গল্প:: দেবতার আভরণ - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস


দেবতার আভরণ
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

আমি অ্যালফ্রেড গোমেজ আর আমার বন্ধু আন্টানিও ডিয়েগো, আমরা দুজনেই খড়ি নদীর মোহনার কাছে কোর্টলিম গ্রামের অনাথ তরুণএকসময়ের পর্তুগীজ রক্ত শরীরে আজও বহন করবার সূত্রে স্থানীয় বাঙালিরা আমাদের পর্তুগীজ ইন্ডিয়ান বলেআমাদের এই অঞ্চলে ভয়ংকর জিনিস হচ্ছে হঠাৎ করে শুরু হওয়া ঝড় তুফান এবং সেই সঙ্গে একটানা দু-তিনদিন ধরে বৃষ্টি গেল বছর বেনলিম গ্রামে এক জলসার রিহার্সাল শেষ করে এইরকম ঝড়জলের মুখে পড়ে বৃদ্ধ কার্ভালোর বাংলোতে আশ্রয় পেয়েছিলাম
কার্ভালো আঙ্কেল আমাদের সুপরিচিত হওয়ায় সেই দুর্যোগের রাতে নিজের থেকেই তাঁর বাংলোর গেস্ট রুমে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। রাতে ডিনারের আগে আমাদেরকে তাঁর নিজের এক-দুটো অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি বললেন। দেখা গেল যে অ্যাডভেঞ্চার আমাদের তিনজনেরই খুব প্রিয় বিষয়। পরের দিন সকালে তুফান আরও তুমুল হওয়ায় আমরা নিরুপায় হয়ে তাঁর অনুরোধে থেকে গেলাম।
কার্ভালো আঙ্কেল এক সময়ে বড়ো জাহাজের নাবিক ছিলেনঅনেকগুলো লম্বা লম্বা ভয়েজের অভিজ্ঞতার ঝুলি ওনার কাছেদুপুরের খাবারের পরে, উনি বললেন একটি রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি -

বছর দশেক আগে, একটা ভয়েজ পুরো করে, আমরা ফিরছিএক বিকেলে, হঠাৎ করে তুমুল প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হওয়ায় আমাদের জাহাজ দিকভ্রষ্ট হয়ে এক ডুবোপাহাড়ের চুড়োর খাঁজে আটকে গেলসকালে জাহাজের ক্যাপটেন আমাদের জানালেন যে জাহাজে পানীয় জল এবং কিছু খাদ্যসামগ্রীর টান পড়তে পারেদূরে একটা পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপ দেখা যাচ্ছেশক্তিশালী দূরবিন দিয়ে দেখা গেল যে পাহাড় কেটে একটা ঝরনা নিচে লাফিয়ে পড়ছেআমরা যদি লাইফবোটে ওই দ্বীপে গিয়ে পানীয় জল আর কিছু শিকার করতে পারি তবে আমাদের খাদ্য আর জলের সমস্যা মিটে যাবে
“আমরা চারজন সহকর্মী বন্ধু দ্বীপে নেমে ক্রোশ দুয়েক হাঁটবার পর ঝরনা আর সেইসঙ্গে সেখানের জঙ্গলে প্রচুর বড়ো বড়ো কুমড়ো আর মেটে আলু পেলামএইসব তোলবার নেশায় আমাদের দেরি হয়ে গেল। একটা টিলার চূড়ার কাছে, অনেকগুলি বড়ো গাছ দেখে তারই একটার তলাতে রাতের মতন থাকা স্থির করলাম
“সারা রাতের আগুন জ্বালবার ইন্ধনের কাঠ জোগাড় করবার জন্য আমি আর আমার আরেক সঙ্গী অ্যালজো, আমরা দুজনে ভাগ হয়ে, টিলার দুই প্রান্তের ঢালু জায়গাতে গেলাম। আমি যে জায়গাতে গেছিলাম, শুকনো ডালপালার একটা বোঝা তৈরি করে, হাতের চপারটা দিয়ে গর্ত করতেই একটা প্রকাণ্ড মেটে আলু পেয়ে গেলামকিন্তু এরপর আরও কয়েকটা জায়গায় গর্ত করে বিফল হলাম বেশ রাগতভাবে টিলার ঢালের একদম নিচে এসে, গায়ের সব জোর দিয়ে বেশ অনেকটা গর্ত করবার পর, একটা ধাতব ঠং করে আওয়াজ হলগর্তটা আরও সামান্য গভীর করতে, হাতে এল একটা মরচে ধরা লোহার চৌকো বাক্সএটা বাইরে এনে কয়েকবার মাটিতে আছাড় দেবার পর, চপার দিয়ে ডালাতে চাড় দিয়ে খোলবার অনেক চেষ্টার পর, ঢাকনা খুলে বেরিয়ে পড়ল একটা সোনালি হলদে রঙের গোল বাক্সবাক্সটা নেড়ে-চেড়ে দেখতে যাব, ঠিক এমন সময় আমার সঙ্গীদের মিলিত ‘গেল, গেলচিৎকার কানে এলবাক্সটা তখনের মতো আমার হ্যাভারস্যাকের মধ্যে কোনোরকমে চালান করে, তাদের অবস্থান আন্দাজ করে দৌড়াতে থাকলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি, দলের সবাই আকাশের দিকে চেয়ে আছেকর্কশ আওয়াজ করে অদ্ভুত দর্শনের গাঢ় নীল রঙের একটা পাখি নখ বসিয়ে সদ্য তোলা সবজির একটা বড়ো ঝুড়ি অনায়াসে নিয়ে যাচ্ছেদেখতে দেখতে সেই পাখি, এই দ্বীপের সবচাইতে উঁচু খাড়া পাহাড়ের দিকে গিয়ে, কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এতক্ষণে আমাদের নজরে এল, সেই পাহাড়ে একটা মিনারের মতো জায়গা থেকে, রংবেরঙের আলোর রশ্মির ঝলকানি আসছে
“অন্ধকার হবার আগেই নিজেদের থাকবার জায়গা ঘিরে আগুন না জ্বাললে বিপদ হতে পারেসবাই সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কিন্তু আমার একটা কাজ যে বাকি আছে। ‘সবাইয়ের চিৎকার শুনে বেশ কয়েকটা বড়ো মেটে আলু ছেড়ে এসেছি,’ এই বলে আমি সেই ঢালের দিকে গেলামমেটে আলুর কথাটা একটা বাহানা মাত্র। আসবার সময় একটা পাথরে পায়ে চোট লেগেছিলএক লহমার মতো সেই সময় মনে হয়েছিল পাথরটা দিয়ে বোধ হয় একটা গর্তের মুখ চাপা দেওয়া ছিল এইখানে এই পাতকুয়োর মতো গর্ত কে বা কারা খুঁড়ল? কীসের জন্য? কিছু কি লুকিয়ে রাখবার জন্য? এখন সেখানে ফিরে এসে দেখি, আমার তখনের দেখাটা ভুল নয়। পাথরটা সরে গিয়ে, পাতকুয়োর মতো একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে।
“আমার মনের মধ্যে কেউ আর একজন বাস করেসে আমাকে সাবধান করে, পরামর্শ দিল যে একটু আগে পাওয়া কৌটো আর এই পাতকুয়োর কথা যেন বন্ধুদের কাউকেই না বলিআমরা সবাই পর্তুগিজ কিন্তু সহকর্মী আইজ্যাক আর শেভালোর গায়ে ভাইকিং জলদস্যুর রক্ত আছেএই জিনিসগুলোর কথাতে ওরা গুপ্তধনের গন্ধ পেয়ে গেলে, শুধু আমার একার নয় দলের সবাইয়ের বিপদ হতে পারে

হাওয়াতে দরজা-জানালাতে একটা আওয়াজ হচ্ছেকার্ভালো ইশারা করলেন আমাদের দুজনকে ঘরের দরজা আর জানালাগুলো ঠিকঠাক বন্ধ আছে কিনা তা দেখে আসতে উনি ততক্ষণে পালঙ্কের বিছানা সরিয়ে, তার পাটাতনের মধ্যে এক জায়গায় একটু টোকা দিলেন। আওয়াজে সন্তুষ্ট হয়ে, সেই জায়গার পাটাতন সরিয়ে একটা লোহার বাক্স বার করলেনএকটা বিশেষ কায়দায় তাতে চাপড় দিয়ে বাক্সের ডালা খুলে বার করলেন একটা সোনালি হলুদ রঙের টিফিন বাক্স
আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “আঙ্কল, এইটা কি সেই বাক্স?
নির্লিপ্ত গলায় কার্ভালো বললেন, “ঠিক তাইএর থেকে একটু সামান্য অংশ কেটে নিয়ে সোনার দোকানে দেখিয়ে জেনেছিলাম যে এটা পাকা সোনা বিপদের আন্দাজ করে এটা আমার ব্যাগের মধ্যে খুব কায়দা করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। নিজের ঘরে ফিরে এসে, এই বাক্স খুলে দেখি এর মধ্যে কোনো মোহর নেই তবে…”
ওঁকে শেষ না করতে দিয়ে আন্টানিও অধীর স্বরে বলে ওঠে, “তবে কী আঙ্কল? কী পেয়েছিলেন এর মধ্যে?”
কার্ভালো আঙ্কল বললেন, “বাক্সটার মধ্যে, একটা ম্যাপ মতো জিনিস, তুলোট কাগজে আঁকা আছেতাতে সেই দ্বীপের তিনটে চূড়ার একটা বড়ো পাহাড়, পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা ঝরনা, সমুদ্র, জঙ্গল এইসব দেখানো আছে। ম্যাপের মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় এক, দুই, তিন আবার 71, 91 ইত্যাদি সংখ্যা লেখা আছে ম্যাপের স্কেল লেখবার জায়গায় কিছু সংখ্যা, কবিতার পংক্তির মতো করে লেখা আছে, যেমন এই দেখ একদম নীচে বাঁদিকে -
      ৪ ৩
    ৩ ২ ১
    ৪ ৩ ২
    ১ ২ ৩
      ২ ১
“এই নম্বর সাজানো আছে বাঁদিক থেকে শুরু করে একদম ডানদিকের শেষ অবধিএই সংখ্যাগুলোর কী অর্থ আমি বুঝতে পারিনি
“তবে একটা জিনিস আমি ধরতে পেরেছিএই ম্যাপে যেখানে ১১ সংখ্যাটা লেখা আছে, আমি খুব নিশ্চিত এইটাই সেই জায়গা যেখানে আমি মেটে আলু খুঁজবার অছিলায় ফিরে এসে একটা পাথরে চোট পেয়েছিলাম, আর সেইখানেই, এই কুয়োর মতন গর্তটা, শেষ বিকেলের মরা আলোতেও পরিষ্কার দেখেছিলাম। আমার ধারণা যেখানে আমি মেটে আলু খুঁজবার জন্য প্রথমবার মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ঐ কৌটোটা পেয়ে যাই তার সামনের পাথরে ১ সংখ্যাটা লেখা ছিল। ম্যাপে ১ সংখ্যা লেখা জায়গাটা সেই জায়গা। তোমরা ম্যাপটা দেখে কি কিছু ধরতে পেরেছ?”
তুলোট কাগজের ম্যাপটা দেখতে দেখতে আমি বলি, “আন্টানিও, ম্যাপের ডানদিকে লেখা এই সংখ্যাগুলোর উলটো প্রান্তটা দেখ - গোটা গোটা বাংলা হরফে কীসব লেখা আছে। আমি তো বাংলা পড়তে তেমন পারি না আঙ্কেল বললেন, “আমিও না” আন্টানিও লেখাগুলো বেশ জোরেই পড়তে যাচ্ছিল কিন্তু আঙ্কেল জানালার দিকে তাকিয়ে চুপি চুপি পড়তে ইশারা করলেন।
    ‘চাকার পর চাকা
    এক, এক করে পাতা
    শেষের আ দেবে ছেড়ে,
    গন্ডমূর্খ না হলে
    কু দেবে না ছেড়ে
    ও নয় এর পরে
    য়ো দেবে জুড়ে
বৃদ্ধ বয়েসেও কার্ভালো আঙ্কেলের মনে রাখবার শক্তি অসাধারণ। উনি একবার শুনেই সেটি আমাদের শুনিয়ে দিলেন। আমার মাথায় কিছু একটা আসছিল, তার আগেই আঙ্কেল ‘ইউরেকা’ বলে লাফিয়ে উঠলেন। আমরা দুজনে ওনার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে উনি বললেন, “ইয়ং বয়েজ, জাস্ট থিংক। চাকার পর চাকা কোথায় থাকে? সেটা কুয়োতে থাকে
আমি বলি, “আঙ্কেল, ছড়ার ক্লু অনুযায়ী, পাতা-র শেষের আ-কার ছাড়লে সেটা হয় পাত আর তারপর প্রথমে কু, পরে ও নয়, হবে য়ো। অর্থাৎ পাতকুয়ো, মানে কম গভীরতার কুয়ো। কিন্তু সেই দ্বীপটা কোথায়?”
আমার প্রশ্নের উত্তরে আঙ্কেল বেশ চিন্তা করে বলেন, “যে দ্বীপে আমরা সেদিন গিয়েছিলাম সেটা আমি জাহাজি কায়দায় চিনে রেখেছিলামসেটা খড়ি নদীর মোহনা থেকে ঠিক পশ্চিমদিকে, সাগরে একশো নটিক্যালের একটু বেশি দূরেদ্বীপ গুনলে, মোহনা থেকে সাগরে পশ্চিম দিকে সেইলিং করলে, একুশতম দ্বীপভয়েজ থেকে ফিরে, আমি নিজেই সেখানে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেখানে যাবার আগেই এক দুর্ঘটনায় আমার দুটো পা জন্মের শোধ অকেজো হয়ে গেল
সব শুনে আমরা সবাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম, নীরবতা ভেঙে আমি বললাম, “আঙ্কল, আপনি আমাদের কী করতে বলেন?”
আঙ্কল বললেন, “দু-দিন ধরে তোমাদের দেখছি আর কথা শুনছি আমার নিজের মনে হয় যে তোমরা অ্যাডভেঞ্চার মন থেকে ভালোবাসআমি নিজে আর হয়তো বেশি দিন বাঁচব নাযাবার আগে এই ম্যাপ তোমাদের হাতে তুলে দিলে হয়তো তোমাদের কাজে আসতে পারেআমি আশা করব যে এই ম্যাপ বা আমার মুখ থেকে শোনা কথা, তোমরা দু-বন্ধু নিজেদের কাছেই রাখবে
আণ্টানিও এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলও বলে ওঠে, “স্যার, আপনি আরও অনেকদিন সুস্থ থাকবেন এবং আমরাও চেষ্টা করব এই রহস্যময় দ্বীপে গিয়ে সব কিছু দেখে আসতেকিন্তু এই বহুমূল্য জিনিস আমাদের কাছে রাখবার সেরকম কোনো জায়গা নেইতবে আমার কাছে কাজ চালাবার মতো একটা ক্যামেরা আছেআমি তাতে নানা অ্যাঙ্গেলে বেশ কতগুলো ফটো নিয়ে নিচ্ছিসে ফটোগুলো আমাদের কাছে সুরক্ষিত থাকবে

কার্ভালো আঙ্কেলের কাছ থেকে ফিরে এসে আমাদের বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে গান গাইবার কল শো ছিল। একদিকে আমরা এইসবে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, অন্যদিকে আঙ্কেলকে দেওয়া কথা আদৌ রাখতে পারব কিনা সেই নিয়ে প্রবল সন্দেহ হল। মোহনা থেকে পশ্চিম দিকে ভয়েজে যাওয়া ছোটো বোটের পক্ষে নিরাপদ নয় এবং আমরা ওইদিকে যাব জেনে কোনো বোট মালিক তার বোট দিতে রাজি হল না।
আঙ্কেল যে অ্যাডভেঞ্চার আমাদের করতে বলেছিলেন, সেটা আপাতত মুলতুবি রাখলেও রহস্যময় সেই ম্যাপটা আমাদেরকে খুব টানত। ম্যাপটার ক্লোজ আপ আর নানা অ্যাঙ্গেলে তোলা ফটোগুলোর প্রিন্ট থেকে আরও অনেক কিছু দেখা গেল যা সেই রাত্রে খালি চোখে দেখা যাচ্ছিল না দেখা গেল সেই ম্যাপের কোণে আরও একটা ধাঁধা আছে। ছড়ার আকারে ধাঁধাটা এইরকম -
    ১ ১
    ওটা নয় বং অথবা হিং
    হতে পারে কি সেটা ইং?
    এই যে পিঠোপিঠি দুই ভাই,
    তবুও তফাতে থাকে সদাই,
    দাঁড়িয়ে আছে হেথায়,
    পালিয়ে যাবার নেই উপায়।
    সারি সারি শিক,
    ফুঁড়ে দাও এদের পিঠ।
একদিন এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেও এর কোনো সমাধান না পেয়ে ফটোগুলো স্যুটকেসে রেখে খেতে যাব, এমন সময় আন্টানিও বলে, “দোস্ত, ওটা আসলে খুব সোজা কিচেন থেকে খাবারগুলো নিয়ে এসে আমাদের নৌকাঘরের বাইরের ডেকে রাখতে গিয়ে দেখি আন্টানিও সেই ম্যাপটার ফটো নিয়ে এসেছে। আমাকে ও বলে, “দোস্ত দিস ইজ দ্যাট ইজি। সবার ওপরে আছে বাংলায় লেখা ১১। সেটা যদি ছড়া অনুযায়ী ইং মানে ইংলিশ হয় তাহলে দাঁড়ায় 11। এই সংখ্যাটা কেমন দেখতে?” আমি ধরতে পেরে বললাম, “দুটো 1 একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে এমন ভাবা যেতেই পারে আন্টানিও বলে, “দোস্ত একটু মাথা খাটাও। এই যে দুটো তফাতে থাকা 1 আর 1, এদের পিঠে অর্থাৎ চওড়ার দিকে যদি একসারি সমান্তরাল লাইন বা শিক দিয়ে গেঁথে দাও তাহলে ঐ দুটো তফাতে থাকা 1 কীরকম দেখতে হবে?”
আমি খাবার প্লেটে নামিয়ে বলি, “মই। আরে আঙ্কেল তো বাংলায় 11 লেখা অর্থাৎ ১১ লেখা পাথরে হোঁচট খেয়ে কুয়ো দেখতে পেয়েছিলেনআর এখন বোঝা গেল যে অন্ধকারে আঙ্কেল যা দেখতে পাননি, সেটা হচ্ছে কুয়োর গায়ে গাঁথা মই
পরে জেনেছিলাম শুধু আঙ্কেল কার্ভালো নয়, এই ম্যাপ যিনি তৈরি করেছেন আর ছড়া লিখে সংকেত লিখেছিলেন, তিনি সংকেতগুলো লিখে রহস্যময় কিছু আছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র। তিনি চেয়েছিলেন যে যাঁরা এই ম্যাপ হাতে পাবে, তারা শুধু ধন সম্পদের লোভে নয়, অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণে আসে।
এই সময়ে একটা পাওয়ার বোট আমাদের বোটের দিকে আসছে বলে মনে হল। নদীর পাড়ে স্থায়ীভাবে লাগানো আমাদের ভাঙাচোরা বোটের আস্তানার জানালা থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দেখি, তীর থেকে দূরে একটা শক্তিশালী সমুদ্রগামী স্টিলবডি পাওয়ার বোট নোঙর লাগিয়ে থামল। বোট থেকে আমাদের গানের খুব ভক্ত উকিল স্যামস সেলভেন মুখ বাড়িয়ে আমাদেরকে ইশারা করে বোটে আসতে অনুরোধ করলেন। উকিল স্যামস আমাদের এক দারুণ দুঃসংবাদ শোনালেন। কাল রাত্রে, হার্ট অ্যাটাক হয়ে কার্ভালো আঙ্কেল মারা গেছেন। তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী, একটি নতুন সমুদ্রগামী স্টিল বডি পাওয়ার বোট এবং ব্যাংকে রাখা পাঁচ লক্ষ টাকা, আমাদেরকে দেবার জন্য কাগজপত্র করে উকিল স্যামসকে বলে গেছেন।
উকিল স্যামস যাবার আগে বলে গেলেন, “এই নতুন আল্ট্রা মডার্ন স্টিল বডি পাওয়ার বোটটা তোমাদের। কয়েকদিন চালিয়ে দেখে নাও। তোমরা এর চালচলনে সন্তুষ্ট হলে আমার অফিসে এসে এই বোটের আর ব্যাংকের কাগজপত্র নিয়ে যেও। তবে বেশি দেরি কোরো না। আমার অন্য কেসের হিয়ারিং শুরু হয়ে গেলে তোমাদেরকে সময় দেওয়া মুশকিল হবে
আঙ্কেল কার্ভালো ধরতে পেরেছিলেন যে অভিযানের জন্য আনুষঙ্গিক খরচা জোগাড় করা আমাদের পক্ষে খুবই মুশকিল। সেই কারণে তিনি একটা আস্ত বোট আর এমন অর্থ দিয়ে গেলেন যাতে আমাদের এই অভিযানে গিয়েও কিছু অর্থ থেকে যায়। উকিল স্যামসের অফিসে গিয়ে এও জানা গেল যে আঙ্কেল কার্ভালোর সেই অসমাপ্ত অ্যাডভেঞ্চার আমরা যেন পূর্ণ করতে পারি, এইটা ওনার শেষ ইচ্ছে। এইসব জেনে আমরা দুজনে স্থির করলাম, যে করেই হোক, এবার অভিযানের প্রস্তুতির জন্য লেগে পড়তে হবে।

মে মাসের প্রথম পনের দিন এই অঞ্চলের স্থানীয় সমুদ্রে ঝড় তুফান কম হয়ে থাকে। মে মাসের প্রথম দিনেই, খড়ি নদীর মোহনা থেকে, এই শক্তিশালী পাওয়ার বোটে পুরো দুটি দিন একটানা সেইলিং করবার প্রতিজ্ঞা করে, আমাদের লক্ষ্যস্থল একুশতম দ্বীপের দিকে রওয়ানা হলাম। শুরু থেকেই অনুকূল পরিবেশ পেয়ে, একশো নট দূরত্ব আর দ্বীপসংখ্যা এই দুটোর দিকে নজর রেখে, আমরা বেশ ভালো গতিতে এগিয়ে চলছিলাম।
কুড়িতম দ্বীপ পার করে দেখি যে তখন আর পঞ্চাশ নট বাকি। আবহাওয়া নিয়ে আমাদের আন্দাজটা ঠিক এইখান থেকে আছাড় খেতে শুরু করল। এই অঞ্চলের ডুবোপাহাড় আর চোরাখাদ বা সী ট্রেঞ্চের কথা আমরা নাবিকদের মুখে শুনেছি। পাওয়ার বোটের জন্য, ডুবোপাহাড় থেকে ভয়ংকর হল এই চোরাখাদ
একুশতম দ্বীপের দিকে সামান্য এগোতেই, আমাদের বোটের চাল দেখে আন্দাজ করতে পারলাম যে চোরাখাদের কারণে ঘূর্ণি শুরু হয়েছে। আমাদের সেইলিং এখন পশ্চিম থেকে দক্ষিণ পূর্বের দিকে ঘুরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু পুবালি হাওয়াতে ভেসে আসা একটুকরো মেঘ বড়ো হয়ে, জোর তুফান আর বৃষ্টি নিয়ে আমাদের পাওয়ার বোটকে সেই ঘূর্ণির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। বোট আর নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্য দুজনে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। একটু পরে ইঞ্জিনের আওয়াজ থেমে গেল। এবার যে জীবনের শেষ মুহূর্ত সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সেটা দুজনেই বুঝলাম।
ঝড় থেমে গেছে। ইঞ্জিনরুম আর সেইসঙ্গে পাশের স্টোররুম বড়ো বড়ো ঢেউয়ের জলে ভরে গেছে দস্যুর লুঠের মতো, সমুদ্রের ঢেউ আমাদের পুরো রেশন এবং পানীয় জল সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ওপরের অপারেটর কেবিন থেকে সমুদ্র দেখে মনে হল ঝড়তুফান আমাদের বোটকে গভীর সমুদ্রেই টেনে নিয়ে গেছে। মাছ ধরবার জাল আমাদের সঙ্গে নেই, থাকলেও এই গভীর জলে এই সময় একটা জালে মাছ ধরা দুষ্কর। খাবার আর জল না পেয়ে একদিকে যেমন শুকিয়ে মরতে হবে, অন্যদিকে আর এক বিপদের হাত থেকেও নিস্তার নেই। ঢেউয়ের জল একটু একটু করে এই বোটকে ভরিয়ে দিয়ে ডোবাতে থাকবে। তাহলে মরতেই হবে? কিছু কি উপায় নেই? কী করি এখন? কী উপায় আছে এখন?
আমি কয়েকবার এই কথা ভাবতে-ভাবতে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলামহঠাৎ মনে হল কে যেন একটা কড়া আলো চোখের ওপর ফেলছেবহুকষ্টে চোখ খুলে দেখি বহুদিন পর রোদ উঠেছেডেকের রেলিং ঘেঁষে আন্টানিও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে এত বিপদেও হাসি আসে কী করে? হঠাৎ দেখি, দূরে একটা সিগ্যাল কাঁ-কাঁ করছে দিকহারা জাহাজিদের কাছে এই আওয়াজের মানে অনেক কিছু।
সদ্য ঘুমভাঙা আলস্যভাব কাটিয়ে আমি ডেকের রেলিঙের দিকে দৌড়ে গিয়ে চোখে দূরবিন লাগাতেই সিগ্যাল ছাড়াও দলে-দলে উড়তে থাকা স্যান্ডপাইপার, রেড হেরন, ব্ল্যাক বারবিও নজরে এল
দ্বীপ কাছেই আছে, এই আনন্দে বুকটা প্রথমে ঢিপঢিপ করছিলকিন্তু এ কী? দুই দিকে বালির বেলাভূমি দেখা যাচ্ছে। জোয়ারের জল আমাদের বোটকে সমুদ্র থেকে এ কোথায় ঠেলে দিয়েছে? এটা হয় একটা চওড়া নদী অথবা সামুদ্রিক খাঁড়ি আমরা এখন কোথায়? আঙ্কেল কার্ভালো যে দ্বীপের কথা বলেছিলেন সেখানে কোনো সামুদ্রিক খাঁড়ি আছে এইকথা বলেননি। আন্টানিও এক সুসংবাদ দিলপাইলট কেবিনের পাশে একটা স্টোর রুমে চারটে বড়ো জ্যারিকেন ডিজেল পেয়ে গেছেসেগুলো ক্ষুধার্ত অনবোর্ড ইঞ্জিনের ফুয়েল ট্যাঙ্কে শুধু ঢেলেই আসেনি, পাম্প করে এয়ারও বার করে দিয়েছে
কয়েকবার ম্যানুয়াল ক্র্যাংকিং করবার পর কাশতে কাশতে ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলআর বেশি না এগিয়ে, দুই তীরের মধ্যে যে তীরে গাছগাছালির ছায়া আছে, সেই তীরে বোট নোঙর করে এখনকার মতন আশ্রয় নেওয়া ঠিক করলাম। কিন্তু আমাদের জন্য আরও কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
খাঁড়ি ধরে আর একটু এগিয়ে দেখলাম যে দ্বীপটায় পাহাড় আর জঙ্গল দুটোই আছেএকটা জায়গায় তিনটে চূড়া নিয়ে একটা বড়ো পাহাড় মাঝখানের চূড়া থেকে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসছে একটা বড়ো ঝরনাসেই ঝরনার জল এই খাঁড়িতে এসে মিশেছে। তার মানে এই খাঁড়িতে প্রচুর মাছ আছেঅনেকদিন পর অঢেল জল আর খাবার পাওয়া যাবে মনে হতেই শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠল আর দেরি না করে খাঁড়ির পশ্চিম তীর থেকে সামান্য দূরে বোটকে নোঙর করে আমরা দুই বন্ধু পশ্চিম তীর ধরে এগিয়ে চললাম খাবার আর জলের সন্ধানে আর সেই সঙ্গে দ্বীপটাকে জেনে নেবার জন্য।
দুজনের কাঁধে রইল একটা বাঁকের দুই প্রান্তএতে নেওয়া হল রান্নার সামান্য বাসন আর রাতে শোবার জন্য গাছের মগডালে বাঁধা দোলনা বিছানা বা হ্যামক দুটো ঢাউস ব্যাকপ্যাক বাঁকের মাঝখানে ঝুলছে। এই দুটোতে আছে অভিযানের দরকারি জিনিস। খাঁড়ির পশ্চিম পাড় ধরে একটু এগিয়েই একের পর এক সারি সারি বড়ো বড়ো গাছ। তাদের নিচে বিশ্রাম নেবার জন্য একটানা চওড়া ছায়া আর আগুন জ্বালানোর জন্য প্রচুর শুকনো ডালপালা।
হাতের কাছে পাওয়া সেই জ্বালানী দিয়ে আগুন জ্বেলে খাঁড়ির জল থেকে বাস্কেট জালে ধরা মাছগুলোর রোস্ট বানিয়ে নিলাম। লাঞ্চ সেরে দুই বন্ধু স্থির করলাম যে এমনিতেই অভিযান আর চালানো যাবে না। ম্যাপ অনুযায়ী একুশ নম্বর দ্বীপে পাশাপাশি থাকা তিনটে পাহাড়চুড়ো আর ঝরনা মিলে গেলেও এই খাঁড়ি দেখানো নেই একুশ নম্বর দ্বীপের প্রায় কাছাকাছি আসবার ঠিক আগে, ঝড় তুফানের জন্য ছিটকে গিয়ে, এইটাই একুশ নম্বর দ্বীপ কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে নাতবে সেটা জানবার জন্য অনেক জাহাজি তুকতাক আছে। কিন্তু বোটটাই এখন সংকটের মুখে। যেটুকু ফুয়েল আন্টানিও পরে পেয়েছিল সেটাই এখন অর্ধেকের কাছে। ফুয়েল যদি অঢেল থাকত তাহলেও প্রবল তুফানের চপেটাঘাত খেয়ে তার অবস্থা এখন ঘরে ফেরার মতন নয়। অভিযানের চাইতে এখন জরুরি ঘরে ফেরবার জন্য অন্য উপায় খোঁজা। কিন্তু বোট ছাড়া আর কী উপায় আছে? সে প্রশ্নের উত্তর পেলাম রাত্রে, গাছের মগডালে বাঁধা হ্যামক বিছানায় রাতের বিশ্রাম নেবার সময়। হ্যামকে চড়বার আগে, আমরা জায়গায় জায়গায় আগুন দিয়ে এস ও এস ত্রিভুজ সিগন্যাল বানাতে ভুলিনি এইটার জবাব এসেছিল, কিন্তু আমরা নিজেদের ভুলে সেটা কাজে লাগাতে পারিনি।
সারাদিনের গভীর পরিশ্রম, ক্লান্তি সব মিলেমিশে আমাদেরকে গভীর ঘুমে ডুবিয়ে রেখেছিল। কিন্তু একটা কানফাটা আওয়াজ যেন হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাদের দুজনকে টেনে তুললআন্টানিওর হ্যামক আমার পাশেই একটা মোটা ডালে বাঁধা ছিলও ওখান থেকে শুয়ে শুয়ে আমাকে বলে, “আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বাজ পড়ার আওয়াজ। এক সেকেন্ড পরে আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়ে তিনটে প্লেন আমাকে যেন ছুঁয়ে চলে গেল
আমি বলি, “eh bien je sure? (তুই ঠিক বলছিস?) এটা যে আকাশের ধূমকেতু বৃষ্টি বা খসে যাওয়া তারা নয় সেটা কী করে...”
আমার কথা শেষ হবার আগেই পুব দিকে ছুটে গেল সেই আলোর ফুলঝুরি আর তারপর তিনটে তারা আর সেই আওয়াজ
এবার অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়াতে স্পষ্ট বোঝা গেল এগুলো সি-প্লেন, কোনো মিলিটারি মহড়ায় অংশ নিয়েছেপরে দেখলাম, আমাদের গাছের তলায় আগুন জ্বেলে যে এস ও এস সিগন্যাল বানিয়েছিলাম সেই দেখে ওরা মর্স কোডে আমাদের রেসকিউ সিগন্যাল পাঠিয়েছিল আমাদের ওয়াকি টকি অন করা ছিল, তাতে সেই সিগন্যাল ধরাও পড়েছিল, কিন্তু দুজনের একজনও তা দেখিনি।
গাছের মগডালে চড়বার সময় একটা পায়ে চলা পথ নজরে এসেছিল। পথটা কিছুটা গিয়ে গভীর জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। আমি আন্টানিওকে বলি, “একুশতম দ্বীপের কোনো এক জায়গায় পাতকুয়ায় লাগানো জোড়া সিঁড়ির রহস্য থাকুক তার জায়গায়এখনকার মতন আগে আমাদের নিজেদের বাঁচবার আর উদ্ধার হবার চেষ্টা করি” আন্টানিও সহমত জানিয়ে বলে, “এখনকার মতো, এই অভিযানকে পরের বারের জন্য মুলতুবি রেখে, উদ্ধারের পথ দেখাই বাস্তবসম্মত আমি বলি, “আমার মনে হয়, এই পায়ে চলা পথটা নিশ্চয় কোনো গ্রামে নয়তো সেনাবাহিনীর গোপন ব্যারাকে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখানে পৌঁছাতে পারলে তারা সব কথা শুনে আমাদের নিশ্চয় কোনো উপায় করে দেবে
আমাদের সব আশা চূর্ণ করে, পায়ে চলা রাস্তাটা একটা বেশ উঁচু টিলা আর গভীর জঙ্গলের কাছে এসে শেষ হয়ে গেলআমি আন্টানিওকে বলি, “রাস্তাটা এইখানেই শেষ, না তারপর কিছু আছে সেটা একবার পরখ করে দেখবার জন্য টিলার চূড়ায় ওঠা যাক
সূর্য তখন সবে আকাশে উঠে আলো ছড়াতে শুরু করেছেটিলার চূড়ার কাছাকাছি আসতেই, হঠাৎ কাচের শার্সিতে পড়া আলোর ঝলকানির মতো রশ্মির ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে গেলচট করে একটা গাছের ছায়ার কাছে দাঁড়াতেই পরিষ্কার দেখা গেল যে খাড়াই পাহাড়গুলোর মধ্যে যেটা সব চাইতে উঁচু আর নেড়া, সেই পাহাড়ের ঠিক মাথায় অনেকটা সমতল জায়গা আর সেইখানে সাদা রঙের একটা পাথুরে গম্বুজআলোর ঝলকানি আসছে সেই গম্বুজ থেকে
এই জায়গায় উঠে, রাত্রে আগুন দিয়ে “এস ও এস” ত্রিভুজ বানিয়ে রাখলে, সেটা রাত্রের মিলিটারি মহড়ার প্লেনগুলোর নজরে আসবে। কিন্তু পাহাড়ে চড়বার ট্রেনিং আর সেরকম সাজসরঞ্জাম না থাকলে, এইরকম খাড়া পাহাড়ে ওঠা আর আত্মহত্যা করার চেষ্টা করা একই কথা
আন্টানিও আমাকে ইশারায় চুপ করতে বলে আঙ্গুল তুলে কিছু একটা দেখাচ্ছেআমি সেদিকে চেয়ে একটা শিশু হরিণকে দেখতে পেলামএর পেছনেই একটা হরিণের দল দৌড়ে আসছে মনে হল। ঠিক এই সময়ে, কুৎসিতদর্শন একটা পাখি আকাশ থেকে ফাইটার প্লেনের মতো নেমেই, সেই শিশু হরিণকে তার নখ দিয়ে ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে গেলবাইনোকুলারে পাখিটাকে খুঁজতে খুঁজতে শেষটায় দেখা গেল যে সেই পাখি সবচাইতে উঁচু নেড়া পাহাড়ের দিকে উড়ে যাচ্ছেপাখিটা শেষ অবধি সেইখানেই নামে কিনা এবং তার নামবার সময় কেউ আসে কিনা, এইটা দেখার জন্য টিলার ঢাল বেয়ে চুড়োর দিকে দুজনেই দৌড়ে উঠতে গিয়েও শেষটায় একটা জোর বিপদ হতে যাচ্ছিলএকটা ডালপালার স্তূপ পেরোতে গিয়ে আমার লাফ সামান্য কম হলআমার পা সেখানে পড়ামাত্র আমি ডালপালাসমেত একটা বিশাল গর্তে তলিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আন্টানিও বিদ্যুৎগতিতে আমার হাত টেনে ধরায় আমি পাতালপুরীতে হারিয়ে যাবার আগে বেঁচে যাই
টিলার চুড়োয় যাওয়া স্থগিত রেখে আমরা দুজনেই তখন বসে পড়ে হাঁপাচ্ছি আর ভাবছি এই শক্তিশালী পাখিটার কথা আঙ্কেল বলেছিলেন তবে কি আমরা শেষ অবধি সেই একুশতম দ্বীপে পৌঁছে গেছি? এই সময় আমার নজরে এল, একটু ওপরে টিলার ঢালের গায়ে, একটা মাঝারি সাইজের গুহা এই উচ্চতায় সেখানে কোনো প্রাণীর থাকা অসম্ভব। কিন্তু নিশ্চিত হতে ব্যাগ থেকে বার করা পটকাগুলোকে একের পর এক গুহার মুখে ছুঁড়ে মারা হল। ধোঁয়া কেটে গেলে দুজনে গুহার ভিতরে গিয়ে দেখি, গুহাটা একটা জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সেইখানে তার ছাদটা খুব চওড়া। সেইদিকে তাকালে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে আর সেখান থেকে ঠান্ডা হাওয়া হু হু করে ঢুকে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে।
আন্টানিও গুহার ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে ঝিমোচ্ছিল। আমি ব্যাকপ্যাক ব্যাগ থেকে একটা বড়ো ফ্লাশলাইট জ্বেলে, গুহার ছাদে এবং গুহার মেঝেতে কিছু দেখে আন্টানিওকে ডাকতে যাব, তার আগেই কিছু একটার আওয়াজ পেয়ে ও বিজলির বেগে দৌড়ে গুহার বাইরে চলে যায়। কিছু একটা আসছিল গুহার দিকে, আমিও সেটার আঁচ পেয়েছিলামদৌড়ে আন্টানিওর পিছু নিয়ে দেখি, সেই কুৎসিতদর্শন বিশাল পাখিটা, এক বড়ো কাঁদি কলা জমি না ছুঁয়েই নামিয়ে উড়ে গেল। বেশ কিছু দূরে একটা সদ্য মৃত হরিণ পড়ে আছেআন্টানিও পাখিটার দিকে চিৎকার করে আমাকে আবেগভরা কণ্ঠে বলছে, “se Passaro preto, Deus enviou (দেখ ওই কালো পাখিটা ঈশ্বর প্রেরিত)” কাল দুপুরে, খাঁড়ি থেকে বাস্কেট জালে ধরা দুটো দুটো পাঙ্গাশ মাছের রোস্ট, সেইটাই ছিল আমাদের আগের খাবার ওই পাখি যাকে আমরা কুৎসিত বলছিলাম, তার আনা এই সদ্যমৃত হরিণের টাটকা মাংসের রোস্ট আর কলা দিয়ে গুরুভোজনটা বেশ ভালোই হবে। কে পাঠালে দুই অনাহারী অনাথ তরুণের জন্য আহার? খাবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে পরম করুণাময় ঈশ্বরের করুণার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে ভুলিনিকিন্তু ঈশ্বরের আর এক মোহন রূপ আমাদের দেখা বাকি ছিল।
হরিণের রোস্ট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে করতে আন্টানিও একটা কথা বলল যেটা আমি না বলতে পারলাম নাআন্টানিও বললে, “দোস্ত একবার ভেবে দ্যাখো, এই অজানা দ্বীপের অনেক কিছুই আঙ্কল কার্ভালো সেই রাতে আমাদের যে দ্বীপের কথা বলেছিল তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছেএই দ্বীপের ঝরনা, তিনটে চূড়ার খাড়াই পাহাড়, সেটা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়া ঝরনা, আকাশ থেকে নেমে আসা ভীষণদর্শন পাখির আস্ত হরিণ ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, সব মিলে যাচ্ছে শুধু সেই জোড়া সিঁড়ি লাগানো পাতকুয়োটা পাইনি। হয়তো এবার সেটাও পাওয়া যাবে
আমি বললাম, “আন্টানিও, তোমার খাওয়া শেষ হলে গুহার মধ্যে চলে এসোহয়তো আমাদের জন্য কিছু সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আর বলতে হল না, আমার হাতের ফ্লাশলাইটটা নিয়ে, আমার আগেই গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল আন্টানিও। ফ্লাশ লাইটের আলোয় এবার দেখা যাচ্ছে গুহার বন্ধ মুখের কাছেই একটা বড়ো ব্যাসের গর্ত নিচে নেমে গেছে। সেই গর্তের দুই প্রান্তে দুটি কাঠের সিঁড়ি লাগানো আছে। গুহার ছাদের একদম ওপরে যেখান দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে, পাহাড়ে চড়ে কেউ যদি সেই জায়গা থেকে পাতকুয়োটা দেখে, এই সিঁড়ি দুটো দেখতে পাবে না।
আন্টানিও মাথা নেড়ে বলে, “এই কারণে, আঙ্কেল কার্ভালো সেই জায়গা থেকে শুধু পাতকুয়ো দেখেছেন। ঘটনাচক্রে, আমরা সেই জায়গা থেকে অনেক নিচে গুহার মধ্যে ঢুকে সেটা দেখছি আমি বলি, “আন্টানিও, তাহলে নিশ্চিতভাবে এইটাই ম্যাপে দেখানো সেই 11 নম্বর জায়গাটা
সবকিছু মিলিয়ে আমরা বুঝে নিলাম যে আঙ্কেলের দেখা আর ম্যাপে দেখানো কুয়ো, এই জায়গাটি হবার প্রবল সম্ভাবনা। আর বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা অভিযানের জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।
আমাদের ব্যাগ দুটোতে অভিযানের জন্য দরকারি জিনিস যেমন হুক লাগানো রোপ, মশাল, গ্যাস লাইটার, ব্যাটারি টর্চ, গ্যাস মাস্ক, আত্মরক্ষার জন্য বেরেটো গান, মাস্কেট দা আর আমার জুতোর হুকে স্টিলেটো ছুরি এইসব থাকেইসিঁড়িতে নামার আগে দুজনে স্থির করে নিলাম যে সামান্যতম শ্বাসকষ্ট হলেই গ্যাস মাস্ক বার করা হবেআমি আগে রইলামকোনো বিপদ এলে আমি প্রথমে স্টিলেটো ছুঁড়ে তাকে কাবু করবার চেষ্টা করব, আমি না পারলে আন্টানিও তার বেরেটো থেকে কয়েক রাউন্ড ঘুম পাড়ানো গুলি ছুঁড়বে
এই গুহাতে কাঠের সিঁড়ি কিছুটা দূর নেমেছে। তার পরেও সিঁড়ি আছে, মানে পাথরের গায়ে একটু অন্তর অন্তর চওড়া ধাপ কাটা আছেপ্রতি ধাপে হাত-পা দুটোই ব্যবহার করতে হবে সাবধানের একটু হেরফের হলেই বিপদ হতে পারে অন্য গুহাতে সিঁড়ি দিয়ে ভূগর্ভে নামবার সময় সাধারণত ভ্যাপসা পচা গন্ধ বা বাদুড়ের মলের নোংরা গন্ধ আসে, কিন্তু এই গুহাতে নামবার সময় সেরকম কিছু না মনে হওয়াতে আমরা মুখ থেকে গ্যাস মাস্ক সরিয়ে দিয়ে নামছিলামসিঁড়ি গুহার শেষ ধাপে এসে আমরা কাঠের ধোঁয়ার একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলামএত নীচে নেমেও হালকা আলো আছে
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দেখি, পাথর কেটে পর পর দুটো থামওয়ালা একটা বেশ বড়ো চত্বর বানানো হয়েছেথামগুলো পার করেই দেখি, এক নয়ন মনোহর দৃশ্যচত্বরের মধ্যে মন্দিরের মতো গর্ভগৃহ বানানো হয়েছে যার বাম প্রান্তে শিবের হাস্যময় শ্বেত মূর্তি, ডানে ধ্যানমুদ্রায় বুদ্ধ আর মাঝখানে এক বিশাল আকৃতির শিব লিঙ্গ যাতে দুজনের হাত স্পর্শ করে আছে আমরা দুজনে অনেক হিন্দু মন্দিরে গেছি, কিন্তু কোথাও এইধরনের অভিনব পরিকল্পনার দেব-দেবীর মূর্তি দেখিনি। এইখানে মাঝে মাঝে আলো চমকে চমকে আসছেএই পাতালপুরীতে আলো কোথা থেকে আসছে? ব্যপারটা কী? কৌতূহলী হয়ে চারপাশে খুঁজে দেখি, এক কোণ থেকে সূর্যের আলো আসছেআন্টানিও আমাকে দেখাল সেখানে কোনো স্ফটিক লাগানো আছে যা লেন্সের মতো মাঝে মাঝে সূর্যের আলো ফেলছে কখনও মূর্তিদের ওপর আবার কখনও নিচে রাখা কাঠের গুঁড়ির ওপরকাগজের ওপর লেন্স দিয়ে সূর্যের আলো ফেললে সেটিতে প্রথমে ধোঁয়া পরে আগুন জ্বলে। এখানে ঠিক সেইরকম সুগন্ধি কাঠের ওপর লেন্স দিয়ে ফেলা সূর্যের আলো পড়বার কারণে ধিকি ধিকি করে জ্বলে সুগন্ধি ধোঁয়া হচ্ছে। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ এইমাত্র পুজো সেরে ফিরে গেছেন
হঠাৎ করে আসা আলোর দ্যুতিতে প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেলভালো করে লক্ষ্য করে দেখি, আলো আসছে রাজবেশী বুদ্ধের মাথার মুকুট থেকেআন্টানিও বললে, হতে পারে, এনার মাথার মুকুটে বড়ো হিরে লাগানো আছে
গর্ভগৃহের বাইরের বারান্দায় দরজার পাল্লার মতো কিছু দেখা যাচ্ছেআমরা দুজনে সেটা টানতেই দেখলাম সেটা একটা আলমারিআলমারিতে তাকের পর তাকে রয়েছে অনেকগুলো হিরে বসানো মুকুট আর সোনার অলংকারআমি বললাম, “আন্টানিও, হয়তো কোনো রাজা যুদ্ধে শত্রুর ধনসম্পদ লুঠ করে বা সমুদ্রবাণিজ্য করে ফেরবার পথে কোনো সদাগর এই বহুমূল্য হিরেজহরত মন্দিরের দেবতাদের দান করে গেছেন সেইসব ধনসম্পদ যাতে সহজে কেউ সন্ধান না পায় সেজন্য এভাবে দেবতা এবং তার সম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন আর উত্তরপুরুষদের দেখাবার জন্য ম্যাপ বানিয়ে সংকেত দিয়ে গেছেন
ঠিক এই সময় মন্দির চত্বরের এককোণে সূর্যের আলো এসে পড়লসেইখানে যেতেই নজরে এল এক দীর্ঘ হেলানো রেলিং পাথরের গায়ে আটকে রাখা আছে আর সেখানে জায়গায় জায়গায় চওড়া চওড়া খোপ অর্থাৎ এটি একটি সিঁড়িপথ। এইটি বেয়ে উঠে গেলে হয়তো পাহাড়ের চুড়োর কাছে পৌঁছানো যেতে পারে।
এই সিঁড়ির ঠিক তলায় কিছু একটা লম্বা জিনিস ঢাকা দেওয়া আছেএইখানে বোধহয় এই মন্দিরের কোনো সাধককে সমাহিত করা আছেআমি প্রথমটায় রাজি না থাকলেও আন্টানিওর কথা মেনে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের খ্রিস্টানমতেই হাঁটু গেড়ে বসে গেলাম
কী ভেবে আন্টানিও সেই কাপড় সরিয়ে ফেললএবার দেখি সেটি কোনো সমাধি নয়, একটা বিশাল আকারের সেকেলে পিয়ানোতবে কি রোজ আরতির সময় এই পিয়ানো বাজত? আমাদের অনাথাশ্রমের হিন্দি শিক্ষকের কাছে হিন্দুদের ঠাকুর দেবতা সম্পর্কে কিছু জানতামতার মুখে এইরকম বুদ্ধ আর শিবের একসঙ্গে মূর্তি যেমন শুনিনি তেমনি মন্দিরে আরতির সময় কাঁসর, ঘণ্টা, ঢোল, মৃদঙ্গ বাজে দেখেছি, পিয়ানো দেখিনিএটি তো আমাদের গির্জাতে দেখেছি
আন্টানিও-র প্রিয় বাজনা পিয়ানোসে এর মধ্যে সেটি নেড়েচেড়ে তা বাজে কিনা দেখতেও শুরু করে দিয়েছেপিয়ানোর সামনে পাথরের দেয়ালে কিছু লেখা দেখে সে আমাকে চিৎকার করে বলে, “অ্যালস, ম্যাপের ছবিটা হাতের কাছে থাকলে নিয়ে আয়” ব্যাকপ্যাকের সামনের পকেট থেকে ছবিটা বার করে আন্টানিওর হাতে তুলে দিয়ে আমি বলি, ম্যাপ রহস্যের আর কী বাকি আছে?”
ম্যাপটা হাতে নিয়ে আন্টনিও আমাকে বলে, “ম্যাপের একেবারে নিচে দ্যাখওখানে আছে -
      ৪ ৩
    ৩ ২ ১
    ৪ ৩ ২
    ১ ২ ৩
      ২ ১
এইগুলো আঙ্কেল বা আমরা কেউ তখন বুঝতে পারিনি ভালো করে দেখ, ওই দেয়ালে এইগুলোই আছে। এইগুলো আসলে পিয়ানোর কোনো বাজনার স্বরলিপিআমি নিজে পিয়ানো বাজিয়ে হয়েও এটা আমার মাথায় আসেনি
আন্টানিও সে দিকে তাকাতে তাকাতে স্বরলিপি অনুযায়ী বাজানো শুরু করেপিয়ানোর মিঠে আওয়াজে কিছু যেন এক নিবেদনের আর আহ্বানের আর্তি এক মায়াবী সুরে বেজে ওঠেএকটু পরে পিয়ানোর অনুরণনে চারদিক কেঁপে উঠতেই গুহার গর্ভগৃহের ছাদ থেকে ঝোলানো ঘণ্টাগুলো বাজতে শুরু করল এইসময়ে দেবমূর্তিগুলির মাথার ওপরের স্ফটিকগুলির ওপরে সূর্যের রশ্মিগুলো তাঁদের মুখে পড়তেই মনে হল যেন এক জ্যোতিঃপুঞ্জের আবির্ভাব হয়েছেদেবমূর্তিগুলির সামনে রাখা একটি দীপক আপনা থেকেই জ্বলে উঠলআন্টানিওর পিয়ানোর সুর আমাদের দুজনের শরীরের সারা লোমকূপ শিহরিত করে নিরাবিল আনন্দে ভরে দিল। স্বরলিপির শেষে এসে পিয়ানো ধীরে ধীরে থামতেই পুরো পরিবেশটা ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল এই গুহাতে আনন্দের গুপ্ত সম্পদ আমাদের মনের ডালা ভরিয়ে দিল। আমাদের দুজনের একই সঙ্গে মনে হল এই অপার প্রাপ্তির পর আমাদের আর কোন সম্পদের দরকার?

রেলিংটা হেলানো হলেও যথেষ্ট চড়াইপাথরের খোপে খোপে পা দিয়ে সাবধানে ওপরে ওঠা বেশ শক্ত কাজকিন্তু একটু আগে পিয়ানোর প্রার্থনার সুরে যে আনন্দ আমাদের মনপ্রাণ ভরিয়ে দিয়েছিল আমরা তারই শক্তিতে পুরো পথটা অনায়াসে চলে এসে থামলাম যেখানে সেটা একটা সমতল জায়গা চারপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলাম যে এই জায়গাটাই সবচাইতে উঁচু খাড়াই পাহাড়ের চূড়ার কোলের সমতল জায়গা। এর এককোণে আছে গম্বুজ, যেখানের কাচের শার্সিতে পড়া আলোর ঝলকানিতে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল
আন্টানিও বললে, “দোস্ত, এই গম্বুজ সম্ভবত সেই যুগের কোনো লাইট হাউসআমার বিশ্বাস ওইখানে একটা বেশ শক্তিশালী ধাতব রিফ্লেকটর বসানো আছেএই থেকে সূর্যের প্রতিফলিত আলো এসে মন্দিরের চূড়ার ওপরের খোলা জায়গা দিয়ে ঢুকে স্ফটিকের ওপর পড়ে দেবস্থানকে আলোকিত করে রাখছে, আর তাঁদের সামনে রাখা কাঠের গুঁড়ো হালকা পুড়ে ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছেযদি পিয়ানো বাজে সেই 1 2 3 লেখা স্বরলিপিতে তবে তার সুরের অনুরণনে আরও শক্তিশালী হয়ে দীপক জ্বালিয়ে দিচ্ছে
এতটা পথ চড়াই সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদের গলার টাকরা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছেপাহাড়চুড়োর পাথর থেকে ঝিরঝির করে জলধারার আওয়াজ শুনে সেদিকে দুজনে এগিয়ে গেলামআকাশ থেকে একটা আওয়াজ শুনে দেখি সেই বিকটদর্শন পাখিতবে সেটা এবার এক নয়, একজোড়াপাখিদুটো চক্রাকারে সেখানে নেমে এসে এক কাঁদি ডাব আর পাকা কলা রেখে আবার কোথাও উড়ে গেল
বিশ্বাস করা একদিকে যেমন কঠিন অন্যদিকে এইটাই হয়তো দেবস্থানের মহিমাআন্টানিও বললে, নীচের গুহামন্দিরে আছেন হাতে হাত ধরে শিব আর বুদ্ধ আর এখানে কি তাঁরা পাখির রূপ ধরেছেন?”
দুজনে মিলে অনেক কাঠকুটো জোগাড় করে আনলামআজ সন্ধে নামার আগে এই পাহাড়ের তিন জায়গায় তিনটে ত্রিভুজ আকৃতির আগুন জ্বালিয়ে এস ও এস সিগন্যাল তৈরি করে সারা রাত জ্বালিয়ে রাখতে হবেআমাদের ভাগ্য ভালো হলে আজ রাত্রে নৌবাহিনীর বিমান আমাদের সিগন্যাল দেখে হয়তো উদ্ধার করতে পারে আমাদের
পরের দিন সকালে আমাদের অনুমানকে ঠিক প্রমাণ করে, নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার এখানের আকাশে এসে বিমান থেকে রোপ ল্যাডার নামিয়ে আমাদেরকে উদ্ধার করেপাইলট তার সিট থেকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলে যে এই দ্বীপে কোনো প্রাচীন মন্দির আমরা দেখেছি কিনা
সিঁড়িগুহার দেবতারা যেন শান্তিতে থাকেন, গুপ্তধনের লোভে কেউ যেন আর এখানে পা না দেয়, এই উদ্দেশ্যেই মিথ্যে বললে কি পাপ হয়? চোখ বন্ধ করে তাঁদের জিজ্ঞেস করলামমনে হল রাজবেশী বুদ্ধ আর দেবাদিদেব দুজনেই যেন সম্মতি দিয়ে মৃদু হাসছেন
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment