ম্যাজিক পেনসিল: গল্প:: মেহরানগড়ের ভূত - অদ্রিজা মণ্ডল

ম্যাজিক পেনসিল
ছোটোদের নিজস্ব বিভাগ

এবারের ম্যাজিক পেনসিল বিভাগে একটি বড়োগল্প পাঠিয়েছে ক্লাস এইটের ছাত্রী অদ্রিজা মণ্ডল। এসো, পড়ে নেওয়া যাক গল্পটা...


মেহরানগড়ের ভূত
অদ্রিজা মণ্ডল
অষ্টম শ্রেণী, সেণ্ট মেরীজ কনভেণ্ট স্কুল, সাঁতরাগাছি

“মেহরানগড় ফোর্ট বেড়াতে যাবি?” আচমকা এই প্রশ্ন শুনে আমি চমকে গেলাম বই বন্ধ করে বললাম, “ব্যাপার কী?” রিমি আমার পাশে বসে ছোট্ট সোফাটা তার ডলহাউসের মধ্যে ঢোকাচ্ছিল তেরো বছর বয়সেও সে পুতুল নিয়ে খেলতে ভারী ভালোবাসে তার বিরাট ডলহাউসের একভাগ বাড়ি, একভাগ স্কুল ও তার সামনে একভাগ শপিং মল ও তার পাশে পার্ক সোফাটা ঢোকাতে ঢোকাতে প্রশ্নটা করল আমার কথায় বলল, “কেন, এমনি বেড়াতে যাব!” আমি বললাম, “বেশ তো! জিত আর দেবকে জানিয়ে দিই
জিত আর দেব দুই ভাই – পরমজিত আর দেবাদিত্য সামন্ত আমরা চারজন একই ক্লাসে পড়ি চারজনে টিকিয়াপাড়ায় একই ফ্ল্যাটে থাকি আর রোজ সকালে একসঙ্গে সাইকেলে করে স্কুলে যাই আমরা পড়ি নারায়ণা স্কুলের ক্লাস এইটে আমি আমার ফোনে জিতকে ফোন করলাম ফোন ধরল দেব বলল, “কী রে, এত সকালে কী ব্যাপার?” আমি বললাম, “জিত কোথায়? তোর রিমিমণির মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি এসেছে” ওদিক থেকে মনে হল দেব একটু জোরে নিঃশ্বাস টানল – রিমি আর দেব খুব ভালো বন্ধু তারপর দেব বলল, “রিমিকে ফোনটা দে” আমি মনে মনে একটু হেসে নিয়ে স্পিকারটা অন করে রিমির হাতে দিলাম রিমি ফোন ধরে বলল, “কে?” ওপার থেকে সকৌতুক উত্তর এল, “আমি তোমার সুদূর পিয়াসী” তাতে রিমির মুখখানা লাল হয়ে গেল আর আমি থাকতে না পেরে হা হা করে হেসে উঠলাম ওদিক থেকে দেব হাসতে হাসতে বলল, “কী রে, এইটুকু কথাতেই রিমিমণি ভড়কে গেল নাকি?” রিমি ধমকাল, “কথাটা শুনবি না কেটে দেব?” দেব বলল, “আচ্ছা বল” রিমি বলল, “আমরা প্ল্যান করেছি যে এবার আমরা মেহরানগড় ফোর্টে যাব কী বলিস?” দেব বলল, “দাঁড়া জিতকে বলছি” একটু পরে জিতের গলা শুনতে পেলাম, “মেহরানগড় ফোর্ট? ভালো আইডিয়া দিলি বটে কবে যাবি?” রিমি বলল, “তোদের ঘরে গিয়ে কথা বলব” জিত বলল, “ঠিক আছে, আধঘণ্টা বাদে আয় আমাদের একটু কাজ আছে” বলে ফোনটা কেটে দিল
আধঘণ্টা পর আমরা আমাদের ঘরের পাশের ঘরটায় গেলাম রিমি ঠকঠক করতেই জিত এসে খুলে দিল, বলল, “আয়, ভিতরে চল” আমরা ভিতরে গিয়ে জিত আর দেবের ঘরে এলাম দেব বসে বসে কয়েকটা জামাকাপড় ভাঁজ করছিল রিমি গিয়ে হাত লাগাল আমি জিতের পাশে বসে বললাম, “তো কীভাবে যাব ঠিক করলি?” জিত বলল, “ফ্লাইটে গেলে কেমন হয়?” আমি চমকে গিয়ে বললাম, “পাগল নাকি? ফ্লাইটের প্রচুর দাম!” জিত নিরস্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা, ট্রেনে যাব, কিন্তু কোন ট্রেন?” আমি ফোন খুললামখুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বলে উঠলাম, “এই তো, ভালো ট্রেন পেয়েছি” রিমি আর দেব কাজ ফেলে এগিয়ে এল, বলল, “কী ট্রেন রে?” আমি একবার গলা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, “হাওড়া টু দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস বিকেল চারটে পঞ্চাশে ছাড়ে আর বেলা দশটা পাঁচে নিউ দিল্লি পৌঁছোয়” দেব একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “নিউ দিল্লি কেন? যাচ্ছি তো যোধপুরে বেড়াতে, কুতুব মিনার তো দেখতে যাচ্ছি না” আমি বিরক্ত হলাম - দেবটা বড্ড অধৈর্য! বললাম, “পুরো প্ল্যানটা কি বলেছি? দাঁড়া না ধৈর্য ধরে” দেব মুখ ব্যাজার করে কাজ শুরু করে দিল আর আমি খুঁজে খুঁজে দিল্লি থেকে যোধপুরের মান্দোর এক্সপ্রেস পেলাম দেখলাম যে ট্রেন ছাড়বে ন’টা কুড়িতে ওল্ড দিল্লি থেকে আমি ভাবলাম যে কী করা যায় ভেবেচিন্তে আমি কূলকিনারা পেলাম না জিতকে বললাম, “দিল্লি থেকে যোধপুরের ট্রেন পেয়েছি, কিন্তু দেখছি যে ট্রেন ছাড়বে রাত ন’টা কুড়ি নাগাদ অতক্ষণ বসে কী করব? বাকি ট্রেন তো সব ভোরবেলা ছাড়ে” জিত দু-মিনিট কী যেন ভাবল তারপর বলল, “আমি শুনেছি যে নিউ দিল্লি স্টেশনে একটা এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জ আছে আমরা যদি সেখানে বুক করে রাত অবধি থাকি, তাহলে ভালো হয় না? মাঝে দিল্লির দু-একটা জায়গায় ঘুরঘুর করে তারপর রাতে নিউ দিল্লি থেকে মেট্রো করে ওল্ড দিল্লির মেট্রো স্টেশন চাঁদনি চকে নেমে সেখান থেকে ওল্ড দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন অবধি হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম! কেমন হয় তাহলে?” আমি একটু ভাবলাম তারপর বললাম, “ভালো প্ল্যানকবে যাবি?” জিত বলল, “এখনই বুক করে নে, শীতের ছুটিতে যাব” আমি টুক করে সব বুক করলাম এই সব করতে গিয়ে আমাদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে বেশ কিছু টাকা খরচ হল সেই সঙ্গে আমরাও সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম সমস্ত পরীক্ষা, প্রজেক্ট আর পড়াশোনার চাপের মধ্যে আমাদের চারজনের মনে একটা ছোট্ট উচ্ছ্বাস লেগে রইল – মেহরানগড় কেল্লায় যাওয়া
অবশেষে সেই দিনটি এলডিসেম্বরের কুড়ি তারিখে বড়োদিনের উত্সব উপলক্ষ্যে ছুটি ঘোষণা করল স্কুলে আর আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম কুড়ি তারিখেই আমাদের ট্রেনে এসি থ্রি টায়ারে বার্থ বুক করা ছিল আগের দিন ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছিল তাই স্কুল থেকে বারোটায় ফিরে শুয়ে পড়লাম আমি একটা লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটলাম রিমি ব্যাগপত্তর রেডি করল দুপুর সাড়ে তিনটেতে আমরা টিকিয়াপাড়া থেকে ট্রেনে উঠলাম হাওড়াতে পৌঁছে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন এল আমরা উঠে পড়লাম
এইসময় আরও একজন লোক উঠল তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম অস্ফুটভাবে বললাম, “বরুণ ঘোষ” বরুণ ঘোষ আমাদের নীচের ফ্ল্যাটে থাকেন বাইরে ভালোমানুষ সেজে থাকেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি এক পাচারকারি দলের সঙ্গে যুক্ত গত বছর আমরা চারজন মিলে তাঁর পাচারের কাজকর্মের কথা জানতে পেরে পুলিশকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে মাসকয়েক জেলে থাকতে হয়েছিল জিতই প্রথম তা জানতে পেরে পুলিশকে জানিয়েছিল বরুণবাবু কিছু বললেন না, শুধু জিতের দিকে এক ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেনতারপর চুপচাপ স্যুটকেস আর ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন জিত বিচ্ছিরিভাবে ভেংচি কেটে বলল, “রাগে মনে হচ্ছে জল ফেলা হয়নি ওর কথায় আমরা সবাই হেসে ফেললাম তারপর ট্রেন চলা শুরু করলে আমরা স্ন্যাক্স খাওয়া শেষ করলাম তারপর আমি আমার প্রিয় বই ‘ঝিন্দের বন্দী’ নিয়ে সাইড আপার বার্থে উঠে পড়লাম রিমি ফোন নিয়ে কানে আইপড লাগিয়ে চোখ বুজে আমার নীচের বার্থে শুয়ে গান শুনতে লাগলজিত আর দেব ফ্রি ফায়ার খেলতে বসে গেলদু-ঘণ্টা পর যখন গৌরী শঙ্করের সঙ্গে কস্ত্তুরী বাঈয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হল, তখন জিত ডাকল, “এই ইমন! ন’টা বাজে, খাবি আয়” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “দাঁড়া না, আগে কস্তুরী গৌরীকে দুটো কথা বলুক” “ধ্যাত্তোর, কস্তুরী আর গৌরী! নেমে আয় না!” অগত্যা আমি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে নেমে এলাম
খাওয়া শেষ হতে হতে সাড়ে ন’টা বেজে গেল আমি তারপর মুখ ধুতে গিয়ে ঘোষবাবুর সঙ্গে ধাক্কা খেলামঘোষবাবু ‘সরি’ বলে চলে গেলেন আমার হঠাৎ মনে হল, ঘোষবাবু কিছু বদ-অভিসন্ধি করেছেন আমি জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে টের পেলাম যে কী একটা রয়েছে বার করে দেখলাম যে একটা ছোটো মাইক্রোফোন বুঝতে পারলাম যে ঘোষবাবু আমাদের প্ল্যান রেকর্ড করতে চান আমি মাইক্রোফোনটা পকেট থেকে বার করে ভিতরে এলাম তখন জিত, দেব আর রিমি শুয়ে পড়েছে আমি আসতে আসতে কিছু দূরে গিয়ে দেখি যে ঘোষবাবু শুয়ে আছেন চোখ বুজে, তাঁর নিজের বার্থেআমি খুব আস্তে করে তাঁর ব্যাগ খুলে মাইক্রোফোনটা রেখে আবার ব্যাগটা বন্ধ করলাম তারপর পা টিপে টিপে জায়গায় ফিরে এলাম তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম
সকালবেলায় ঘুম ভাঙল যখন একটুকরো রোদ পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে ঘরে জিত হাঁক দিল, “ওরে এই মেয়েগুলো, সাতটা বাজে রে, এক ঘুমে পুরো জার্নি কাবার করে দিবি নাকি?” আমি পর্দা সরিয়ে উঠে পড়লামতারপর টয়লেটে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বললাম, “যা আছে দে দেখি, খুব খিদে পেয়েছে” জিত পাঁউরুটি আর কলা দিলবলল, “কফি এলে দিচ্ছি” খাওয়া শেষ করে বই নিয়ে বসে গেলাম খানিকক্ষণ পড়ে তারপর শুয়ে ‘ঝিন্দের বন্দী’ পড়তে শুরু করলাম দশটা পাঁচে দিল্লি স্টেশনে আমরা নামলামজিত বলল, “চল, লাউঞ্জের খোঁজে যাই” লাউঞ্জে পৌঁছোতে কয়েক মিনিট লাগল গিয়ে টিকিট দেখাতে কর্মচারীরা ঘর দেখিয়ে দিল সেখানে সব গুছিয়ে রেখে জামা চেঞ্জ করে বেরিয়ে পড়লাম একটা ট্যুরিস্ট বাসে করে আমরা ঘুরতে গেলাম প্রথমে রাষ্ট্রপতি ভবন দেখে ইণ্ডিয়া গেটের দিকে গেলাম তারপর বারোটায় কুতুব মিনারে নামলাম সেখানে লৌহস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে লেখাটা পড়তে লাগলাম দেব আর রিমি সেলফি তুলতে চলে গেল আমি জিতকে ফিসফিস করে কাল রাতের ঘটনা বললাম জিত শুধু বলল, “বেশ করেছিস” লাল কেল্লা দেখে শেষে লাউঞ্জে ফিরলামতারপর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মেট্রো স্টেশনে মেট্রো ধরে চাঁদনি চকে নেমে স্টেশনের দিকে গেলাম ট্রেন এল ঠিক সময়ে আমরা উঠতেই দেখি একটা ছেলে বসে আছে, একুশ বাইশ বছরের সে একবার চুপ করে আমাদের সবাইকে দেখল তারপর বলল, “তোমাদের কি এই বার্থ বুক করা?” আমি হিন্দিতে বললাম, “একটা আপার, একটা মিডল, আর একটা সাইড আপার–লোয়ার আমাদের” “আমি লোয়ার বুক করেছি তোমরা কি বাঙালি? কোথা থেকে আসছ?” ছেলেটি এবার আমাদের অবাক করে দিল, বাংলায় কথা বলে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, রাজস্থানী ছেলে আমি বললাম, “আমরা বাঙালি আপনি?” ছেলেটি বলল, “আমার জন্ম আর পড়াশোনা কলকাতায় কিন্তু আমি রাজস্থানী মহারাজ সর্দার সিং-এর নাম শুনেছ? আমি তাঁর বংশধর কুমার কল্পেশ সিং আমায় কল্পেশদা বলে ডাকতে পারো” জিতের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে সে কথা হারিয়ে ফেলেছে কল্পেশদা বলল, “অবাক হয়েছ, না? তোমাদের নাম কী?” আমি আমাদের সবার নাম বললাম কল্পেশদা বলল, “যোধপুর যাচ্ছ?” রিমি বলল, “মেহরানগড় ফোর্ট দেখব” কল্পেশদা প্রায় লাফিয়ে উঠল, “আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি যাবে? তাহলে আমার সঙ্গে এসো আমি দারুণ দারুণ জিনিস দেখিয়ে দেব” জিত বলল, “তাই?” তারপর রাতটা গল্প করেই কেটে গেল জানতে পারলাম যে, কল্পেশদা নারায়ণাতেই (দুর্গাপুর) পড়েছে, তারপর আই.আই.টি-তে সুযোগ পেয়েছে তাই যাবার আগে সে একবার পৈতৃক কেল্লাটা দেখতে যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে সে একই হোটেলে আছে পরদিন সকালে আমরা ট্রেন থেকে নেমে অটো করে এলাম, কল্পেশদা আলাদা অটোয় সারাদিন আমরা যোধপুর ঘুরলাম কল্পেশের সঙ্গে। রাত্তিরবেলা সাড়ে দশটায় কল্পেশদা বলল, “মেহরানগড় ফোর্ট যাবে?” আমরা একটু ইতস্তত করলাম, কিন্তু জিত আগ বাড়িয়ে বলল, “যাব না মানে? আলবাত যাব!” অগত্যা আমরা জামাকাপড় চেঞ্জ করলাম কল্পেশদা আমাদেরকে নিয়ে বাইরে গিয়ে অটো ভাড়া করল ড্রাইভার একটু আপত্তি করতে কল্পেশদা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করাল আমরা অটো করে যখন পৌঁছোলাম তখন বাজে রাত বারোটাআমাদের নামিয়ে দিয়ে অটো পত্রপাঠ চলে গেল আমার তখন ঘুম পাচ্ছিল রাতে প্রচুর খাবার সাঁটিয়ে এসে ঝিমুচ্ছিলামহঠাৎ রিমি আমার মাথায় টোকা মারল, বলল, “ও দিকে দেখ!” দেখি যে জিত, দেব আর কল্পেশ এগিয়ে গেছে তাড়াতাড়ি ওদের পিছু নিলাম রিমির সঙ্গে, কিন্তু ভিতরে ঢোকবার আগে দেখলাম, কিছু দূরে একটা অটো থেকে বরুণবাবু আর তাঁর ছেলে ঈশান নামছে
অনেকক্ষণ ধরে ফোর্টের ভিতরটা দেখলাম তারপর রিমি বলল, “একটু জিরিয়ে নেওয়া যায় না?” ফোর্টটা ভাঙাচোরা ছিল একট বিরাট পাথরের পিছনে অদ্ভুতভাবে একগাদা চাদর রাখা ছিল কিন্তু আমার যা ঘুম পাচ্ছিল, আমি বললাম, “এগুলোই বিছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ি” জিত গিয়ে চাদর আলাদা করে দিয়ে বিছিয়ে দিল আমরা তাতে বসলাম আমি শুয়ে পড়লাম একটু তন্দ্রা এসেছে সবে জিত পাথরের গায়ে গা এলিয়ে নাক ডাকাচ্ছে রিমি আর দেব পাশাপাশি শুয়ে পড়েছে আর ঘুমোচ্ছে কল্পেশদাও ঘুমিয়ে পড়েছে
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটু ঠান্ডা বাতাস বইল সঙ্গে সঙ্গে নূপূরের রুমঝুম শোনা গেল, যেন নূপূর পায়ে কে যেন হাঁটছে পাথরের পাশে এসে নূপূরের শব্দ বন্ধ হল আমি আস্তে করে উঠে বসলাম ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলাম – রাত বারোটা পাঁচ!
হঠাৎ করে কান্নার শব্দ আমার কানে এল উঠে গিয়ে দেখি – রিমি! আমি ডাকলাম, “রিমি!” রিমি উত্তর দিল না তখন পিছনে দেখি শুধু কল্পেশদা শুয়ে রয়েছে আর পাঁচটা ব্যাগ আছে ভয়ে আমি চিত্কার করে উঠলাম, কিন্তু কান্না বন্ধ হল না কল্পেশদা ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল, “কী হল! কী হল!” তারপর চোখ কচলে নিয়ে বলল, “কী হয়েছে ইমন?” আমি তখন ভয়ে সাদা হয়ে থরথর করে কাঁপছি। কল্পেশদা উঠে দাঁড়িয়ে দেখল রিমিকেতারপর বলল, “ও তো জিনস শার্ট পরে ছিল, রানির পোশাক কোত্থেকে পেল?” আমি ভয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “জিত কই? দেব কই? রিমির কী হল? ও কল্পেশদা, আমি কি...” কথা শেষ করবার আগেই কল্পেশদা বলে উঠল, “কে ওখানে?” সঙ্গে সঙ্গে কে যেন একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল তার মাথায় ঢিল লাগতেই রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে লাগল তার মাথা থেকে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল কল্পেশদা আমি ভয়ে দিশাহারা হয়ে ‘কল্পেশদা’ বলে চিত্কার করে উঠলাম, কিন্তু ততক্ষণে আততায়ী পালিয়ে গেছে কল্পেশদা ধপ করে বসে পড়ল তারপর অতিকষ্টে বলল, “রুমাল থাকলে মাথাটা বেঁধে দাও” আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে রুমাল নিয়ে ব্যাগ বন্ধ করে তার মাথায় রুমালটা বেঁধে দিলাম কল্পেশদা বলল, “জল দেবে?” আমি ব্যাগ থেকে বোতল বার করে তার হাতে দিলামখেয়ে সে ‘আঃ’ বলে পাথরের গায়ে হেলান দিল আমি দাঁড়াতেই হঠাৎ গুলি ছুটে এল, এসে লাগল কাঁধে সে সঙ্গে সঙ্গে চিত্কার করে কাঁধ চেপে লুটিয়ে পড়ল অমনি চড়াত করে আমার রক্ত গরম হয়ে গেল আমি এবার ব্যাগ থেকে একটানে ছোরা আর দড়ি বার করে গুলি যেখান দিয়ে এসেছিল, সে দিকে ছুটে গেলাম গুলি আবার ছুটে এল আমি সঙ্গে সঙ্গে পা হড়কে ধপ করে আছাড় খেলাম গুলি মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল আমি কোনোমতে উঠে একটা থামের পিছনে গিয়ে লুকোলামসেখানে বসে তাড়াতাড়ি একটা বড়ো ফাঁস শক্ত করে বাঁধলাম তখনও আমার হাত কাঁপছে তারপর উঠে আমি অন্ধকারে মিশে মিশে আস্তে আস্তে গেলাম ভাগ্য ভালো, ঠান্ডা বলে আমি কালো জ্যাকেট আর জেগিংস পরেছিলাম তাই কোনো অসুবিধা হল না দড়িটা তখন আমার হাতে ছিল আমার ছোরা ছিল পকেটেএকসময় দেখি কারা যেন টর্চ জ্বালিয়ে বসে আছে কাছে গিয়ে দেখে প্রায় চিত্কার করে উঠলাম দেখি বরুণবাবু আর তাঁর ছেলে ঈশান বসে আছে আমি সুট্‍ করে থামের পিছনে লুকোলাম শুনলাম বরুণবাবুকে ঈশান বলছে, “বাবা! দিব্য তো বাড়িতে ছিলাম এসব বিপদ ডেকে আনলে কেন?” বরুণবাবু বললেন, “সাধে কি এনেছি? তুই তো কল্পেশের বন্ধু তোকে নিশ্চয়ই বলেছে এই কেল্লার গুপ্ত কুঠুরির কথা!”
- “কীসের কুঠুরি, কিসের কী?”
- “আরে, সেদিন যে নকশার ছবি পাঠালাম!”
- “ডিলিট করে দিয়েছি, দেখিনি কোনো দরকারি জিনিস না পাঠিয়ে এসব উলটোপালটা জিনিস পাঠাও কেন? তোমার এসব স্মাগলিং কারবারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই
- “ব্যাটা, তোর এত বড়ো সাহস?”
এবার ঈশান রাগে লাফিয়ে উঠল, “অনেক সাহস, বুঝলে! মা, দাদু, ঠাম্মা, দিদা, পিসিমা, মামা এরা সবাই বারণ করল, এসব কাজে নেমো না! কোনো কথা শুনলে না ছোটো থেকে এসব দেখে দেখেও কিছু বলবার সাহস পাইনি এসব জিনিস অভিশপ্ত আর এসব জায়গাও বিপজ্জনক! সেদিন ওদের হাতে ফেঁসে গিয়ে পুলিশের হাতে পড়ছিলে আর-কি! ভাগ্যে আমি বুঝিয়েসুঝিয়ে তোমায় ছাড়ালাম আর আমি সইব না... আঁ আঁ আঁ,” বলে ঈশান ককিয়ে উঠল আমি এগিয়ে দেখি, এক রাজা যেন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আর ঈশানের গলা টিপে ধরেছে আমি এগিয়ে দেখি - জিত! আমি আর থাকতে না পেরে চিত্কার করে উঠলাম, “জিত!!” জিত ঈশানকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাল আমি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলাম ঐ মুহূর্তে বরুণবাবু পিস্তল বার করে গুলি করতে গেলেন, কিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ছুঁড়লাম মোক্ষম টিপ! দড়িটা একেবারে বরুণবাবুর কোমর অবধি গলে গেল আর অমনি আমি এক হ্যাঁচকা টান মারলাম আর বরুণবাবু পড়ে গেলেনহাত থেকে পিস্তল পড়ে গেল এদিকে জিত সুযোগ নিয়ে আমি যে পথে এসেছি সেই পথে ছুটল আমি এই সুযোগে বরুণবাবু আর ঈশানকে দড়িটা দিয়ে থামের গায়ে শক্ত করে বেঁধে ঈশানের পিস্তলটা তুলে নিয়ে ছুটে গেলাম উলটোদিকে যে পাথরের কাছে আমরা ছিলাম। সেখানে আর এক দৃশ্য আমি তাড়াতাড়ি পাথরের পিছনে লুকালাম জিত রিমিকে বলছে, “হমে হিঁয়া সে চলনা পড়েগা” রিমি কেঁদে বলল, “সর্দার, ইয়ে ক্যা কর রহে হো! মুঝে মত মারো” “শান্তিবাঈ কি আদেশ হ্যায় তুমে কাটনা হি পড়েগা,” জিতের এবার গলাটা কান্নাধরা “কিঁউ তুম শান্তিবাঈ কো শাদি কর রহে হো? মুঝে পসন্দ নহি আয়ী?” রিমি এবার আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল জিতের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে বলল, “নেহি, ম্যায়, তুমসে বহত প্যার করতি হুঁপর পিতাজি নে কহ দিয়া কি শান্তিবাঈ সে মেরে শাদি হোগি। মুঝে মাফ করো জাহ্নবী” রিমি জোর গলায় বলল, “তো চলো ম্যায় অব মৌত কে লিয়ে তৈয়ার হুঁ” তারপর দুজনে চলে গেল কল্পেশদা পাথরের পাশে পড়ে ছিল সে কাতরভাবে বলল, “কাঁধটা কিছু করো।” আমি বোতলে করে তার কাঁধে একটু জল দিলাম তারপর আর একটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দিলাম আমার কানে রিমির কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমি বললাম, “উঠতে পারবে এবার?” কল্পেশদা বলল, “চেষ্টা করি” এই বলে উঠে দাঁড়ালআমি ওকে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম একসময় একটা বিরাট হলে এলাম সেখানে মঞ্চে দঁড়িয়ে রিমি ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছে সত্যি রিমি মরবে নাকি? দেব তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখ নির্বিকার জিত আদেশ দিল, “তলোয়ার চালাইয়ে” দেব তরবারি ওঠাল তারপর যা ঘটল তা আমার ধারণারও বাইরে
পাশে রানি জাহ্নবী বাঈয়ের মানুষ সাইজের মূর্তি রাখা ছিল তলোয়ার পড়ার আগেই আমি তিনবার গুলি করলাম তারপর রিমিকে টান মেরে একপাশে সরিয়ে মূর্তি রাখলাম মূর্তি রানি সত্যি চিত্কার করে উঠল আর রক্ত ঝরতে লাগল রানি ছটফট করতে করতে পড়ে গিয়ে মূর্তি হয়ে গেল শুধু কে একজন সাঁ করে মূর্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আর অদৃশ্য হল এমন ভয়ংকর ঘটনা আমি কোনোদিন দেখিনি রিমি ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে এবার জিত আর দেবের শরীর থেকে আরও দুজন বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলতারা ধপ করে বসে নেতিয়ে পড়ল আমি তখন ডাকলাম, “কল্পেশদা!” কিন্তু কোনো সাড়া নেই আমি কাছে গেলাম দেখি, বরুণবাবু চেপে ধরে আছেন তাকে, বলছেন, “ব্যাটা বল, গুপ্তধন কোথায়, বল!” কল্পেশদা গোঁ গোঁ করে চলেছেহঠাৎ কে যেন তাঁর হাতে তলোয়ারের কোপ বসালতাকিয়ে দেখি, জিত রাগে ফুঁসছেহাতে তলোয়ার বলল, “কেমন দিলাম, বল ব্যাটাএক্ষুনি যদি ওকে না ছাড়িস তবে কেটে কিমা বানিয়ে ফেলব ছাড়!” বলতেই বরুণবাবু ছেড়ে দিলেন কল্পেশদাকে সে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল তখন জিত বলল, “নকশা বার কর! নইলে আর এক কোপ দেব বরুণবাবু একটা প্রিন্ট আউট পকেট থেকে বের করে জিতের হাতে দিলেন তারপর সুড়সুড় করে জিতকে তাঁর পিস্তল দিয়ে দিলেন আমি পিছনে তাকালাম দেখি, ঈশান দেবকে একটা লাঠি দিয়ে সজোরে মারতে যাচ্ছে আর দেবের পিছনে রিমি আমি জিতকে টোকা দিতেই সে ঈশানের কাছে ছুটে গিয়ে তার হাতে তলোয়ারের কোপ মারল ঈশান যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল হাত থেকে লাঠিটা পড়ে গেল আমি তুলে নিলাম সেটা দেব উঠে দাঁড়াল আর রিমিকে টেনে তুলল জিত বলল, “আমি নকশার কিচ্ছু বুঝছি না কল্পেশদাকে জাগা ও ভালো বলতে পারবে” আমি বরুণবাবুর ব্যাগ থেকে বোতল বের করে কল্পেশদার মুখে জল ছেটালাম কল্পেশদা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল আমি বললাম, “ঠিক আছ তো?” “হ্যাঁ,” কল্পেশদা সোজা হয়ে বসল আমি জিতের কাছ থেকে নকশা নিয়ে কল্পেশদাকে দিলাম, বললাম, “কী লেখা আছে গো? একটু পড়ে দাও” কল্পেশদা একটুক্ষণ নকশাটা দেখল তারপর বলল, “এখানে মেওয়ারি ভাষায় লেখা, মূর্তি সরিয়ে নামো, উত্তরদিকে যাও আর সেখানে গিয়ে পাবে ধনের সন্ধান লিখেছেন... রানি জাহ্নবী বাঈ” তক্ষুনি শুনতে পেলাম যেন ধস্তাধস্তি চলছে পিছন ফিরে দেখি বরুণবাবু রিমির হাত শক্ত করে ধরে আছেন রিমি যেই ছটফট করছে, তিনি অমনি তার চুলের মুঠি ধরে মাথা ঠুকে দিচ্ছেন দেয়ালে ওদিকে ঈশান দেবকে গলা টিপে ধরার চেষ্টা করেও পারছে না দেব তার হাত শক্ত করে ধরে তাকে আটকাচ্ছেজিত লাঠিটা তুলে নিয়ে ছুটে গিয়ে ঈশানের মাথায় এক বাড়ি মারল ঈশান তখন দেবকে ছেড়ে ধপ করে পড়ে গেল জিত তখন বলল, “অনেকক্ষণ দেখছি এবার কেমন লাগল ব্যাটা?” তারপর বরুণবাবুর মাথায় মারতেই তিনিও পড়ে গেলেন তখন আমি মঞ্চে উঠে দেখি দেয়ালের গায়ে একটা লোহার দরজা আর তার গায়ে একটা লোহার আংটা আমি ডাকলাম, “সবাই একবার এদিকে আয়” জিত, দেব, রিমি আর কল্পেশদা এগিয়ে গেল দেব বলল, “একবার আংটা টান দেখি” আমি তাই করতেই একটা সুড়ঙ্গ খুলে গেল আমি বললাম, “কল্পেশদাকে নিয়ে ঢুকছি বিপদ হলে টেক্সট করব জিতকে তখন তোরা ঢুকে পড়বি” জিত রাজি হল আমি আর কল্পেশদা টর্চ হাতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লাম তারপর একটু হামা দিয়ে এগিয়ে দেখি, এরপর অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে ফোন বার করে কম্পাস চালিয়ে দেখি...
পিছনে কল্পেশদা অস্ফুটভাবে বলল, “উত্তরদিক!”
আমি বললাম, “চলো তাহলে দেখি কী আছে” আমরা এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির একদম নীচে দেখতে পেলাম বেদির ওপর একটা মূর্তি রাখা এগিয়ে দেখি, দুই ভারী সুন্দর তরুণ–তরুণী, দুজনে দুজনকে ধরে আছে আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, কী সব লেখা আছে বেদির গায়ে কল্পেশদা পাশ থেকে বলল, “লেখা আছে, বিয়ের দিন রানি জাহ্নবী বাঈ আর রানা সর্দার সিং তার নীচে একটা পদ্য” বলে তার ফোন নিয়ে একটা ছবি তুলল তারপর ছবি দেখে বলল, “রানার মাথায় পালক তুললে রানি যাবে আলাদা হয়ে তাদের মাঝে রানি নাচে, মাথার ঘোমটা উড়িয়ে দিয়ে হাতের দণ্ডি সরিয়ে দিয়ে ঢোকে কুমার আর এক মেয়ে” আমি কিছু না বলে রানার পাগড়ি থেকে একখানি পালক তুলে নিলাম আর পিছিয়ে এলাম সঙ্গে সঙ্গে রানির মূর্তি সরে গেল ঘড়ঘড় করে সত্যি তাদের মাঝে একটা ছোটো মূর্তি উঠে এল তাতে রানি জাহ্নবী বাঈ দুই হাতে লাঠি নিয়ে ঘোমটা উড়িয়ে নাচের ভঙ্গিতে আছেন কল্পেশদা হাত বাড়িয়ে রানির ডান হাতের ডান্ডা একটু বাঁকিয়ে ধরলে মূর্তি পিছন দিকে সরে গেল একটা বিরাট বড়ো গর্ত বেরিয়ে পড়ল তাতে কল্পেশদা নেমে পড়ল আর আমি তড়িঘড়ি করে রানার পাগড়িতে পালক গুঁজে দিলাম আর রানির ডান্ডা যেমন ছিল তেমন করে দিলাম, তারপর সুড়ঙ্গ বন্ধ হবার আগেই একলাফে ঢুকে পড়লাম সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে গেল ঘড়ঘড় করে টর্চ জ্বেলে আমি তড়িঘড়ি ফোন খুলে জিতকে টেক্সট করে চলে আসতে বললাম আর নির্দেশগুলো দিলাম আর বললাম যে ঐ রাজকীয় পোশাক ছেড়ে তাদের জামা পরে নিতে, যাতে কোনো অসুবিধা না হয়তারপর বললাম, “টেক্সট করে দিয়েছি” কল্পেশদার কোনো সাড়া নেই কী যে হল! আমি টর্চ ফেরালাম, কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পেলাম না হঠাৎ আমার পিছন থেকে কল্পেশদা চিত্কার করে উঠল, “ইমন!!!” তাতে আমার পিলে চমকে গেল আর আমি ভয়ে তিন পা পিছিয়ে গিয়ে টর্চ উঁচিয়ে দেখতে গেলাম, কিন্তু ঠিক করে কিছু দেখতে পাওয়ার আগেই কে সজোরে মাথায় বাড়ি মারল আর অসহ্য যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে পড়ে গেলামতারপর ভুবন অন্ধকার ঘুম ভাঙতেই দেখি, জিতের কোলে শুয়ে আছি দেব, রিমি আর কল্পেশদা আমার দু-ধারে বসে রয়েছে আমি চোখ মেলতেই জিত বলল, “ঠিক আছিস তো!” আমি কিছু বললাম না মাথাটা তখনও টনটন করছিল আর সারা শরীর দুর্বল লাগছিল রিমি আমার বোতলটা এগিয়ে দিল আর আমি উঠে বসে সেটা নিয়ে ঢকঢক করে একটু জল খেয়ে কোনোমতে বললাম, “কে মারল আমায়?” জিত বলল, “রানা!” যদিও শরীর খারাপ লাগছিল, তবু খ্যাঁক করে উঠলাম, “বাজে বকিস না” জিত বলল, “সত্যি বলছি, তাই তো দেখলাম” কল্পেশদার দিকে আমি তাকাতেই সে বলল, “আমি জানি না আমায় কে যেন চেপে ধরেছিল শক্ত করে আমি বহু কষ্টে তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে পড়ে গেলাম তারপর ভুবন অন্ধকার” জিত বলল, “ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গিয়ে ঐ সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে দেখি তোরা পড়ে আছিস আর দুই রাজকীয় মূর্তি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আমরা গুলি ছুঁড়তে গিয়েও পারলাম না, কারণ গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল” কিচ্ছুটি না করতে পেরে চুপটি করে বসে আছি হতাশ হয়ে আমি বলে উঠলাম, “তাহলে চল! আমরা আমাদের কাজ শেষ করি” সবাই জিনিসপত্র নিয়ে এগিয়ে গেল আর আমি এগোতে লাগলাম ধীরে ধীরে হঠাৎ আমার চোখ পড়ল একটা চকমকে জিনিসের ওপরে দেয়ালের গা থেকে কী একটা লম্বামতন বেরিয়ে রয়েছে আমি চেঁচিয়ে বললাম, “রেড লাইট” এটা হাইকিং বা ট্রেকিং করার একটা নিয়ম যা আমি শিখেছি সামনে সবাই থেমে গেল তারপর জিতের গলা ভেসে এল, “কী ব্যাপার?” আমি বললাম, “একবার আয়” তক্ষুনি জিত, দেব, রিমি আর দাদা পিছনদিকে আসতেই আমি জিনিসটা দেখালাম জিত একটা পাথর নিয়ে মাটির চাঙড় ভেঙে বের করল “ওরেব্বাস! এ কী রে!” জিত অবাক হয়ে বলল “ত্রিশূল, দাও একবার,” দাদা হাত বাড়াল জিত দিতেই দাদা বলল, “এই বোধহয় চাবি” আমি প্রশ্ন করতে যাচ্ছি যে কীসের চাবি, কিন্তু রিমি চিত্কার করে উঠল অবাক বিস্ময়ে, “এত বড়ো তালা কী করে হয়!” আমি বাঁই করে ঘুরে গেলাম দেখি, একটা বিরাট দরজা, তার গায়ে তিনটে বড়ো ফুটো দাদা এগিয়ে গিয়ে ত্রিশূল ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দিতেই খুট করে খুলে গেল আর তক্ষুনি একজন পুরুষের রাশভারী গলা ভেসে উঠল, “কৌন মেরে ধন চোরি করনে কে লিয়ে আয়ে হ্যায়!!” দাদার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল দেব দরজা খুলতেই পুরো সুড়ঙ্গ আলোয় ভরে উঠলভিতরে রাশি রাশি সোনার গয়না, বাসনকোসন আর মোহরের মধ্যে দুটি বিরাট সিংহাসন ঘরটি আমাদের শোয়ার আর পড়ার ঘরের সমান আর সিংহাসনে বসে...
“মা গো,” বলে রিমি ধপ করে বসে পড়ল সিংহাসনে বসে মহারানা সর্দার সিং আর রানি জাহ্নবী বাঈমহারানা দাঁড়িয়ে কী যেন বললেন। রানি চিত্কার করে ছুটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় কী যেন বললেন তাতে দাদাও বসে পড়ল আর তার অমন সুন্দর মুখখানা সাদা হয়ে গেল জিত আর দেব কাঠ হয়ে গেছে রানা তলোয়ার টেনে বার করলেন
হঠাৎ আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল রানা যে দাদাকে মারতে যাচ্ছেন, তা আমি টের পেলাম এও টের পেলাম যে রানি তাকে বাঁচাতে চান আমি আড়ালে গিয়ে টুক করে একটা ছোরা তুলে নিলামছোরাটার সোনার হাতল আর ইস্পাতের ব্লেড দেখি, রানি একপাশে পড়ে কাঁদছেন আর দাদাকে রানা মারতে যাচ্ছেন। যে মুহূর্তে তলোয়ার নেমে এল, আমি সজোরে ছোরা চালিয়ে দিলামরানা চিত্কার করে উঠলেন আর অদ্ভুতভাবে তাঁর দেহ গুঁড়ো হয়ে উড়ে গেল তখন রানি বললেন, “মুঝে ভি” আমি তখন বুঝলাম যে রানা মুক্তি পেয়ে গেছেন আর রানিও তা চান সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে ছোরা ছুড়ে মারলামঅদৃশ্য হওয়ার আগে রানির মুখে এক অদ্ভুত, রহস্যময় হাসি দেখা দিয়েছিল হাসিটা কোনোদিন ভুলতে পারিনি
রানি মুক্তি পেতেই জিত আর দেব দুই ভাইয়ের মুখ থেকে অনেকক্ষণ চেপে রাখা নিঃশ্বাস সশব্দে বেরিয়ে এল রিমি কোনোমতে উঠে দাঁড়াল আমি প্রথম মুখ খুললাম, “সবার ঘোর কেটেছে? এবার চল” আস্তে আস্তে দাদা উঠে দাঁড়াল তারপর বলল, “চলো” দশ মিনিটে আমরা সোনার কেল্লা থেকে বেরিয়ে দেখি, ভোর হয়ে গেছে পাশ দিয়ে একটা অটো যাচ্ছিল তাতে করে আমরা ফিরে গেলাম সেদিনই ট্রেন ছিল, আমরা সেই ট্রেনে বাড়ি ফিরলাম তার দু-দিন পর খবর পেলাম, কল্পেশদা রওনা দিয়েছে “ফোন করেছিল এই মাত্র,” বলতে বলতে রিমি বসে পড়ল তার ডলহাউসের সামনে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এখনও নেশা গেল না তোর?” হেসে রিমি বলল, “অত সহজে ছাড়া যায় না রে” বলে খেলায় মন দিলআমি হঠাৎ টের পেলাম রিমির হাসি আর রানির শেষ হাসি অনেকটা এক তবে কি...
আর পারলাম না ভাবতেবুক ধড়াস করে উঠল
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment