ওলাই চণ্ডীর গুপ্তধন
পূবালী চট্টোপাধ্যায়
গ্রামের মধ্যে একটা খেলার মাঠ আছে, সেই মাঠে একটা
বিশাল বড়ো অশ্বত্থ গাছ আছে। সেই গাছের ডাল থেকে অসংখ্য ঝুরি নেমে এসেছে। লোকে বলে
এই গাছে নাকি ভূত আছে। বিনু আর তার বন্ধুরা রোজ বিকেলবেলা সেই মাঠে খেলতে যায়।
আর অশ্বত্থ গাছের ঝুরি ধরে ঝোলে। ওরা এসব বিশ্বাস করে না। ওই গাছের ডালে কত পাখি সন্ধে
হতে না হতেই এসে বসে। বিনু দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে খেলতে হঠাৎ দূর থেকে দশাননকাকাকে
আসতে দেখল। ওদের গ্রামেই থাকে দশাননকাকা। গ্রামের ওলাই চণ্ডী মন্দিরের কাছে যে
পোড়ো বাড়িটা আছে সেটা নাকি দশাননের পূর্বপুরুষদের ভিটে। সেখানে সে নানান সব অদ্ভুতুড়ে
কাণ্ডকারখানা করে। সে নাকি অনেক দূর দেশ থেকে কী সব বিজ্ঞানে গবেষণা করে
এসেছে। সারা দিন এই গ্যাসের সঙ্গে ওই কঠিন পদার্থ মিশিয়ে, সেই গ্যাসের সঙ্গে
তরল মিশিয়ে কী সব নাকি নানান জিনিস তৈরি করছে তার ঠিকঠিকানা নেই। এই সব আবিষ্কার
নাকি বিজ্ঞানের এক বিশেষ দিক উন্মোচন করবে। আর তাই দিয়ে গ্রামের মানুষের অনেক
উপকার করবে সে। কিন্তু বিনুদের লোকটাকে একটুও ভালো লাগে না। দশননকাকা কাছাকাছি
আসতেই ভ্রূ নাচিয়ে বিনুদের বলল, “সারাদিন খেললে হবে? বিজ্ঞানে তো একেবারে অজ্ঞান
হয়ে যাবে।” বিনুর হাতে পুপে একটা চিমটি কাটল। বিনু কিছু বলতে গিয়েও
চুপ হয়ে গেল। দশাননকাকা চলে যেতেই পুপে নীচু স্বরে বিনুকে বলল চণ্ডীমণ্ডপের পাশ
দিয়ে আজ বিকেলে আসতে গিয়ে সে নাকি শুনেছে দশাননকাকা কার সঙ্গে যেন ফিসফিস করে
কথা বলছিল এই গ্রামে গুপ্তধন আছে সেই ব্যাপারে। আরও শোনার জন্য যেই জানালার কাছে
সরে গিয়েছিল পুপে, অমনি দশাননকাকার কুকুর কেলো ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এসেছিল। পুপে পড়ি কি মরি
করে ওখান থেকে পালিয়ে এসে বেঁচেছে। বিনু কথাটা শুনে বলল, “গুপ্তধন! গুপ্তধন! তাও
আবার আমাদের গ্রামে!”
মাঠে সেদিন আর খেলা জমল না। বিনু, পুপে, রাজা ও শঙ্কু ওরা চার বন্ধু মিলে মহা চিন্তায় পড়ল। গুপ্তধন কোথায় আছে
সেই নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা চলল। আর গুপ্তধন পেলে দশাননকাকা কী করবে? কী ভাবে গ্রামের মানুষের ভালো করবে সে সব নিয়েও অনেক রকম কথা হল। তবে
গ্রামের লোকে দশাননকাকাকে ভয়ভক্তি করলেও এই খুদে মহল যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে
পারে না লোকটাকে। কেমন যেন কুতকুতে চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে আর বড্ড বিটকেলে স্বভাব।
একদিন রাজার বাড়ির কাজের মাসি নাকি দেখেছিল রাতের
দিকে দশাননের বাড়ির থেকে নানান রঙের সব আলো বেরিয়ে আসতে। আর তার সঙ্গে অদ্ভুত সব
আওয়াজ। মঞ্জু মাসি ভয়ে ওই রাস্তা দিয়ে আর যায় না। গ্রামের লোকে আরও নানান কথা
বলে। ওরা ঠিক করল মঙ্গলবার দুপুরে ওরা দশাননকাকার বাড়ি যাবে। প্রতি মঙ্গলবার
দশাননকাকা সদরে যায়। ওর নাকি নানান কাজ থাকে সদরে। ওই সময় ওর বাড়ি গেলে
গুপ্তধনের ব্যাপারে কিছু একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। সেই মতো যুক্তি করে ওরা যে
যার বাড়ির পথ ধরল।
বিনু বাড়ি এসে হাত-পা ধুয়ে মুড়ি আর আলুর চপ খেতে
খেতে ঠাম্মার কাছে গুপ্তধনের কথা জানাল। ঠাম্মা বললেন, হ্যাঁ গুপ্তধনের কথা
ঠাম্মা শুনেছেন ঠাম্মাদের ছোটোবেলা থেকে। অনেক মানুষ এ যাবৎ গুপ্তধনের সন্ধানে
এসেছে গেছে, কিন্তু কেউ গুপ্তধনের নাগাল পায়নি। সেই গুপ্তধন পাহারা দেয় এক
ভয়ঙ্কর যক্ষ। গুপ্তধনের চারপাশে আছে অসংখ্য সাপ। ঠাম্মা বললেন, “আমার মা বলত যদি
কোনোদিন এই গ্রামের খুব দুর্দিন আসে তবে এই গ্রামকে তার থেকে রক্ষা করবে যে,
গুপ্তধন সেই পাবে।” সেদিন বিনুর একদম পড়াতে মন বসল না। শুধুই মাথায় গুপ্তধনের
চিন্তা। ক’টা দিন খেলার মাঠে স্কুলে সব জায়গায় চার বন্ধু মিলে কীভাবে গুপ্তধনের
সন্ধান পাওয়া যায় তাই নিয়ে আলোচনা হল। দেখতে দেখতে মঙ্গলবার চলে এল। ওদের স্কুলের গরমের ছুটি
পড়েছে। তাই এখন বাবা-মায়ের বকাঝকা খানিক কম। ওরা তিন বন্ধু মিলে আম কুড়োবার নাম
করে ওলাই চণ্ডী মণ্ডপের পাশ দিয়ে ছোট্ট পাঁচিল টপকে পৌঁছে গেল দশাননকাকার বাড়ি।
অন্য দিকে রাজা ঢুকবে সদর দরজা দিয়ে। দশাননকাকার বাড়ি পাহারা দেয় কেলো। যেমন
গায়ের রং কালো কুচকুচে তেমন বাঘের মতো চেহারা। শঙ্কুর বাড়িতে কুকুর থাকায় ও
কেলোকে আদর করে ওর সঙ্গে কেমন ভাবে যেন ভাব জমিয়ে ফেলল। আর এ বাড়ির পাহারায়
থাকে দারোয়ান জগদ্দল সিং। তাকে ভয় পায় না, এ চত্বরে এরকম মানুষ খুব কমই আছে। রাজা
প্যাকেটে করে দুটো বিলিতি চকোলেট নিয়ে এসেছে। সদর দরজায় খট খট করতেই দরজা খুলল
জগদ্দল সিং। মাথায় ইয়া বড়ো পাগড়ি আর মস্ত এক গোঁফ। গম্ভীর গলায় বলল, “কী চাই
খোকাবাবু?” রাজা নরম গলায় বলল, “দশাননকাকার সঙ্গে একটু
দরকার ছিল। বিজ্ঞান বইয়ের কয়েকটা জায়গা বুঝতে পারছি না, কাকা যদি একটু বুঝিয়ে
দিতেন আমার খুব সুবিধা হত। তা না হলে স্কুল খুললে স্যারের কাছে বকা খেতে হবে।”
জগদ্দল সিং ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে একবার রাজাকে দেখে নিল। “তো খোকাবাবু
তোমার হাতে বই কোথায়?” রাজা আমতা আমতা করে বলল, “এই দেখেছ!
তাড়াহুড়োয় বইটা আনতে ভুলে গেছি! যাক গে, সিংকাকা তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি,
তুমি কি খাবে?” জগদ্দল সিং বলল, “কী?” রাজা
তখন চকোলেট দুটো তার হাতে দিল। বিলিতি চকোলেট পেয়ে সে বেজায় খুশি। রাজাকে বলল, “খোকা
তুমি একটু এখানে থাক, আমি এই যাব আর এই আসব। সকাল থেকে এইখানেই আছি।
কত্তা আজ সদরে গেছে। কত্তার হুকুমে কোথাও নড়তে পারিনি।” রাজা এই সুযোগের
অপেক্ষাতেই ছিল। এদিকে বাড়ির ভেতরে গিয়ে শঙ্কু পুপে আর বিনু ঢুকে পড়েছে দশাননের
গবেষণা ঘরে। কী সব আজব আজব জিনিস, দেখেই তাজ্জব হতে হয়। পুপে আর বিনু ওদের সায়েন্সের
ল্যাবে এসব জিনিস কখনও দেখেনি। ওরা এদিক ওদিক ঘুরে দেখল। গবেষণা ঘরটা পোড়োবাড়ির
ওপরের তলার একটা ঘর। ওরা আজ মোটামুটি বাড়িটার একটা ম্যাপিং করে বেরিয়ে এল। রাজা
ততক্ষণে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
ক’দিন পরে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় ওরা শুনতে পেল
পাশের পাড়া থেকে একটা বাচ্চা চুরি গেছে। বাচ্চাটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে
না। এদিকে গেল মঙ্গলবার সদর থেকে দুজন লোক দশাননকাকার সঙ্গে এসেছে। ওদের মধ্যে
একজনের নাকি সবুজ সবুজ চুল আর ইয়া বড়ো লম্বা দাড়ি। অন্যজন বেজায় লম্বা আর একটা
চোখ কেমন ছোটো। গ্রামের লোকের মুখে ওরা এই লোক দুটোর কথা শুনেছে। দু-দিন
যেতে না যেতে আরও দুটো বাচ্চা চুরির খবর শোনা গেল। ওদের চারজনের বাড়ি থেকে
এক্কেবারে বেরোনো বন্ধ করে দিল বাড়ির বড়োরা। ছুটির মধ্যে বাড়ি বসে থাকা বিরক্তিকর।
গুপ্তধনের কথা সকলের মাথায় উঠেছে, এখন শুধু বাচ্চা চুরি নিয়ে কথা হচ্ছে। বিনু
মনের দুঃখে দাদু ভাইয়ের বইয়ের আলমারি ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল। সেখানে খুব পুরোনো
একটা বই তার হাতে পড়ল। বইটির উপরে লেখা আছে ‘দেবী ওলাই চণ্ডীর ইতিকথা’। পড়ার জন্য বিনু বইটি নিল। সেখানে
দেবী মায়ের অনেক ইতিহাস লেখা আছে। বইটি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে মাঝবরাবর
পড়ে ফেলেছে, এমন সময় তার হাতে পড়ল একটা লাল খাম। খামটি খুলে একটা কালো
কাগজ পেল। সেখানে সোনালি কালিতে লেখা আছে একটি ছড়া -
চণ্ডী তলায় গণ্ডি,
ফন্দি আঁটে নন্দী।
দক্ষিণে যাও বিশ,
মিলবে তবে হদিস।
যক্ষই তার রক্ষক,
ভয় করো সব ভক্ষক
তবে হয়ো সাবধান,
যদি চাও সমাধান।
বিনুর মাথায় এই ছড়ার কিছুই ঢুকল না। সে ফোন করে
তার বন্ধুদের সব জানাল। বন্ধুরা সবাই বিকেলে বিনুদের বাড়ি এল। ওরা ছাদের উপর
সবাই এই নিয়ে আলোচনা করছে, এমন সময় দূর থেকে বিনুর বাড়ির চাকর ছুটতে ছুটতে এসে
জানাল তার ছোটো ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ধাঁধার উত্তর ভাবা তখন
মাথায় উঠেছে। এই সময় পুপের চোখে পড়ল একটা লম্বা ঢ্যাঙা লোক ওদের বাড়ির দিকে
কেমন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। পুপের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটা টুক করে কেটে পড়ল।
ওদিকে দাদু ওদের চারজনকে ডেকে বলল, “দেখ, আমাদের গ্রামে রোজ এরকম বাচ্চা চুরি হচ্ছে,
তোমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।” ওরা যে যার বাড়ি ফিরে গেল। আর দাদু আর কাকা ওদের
চাকর বিশেকে নিয়ে থানায় গেল। কোতোয়ালি থানার দারোগা সব শুনে ভুরু কুঁচকে বললেন,
“আমরা তো আমাদের মতো করে চেষ্টা করছি। দেখি কবে চোর ধরতে পারি।” দাদু রেগে বললেন, “দেখি-টেখি
কিছু শুনব না। আজকের মধ্যেই চোর ধরো, নয়তো এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। আদিনাথ
মোক্তারের বাড়ি থেকে বাচ্চা চুরি হচ্ছে আর পুলিশ এখনও বসে আছে, এটি হবে না।” এই
বলে লাঠি ঠকঠক করতে করতে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে বাড়িতে কী একটা কাজ নিয়ে দাদুর কাছে দশাননকাকা
এল। দাদুকে দেখতে না পেয়ে বিনুর কাছে গিয়ে বলল, “তোমার কাছে যে কাগজটা আছে সেটা
আমাকে দিয়ে দাও। তোমরা ওই দিয়ে কিছু করতে পারবে না। আমি বিজ্ঞানের মানুষ,
আমি এই ধাঁধার উত্তর ঠিক বের করব।” বিনু অবাক হয়ে ভাবল দশাননকাকা এ কথা জানল কী
করে! দশানন যেন বিনুর মনের ভাব বুঝে বলল, “তোমার দাদুর সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি
আমাকে এই কাগজটা দেবেন বলেছেন আমার বিশেষ গবেষণার জন্য।” অগত্যা মোবাইলে একটা ছবি
তুলে রেখে কাগজটা দশাননের হাতে দিয়ে দিল বিনু।
দাদু বাড়ি আসতেই বিনু জিজ্ঞেস করল দাদুকে। দাদু
বললেন, “একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম ওকে, তবে দশানন আজই সেটা নিয়ে যাবে এমন কথা
তো ছিল না।” দাদু এসব নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না। বিনুর মনে খটকা লাগল। ও বড়োদের কিছু না বলে
তিন বন্ধুকে ফোন করে ওলাই চণ্ডীর থানে ডাকল। ওরা এক সঙ্গে হতেই জানাল দশানন কাগজটা
নিয়ে গেছে ওর কাছ থেকে। তবে মোবাইলে ছবি তোলা আছে এই যা ভরসা। পুপে বলল ধাঁধাটা
ওর কিছুটা মনে আছে, চণ্ডীতলায় গণ্ডি - এটার মানে মা চণ্ডীর থানকে বোঝানো হচ্ছে।
তবে গণ্ডি মানে কী? বিনু বলল, “গণ্ডি তো লক্ষণ দিয়েছিল সীতাকে রাবণের হাত থেকে রক্ষা করার
জন্য। রাবণের আরেক নাম দশানন। কিন্তু এ কাগজ তো বহু পুরোনো। দশাননকাকা তখন তো
জন্মায়নি।” অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে চারপাশে, চণ্ডীমণ্ডপে
টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। ওরা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েই
চারজনে কথা বলছিল। হঠাৎ পাশের থেকে ভারী গলা শোনা গেল, দশাননের পূর্বপুরুষের মধ্যে
আরেকজনের নামও ছিল দশানন। বিনু হঠাৎ খেয়াল করে বলল, “পোড়ো বাড়িটাকে গণ্ডি দিয়ে
রেখেছে চারদিকে চারটে বড়ো বড়ো অশ্বত্থ গাছ। হিসেব মতো দেখলে মাঠের মধ্যে যে বড়ো
অশ্বত্থ গাছটা আছে সেটা পোড়ো বাড়িটার দক্ষিণ কোণে। আর চণ্ডীতলায় বুড়ো
শিবের সঙ্গে তার বাহন নন্দী আছে।” দাদু বললেন, “ঠিক বলেছ তোমরা।” বিনু রাজাকে
একবার অশ্বত্থ গাছের থেকে বাড়ির দূরত্ব মেপে দেখতে বলল। রাজা মাঠের অশ্বত্থ গাছটা
থেকে তাড়াতাড়ি হেঁটে পোড়োবাড়ির দূরত্ব দেখল কুড়ি পা। এমন সময় দশাননের গলা
শোনা গেল। “সবাই সাবধান, গুপ্তধন আমি আগে পেয়েছি,” এই বলে সে বন্দুক উঁচিয়ে এল।
আদিনাথবাবু একেবারেই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। ঐ দুটি অদ্ভুত দেখতে লোকও
ওর সঙ্গে এসেছে। দশাননরা অশ্বত্থ গাছ তলার মাটি খুঁড়তে শুরু করল। আদিনাথবাবু বললেন,
“বাড়াবাড়ি কোরো না দশানন।” দশাননের তখন সে কী হাসি। এমন সময় হঠাৎ দিকবিদিক
অন্ধকার করে কালবৈশাখী ধেয়ে এল। চারদিকে ধুলো উড়ছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। সবুজ
চুলের লোকটা বিনুকে ধরে ফেলেছে। অন্য দিকে শঙ্কুকে তাড়া করেছে কেলো, ভাগ্যিস ওর হাতে
বিস্কুট ছিল, সেই দিয়ে কেলোকে শান্ত করল শঙ্কু। চারিদিকে কেলেঙ্কারি পরিস্থিতি।
দশাননের হাতে হঠাৎ করে ঝড়ের বেগে অশ্বত্থ গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল। সে ব্যথা
পেয়ে ছিটকে কিছুটা দূরে পড়ল। বিনুকে ছেড়ে সবুজ চুলের লোকটা দশাননকে সাহায্য
করতে এগিয়ে গেল। জগদ্দল সিং আর লম্বা মতো লোকটা এই ঝড়ের মধ্যেও মাটি খুঁড়ছে।
মাটি খোঁড়া শেষ হতেই উঠে এল একটা সোনার ঘড়া। আর তখনই চারিদিক কাঁপিয়ে প্রকাণ্ড
একটা বাজ পড়ল, ওই অশ্বত্থ গাছের উপর। জগদ্দল সিং আর লম্বা
লোকটাও জখম হল বাজ পড়ে। আদিনাথ আর পুপে এর মধ্যে পোড়ো
বাড়িটাতে গিয়ে উঠেছে। পুপে আদিনাথকে নিয়ে গেল দশাননের গবেষণা ঘরে। ঘরটি বাইরে
থেকে তালা বন্ধ। রাজা কখন যেন ওদের পেছনে এসেছে, একটা থান ইট কুড়িয়ে নিয়ে এসে জোরে
বাড়ি মেরে তালাটা ভাঙল। দরজা খুলেই দেখল ঘরের মধ্যে
হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলো বসে আছে হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায়। পুপে আর রাজা তাড়াতাড়ি
করে ওদের বাঁধন আলগা করল। ওদের মুখে শুনতে পেল, দশানন ওই দুটো লোকের সঙ্গে পরামর্শ
করে ওদের বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিত লোকদুটোর সঙ্গে। আদিনাথবাবু ততক্ষণে ফোন
করে পুলিশদের খবর দিয়েছেন। ওরা সবাই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ওইদিকে মাঠের মধ্যে বিনু
আর শঙ্কুর দশাননদের সঙ্গে ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ চলছে। এরই ফাঁকে সবুজ চুলের লোকটা
সোনার ঘড়া নিয়ে পালাচ্ছিল। বিনু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। বিনুর মনে হল ঐ
লোকটাকে কে যেন পেছন থেকে এক ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। বিনু চোখ বড়ো বড়ো করে
দেখল, একটা কালো ঘন কুয়াশার মতো ধোঁয়া সোনার ঘড়াটাকে ঘিরে ফেলল। দাদু আর
পুলিশের গলা পাওয়া গেল। “কেউ এক পা-ও নড়বেন না, তাহলেই গুলি করে মাথার খুলি
উড়িয়ে দেব।” জগদ্দল সিং আর ঐ লম্বা লোকটিকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দশানন
আর সবুজ চুলের লোকটাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। যাবার আগে দশানন বলতে বলতে
গেল, “আমার গবেষণা দিয়ে আমি এ গ্রামের অনেক উন্নতি করতাম।” দারোগা সাহেব দশাননের
মাথায় এক গাঁট্টা মারল, “বাচ্চা পাচার করে তুমি গ্রামের উন্নতি করবে? বদমাইশ
জোচ্চোর বিজ্ঞানী কোথাকার।”
সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বিনু দাদুকে জিজ্ঞাসা করল,
“দাদু, গুপ্তধন কীভাবে সত্যি সত্যি যক্ষ পাহারা দেয়? তাই কি এভাবে গুপ্তধন উদ্ধার
হল?” দাদু
বললেন, “কত কিছু তো ঘটে। সবকিছুর কি উত্তর আছে? চলো আমরা মা ওলাই চণ্ডীর থানে এই
গুপ্তধন রেখে দিই। মা আমাদের এই মহা বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন।” ওরা সকলে মায়ের
থানে গিয়ে গুপ্তধন রেখে মাকে প্রণাম করল। মা এই গ্রামকে মহামারি থেকে রক্ষা করে
আসছেন। যখনই গ্রামে কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসে, মা দু-হাতে আগলে রাখেন।
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment