গল্প:: লংকার অলংকার - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

লংকার অলংকার
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

বাগানের দিকের ছোট্ট ঘরটা আগে পাঁচিপিসির নিজস্ব রান্নাঘর ছিল। কাউকে ঢুকতে দিত না। কীসব পরীক্ষানিরীক্ষা চলত।
বাবা, জেঠুরা পাঁচিপিসিকে পাঁচিদিদি বলে ডাকে আসলে পাঁচিপিসির বয়স কত জানা নেই। সব চুল সাদা আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আঁটা। একটু ঝুঁকে যাওয়া চেহারা কিন্তু ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি লেগে থাকে।
মা, জেঠিমা অসুস্থ হলেই খবর পেয়ে পাঁচিপিসি ঠিক চলে আসে আর সেই বাগানের ঘরে গিয়ে হাতা, খুন্তি নেড়ে কড়াতে ছ্যাঁকছোঁক শব্দ করে কত রকমের যে পদ রাঁধে।
সেইসব রান্না অসামান্য খেতে কিন্তু তেমনি ঝাল।
জেঠু যেই বলে, “পাঁচিদি এবারে একটু কম ঝাল দিও”, অমনি পাঁচিপিসির মুখটা অভিমানী হয়ে ওঠে।
পাঁচিপিসির আসলে লংকার শখ, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতের লংকা সংগ্রহে রাখে। এক একটায় একেকরকম ঝাল। একেকটা একেক রঙের। সেই লংকা খেয়ে ঘরে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যেত। অসুখের বাবাও বাপ বাপ করে পালাত।
কিন্তু পাঁচিপিসির সেই এক কথা – “সামান্য একটু ঝাল দিয়েছি, ঝাল না দিলে কি আর রান্না ভালো হয়?
ঝাল দিতে পারলেই পাঁচিপিসির আহ্লাদের সীমা থাকে না। তাই আমরাও একটু কষ্ট করে কয়েকটা দিন হুশ-হাশ করে ঝাল খেয়ে নিই।
হপ্তাখানেক পরেই পাঁচিপিসি আবার বাক্স গুছিয়ে “জামাইয়ের ঘর চল্লুম” বলে জামাইয়ের ঘর চলে যায় পাঁচিপিসির অনেকগুলো ভাই, কিন্তু তারা কেউ খবর রাখে না। পিসেমশাই গত হয়েছেন অনেকদিন, তাই পাঁচিপিসি দুঃখ করে বলে, “আমার ভালো ভাই এখানে থাকলে সে আমাকে কত যত্নই না করত।” কিন্তু ভালো ভাই বহুদিন নিরুদ্দেশ।
পাঁচিপিসিও অনেকদিন আসে না।
তাই আমি দাবি করলাম ঘরটা আমাকেই দিয়ে দেওয়া হোক। আমার কোনো নিজস্ব ঘর নেই আজ অবধিএত এত কবিতা আমি কখনও ছাতে, কখনও বারান্দায়, কখনও বাগানে গাছতলায় বসে বসে লিখেছি, তাতে সাতবার হনুমানের থাপ্পড়, পঁয়ত্রিশবার কাকের পায়খানা, আর কুড়িবার কুকুরের তাড়ায় আমার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের খ্যাতনামা লেখকের প্রতি সমাজের এ কী অভব্য আচরণ!
তাই সকাল সকাল কথাটা মাথায় আসতেই আমি দাদুর ঘরে গিয়ে হাজির, ওমা গিয়ে দেখি সেই একই দাবি নিয়ে সেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হাড়জ্বালানো ছোড়দাও এসে হাজির।
তিনবার অংকে ফেল করে কী করে ছোড়দা একটা এক্সট্রা ঘর পেতে পারে?
ছোড়দা গম্ভীর হয়ে বলল, “সেই জন্যই তো দরকার। ঘর নেই বলেই তো ফেল করে যাচ্ছি। আর তুই যে অংকে চল্লিশ পেয়েছিস সেটাও এমন কিছু কাজের কথা না।”
দাদু তখন জলখাবার খেয়ে গেঞ্জিটা তুলে পেটে আলতো করে তবলা বাজাতে বাজাতে বলল, “ওটা তো পাঁচির ঘর। পাঁচিকেই চিঠি লিখছি। ওর মতটাও তো জানা দরকার। না হয় জন্মসূত্রে আমাদের পরিবারের কেউ নয়, কিন্তু ওকে আমরা পরিবারের লোকই মনে করি।”
পাঁচিপিসিকে চিঠি দেওয়া হবে, সেই চিঠির উত্তর আসতে আসতে তো আমি বড়ো হয়ে বুড়ো হয়ে যাবপাঁচিপিসির না আছে ফোন, না আছে ইমেইল। ধুর ছাতা, ভালোই লাগে না।
ছোড়দা ঠিক এবারে ‘জোর যার মুলুক তার’ অ্যাপ্লাই করে ঘরটা হাতিয়ে নেবে।
দাদু বলল, “ঘরটা কত নোংরা হয়ে আছে দেখেছিস? আগে দুজনে মিলে পরিষ্কার কর, তারপর দেখছি।”
ছোড়দা গাঁট্টা মেরে বলল, “শুনলি তো, যা গিয়ে ঝাঁট দে।”
“আর তুমি? আমি রেগে গিয়ে বললাম
“আমি অলরেডি ইঁদুর, আরশোলা, মাকড়সা তাড়িয়েছি। এখন একটা দুটো সাপ থাকতে পারে। তবে বিষাক্ত নয় মনে হয়,” বলে ছোড়দা ফিক করে হেসে পালিয়ে গেল
সাপ শুনেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। বাগানের দিকের ঘরে সাপ থাকা আশ্চর্য কিছু নয়। না, সাপের সঙ্গে বসত করে সাহিত্য লেখা একেবারেই সম্ভব নয়, ওই ঘরের মায়া আমাকে ত্যাগ করতেই হবে। হনুমান, কুকুর, কাকের ইয়ে বেটার।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একবার কৌতূহলবশে ঘরটায় গিয়ে ঢুকি। না, যতটা ভয়াবহ ভেবেছিলাম ততটা নয়। একদিকে বড়ো বড়ো ডেকচি, হাঁড়ি কড়া রাখা আছে। একটা বড়ো কাঠের আলমারি, তার ভেতরে যত্ন করে রাখা কাঁসা পেতলের বাসনকোশন। বিভিন্ন নকশাকাটা মশলার কৌটো। আর একটা সুন্দর ভেলভেটের মলাট দেওয়া ডায়েরি
সেটা খুলে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। কত রকম যে লংকার নাম আর গুণ লেখা আছে সেখানে। পাঁচিপিসিই লিখেছে।
সত্যবান লংকা - যে লংকায় কামড় দিলেই মানুষ সত্যি কথা বলতে শুরু করে।
স্মৃতিসুধা লংকা - ভুলে যাওয়া স্মৃতি ফিরিয়ে আনে
মনোরমা লংকা - সব কিছু সুন্দর লাগতে শুরু করে।
সাহসিনী লংকা - ভয় দূরে পালায়
অমৃতানী - আয়ুবর্ধক লংকা
এরকম কতশত লংকার নাম যে চোখে পড়ল
“তোর আগে ওটা আমি পেয়েছি। অতএব ওটা আমার।”
দেখি পেছনে ছোড়দা দাঁড়িয়ে আছে।
এক ঝটকায় খাতাটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, “আর ভাবতে হবে না, বাকি জীবনটা লংকার চাষ করে কাটিয়ে দেবএকেবারে কোটিপতি। সমুদ্রের ধারে একটা বিশাল বাংলো বাড়ি। তুইও আসবি মাঝে মাঝে। তবে বছরে তিনদিনের বেশি নয়।”
আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম, “আসতে আমার বয়েই গেছে।”
“এত বড়ো বাংলো - ঝাঁট দিয়ে যাবি একটু,” বলে ছোড়দা আমাকে ঠেলে বের করে ঘরটায় তালা ঝুলিয়ে দিল

সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। পড়ালেখাতেও মন বসছিল না। পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি ছোড়দা ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করেছে – “এই অপু হতচ্ছাড়া, পাঁচিপিসির ঘর কে খুলেছিল? আমার লংকার খাতা কোথায় গেল?
“যা বাবা! আমি কী তার জানি? একেই বলে অতি দর্পে হতা মানে গতা লঙ্কা।”
এই শুনে খেপে গিয়ে নেত্য করতে করতে ছোড়দা ছুটতে ছুটতে চলল দাদুর কাছে।

দাদু তখন গেঞ্জিটা ওপরে তুলে ভুঁড়িতে তবলা বাজিয়ে বলল, “পাঁচির মেইল পেয়েছিলাম। সে তো এখন আমেরিকায় তার ভালো দাদার কাছে। লিখেছে খুব যত্নে আছে সেখানে, লংকার চাষের জন্য বিশাল বাগান করেছে, কত সব জ্ঞানী বিজ্ঞানী রোজ দেখা করতে আসছে।
“তো সে লিখেছিল আমি যেন তার খাতাটা তাকে পাঠিয়ে দিই, তাই আজ সকালেই ক্যুরিয়ার করে দিয়েছি।
“পাঁচি নতুন ভ্লগ খুলেছে ইন্টারনেটে, তার বই আসছে, বইমেলায় - নাম ‘লংকার অলংকার’, পাঁচি মানে পঞ্চমী আমাদের গর্ব।”
এতটা শুনে ছোড়দার মুখ শুকনো লংকার মতো শুকিয়ে গেছে।
সমুদ্রের ধার, কোটি টাকার বাংলো, লংকার অলংকার আওড়াতে আওড়াতে আমি টেনে এক দৌড়।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment