্যে হাপরের শব্দটা অন্যরাও শুনতে পাচ্ছে
- ক্ ক্ কে?
ডাকাবুকো বুবাই বরাবর সবার আগে নিজেকে সামলায়
ছায়ামূর্তি উত্তর দেয় না চেপে চেপে সব ক’টা জানলা বন্ধ করে দেয় হাতে অদ্ভুত একটা ডিভাইস আবছা আলো বেরোচ্ছে ওটা দিয়ে ওটা হাতে নিয়ে কী যেন খুঁজছে দেখে-টেখে নিয়ে এগিয়ে আসে ওদের দিকে
- বলেছিলাম আবার দেখা হবে, ছায়ামূর্তি ফিসফিস করে কথা বললেও পরমার গলাটা চিনে নিতে কারোর ভুল হয় না

- জয় হনুমান জ্ঞানগুণসাগর জয় কপিশ তিঁহুলোক উজাগর মিন্টু কাঁপা কাঁপা গলায় হনুমান চালিশা আওড়াতে শুরু করেছে
- আরে আমি ভূত নই বাবা ছুঁয়ে দেখ না হয় আর তোমরা না আমায় বলেছিলে তোমরা ভূতে বিশ্বাস কর না?
- বম্ব ব্লাস্টে তোমার কিছু হয়নি? তুমি বেঁচে আছ?
- আলবত আছি বহাল তবিয়তে আছি তোমাদের সন্দেহ হচ্ছে নাকি? পুলিশ তোমাদের ওপর নজর রেখেছে তাই তো অন্ধকারে লুকিয়ে এলাম আর আগে চেক করে নিলাম এ ঘরে লুকোনো ক্যামেরা বা অডিও রেকর্ডার আছে কিনা
- বম্ব ব্লাস্ট-এর ব্যাপারে পুলিশ আমাদের সন্দেহ করছে নাকি? চারজনের গলায় নিখাদ বিস্ময়
পরমা হাসে
- মনে রেখো, ঠিক সেই দিনই ঘটনাস্থলে তোমাদের দেখা গেছে পুলিশ চোখ কান খোলা রাখছে... যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়
- হুমম বুঝলাম তবে পুলিশ যেটা জানে না কিন্তু আমরা জানি আর সেটা হল তুমি ও বাড়িতে ঢোকার কিছু ঘণ্টা পরেই বম্ব ব্লাস্টটা হয় অথচ তোমার একটা চুলও বাঁকা হল না - এর মানেটা কী? তাছাড়া বুড়ির বডিটাই বা কোথায় হাপিস হয়ে গেল? টুটুল এক্কেবারে পুলিশি কায়দায় জেরা শুরু করে
- কোনো বুড়ি থাকলে তবে না তার বডি হাপিস হওয়ার প্রশ্ন কোন এক কালে কোনো বৃদ্ধা হয়তো বাড়িতে থাকতেন, তবে ইদানিংকালে কোনো বুড়ি মানুষ ওখানে থাকত না আর চুল বাঁকা হওয়ার কথা বলছ সেটা হয়নি তার কারণ সিম্পল - ব্লাস্টটা আমিই ঘটিয়েছি পরমা সহজভাবে বলে ওঠে
বাইরে ইতিমধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ-এর ঘনঘটা শুরু হয়ে গেছে পরমার কথায় ঘরের মধ্যেও যেন বাজ পড়ে চার বন্ধু সবার গলা শুকিয়ে এসেছে
বন্ধ ঘরের মধ্যে তাদের মাঝখানে যে বসে আছে সে আসলে কে? একজন নিষ্ঠুর সন্ত্রাসবাদী? ছদ্মবেশী ক্রিমিনাল? মাফিয়া চক্রের মেম্বার?

পুলিশ সারা শহরে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে - তুমি কি ভ্যানিশ হওয়ার মন্ত্র জানো যে পুলিশ তোমায় খুঁজে পেল না? কোথায় লুকিয়ে ছিলে তুমি এতক্ষণ? কোথায় লুকিয়ে ছিলে?
- বলছি বলছি সব বলছি তোমাদের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এবং আমি চাই না আমার সম্পর্কে তোমাদের মনে কোনো ভুল ধারণা থেকে যাক, তাই এসেছি যাওয়ার আগে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার জন্য জানি তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন তোমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অধিকার আমার নেই কিন্তু তার আগে আমায় কথা দিতে হবে, আমি যা বলব, তা তোমাদের চারজনের বাইরে আর কারোকে জানাতে পারবে না তোমাদের মা-বাবাদেরও নয়
টুটুল বলে, আমরা রাজি সবাই ওর সঙ্গে গলা মেলায় চারটে মাথা পরমাকে ঘিরে ঘন হয়ে বসে
- তোমরা নিশ্চয়ই ব্রাহ্মজ মিসাইলের খবর পড়ে থাকবে কিছুদিন আগেই এই মিডিয়াম রেঞ্জ সুপারসোনিক অস্ত্রটার সফল টেস্ট-ফায়ার হল এই সাফল্য কিন্তু সহজে আসেনি প্রায় বছর দশেক আগে, ২০০৯ সালে প্রথমবার যখন এর টেস্ট-ফায়ার হয়, মিসাইলটা মুখ থুবড়ে পড়ে ঠিক সেই সময় আমেরিকায় বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্ৰহণ করছিলেন আর সেখানকার মিলিটারি দিয়েছিল জিপিএসের সিগন্যাল অফ করে মিডিয়ার সামনে জিপিএসের গন্ডগোলকেই এই অসাফল্যের কারণ হিসেবে দর্শানো হয় কিন্তু ভারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের একটা অংশ দাবি করেছিলেন, এটা সাবোত্যাজ ছাড়া কিছুই নয় এবং এরই ফল হিসেবে একটা টপ সিক্রেট প্রজেক্ট লঞ্চ করা হয় যার নাম রাখা হয় পরমা জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত পরমা এই ধরনের হাই প্রোফাইল ষড়যন্ত্রমূলক কাজের বিরুদ্ধে শ্যাডো ওয়র চালিয়ে যাচ্ছে ভাইরাস ঢুকিয়ে শত্রুর কম্পিউটার সিস্টেম অচল করে দেওয়া থেকে শুরু করে, তাদের আস্তানা বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া অবধি সবরকম কভার্ট অপারেশন চালানর জন্য প্রশিক্ষিত করা হয় পরমার টিম মেম্বারদের
এতক্ষণ সবাই চোখ গোল্লা করে পরমার কথা শুনছিল এবার বুবাই প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে - তাহলে তোমার নাম...?
- না পরমা নয় ইন ফ্যাক্ট, আমার এখন কোনো নাম নেই - আমার পরিচয় এখন শুধু একটা বিশেষ নম্বরে আর সেটা জানে পরমার টিমে যারা আছে, কেবলমাত্র তারাই
আমবাগানে ঢোকার সময় তোমাদের মুখোমুখি পড়ে যাওয়াটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত আমার কাজের জন্য দিনের আলোর প্রয়োজন ছিল আর আমাদের স্ট্র্যাটেজি টিমের ইনফর্মেশন অনুযায়ী, ঐ সময়ে ওখানে কারোর থাকার কথাই নয়
আমাদের নিয়মমতো, অ্যাকশনের সাক্ষী রাখা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, তোমরা ক্ষতিকর নও না হলে হয়তো অন্য ব্যবস্থা নিতে হত
- অন্য ব্যবস্থা? শুট অ্যাট সাইট? চার বিচ্ছুর চোখ কপালে
- না না বাচ্চাদের জন্য ব্যবস্থাটা নয় হয়তো তোমাদের কিছুদিনের জন্য সরিয়ে দেওয়া হত অন্য জায়গায় কিন্তু তোমাদের দেখেই আমার মনে হয়েছিল তোমাদের বিশ্বাস করা যায় তাই তোমাদের যেতে দিয়েছিলাম
- সবই তো বুঝলাম কিন্তু আমবাগানের পোড়োবাড়িটা হঠাৎ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন সেটা তো বল নাকি সেটা টপ সিক্রেট, বলা যাবে না?
পরমা কোনো উত্তর দেয় না খানিকক্ষণ চুপটি করে ওদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ওরাও জোর করে না, কিন্তু মনে মনে চায় পরমাদি যেন ওদের পুরো আ্যকশনের ঘটনাটা সবিস্তারে বলে
- খুব জানতে ইচ্ছা করছে না মিশনটা সম্বন্ধে?
ওরা খুব প্রত্যাশা নিয়ে পরমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে
পরমা চট করে সিদ্ধান্তে আসে বলে - দেখ তোমরা হলে দেশের ভবিষ্যৎ দেশের জন্য মিলিটারি আর সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা সর্বক্ষণ নিঃশব্দে কীভাবে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে তা জানলে তোমরা ভবিষ্যতে দেশের সেবা করার অনুপ্রেরণা পাবে কিন্তু যে কোনো ইনফর্মেশনের গোপনীয়তা রক্ষা করাটাও একটা বিরাট দায়িত্ব আমার মনে হয়েছে সেই দায়িত্ব নেওয়ার মতন ম্যাচিওরিটি তোমাদের আছে তাই আমি এই পুরো অপারেশনটার কথা তোমাদের বলার সিদ্ধান্ত নিলাম
পরমা মিটিমিটি হাসতে হাসতে মুখগুলো দেখে কিশোর মুখগুলো খুশি আর গর্বে ঝলমল করছে

১০
পরমা পুরো ঘটনাটা বলতে শুরু করে দেখা যায়, অন্য সব গুণের মতন গল্প বলাতেও মেয়েটা ভারী দক্ষ
ছোটো শহরের একটেরে একটা ঝোপজঙ্গলে ভরা আমবাগান তার মাঝমধ্যিখানে একটা পোড়ো বাড়ি বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে আর পিছনদিকে পাঁচিলের প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেছে ট্রেন লাইন বাড়ির মালিকের ঠিকঠিকানা নেই যতরকম কুকার্য করার জন্য এর থেকে ভালো ঠিকানা আর কীই-বা হতে পারে? এর ওপর এক কাল্পনিক বুড়ির গল্প খাড়া করে ভূতুড়ে বাড়ির গুজব ছড়িয়ে বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে কৌতূহলী লোকজনকে তফাৎ রাখা কী আর এমন কঠিন কাজ? শুধু বছরে একবার কোনো একটা এজেন্সিকে কনট্র্যাক্ট দিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা বচ্ছরকার আমগুলো পেড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য
কিন্তু কারা করতে চাইবে এমন কাজ? লাভ কী তাদের এসব করে? টুটুল প্রশ্ন করে
- যারা বায়ো-ওয়েপনস বানায় তারা
জোড়া জোড়া বিস্ফারিত চোখ আর এত্ত বড়ো বড়ো হাঁ-ওয়ালা মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরমা বলে যায়
- রাতের অন্ধকারে মালগাড়ি থেকে ঝপাঝপ পড়তে থাকে বড়ো বড়ো পেটি মাটির তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে সেগুলো চলে আসে পোড়োবাড়ির বেসমেন্টে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছে মারণ জৈব অস্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে আবার উলটো পথে তারা পাচার হয়ে যায় - ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে
- কতদিন ধরে চলছে এসব? বুবাই প্রশ্ন করে
আমাদের টিম খোঁজ করে জানতে পারে যে সম্পত্তির শেষ বৈধ দাবিদার মারা যান তা আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রায় তখন থেকেই এই বিশাল সম্পত্তি দুস্কৃতিদের দখলে তখন থেকেই ক্রমশ হাত বদল হতে হতে এই বাড়ি আর আমবাগান জীবাণুর কারবারিদের হাতে আসে মাটির তলায় গোপনে তৈরি হয়ে চলে ভয়ঙ্কর সব জার্ম আর পাচার হয়ে যায় পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম টেররিস্ট সংগঠনগুলোর কাছে এমনকি কিছু দেশের সিক্রেট এজেন্সিগুলোও ছিল এদের কাস্টমার লিস্টে
প্রায় দু-বছর ধরে ট্র্যাক করে তবে এই আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায় মাত্র সাতদিন আগে আস্তানার সন্ধান পাওয়াটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ সন্ধান যেই পেয়ে গেলাম, বেসটা উড়িয়ে দেওয়া তো বাঁ হাতের খেল
সবাই অ্যাত্তো বড়ো হাঁ করে পরমার কথাগুলো গিলছিল এবার টুটুল জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, ব্লাস্টের সময় ল্যাবের মধ্যে মানুষ ছিল না? তারাও নিশ্চয়ই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছে?
- মিশনটা অতটাও সোজা ছিল না
- মানে?
- রিসার্চার, আ্যসিস্ট্যান্ট আর গার্ড নিয়ে জনা পাঁচেক কর্মী ছিল ল্যাবের মধ্যে আমার ওপর নির্দেশ ছিল ওদের সবাইকে বন্দি করে বাইরে পাঠিয়ে তারপর ল্যাবটা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার
- তুমি তাই করলে? চারমূর্তি একসঙ্গে প্রশ্ন করে
- পাঁচজনকে ক্যাপচার করতে পারিনি... একজন মারা যায়
পরমা ক্যাজুয়ালি বলে
- বছরের পর বছর ধরে মাটির তলায় কার্যত বিনা বাধায় কাজকম্ম চালিয়ে গিয়ে ওদের আত্মবিশ্বাস একেবারে তুঙ্গে উঠে গেছিল সিকিউরিটির ব্যবস্থা একদম ঢিলাঢালা হয়ে পড়েছিল অ্যাবাভ দ্য গ্ৰাউন্ড সারভাইলেন্স সিস্টেমটাকে আগেই অকেজো করেছিলাম আমি যখন চুপিসারে মাটির নীচের ল্যাবে গিয়ে নামলাম, দেখলাম একটিমাত্র গার্ড, একটা লোহার বন্ধ দরজার সামনে বসে বসে ঢুলছে হাতে কিন্তু কালাশনিকভ
- কা লা নি ? বিস্ময়ের সমবেত বহিঃপ্রকাশ
আমি সামনে এসে দাঁড়াবার পর, বেচারা বন্দুকটা তোলারও সময় পায়নি তার আগেই দুটো চোখের মধ্যে সোজা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যাটাকে ধরাশায়ী করেছি কিন্তু ব্যাটা মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গিয়ে রাইফেলটা প্রায় হাতে তুলে নিয়েছিল আর-কি ফলে বাধ্য হয়েই রিভলবারটা ব্যবহার করতে হয় ঠিক কপালের মাঝখানে একটা বুলেট ...সব শেষ
সবাই একটু শিউরে ওঠে
- আরেকটা বুলেট খরচ হল লোহার দরজার লকটা ভাঙতে দরজা খুলতেই সামনে লম্বা করিডোর সোজা চলে গেছে সামনে অনেকটা অবধি ভেতরটা আর্টিফিসিয়াল আলোয় ঝলমল করছে ল্যাবটা একদম শেষ প্রান্তে লম্বা করিডোরের দুই পাশে বন্ধ দরজা দুপাশে চারটে চারটে করে কর্মীদের থাকার জায়গা বোঝাই যাচ্ছে
এক্ষুনি যদি কোনো একটা দরজা খুলে যায়, এই সোজা, লম্বা, আলোকিত করিডোরে লুকানোর কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না আমি বুকে হেঁটে এগোতে থাকি
তৃতীয় দরজাটার মুখে পৌঁছোনোর জাস্ট একটু আগে দরজাটা ফট করে খুলে গেল তাড়াতাড়ি বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলাম একটা পা দরজার মধ্যে থেকে বেরোনো মাত্র, হাত বাড়িয়ে পায়ে হ্যাঁচকা টান লোকটা ধড়াম করে পড়ে যেতেই ঘাড়ের মোক্ষম জায়গায় একটা ছোট্ট পাঞ্চ সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান এরপর লোকটাকে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলতে আমার লাগল ঠিক তিন মিনিট অজ্ঞান দেহটাকে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিই জোরে বন্ধ করি না - ভেতর থেকে লক হয়ে গেলে আবার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে বেকার সময় নষ্ট হবে
এবার আর বুকে হেঁটে নয়, সোজা পায়ে হেঁটে ল্যাবের দিকে এগিয়ে যাই মোটা গেজের স্টিলের দরজা সহজে ভাঙার নয় এসব হাই সিকিউরিটি লক বায়োমেট্রিকস ছাড়া খুলবে না কী করা যায়? দরজার গায়ে হাত বুলিয়ে একটা বোতামের মতন পাই সেটা টিপে দিই কিছুই হয় না এমন সময় পিছনে আওয়াজ সারি সারি দরজার একটা খুলে যাচ্ছে আমি দেয়ালে পুরো সাঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ল্যাবের ভেতরটা সাদা রঙের হবে আন্দাজ করেই সাদা রঙের পোশাক পরেছিলাম ফলে দেয়ালে মিশে যাওয়াটা সহজ হয়ে গেল
দরজা দিয়ে যে বেরোল তার চোখ হাতের ট্যাবে চলতে চলতেই কীসব যেন লিখছে ল্যাবের গেটের সামনে এসে সে চোখটা গেটের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করল রেটিনা স্ক্যানিং দরজাটা যেই আস্তে করে ডানদিকে সরতে শুরু করল, আমার দুটো হাত পেছন থেকে এসে সাঁড়াশির মতো করে ওর গলাটা টিপে ধরল মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে লোকটা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল থ্রি ডাউন
একটা পা গেটের ভেতরে রেখে লোকটাকে বাঁধতে লাগলাম ভেতর থেকে এই মুহূর্তে কেউ বের হয়ে এলে মুশকিল হবে
বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর পা দিয়ে ঠেলে ওকে আগে ভেতরে ঢোকালাম তারপর নিজে ঢুকলাম যা ভেবেছিলাম ভেতরে ঢুকে একটা এনক্লোজার মতন সেখানে হ্যাজম্যাট পোশাক, গ্লাভস আর মাস্কের সম্ভার আমি একটা সেট চাপিয়ে নিলাম কিন্তু আমি যাকে এইমাত্র ধরাশায়ী করলাম বেশ স্বাস্থ্যবান সে হাইট নিয়ে অবশ্য অসুবিধা হবে না এই লোকটির উচ্চতা কম প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টের আড়ালে দুটো মানুষকে কতটা আলাদা করে চিনে নেওয়া সম্ভব?

১১
বিশাল ল্যাবের দুই প্রান্তে দুজন সায়েন্টিস্ট কাজ করছে যাক! দুজনকে কাবু করাটা খুব একটা কঠিন হবে না প্রথমজনের দিকে এগিয়ে যাই আমার উদ্দেশ্যে কী যেন বলে উঠল সে মহিলা অচেনা ভাষা রাশিয়ান হতে পারে নড করে এগিয়ে যাই ওর পেছন দিকটায় পৌঁছোতে হবে আমায় ততক্ষণে আমার হাতে উঠে এসেছে আমার ছুরিটা মেয়েটার পিছন দিকে গিয়ে দ্রুত সেটা চালিয়ে পোশাকের পিছন দিকটা ফেঁড়ে দিলাম মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর আগেই ঘাড়ের নীচে মোক্ষম একটা চাপ মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে নেতিয়ে পড়ল ডেস্কের ওপর চার নম্বর ডান
বাঁধা শেষ করে যেই না মাত্র সোজা হতে যাব, ঘাড়ের কাছে একটা শক্ত স্পর্শ সঙ্গে সঙ্গে হাত মাথার ওপর তুলে ঘুরে দাঁড়ালাম সামনে হ্যাজম্যাট স্যুটে এবং মাস্কে মুখ ঢাকা ব্যক্তিটির হাতে একটা অটোমেটিক পিস্তল
- হু আর ইউ?
উচ্চারণে বিদেশী ছাপ স্পষ্ট পিস্তল ধরার ধরন দেখেই মনে হচ্ছিল, জীবনে বন্দুক চালায়নি নিছকই আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রাখে ...এই আর-কি
- প্লিজ ডোন্ট শুট
আমি আসলে টাইম বাই করতে চাইছিলাম
- টেলিং ইউ এভরিথিং
বলতে বলতে একচুল একচুল করে সামনে এগোতে লাগলাম সামনের বন্দুকধারী কি একটু অসতর্ক?
ঠিক তখনই পায়ে কী একটা ঠেকল মাথা এতটুকু না বেঁকিয়ে চোখ নীচু করে দেখে নিলাম... একটা ওয়েস্ট বাস্কেট
- আয়্যাম স্পাই
- স্পাইং ফর হুম?
এই দুটো কথা বলার জন্য যে ডিস্ট্র্যাকশনটা তৈরি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে ওয়েস্ট বাস্কেটটা পায়ে করে অনেকটা উঁচুতে তুলে সপাটে মুখ লক্ষ্য করে ছুড়লাম আঘাতের ইমপ্যাক্টে হাত থেকে পিস্তলটা খসে পড়ল আর তারপর ক্যারাটের এক প্যাঁচে বাছাধন কুপোকাৎ পাঁচ নম্বর চলে এল আমার কবজায়

১২
পরমা একটানা বলে এবার থামল এতক্ষণ সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে শুনছিল... বলা ভালো গিলছিল এবার সবাই একসঙ্গে কলরব করে উঠল, তারপর কী হল? এই মানুষগুলোকে বার করলে কীভাবে? বম্ব ব্লাস্টটা কখন হল?
- স্পেশাল সিগন্যাল পাঠাতেই হেলিকপ্টার চলে এল এয়ারলিফ্ট করা হল অজ্ঞান মানুষগুলোকে এরা এখন দেশের মূল্যবান আমানত অত্যন্ত সাবধানতা সহকারে দুটো হেলিকপ্টারে ভাগাভাগি করে তোলা হল চারজন বন্দি এবং একজন মৃত মানুষকে
আমি রয়ে গেলাম স্পটে বেসমেন্টের কোণে কোণে এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস প্লান্ট করলাম ডিটোনেটর হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম হেলিকপ্টার দুটো ততক্ষণে চলে গেছে আমি পাঁচিল ডিঙিয়ে রেললাইনের ধারে লাফ দিয়ে নামলাম তারপর ডিটোনেটরটা প্রেস করেই জোরসে স্প্রিন্ট টানতে লাগলাম পিছনে বিকট শব্দ করে এক বিস্ফোরণ ঘটল আমার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল কিন্তু ছোটা থামালাম না ছুটতে ছুটতে পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে আমি ততক্ষণে হাইওয়েতে উঠে যেখানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে আমার বাইকটা লুকিয়ে রেখেছিলাম সেখানে পৌঁছে গেছি
চারমূর্তির দল গোল গোল চোখ করে শুনছিল চোখের সামনে যেন হলিউডের আ্যকশন থ্রিলার চলছে তাদের চোখের সামনে যেন সিনেমার পর্দার মধ্যে থেকে সুপারম্যান নেমে এসেছে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ওরা পরমাকে

১৩
- হল তো গল্প শোনা? এবার তাহলে ওঠা যাক আমায় অনেক দূরের পথ যেতে হবে বাইক নিয়ে
- আরেকটা মিশন?
- ধরে নাও তাই
ওদের মুখগুলো মলিন হয়ে যায় দেখে পরমার মায়া লাগে কিন্ত নিজেকে সামলায় এই প্রফেশনে কোনোরকম মানসিক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অবকাশ নেই
সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে
- আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে এবার আমায় বেরিয়ে পড়তেই হবে
- তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে?
- আমি না চাইলে আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারে না চিন্তা কোরো না তোমাদের আমাকে দরকার হলে, আমি ঠিক তোমাদের কাছে পৌঁছে যাব
পরমা বারান্দায় পা দেয় দেয়াল বেয়ে নেমে যাবে কোমরে বাঁধা মাউন্টেনিয়ারিংয়ের রোপ কয়েল
এই সময় টুটুল বলে ওঠে, আমরা তোমায় একটু এগিয়ে দিয়ে আসি না? প্লিজ
ওর গলায় আকুলতা পরমা একটু ভাবে
- আচ্ছা আমি বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে তোমরা বেরিও বাড়ির গেটে একজন আর রাস্তার মুখে একজন কনস্টেবল মোতায়েন করা আছে পেছনের পাঁচিল টপকে ওদিকের রাস্তায় বেরোও তোমাদের বাড়ি থেকে রাস্তাটা সোজা গিয়ে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেই কর্নারের বাড়িটা ছেড়ে পরের বাড়িটার সামনে চলে এসো
হিলহিলে শরীরটা অনায়াসে দেয়াল বেয়ে নেমে যায়
খানিকক্ষণ বাদে আস্তে করে সদর দরজা খুলে ওরা বেরোয় খানিকটা হেঁটে, খানিকটা জগ করে দশ মিনিটের মধ্যে ওরা পরমার বলা জায়গাটায় পৌঁছে যায় প্লটটা এক সরকারি প্রাইমারি স্কুলের গরমের ছুটি বলে স্কুল বন্ধ বৃদ্ধ দারোয়ান মিশিরজি - বাড়িটার একমাত্র রক্ষক - পিছনদিকে নিজের ঘরে গিয়ে নির্ঘাত ঘুম দিয়েছে মেঘলা ভোরে জনমানবহীন জায়গাটা ভূতুড়ে লাগে
ওরা হাঁপাতে হাঁপাতে এদিক ওদিক দেখে ঠিক তখনই মেইন গেটের পাশের ছোটো দরজাটা দিয়ে বাইক ঠেলে পরমা বেরিয়ে আসে
বটেই তো! এত বড়ো একটা যান লুকিয়ে রাখার এর থেকে ভালো জায়গা আর হতেই পারে না ঝোপঝাড় আর ঝুপসো ঝুপসো গাছ নিয়ে জায়গাটা পুরো জঙ্গুলে হয়ে রয়েছে বুড়ো মিশিরজি স্কুল বন্ধ থাকাকালীন এদিকটায় পা-ই মাড়ায় না
করুণ মুখে ছেলেগুলো পরমার সঙ্গে হাই ফাইভ করে তারপর পরমা তড়াক করে বাইকে চড়ে বসে মাথায় হেলমেটটা পরে নিয়ে হাতটা নাড়ে একবার তারপর মৃদু আওয়াজে স্টার্ট দিয়ে তুখোড় স্পিড তুলে বেরিয়ে যায়
ওরা মুগ্ধ, শ্রদ্ধাবিনম্র মুখে তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথের দিকে দেশের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ তরুণ এক সৈনিক নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে, লোকচক্ষুর আড়ালে এমনকি নিজের কোনো পরিচয় পর্যন্ত নেই ওর কোনো অপারেশনে মৃত্যু হলে শহীদের সম্মান পর্যন্ত জুটবে না
বুবাই পা দুটো জোড়া করে খটাস করে একটা স্যালুট ঠোকে অন্যরাও তাই করে তারপর বাড়ির পথে পা বাড়ায় ওরা

১৪
এক বছর পর
প্যানডেমিকের কারণে জীবনযাত্রা বদলে গেছে আমবাগান বিস্ফোরণের রহস্যভেদ হয়নি শহরের লোকেরা এখনও ঘটনার অভিঘাত থেকে বেরোতে পারেনি নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত থিওরি ঘোরাঘুরি করে বাজারে সেগুলোকে নাকচ করে মানুষ আবার নতুন একটা কিছু মাথা দিয়ে বার করে
লকডাউনের মধ্যে তো রিউমার-মিল ডাবল গতিতে কাজ করছে
এ বছর আর গরমের ছুটি বলে কিছুই নেই তবে আমবাগানে গিয়ে আম চুরি করে মজা পাওয়ার মানসিকতা ওদের আর নেই ওরা পরমার সংস্পর্শে এসে এক লাফে অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে নিঃশব্দে ভালো কাজ করার বীজমন্ত্র দিয়ে গেছে যেন মেয়েটা ওদের চারমূর্তি তাদের পুরোনো শহরটার পরিবেশ আর ঐতিহ্য রক্ষার ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে কত ছেলেমেয়ে যোগ দিয়েছে ওদের মিশনে আপাতত ওদের স্বপ্ন হল বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্ৰস্ত আমবাগানটাকে আবার গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা আর জায়গাটাকে রিয়েল এস্টেট শার্কদের হাত থেকে বাঁচানো কোভিডের উৎপাত শুরু হওয়ার আগে ওদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল এখন ওরা অনলাইন সিগনেচার ক্যাম্পেন চালাচ্ছে এই ঐতিহাসিক বাগানটাকে হেরিটেজ এস্টেটের তকমা পাওয়ানোর জন্য বাইরের রাজ্য থেকে কাজ খুইয়ে ফেরা কিছু শ্রমিককে ওরা বাগান সংস্কারের কাজে লাগিয়েছে এ বছর আমের ফলন সেরকম হয়নি যা হয়েছে সে সব সময়মতো কাছাকাছি পাইকারি বাজারগুলোয় বিক্রি করার ব্যবস্থা করে ওরা নিজেদের ফান্ড বাড়িয়েছে এসবই হাসিল করেছে তের থেকে ষোল বছরের একদল কিশোর ...বড়োদের কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই ওরা ওদের জীবনের মিশন খুঁজে পেয়ে গেছে
পরমা বলে গেছে আবার দেখা হবে চার কিশোর পথ চেয়ে বসে আছে
----------
ছবি – সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment