অণুগল্প:: দেবদোল - রাজর্ষি গুপ্ত


দেবদোল
রাজর্ষি গুপ্ত

সকাল ন’টায় হরিনাম জাগানো শুনতে শুনতে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্য খুব মনমরা গলায় ট্রাস্টি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট অশোক মান্নাকে বলছিলেন, “কাল বড়ো অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম শ্যামসুন্দরকেই দেখলাম তিনি বলছেন, ‘ওরে, দোলের পুজোই যদি করবি তো আমায় রং দিতে এত কার্পণ্য কেন তোদের?’ তারপর নিজেই হাত নেড়ে বললেন, ‘তোদের দ্বারা হবে না, আমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে’”
আজ দোল হরিসভার আশপাশের চত্বরটুকু মেতে আছে মিঠেরাধে রাধাগোবিন্দ বলোনামগানে প্রতি বছর দোলে তিনদিনব্যাপী অষ্টপ্রহর নামসঙ্কীর্তনের আসর বসে শ্যামসুন্দরের নাটমন্দিরের সামনে তুলসীমঞ্চের আঙিনায় ম্যারাপ খাটিয়ে পুজোও হয় তেমনই ধুমধামে গৌরনিতাই আর রাধারানিকে নিয়ে শ্যামসুন্দর নাটমন্দির থেকে তুলসীতলায় ভক্তজনের মাঝে নেমে আসেন
অশোকের একটা ভুরু কপালে উঠে গেল
দশ রঙের মোট পাঁচ কেজি আবির আমি নিজে কিনে দিয়েছি আর ওই ঠাকুরের সামনে থালায় চুড়ো করে সাজিয়ে রেখেছেন আপনি নিজে এর পরেও রং নিয়ে খুঁতখুঁতুনি থাকে কী করে ঠাকুরের? কাল রাতে আপনার ধোকার ডালনাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল বোধহয়
বিরাজকৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
ঠিক সেই সময় বাচ্চু আর রঞ্জুর সঙ্গে তুলসীতলার সামনে দাঁড়িয়ে টুনাই খুব গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিল বাচ্চু বলল, “এত আবির, কিন্তু কেউ ঠাকুরদের গায়ে দেবে না কী স্যাড!”
রঞ্জু বলল, “শুধু পায়ে ঠাকুররা বড়ো কিনা
টুনাই তড়বড়িয়ে উঠল, “ছাড় দিকি! বড়ো তো কী? ছোটকা কত বড়ো, তবু বাঁদুরে রং মাখে না? বড়োদের যত্ত ইন্তিড়ি ব্যাপার! কৃষ্ণঠাকুর যথেষ্ট ইয়াং, গৌরনিতাইদাদাও তাই ওদের রং মাখতে নিশ্চয় ইচ্ছে করেওই দাদুগুলো মাখতে দেয় না ওদের
সত্যভামা গার্লসের ক্লাস ফোরের ফার্স্ট গার্ল ত্রিনেত্রা সেন ওরফে বাবুপাড়ার দুরন্ত সম্রাজ্ঞী টুনাইকে তার বন্ধুরা রীতিমতো সমঝে চলে, একজন বাদে তাও রঞ্জু মিনমিন করে কী একটা বলতে গেল বলা হয়ে উঠল না, কারণ তার আগেই টুনাইয়ের মুখের উপর পিছন থেকে অতর্কিতে নেমে এসেছে একজোড়া সবুজ হাত, কষে পাঁচ বার ঘষে দিয়েছে তার মুখ-মাথা টুনাই হাঁই হাঁই করে উঠে যখন ভূতের মতো মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল তখন ম্যারাপের বাঁশের উপর থেকে আর একটা ভূত সাদা চোখ আর দাঁত বের করে তাকে ভ্যাংচাচ্ছে
রত্নাবলী মিত্র ওরফে রুপু ক্লাস ফোরের সেকেন্ড গার্ল এবং টুনাইয়ের প্রাণের দোস্ত, এবং পাড়ায় টাইফুন কুমারী নামে পরিচিত
দাঁড়া তুই!” হুঙ্কার ছেড়ে টুনাই বাঁশের উপর লাফিয়ে পড়া মাত্র রুপু লাফ মেরে পাশের বাঁশটা ধরে ঝুল খেয়ে ঝাঁপ মেরে পড়ল মাটিতে হরিসভায় রং মেখে দোল খেলতে ঢোকা সখৎ বেয়াদবি, নামগান চলাকালীন হুটোপুটি করা তো আরওই! চারদিকে একটা হই হই রব উঠল অশোকবাবু সভয়ে দেখলেন দুটো লাল-কালো টাইফুন ম্যারাপের বাঁশগুলো জিগজ্যাগ করে কাটিয়ে ছুটে আসছে তুলসীতলা পেরিয়ে নাটমন্দিরের দিকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুপুর গোঁত্তায় সোফার মধ্যে হতভম্ব বিরাজকৃষ্ণের পাশে সেঁধিয়ে গেলেন তিনি
টুনাই চিলচিৎকার করে তাড়া করে আসছিল, রুপুকে তুলসীতলার সামনে দাঁড়াতে দেখে হঠাৎ ডাইনে বাঁক মেরে দৌড়ে চলে গেল মন্দির চত্বরের কিনারায়
হল কী? এত সহজে হেরে যাওয়ার মেয়ে তো সে নয়
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চত্বরের বাইরে রং খেলতে থাকা ছেলেদের রংজলের বালতিতে হাত ডুবিয়ে সে তুলে এনেছে দুটো রংজল-ভরা বেলুন পরক্ষণেই সাঁ-সাঁ করে কামানের গোলার মতো সেগুলো ছুটে গেল রুপুকে লক্ষ করে পিছন-পিছনইয়াআআআআআআচিৎকার করে ধেয়ে চলল গোলন্দাজ, তার হাতে খাবলে তোলা বাঁদুরে রং
কিন্তু রুপুর হরিণের রিফ্লেক্স চট করে মাথা নিচু করে বসে পড়ল সে
আর রংজলের গোলাদুটো লক্ষ্যভেদ করতে না পেরে সটান গিয়ে আছড়ে পড়ল গৌরনিতাইয়ের বুকের উপর তাঁদের গৌরতনু মুহূর্তে লাল পরমুহূর্তেই যুদ্ধের ট্যাঙ্কের মতো রুপুর ঘাড়ে এসে পড়ল টুনাই একটা হুলুস্থুলু রব উঠল চারদিকে আর তার মধ্যেই দু’জনে জড়ামড়ি করতে করতে গিয়ে পড়ল শ্যামসুন্দরের সামনে রাখা আবিরের থালার উপর চতুর্দিক লালে লাল, সবুজে সবুজ, নীলে নীল নামগান থামিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পল্লব গোস্বামী শ্রীখোল তুলে পালাবে কিনা ভাবছে
এমন সময় কফিনে শেষ পেরেক পড়ল রুপুর হাতের ধাক্কা লাগল শ্যামসুন্দরের ময়ূরপাখা লাগানো মুকুটে, তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন নীল আবিরের থালায় আর টুনাইয়ের হাতের বাঁদুরে রং তাঁর একটা চোখকে রাঙিয়ে দিল
হুলুস্থুল করতে থাকা ভিড়টা এইবার মারমুখী হয়ে উঠল মেয়েগুলো ভেবেছে কী? এতটা দস্যিপনা! দোলের দিন এই ঝামেলা! এ কী অকল্যাণ!
আধমরাই হয়ে যেত হয়তো টুনাই-রুপু কিন্তু ভিড় ঠেলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন এক বৃদ্ধ
ওরে দাঁড়া দাঁড়া! ওদের কিছু বলিসনি রে, কিচ্ছু করিসনি ওদের! ওরা ঠাকুরের মান রেখেছে রে ঠাকুরের বন্ধু ওরা—”
গনগনে মুখগুলো স্তম্ভিত হয়ে বিরাজকৃষ্ণের দিকে তাকাল বৃদ্ধ বলে চললেন
ঠাকুর নিজে ওদের সঙ্গে দোল খেলতে চেয়েছেন সত্যিই তো, আমরা বুড়োরা কি আর তাঁর মতো পিচকিরি নিয়ে দোল খেলতে পারি? তিনি তাঁর সখাদের নিয়ে যেমন বুঝেছেন তেমন খেলেছেন এই কৃষ্ণসখারাতোরা চল, বাল্যভোগের মঠ-ফুটকড়াই দেব তোদের
টুনাই-রুপু বুঝতে পারছিল না কিছু যেখানে তাদের হাড়মাস আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা সেখানে গম্ভীর হরিসভাদাদু এমন প্রাণখোলা হাসতে হাসতে কেন তাদেরকে মঠ-ফুটকড়াই খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে?
যাগ্গে, অত ভেবে লাভ নেই দু’জনে শ্যামসুন্দর আর গৌরনিতাইকে তুলে দাঁড় করিয়ে নিজেরা উঠে দাঁড়াল গৌরনিতাই সারা গায়ে রং মেখে আনন্দে নাচছেন বিরাজকৃষ্ণের মনে হল শ্যামসুন্দরের রঙে-লাল চোখখানা দিয়ে হাসি ঠিকরোচ্ছে যেন আর তাঁর গায়ের ফরসা চাদরটা রাঙিয়ে উঠে তার রংটা যেন অনেকটা পাশে দাঁড়ানো রাধারানির বেনারসীটার মতো হয়ে গিয়েছে
প্রভাতফেরির দল গলির মোড় থেকে বেরিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। সামনের সারির ছেলেমেয়েগুলো গান ধরেছে — “আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে…”
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment