গল্প:: সব পেয়েছির দেশে - রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস


সব পেয়েছির দেশে
রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস

আজ আমার খুব মন খারাপ। বুটুদাদুর কাছে পড়তে যেতেও ইচ্ছে করছে না। নেহাত ঝিকাই ডাকতে এল, তাই! তাছাড়া মা-বাবাও তো বকবে পড়তে না গেলে। আমাদের ছোটোদের না, বড়োরা একটুও বোঝে না! বোঝে না আমাদেরও মন খারাপ হয়। কান্না পায়। এখন তো আমি একটু একটু বড়ো হয়েছি। তাই চিৎকার করে কাঁদতেও পারি না।

আমি, ঝিকাই, তুতুন, রিমলি, গোগোল রোজ স্কুল থেকে ফিরে বুটুদাদুর কাছে অংক করতে যাই। অংক শেষে বুটুদাদু রোজ আমাদের একটা করে গল্প বলেন। ভূত-পেতনি, শাকচুন্নি, ব্রহ্মদৈত্য, এলিয়েন, হাসির গল্প, রূপকথার গল্প - এমন অনেক গল্প বুটুদাদুর কাছ থেকে আমরা রোজ শুনি। অংক করতে এসে আমার থমথমে মুখটা দেখে বুটুদাদু বললেন, “মনে হচ্ছে টুটানবাবুর আজ মন খারাপ!
এমন করে কেউ জিজ্ঞেস করে! বুটুদাদুর কথায় আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। আমি কাঁদছি দেখে বুটুদাদু আমায় কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, “এ মা! বুড়ো ছেলের চোখে জল! কী হয়েছে সেটা তো বলবে?
আমি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেললাম। সত্যি তো, আমি না এখন বড়ো হয়ে গেছি! এবার ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠব। এমন বাচ্চাদের মতন কেউ কাঁদে নাকি! বুটুদাদু আবার বললেন, “টুটানবাবুর মন খারাপের কারণ না জানলে আমি মন ভালো করব কেমন করে!
তুতুন আর গোগোল একসঙ্গে বলে উঠল, “আমাদেরও বলছে না। ওর কেন মন খারাপ।”
ঝিকাই বলল, “টুটান আজ পড়তেও আসতে চাইছিল না...
বুটুদাদু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “সে কী টুটানবাবু! আমার কাছে পড়তে আসতে চাইছিলে না! শুনে বড়ো দুঃখ পেলাম আমি।”
বুটুদাদুর কথা শুনে আমার আরও কষ্ট হল। আসলে আমি যে কাউকেই কষ্ট দিতে চাই না! সবার ভালো করতে চাই! সবাইকে ভালো রাখতে চাই! বড়োরা যেন কিছুতেই সেটা বোঝে না। আমি বুটুদাদুকে বুঝিয়ে বললাম, “তুমি দুঃখ পেয়ো না বুটুদাদু! আসলে তোমাদের বড়োদের যেমন মন খারাপ হলে কিছু করতে ভালো লাগে না তেমন আমাদের ছোটোদেরও পড়তে ভালো লাগে না...
আমার কথা শুনে বুটুদাদু আমায় কোলে টেনে নিয়ে হেসে বললেন, “বেশ। বুঝলাম। এখন চটপট বলে ফেলো তো তোমার মন খারাপের কারণ!
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “কাল রাতে আমার মামাবাড়িতে চুরি হয়ে গেছে। অনেক কিছুই নাকি চোরে নিয়ে গেছে! সেই সঙ্গে আমায় দাদু যে সাইকেলটা কিনে দিয়েছিল, সেটাও নিয়ে গেছে। চোর কেন এমন করল বুটুদাদু? কেন চোর চুরি করে?
বুটুদাদু আমার গাল টিপে আদর করে বললেন, “সত্যিই তো! চোর যে কেন চুরি করে! ভারী অন্যায়। চলো আজ বরং এক চোরের গল্প বলি তোমাদের -

‘সব পেয়েছির দেশে’-র রাজা ছিলেন খুব বুদ্ধিমান। প্রজাদের তিনি সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন তাঁর দেশে যেন কোনোরকম অশান্তি না থাকে। প্রজারা যেন সুখে-স্বচ্ছন্দে বসবাস করে। কিন্তু সেই দেশে ছিল চোরের খুব উপদ্রব। প্রায়ই রাজ-দরবারে কোনো না কোনো প্রজা এসে তার বাড়িতে চুরি হবার নালিশ জানিয়ে যায়।
একদিন রাজামশাই মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, “এ দেশে এত চুরির কী কারণ মন্ত্রী? তোমার কী মনে হয়?
মন্ত্রী সবিনয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আমার মনে হয় এই দেশে কারোর অনেক আছে, আবার কারোর কিছুই নেই। তাই...
মন্ত্রীর কথা শেষ করতে না দিয়ে রাজামশাই বললেন, “ধনের বৈষম্য চুরির কারণ! তবে আজ থেকে দেশে কারও ঘরে যেন অতিরিক্ত ধন না থাকে। সকলের ধনসম্পদ সকলের সঙ্গে সমান ভাগে ভাগ করে দাও। সব কাজের সমান মাইনে হোক। সকলের কাছে সমান ঐশ্বর্য থাক। কারও কাছে যদি এক ফোঁটাও অধিক ঐশ্বর্য থাকে তবে তার গর্দান নেব যাও এখনই ঘোষণা করে দাও। এখনই সব ব্যবস্থা করো মন্ত্রী।”
মন্ত্রী মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে রাজামশাই, দোষ নেবেন না। একটা কথা জানার ছিল।”
“নির্ভয়ে বলো মন্ত্রী!
মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে মন্ত্রী বললেন, “আজ্ঞে, আমার ধনও কি প্রজাদের মধ্যে ভা--- করে দিতে হবে?
রাজামশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “এ প্রশ্ন কেন? তুমি কি দেশের বাইরে থাক?
মন্ত্রীমশাই চুপ করে মাথা নিচু করে রইলেন। রাজাদেশ পছন্দ না হলেও তা তো আর অমান্য করা যাবে না। তাই যেমন আদেশ, তেমন কাজ। সবাই পেয়ে গেল সমান মাইনের চাকরি। সমান সম্মান। চুরি ডাকাতি আর কিছুই হয় না দেশে। চুরি করলে যে চোরের অতিরিক্ত ধন হয়ে যাবে! আর অতিরিক্ত ধন ঘরে থাকলে তার একটাই শাস্তি - গর্দান।
কিন্তু চোর তো দু-প্রকারের। একজন অভাব চোর। একজন স্বভাব চোর। অভাব চোরের অভাব আর নেই। তাই চুরিরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্বভাব চোর! তার তো হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু রাজার ভয়ে চুরি করতেও পারছে না। বাধ্য হয়ে একদিন সেই স্বভাব চোর গিয়ে হাজির হল রাজ-দরবারে। রাজামশাইকে গিয়ে বলল, “আমি দিনের বেলায় করি জুতো সেলাই আর রাতের বেলায় করতাম চুরি। রাজামশাইয়ের দয়ায় আর কোনো অভাব আমার নেই বটে, কিন্তু হাত বড়ো অভাব বোধ করছে প্রতি রাতে।”
রাজামশাই শুনে বললেন, “হাত অভাব বোধ করছে? কাজ পাচ্ছে না বুঝি! বেশ। আজ থেকে তুমি রোজ রাতে দিঘির ধারের মাঠে কোদাল দিয়ে মাটি খোঁড়ো। তোমার হাত তবে কাজ পাবে। চুরির জন্য আর নিশপিশ করবে না।”
যেমন আদেশ তেমন কাজ। সেই থেকে স্বভাব চোর রোজ রাতে দিঘির ধারের মাঠে গিয়ে মাটি খোঁড়ে।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে স্বভাব চোর মাটির তলায় একটা বড়ো পিতলের কলসি দেখতে পেল। টেনে হিঁচড়ে অনেক কষ্ট করে মাটির তলা থেকে বার করল সেই ভারী কলসি। কলসির মুখটা খুলে সে দেখল এক কলসি মোহর। মোহর দেখে তো স্বভাব চোরের চোখ চকচক করে উঠল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। নিশুতি রাতে ঝিঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অতি সন্তর্পণে স্বভাব চোর সেই গুপ্তধন ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখল। গুপ্তধনের দিকে তাকায় আর একা একা হেসে চলে সে। আনন্দ আর ধরে না। সেই রাতটা হেসে হেসেই কেটে গেল তার। কিন্তু পরদিন বাড়ি থেকে সে এক পা-ও বেরোতে পারে না। না যেতে পারে জুতো সেলাই করতে। না যেতে পারে কোদাল চালাতে। ক’দিন সবাইকে শরীর খারাপ বলে কাটিয়ে দিল। বাড়িতে কোনো লোক এলে বুকের মধ্যে ধুকপুক করে। যদি কেউ মোহরের কথা টের পায়! যদি সে কথা রাজার কানে যায়! তবে তো ঘরে অতিরিক্ত ধন থাকার জন্য তার গর্দান নিশ্চিত। এমনি করে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। বেশ কিছু রাত। সে চুপি চুপি একবার করে কলসির মুখ খুলে মোহর দেখে। আবার কলসির মুখ বন্ধ করে কলসি লুকিয়ে রাখে। ভয়ে ভয়ে কাটে তার প্রতি মুহূর্ত। আজ তার টাকার অভাব নেই। কোনো কিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু তার মনে। আনন্দের অভাব। শান্তির অভাব। মোহরের চিন্তায় খাওয়া ঘুম গেছে তার উড়ে। এবারে বোধহয় সে সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমন সময় সে ভাবল, “দূর! যে মোহরের কথা কাউকে বলতেই পারব না, যে মোহর কোনো কাজেই লাগাতে পারব না, সেই মোহর আমার কাছে থাকা আর মাটির তলায় থাকা তো সমান। বরং আমার কাছে থাকলে প্রতি মুহূর্তে ভয়। আতঙ্ক। তার চেয়ে বরং মোহর নিয়ে গিয়ে রাজামশাইকে দিই। তাতে যদি কিছু লাভ হয়।”
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। রাজামশাই তো আনন্দে আটখানা। তিনি সেই গুপ্তধন সমস্ত দেশবাসীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন। কিছু মোহরের ভাগ স্বভাব চোরও পেল। তার মুখে আবার ফুটে উঠল হাসি। মনে ফিরে এল শান্তি। এখন সে বোঝে, নির্লোভ আর নির্লিপ্তিই শান্তির একমাত্র পথ। আনন্দের একমাত্র পথ। এখন রাতের বেলায় চুরির জন্য তার হাত আর নিশপিশ করে না। সে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমায়।”

গল্প শেষে রিমলি বলল, “কী সুন্দর দেশ গো বুটুদাদু! সবার কাছে সমান ধন। কারও কোনো অভাব নেই!
ঝিকাই বলল, “গরিব বড়োলোক কিচ্ছু নেই। কী ভালো!
বুটুদাদু মুচকি হেসে বললেন, “সেই জন্যই তো সেই দেশের নাম ‘সব পেয়েছির দেশ’
গোগোল বলল, “যারা বেশি লোভ করে তারা কেউ ভালো থাকে না, তাই না বুটুদাদু?
বুটুদাদু হেসে বললেন, “আমাদের আসল সম্পদ যে মন! মনের শান্তির থেকে বড়ো সম্পদ আর কিছুই যে নেই! যার সেই সম্পদ নেই, জানবে সব থেকেও তার কিছুই নেই...
বুটুদাদুর কথা শুনে মনের সব কষ্ট কোথায় যেন হারিয়ে গেল আমার। আমি হেসে ফেললাম। মনটা কেমন ভালো হয়ে গেল!
----------
ছবি - শ্রীময়ী

No comments:

Post a Comment