গল্প:: রাজবাড়ির রহস্য - বুমা ব্যানার্জী দাস


রাজবাড়ির রহস্য
বুমা ব্যানার্জী দাস

১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ, খাড়াসুনির জঙ্গল (অধুনা বাংলাদেশ)
নলখাগড়ার ঘন আস্তরণ ভেদ করে চোখে পড়ে না কিছুই তাও প্রৌঢ় টের পেলেন কেউ আসছে মনঃসংযোগে সামান্য ব্যাঘাত ঘটল তাঁর এখানে এখন কার আগমন ঘটল?
প্রথমে নলবনের উপরে দৃষ্টিগোচর হল শিরস্ত্রাণ, কয়েক মুহূর্ত পর দুইজন যুবাপুরুষ এসে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়ের সামনে উভয়ের চোখে বিস্ময় তাঁদের ঘর্মাক্ত কলেবর দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ এই নলখাগড়ার জঙ্গলে ঘুরছেন, হয়তো বা পথভ্রষ্টও হয়েছেন
- পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে রাজপুরুষ, আর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত ভুল অনুমান করলাম কি? – প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করেন
- আপনার অনুমান যথার্থ আমাদের গন্তব্য রাজমহল, কিন্তু রসদ তলানিতে এসে ঠেকেছে আমাদের সেনাধ্যক্ষ ও বাকি লোকজন বেগবতীর পাড়ে অপেক্ষারত আমরা রসদের সন্ধানে বেরিয়ে এই জঙ্গলে পথ হারিয়েছি এ কুটির আপনার?
- এ কুটির এই দীনেরই বটে আপনারা আমার অতিথি নিশ্চিন্ত থাকুন, রসদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে
- বাংলার সুবেদার ও তাঁর বাহিনীর রসদের ব্যবস্থা সাধন সামান্য কার্য নয় মহাশয় - রাজপুরুষের মুখের ভাব সামান্য কঠিন হয়
- বিলক্ষণ - এবার উঠে দাঁড়ান প্রৌঢ়আমি তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি

বেলা পড়ে এসেছে প্রায় কুটিরের সামনের জঙ্গল এখন নিকানো উঠোনের মতো পরিষ্কার কিছুক্ষণ আগেও সেখানে চাল ডাল আনাজ ঘি মশলার বস্তা স্তূপ হয়ে পড়ে ছিল শেষ বস্তাটা নৌকায় ওঠানো হয়েছে এইমাত্র তার আগে দলের প্রত্যেকে পরিতৃপ্তির সঙ্গে ভোজনও করেছে সামান্য মোটা চালের অন্ন, ডাল, শাক ও ভর্জিত সবজি, তাও দীর্ঘ অনাহারের পর অমৃততুল্য মনে হয়েছে সকলের
প্রৌঢ়ের সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন এক বিশালদেহী পুরুষ
- আপনার সত্যকার পরিচয় এবার দিন, জঙ্গলের মাঝে এমন বিপুল পরিমাণ রসদের ব্যবস্থা এই অল্প সময়ে করা যে অসম্ভব এ কি ইন্দ্রজাল!
- আমি সামান্য মানুষ নামেও বিষ্ণুদাস, কর্মেও তাই লোকে বলে আমার কিছু ক্ষমতা আছে, তবে যা করার তিনিই করেনমৃদু হাসেন প্রৌঢ়
- আপনি আমাদের সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, আজ থেকে এই এলাকার আশপাশের পাঁচটি গ্রাম আপনার, আমি দানপত্র এখুনি প্রস্তুত করছি তবে আপনার প্রাপ্য আরও অনেক বেশি কোমরবন্ধের ভিতর থেকে বিশালদেহী পুরুষ মুঠো করে কিছু বের করে আনেন বাড়িয়ে ধরেন প্রৌঢ়ের দিকে
- সর্বনাশ, ওসব আমার সহ্য হবে না আপনি আমার পুত্র শ্রীমন্তকে বরং ওটি দান করুনচমকে ওঠেন বিষ্ণুদাস
- আজ থেকে আপনি ভূস্বামী আমি, বাংলার সুবেদার, আপনাকে হাজরা উপাধিতে ভূষিত করলাম আপনার সর্বাঙ্গীন শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি
হাতজোড় করে নমস্কার জানান বিষ্ণুদাস হাজরা কয়েক প্রহরে জীবনের ধারা বদলে গেল তাঁর কে জানে গোপালের কী ইচ্ছা পুত্র শ্রীমন্ত অবশ্য মহাখুশি সুবেদারের মহার্ঘ উপহার মুঠো করে ধরে রেখেছে হঠাৎ খেয়াল হয় বিষ্ণুদাসের, বড়ো ভুল হয়ে গেছে তো দ্বিধাভরে বলেন আমি জঙ্গলে জপতপ নিয়ে থাকি, বাইরের জগতের খবর রাখি না বাংলার সুবেদারের নামটি যদি জানতে পারতাম...
অট্টহাস্য করে ওঠেন সেই বিশালদেহী পুরুষ ভরাট গলায় বলেনআমি মান সিংহ

মার্চ ২০১৮, শিমুলতলা স্টেশন বাজার
- দিদিদের কি ইউটিউব চ্যানেল আছে? শুটিন করতে এয়েচেন? – অটোচালকের প্রশ্নে চারজনেই রাস্তার দিক থেকে চোখ ফেরায় চালকের পাশে বসা মিঠুর ভ্রূ সামান্য উপরে উঠে যায় টিয়া ফিক করে হেসে ফেলে আর রাকা আবার দু-পাশের দোকানের জিলিপি সিঙাড়ার স্তূপের দিকে চোখ ফেরায় সেখান থেকে প্রাণকাড়া গন্ধ ভেসে আসছে
নন্দিনী স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় বলেনা, বেড়াতে কেন বলুন তো?
- আর বলবেন না দিদি, মাস ছয়েক আগে কলকাতার গোটা পাঁচেক ছোকরাবাবু টাভেল ভোলগ না কী ছাইভস্ম বানাতে এয়েছিল ওই ইউটিউবে যেমন হয় তা তারা নাকি ভোলগে বলেছিল রাজবাড়িতে গুপ্তধন আছে তারপর থেকে নিত্যদিন রাজবাড়িতে সবাই যাচ্ছেন আর শুটিন করছেন বাপের জন্মে রাজবাড়িতে এমন ভিড় দেখিনি
- আর গুপ্তধন? সত্যি আছে নাকি? টিয়ার চোখ ঝিকিয়ে ওঠে
- কী যে বলেন দিদি, রাজবাড়ির যা দশা দরজা জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে লোকে ভূত থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু গুপ্তধন? – পানের ছোপধরা দাঁত বের করে হাসে আটোচালক
লাল রঙের পুরোনো একটা বাড়ির সামনে ঝাঁকুনি দিয়ে অটোটা দাঁড়ায় মাঝবরাবর চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে থাম লাগানো বারান্দায় প্রত্যেক থামের দুইপাশে সবুজ জাফরি
- এই হল যশোদা ধাম, নামেন দিদিমণিরা আপনারা কতদিন আছেন আজ্ঞে? – অটোচালক ইতিমধ্যে লাগেজ নামাতে শুরু করেছে
নন্দিনী ব্যাগ খুলে টাকা দিয়ে বলেদিন তিনেক
সাবধানে ব্যাগটা বন্ধ করে নন্দিনী, এই ট্রিপের সব টাকা তার কাছে জমা
- আমার নম্বরটা রেখে দিন দিদি, যেখানে বলবেন নিয়ে যাব আমার নাম পরিমল

- এই দাঁড়া, আগে বাড়িটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে একটা গ্রুপফি তুলি - টিয়া লাফাচ্ছেভাবতে পারছিস, এই প্রথম আমরা বড়োদের ছাড়া রাত কাটাব?
- এসব পুরোনো বাড়িতে ভূত থাকে, তা জানিস? – রাকা জিভ ভ্যাঙায়
টিয়া সেলফি স্টিক তুলে তাড়া করে রাকাকে চারজনে হাসতে হাসতে যশোদা ধামের সিঁড়ি দিয়ে ওঠে আইএসসি পরীক্ষা শেষ, স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে এবার কলেজে ওঠার পালা সেই ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধুত্ব ওদের শেষ দুই বছরে স্ট্রিম পালটালেও স্কুল চিরকাল একই ছিল এই প্রথম কোনো অভিভাবক ছাড়াই বেরোনোর অনুমতি মিলেছে মনে মনে তাই সবাই বেশ পুলকিত
- আবার কোনো অ্যাডভেঞ্চার হলে মন্দ হয় না বল, সেই গতবারের মতো? – টিয়া মিঠুর হাত ধরে টানে মিঠু আপাতদৃষ্টিতে বড়ো শান্ত
- দাঁড়া, আগে লাঞ্চটা করি আমার বাপু ট্রেনে চড়লে বড্ড খিদে পায়রাকা নাক টানতে থাকেআমি কিচেন থেকে চিকেনের গন্ধ পাচ্ছি
নন্দিনী অফিস রুমের দিকে এগোয় সে এই দলের অঘোষিত লিডার

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ, কলিকাতা
- কর্তামা, আমাকে ডেকেছিলেন?
- আসুন নায়েবমশাই দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে আসে আবছা অন্ধকারে বসে আছেন রানী তারামণি দেবী চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর গায়ে, তবে মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যেন তাঁর চোখে ফুটে ওঠা দুশ্চিন্তাকে ঢেকে রাখতেই এই অন্ধকারের আড়াল বাম কাঁধ বেয়ে নেমেছে চুলের ঢল কে বলবে তাঁর বয়স প্রায় নব্বই নায়েব তাঁর পদপ্রান্তে বসে পড়েন প্রশ্ন করা সহবত বিরুদ্ধ
- শশিভূষণের জন্মের কয়েক মাস আগে আমি বিধবা হই পিতাসম শ্বশুরমশাই যখন চলে যান, শশি তখন দশ মাসের শিশু সেও চলে গেল মাত্র বাইশ বছর বয়সে স্বামীশোক, পুত্রশোক ভুলে প্রজার মঙ্গল করে চলেছি এত বছর ধরে পুত্রবধুও চলে গেল তার তিন বছর পর ভেবেছিলাম দত্তক নেওয়া নাতিটা নিশ্চয়ই থাকবে কিন্তু বংশের মৃত্যুমিছিল ইন্দুভূষণকেও ছুঁয়ে গেল
- কর্তামা, কী লাভ এসব ভেবে
- দরকার আছে নায়েবমশাই এই ভয়ে ইন্দুর ছেলে আমার নয়নের মণি প্রমথর সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দিলাম
- ছোটোরাজাবাবুকে তো সকালেই দেখলাম মা, কী হল? - নায়েব চমকে ওঠেন
- ষাট ষাট, প্রমথ আমার সুস্থ আছে, কিন্তু ছোটোরানি সামান্য চুপ করেন তারামণিসে বড়ো অসুস্থ এই নলডাঙ্গার রাজবংশ বুঝি এবার লোপ পায়
- কী হুকুম, মা?
- শুনেছি পশ্চিমের জামুই জেলায় তেলুয়া বাজার খুব স্বাস্থ্যকর স্থান সেখানে কোনো পাহাড়ের কোলে একটি নিবাসের ব্যবস্থা করুন জাঁকজমকের প্রয়োজন নেই, শুধু নির্জনতা আবশ্যক সেখানে পতিতপাবনী আর প্রমথকে নিয়ে আমি নিজে যাব হয়তো এই আমার শেষ লড়াই
প্রণাম করে বেরিয়ে যান নায়েবমশাই

মার্চ ২০১৮, শিমুলতলা রাজবাড়ি
- এই হল নলডেঙ্গা রাজবাড়ি আর ওই ওদিকে লাট্টু পাহাড়পরিমল অটো থামায় রাস্তার দুইপাশে অগুন্তি পলাশ ফুটে আছে
- কোথাকার রাজা বানিয়েছিল এটা? - টিয়া টিকটিক করে ওঠে নলডেঙ্গা কোথায়?
- অত জানি না দিদি, ওই সবাই বলে ঢাকার রানির প্রাসাদ নাকি
তিনজনে আড়চোখে নন্দিনীর দিকে তাকায় নন্দিনী কিচ্ছুটি না বলে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে এত সকালে কেউ কোথাও নেই
ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িগুলো কোনক্রমে টিকে আছে এখনও সিঁড়ির মাথায় উঠে থেমে যেতে হয় সামনেটা একেবারেই ভেঙে পড়েছে চারদিকে চারটে চৌকো মিনার মাথা তুলে লাট্টু পাহাড়কে দেখছে যেন
- সাবধান দিদিমণিরা, দেখে পা ফেলবেননীচ থেকে পরিমল চেঁচায়
সামনে হয়তো চওড়া চাতাল ছিল, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই প্রান্তগুলো আছে কেবল ব্যালান্স করে প্রাসাদের মূল অংশে হয়তো পৌঁছানো যায়, কিন্তু গোটা ব্যাপারটা ভয়ানক বিপজ্জনক
- পা ফসকালে সটান নীচেমিঠু নিজের মনে বলে ওঠে
- ওরে নন্দুপিডিয়া কিছু তো বল - রাকা খেপেছে এবার

নন্দিনী অন্যমনস্কভাবে লাট্টু পাহাড়ের দিকে তাকায় একবার তারপর বলতে থাকে নলডাঙ্গা বাংলাদেশে সেখানে ঝিনাইদহে এই রাজবংশের তৈরি প্রাসাদ, মন্দির, স্কুল সব আছে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বা আদিপুরুষ ছিলেন বিষ্ণুদাস হাজরা তিনি পুজোপাঠ ধর্মাচরণ এসব নিয়েই থাকতেন শোনা যায় তাঁর নাকি কিছু দৈবী ক্ষমতাও ছিল ঘটনাক্রমে তিনি জমিদার হয়ে পড়েন, স্বয়ং মান সিংহ নাকি তাঁকে ভূসম্পত্তি দান করেছিলেন পরে সেই বিষ্ণুদাসের ছেলে রাজা উপাধি পান বলতে পারিস এই রাজবংশের শুরু জমিদারি দিয়ে
- ওহ! তাই পরিমলদা ঢাকার রানি বলছিল কিন্তু ওনারা এখানে বাড়ি বানালেন কেন? – টিয়া এতক্ষণ পটাপট ছবি তুলছিল, এবার আলোচনায় যোগ দেয়
- তা জানি না তবে এই এলাকাকে হিলিং সেন্টার বলা হত জানিস নিশ্চয়ই আগে নাম ছিল তেলুয়া বাজার হয়তো কারুর হিলিং দরকার হয়েছিল কবে, কেন এই প্রাসাদ পরিত্যক্ত হল, তাও জানি নানন্দিনীর কপালে ভাঁজ বন্ধুরা ওকে উইকিপিডিয়ার অনুকরণে নন্দুপিডিয়া ডাকে, কিন্তু ও আর কোনো তথ্য কোথাও খুঁজে পায়নি
- ওই দেখ দূরে একটা দিঘি আঙুল তুলে দেখায় মিঠু
- শুনেছি পুরোনো বাংলা সিনেমা বলতে গিয়ে থেমে যায় নন্দিনী সিঁড়ির নীচ থেকে চাঁচাছোলা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি রাজবাড়িতে ভূত অথবা গুপ্তধন, চলুন খুঁজে দেখি কী পাওয়া যায় আমার সঙ্গে আছে আমার দুই সঙ্গী
ধসে পড়া জায়গাটার ফাঁক দিয়ে সাবধানে নীচে তাকায় চারজনে তিনটে লোক, একজনের হাতে একটা মোবাইল, কথা আর দৃশ্য রেকর্ড করতে করতে হাঁটছে
- নির্ঘাত ওই টাভেল ভোলগ পার্টিফিসফিস করে টিয়া লোক তিনটে রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের আড়ালে চলে যায় টিয়া খেয়াল করলে দেখতে পেত নন্দিনীর কপালটা ভয়ানক কুঁচকে আছে
- পুরোনো বাংলা সিনেমা কী যেন বলছিলি মিঠু নন্দিনীকে খেই ধরায়
- ওহ্ হ্যাঁ, একটা অনেক পুরোনো কিন্তু খুব মজার বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছিল ওই দিঘির পাশে নন্দিনী এখনও একটু অন্যমনস্ক
- কী সিনেমা রে? – সিনেমার নামে টিয়া এক পায়ে খাড়া
- ‘আশিতে আসিও না’

১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ, তেলুয়াবাজার রাজবাড়ি
পিছনের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে এক কিশোরী আগুনরঙা পলাশে চারিদিক লাল কিশোরীকে দেখলে বোঝা যায় সদ্য রোগমুক্তি ঘটেছে তার চেহারায় পাণ্ডুরতা থাকলেও চোখদুটিতে রোগমুক্তির উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে দূরের পাহাড় থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে শীতল হাওয়া এই জায়গাটা বড়ো ভালো বাড়ির সামনের দিকেও একইরকম সিঁড়ির ধাপ আছে, তবে ও এই পিছনদিকেই আসে
- পতিতপাবনী - শ্বশ্রূমাতার আহ্বান শোনা যায়
- যাই মা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে বোধহয় দুর্বল শরীর টলে যায় হঠাৎ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল কিশোরী ছোটোরানি সামলে নিয়ে দেয়াল ধরেই এগোতে থাকে মস্ত চাতালটার দিকে খেয়াল করে না, গলা থেকে কিছু একটা টুপ করে খসে পড়ে যায় নীচের পলাশের জঙ্গলে

মার্চ ২০১৮, যশোদা ধাম, শিমুলতলা
ডাল, ঝুরি আলুভাজা, ফুলকপির বড়া আর এইবড়ো কইমাছ দিয়ে রাতের খাওয়াটা জমাটি হয়েছে
খেতে গিয়ে চারমূর্তি দেখে সকালের সেই ট্র্যাভেল ভ্লগ বানানো গ্রুপটাও এখানেই উঠেছে
- বাবা এরা যে ওমনিপ্রেজেন্ট রাকা চাপা গলায় বলে
- ওমনিপ্রেজেন্ট হোক আর এমনিপ্রেজেন্ট, উদ্দেশ্য তো একটা আছেই নন্দিনী আরও চাপা গলায় বলে
মিঠু চমকে উঠে তাকায় নন্দিনীর দিকে, বাকি দুজন বোধহয় শুনতে পায়নি ওর কথাটা ভ্রূ সামান্য তুলে ইশারায় মিঠু জিজ্ঞেস করে কেসটা কী নন্দিনী হালকা করে মাথা নেড়ে বোঝায় পরে বলব

আজ বোধহয় পূর্ণিমা। যশোদা ধামের জানলা দিয়ে দূরে আলোয় ধোয়া লাট্টু পাহাড় দেখা যাচ্ছে সেইদিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল টিয়া রাত প্রায় সাড়ে নটা
- বাবা, কী ডেডিকেটেড, এত রাতেও শুটিং করতে চলল, শুধু একটা মোবাইল দিয়েই কত কী করা যায় বল? টিয়া জানলার বাইরে ঘাড় বাড়িয়ে দিয়েছে
- মানে? – নন্দিনী উঠে দাঁড়িয়েছে, গলায় উত্তেজনা
- আরে ওই ভ্লগ পার্টি, এত রাতে বেরোল মনে হয় চাঁদের আলোয় রাজবাড়ির ছবি তুলতে যাচ্ছে নাহলে এত রাতে আর কোথায় যাবে? কোনো দোকানও তো খোলা নেই, মানে সিগারেট-টেটওকে থামিয়ে দিয়ে লাফিয়ে ওঠে নন্দিনীচল তো দেখি কোথায় যাচ্ছে এমনি কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া হাঁটতে যেতেই পারে, সেটাই চেক করতে চাই
অবাক চোখে নন্দিনীকে দেখে টিয়া আর রাকা মিঠু ততক্ষণে স্নিকারে পা গলিয়েছে ও বোধহয় এরকম কিছুর একটা অপেক্ষাতেই ছিল
- কী ব্যাপার রে নন্দু? – শুকনো গলায় রাকা বলে
- কিচ্ছু না, সামান্য একটা খটকা
- কিন্তু এত রাতে যাবি কীভাবে? প্রায় তিন কিলোমিটার এখান থেকে টিয়ার গলায় দ্বিধা স্পষ্ট
- আগে তো দেখি ওরা আদৌ রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছে কিনা, তারপর না হয় পরিমলদাকে ডেকে নেব কী বলিস নন্দু? – মিঠু টানটান
নন্দুর খটকা লাগলে নানাকিছু অবশ্যম্ভাবী, একেবারে ডমিনোজ এফেক্টে

অপার্থিব চাঁদের আলো, সঙ্গে ঝিঁঝিঁর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দূরে সম্ভবত বিন্দুবাসিনী কুটিরে ক্ষীণ আলো জ্বলছে সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি কেউ, শুধু দুলারি ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে টিয়া আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফেলে বলললোকে বলে এখানে ভূত আছে অটোচালক পরিমল পর্যন্ত একদম চুপচাপ সে অবশ্য কী-ই বা বলবে নিঝুম মুখার্জী ভিলার পাশ থেকে লোক তিনটে যখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অটোতে উঠল, তখন পরিমলকে ফোন করে ডেকে এনেছিল এরা অবাক সে নির্ঘাত হয়েছে, তবে বলেনি কিছু

- পরিমলদা, তুমি এখানেই থাকো, তবে ডাকলে এসো কিন্তুচাপা গলায় বলে নন্দিনী রাজবাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই নেমেছে ওরা চাঁদের আলোয় ভাসছে গোটা প্রান্তর আলো মেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়িটা যেন রূপকথার সেই ঘুমিয়ে পড়া দেশের প্রাসাদ হঠাৎ ওদের চমকে দিয়ে রাজবাড়ির ভিতরে একটা আলোর রেখা দেখা গেল
- টর্চ জ্বেলেছেহাওয়ায় নন্দিনীর ফিসফিসে গলা ভেসে আসে গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে রাকার চরম কোনো বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নাকি তারা?
টর্চের আলো এবার বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে নন্দিনী বললশোন, এরা আর যাই হোক নিরীহ ইউটিউবার নয় কী খুঁজছে ঠিক জানি না, তবে রাতের অন্ধকারে এভাবে খুঁজছে কেন? গুপ্তধন হোক আর যাই হোক, এভাবে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে চুরি করবে, তা হতে দেব না আমি আর মিঠু উপরে উঠে আগে বোঝার চেষ্টা করি ওরা এখন কোথায় টিয়া রাকা তোরা এখানেই দাঁড়া

আবার সেই ধসে পড়া চাতালের সামনে এসে দাঁড়ায় মিঠু নীচটা কুপকুপে অন্ধকার, চাঁদের আলো পৌঁছায়নি ওখানে ঝুঁকে পড়ে দেখতে যাবে, পিছনে একটা চাপা আর্তনাদ শুনে ঘুরে দাঁড়ায় মিঠু কিছু বুঝতে পারার আগেই কেউ শক্ত করে চেপে ধরে ওর মুখ কানের কাছে হিসহিসে গলা শুনতে পায়খুব কৌতূহল না তোদের সেই কখন থেকে পিছু নিয়েছিস, ভেবেছিস কিছু বুঝতে পারিনি আমরা?
লোকটা মিঠুকে সিঁড়ি দিয়ে ঠেলে দেওয়ার আগেই মিঠু হাত ভাঁজ করে নিজের কান পর্যন্ত কনুইটা তোলে তারপর বিদ্যুৎবেগে নামিয়ে আনে লোকটার পেটে ওঁক করে একটা আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক পা সামনে এগিয়ে এসে অর্ধেক ঘুরে নীচু হয় মিঠু সেই টানে লোকটাও ঘুরে যায় খানিকটা তারপর নিজের পিঠের উপর দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না মিঠুকে ধসে যাওয়া দালানের ফাঁকটা দিয়ে বস্তার মতো একেবারে নীচে আছড়ে পড়ে সে শান্ত মিঠু, কম কথা বলা মিঠু যে জিৎ কুন দোতে রেড বেল্ট, সেটা চট করে কেউ বুঝতে পারে না

- নন্দিনীইইই গলা ফাটিয়ে চেঁচায় মিঠু, আর আস্তে কথা বলার মানে হয় না
সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ উঠে আসছে না? এ কী! এ তো টিয়া আর রাকা, ওদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা পিছনে উঠে আসছে বাকি দুটো লোক, তাদের মুখ রুমালে ঢাকা কিন্তু নন্দিনী কোথায়?
টিয়া আর রাকাকে ধাক্কা মেরে সিঁড়িতে বসিয়ে দেয় লোকদুটো চাঁদের রূপালী আলোতে টিয়া আর রাকার মুখে আতঙ্ক দেখতে পায় মিঠুলোকদুটো
র মধ্যে একজন কর্কশ গলায় বলেআরেকটা মেয়ে কোথায়? আমার হাত ফসকে পালিয়েছে তখন, এবার পেলে এই দুটোর মতো বেঁধে রাখব এই ওটাকেও বাঁধ, সাবধান, ওটা লড়াকু
মিঠু এক পা পিছিয়ে যায় রাজবাড়ির পাশের দিক থেকে কিছু একটা গড়িয়ে গেল কি? আর তখুনি কালো একটা মেঘ এসে ঢেকে দেয় চাঁদটাকে কিন্তু মিঠু যা দেখার দেখে নিয়েছে ভাঙা পাঁচিলের সরু ধারটা ধরে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে নন্দিনী একদিকে রাজবাড়ির দেয়াল নেমে গেছে, আর একদিকে ধসে পড়া অংশের হাঁ করা গর্ত পা ফসকালে অন্তত পনের ফুট নীচে পড়বে নন্দুপিডিয়া ও পালিয়ে ওদিকে গিয়ে পিছন দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করতে চাইছে বোধহয় পাথর হয়ে যাওয়া মিঠুর সামনে দিয়ে কর্কশ গলার লোকটা পা রাখে পাঁচিলের ধারে তারপর দ্রুত এগোতে থাকে নন্দিনীর দিকে ও ততক্ষণে ওদিকের সিঁড়ির মুখে পৌঁছে গেছে প্রায় টিয়াদের পেছনে দাঁড়ানো লোকটা পা বাড়ায় মিঠুর দিকে, মিঠু নিজেকে প্রস্তুত করে একসঙ্গে তিনটে ঘটনা ঘটল এরপর
নন্দিনী ছুটে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কীসে হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে গেল সটান নীচের পলাশের জঙ্গলে গিয়ে পড়ল সম্ভবত
মিঠুর দিকে এগিয়ে আসা লোকটাকে টিয়া স্রেফ একটা ল্যাং মারল লোকটা এই আশঙ্কা একদমই করেনি, ফলে সামনের সিঁড়ি দিয়ে কুমড়োর মতো গড়িয়ে গেল
আর তীব্র একটা হুইসল চারপাশের নিস্তব্ধতা খান খান করে বেজে উঠল

রাত আড়াইটা পরিমলের অটোতে বসে আছে চারজনে ও নাকি মিঠুর চিৎকারটা শুনতে পেয়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিল থানায় একটা গাড়ি পেট্রোলিং-এ বেরিয়েছিল, সেটাই তড়িঘড়ি এসে যায় অফিসার অবশ্য নন্দিনীকে বলেছেনগুপ্তধন খোঁজার চার্জ তো হয় না ম্যাডাম, তবে কিডন্যাপিং-এর চেষ্টার চার্জে ঢোকাচ্ছি ব্যাটাদের তাছাড়া ওদের আমি চিনতেও পেরেছি ডাকাতির কেস আছে ওদের নামে এবার ঘানি ঘোরাবে খন
অফিসার বাঙালি, আরও বললেনকেউ বলে ভূত, কেউ গুপ্তধন তবে আপনারা বড্ড রিস্ক নিয়েছিলেন কারুর কোনো ইনজুরি হয়নি তো?
- এতক্ষণে হেসে ফেলে নন্দিনী লাজুক মুখে বলেওই সামান্য কাটা ছড়া, বিশেষ কিছু নয়
- আচ্ছা, কাল যশোদা ধামে এসে পুরো ঘটনাটার ডিটেইলস নেব, আজ আপনারা বিশ্রাম নিন অনেক প্রশ্ন আছে আমার

নন্দিনী এগিয়ে যায় পুলিশের গাড়িটার দিকে মিঠু যাকে উলটে ফেলেছিল, তার মাথাটা ফেটেছে রুমাল চেপে বসে আছে এখন সেই সম্ভবত পালের গোদা নন্দিনী তার দিকে তাকিয়ে বলেক্যামেরা অন না করে রেকর্ডিং করলে লোকের তো সন্দেহ হবেই
আগুন চোখে তাকায় লোকটা দাঁত পিষে বলেছাড়া পাই, পুরো রাজবাড়ি খুঁড়ে ফেলব দরকার পড়লে গুপ্তধন বের করে ছাড়ব
গাড়ি থানার দিকে রওনা দেয়

- গুপ্তধন তাহলে সত্যি নেই টিয়া হতাশ গলায় বলে লাট্টু পাহাড়ের দিক থেকে রাতচরা পাখি ডেকে ওঠে হঠাৎ
- ফেরা যাক তাহলে পরিমলের গলায় সম্ভ্রম এমন ট্যুরিস্ট ও দেখেনি আগে
- একটু দিঘিটার কাছে যাব পরিমলদা, কাজ আছেনন্দিনী এগোতে থাকে
- আবার কী? – মিঠু এবার সত্যি অবাক
আস্তে আস্তে জিনসের পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আনে নন্দিনী হাতটা মেলে ধরে সবার সামনে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে ওঠে মস্ত একটা পাথর
- হিরে নাকি রে? কোথায় পেলি? – চেঁচিয়ে ওঠে সবাই পরিমল চোখ ঢেকে ফেলে
- তাই হবে নির্ঘাত গড়িয়ে গিয়ে পড়েছিলাম পলাশের জঙ্গলে উঠে বসতে গিয়ে কনুইটা শক্ত কিছুতে ঠুকে গেল ভীষণ লাগল, ভেবেছিলাম পাথর-টাথর হবে টর্চটা পকেটেই ছিল, ফেলে দেখি কী যেন চকচক করছে মাটিতে এটা গেঁথে গিয়েছিল
দিঘির সামনে এগিয়ে যায় নন্দুপিডিয়া হাঁটু মুড়ে বসে মুঠোটা ডুবিয়ে দেয় দিঘির জলে তারপর খালি হাতটা তুলে আনে
বাকিদের দিকে তাকাতেই ওরা সমস্বরে বলে ওঠেকিছু রহস্য চিরকাল রহস্য থাকাই ভালো
নন্দিনী হাসে বন্ধুদের কাঁধে হাত রেখে বলেতাছাড়া এখানে কিছু পাওয়া গেছে জানাজানি হলে কী অবস্থা হবে রাজবাড়ির ভাব এ তো প্রোটেক্টেড হেরিটেজ সাইট নয়

অটো রওয়ানা দেয় রাকা বলে ওঠেভোর হলেই স্টেশন বাজার গিয়ে কচুরি অ্যান্ড জিলিপি
শেষরাতের মরা চাঁদের আলোয় নলডাঙ্গা রাজবাড়ি গল্প করতে থাকে লাট্টু পাহাড়ের সঙ্গে কত কী বলার আছে তার মানুষের সে সব না শোনাই ভালো কিছু রহস্য চিরকাল রহস্য হয়েই থাক না হয়
----------
ছবি – শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment