গল্পের ম্যাজিক:: আমার কথা - দীনেশ সরকার


আমার কথা
দীনেশ সরকার

আমি তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তাম আমাদের গ্রামে বাড়ি গ্রাম মানে গ্রামই আধা শহর আধা গ্রাম নয় ধুলো ওড়ানো কাঁচা রাস্তা মাটির ঘর-বাড়ি গাছ-পালায় ঘেরা প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা গাছ ছিল গ্রামের সবাই চাষবাস করত, ক্ষেতমজুরের কাজ করত প্রত্যেকেরই জমিজমা ছিল - কারও কম কারও বেশি প্রত্যেক বাড়িতেই গোয়াল ছিল, গরু ছিল, কারও আবার ছাগলও ছিল হাঁস-মুরগি পালনও কেউ কেউ করত শীতকালে কেউ কেউ চটি জুতো পরলেও বর্ষাকালে কারও পায়ে কিছু থাকত না ধুলো ওড়ানো কাঁচা রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চলত আর বর্ষায় সেই রাস্তায় এক হাঁটু কাদা হত আমাদের গ্রামেই প্রাইমারি স্কুল সেই স্কুলেই আমি পড়তাম স্কুলের সামনে একটা বিশাল তেঁতুল গাছ আর ছিল একটা খেলার মাঠ আর একটা ডোবা বর্ষাকালে আমরা তেঁতুল গাছের গোড়ায় বই-পত্তর রেখে ডোবার জলে পা ধুয়ে তারপরে স্কুলে উঠতাম এইরকম একটা গ্রামে কেটেছিল আমার শৈশব তবে আমাদের গ্রামে দুটো প্রধান সমস্যা ছিল এক ছিল পানীয় জলের সমস্যা তিন-চারটে গ্রামের একটাই টিউবওয়েল ভরসা মাকে দেখতাম প্রতিদিন বিকালে প্রায় দু-মাইল দূরের সেই টিউবওয়েল থেকে মাটির কলসিতে করে এক কলসি জল আনতে বাকি কাজ সব গ্রামের পুকুরের জলে হত গ্রামে পুকুর ছিল অনেকগুলো আর দ্বিতীয় সমস্যা ছিল - ডাক্তার ওই অঞ্চলে কোনো পাশ করা ডাক্তার ছিল না একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছিল - সেই পাঁচ-সাতটা গ্রামের ভগবান হাসপাতাল ছিল প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে শহরে তবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামে নুন পড়া জল পড়া দেওয়া ওঝা-গুনিন বেশ ছিল আর ছিল এক বুড়ো দাদু - হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যাগ হাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরত
গ্রামের মানুষের অভাব-অনটন থাকলেও অন্তরঙ্গতা ছিল কারও কোনো বিপদ হলে আশ-পাশের সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ত এখনকার মতো দলাদলি ছিল না একে অপরের বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত সামাজিক অনুষ্ঠানে ছিল অন্তরঙ্গ মেলামেশা মা-মাসিমা-খুড়িমা-জ্যাঠিমারাও দুপুরের পরে ওর বাড়িতে গিয়ে আসর জমিয়ে গল্প-গুজব করত আমরা ছোটোরা হাঁ করে সেই সব গল্প গিলতাম
সেদিন ছিল রবিবার দুপুরের খাওয়ার পর বাবা মাঠে কাজে গেছে দিদি ঘরে পাটি পেতে ঘুমোচ্ছে মা বারান্দায় শীতল পাটি পেতে কাঁথা সেলাই করছে আমি মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে পড়ছি এমন সময় হারু ঘোষের খুড়িমা (আমরা ঠাক্মা ঠাক্মা করি) এসে হাজির
“বউ, কী করছিস্‌? কাঁথা সেলাই করছিস্‌? মা মা, কী সুন্দর পাড় তুলেছিস্রে!
হারু ঘোষের মা আমার মাকে বউ বলে ডাকে আর আমার মা তাকে খুড়িমা বলে আমার মায়ের কাঁথা সেলাইয়ের হাত খুব ভালো অনেকেই আমার মায়ের কাছে আসে কাঁথার পাড়ের নকশা তুলতে মা কাঁথাটা একটু গুটিয়ে তার খুড়িমাকে বসতে বলল
“বোসো খুড়িমা তা হঠাৎ কী মনে করে?
“অনেকদিন তোর সঙ্গে গল্প-গুজব হয় না, তাই চলে এলাম কেমন আছিস্তোরা বউ?
মা আর ঠাক্মার মধ্যে গল্প চলতে লাগল আমার পড়া বন্ধ হল আমি কান খাড়া করে সেই সব গল্প শুনতে লাগলাম বড়োদের গল্প ছোটোরা উদগ্রীব হয়ে শোনে কিছুক্ষণ গল্প চলার পর ঠাকমা ফিস্ফিস্করে মাকে বলল, “জানিস্বউ, হারুর প্রথম বউ আবার হারুকে দেখা দিয়েছে
“বলো কী খুড়িমা!
“তবে আর বলছি কী কত বছর আগে আত্মঘাতী হয়েছে বল্ এখনও তার গতি হয়নি! এখনও তার আত্মা শান্তি পায়নি লো কাল আমাদের পুকুরে হারু নাইতে নেমে ডুব দিয়ে উঠতেই দেখে সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া ওর আগের বউ জল থেকে উঠে ওই বাঁশবাগানে মিলিয়ে গেল ভয়ে তো হারু কাঠ কোনোরকমে ঘরে পৌঁছে জ্ঞান হারায়, দাঁত-কপাটি লেগে যায় গায়ে ধুম জ্বর ওর দ্বিতীয় পক্ষের বউ মিনু চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়, দাঁতের পাটির ভিতর জাঁতি ঢুকিয়ে মুখ হাঁ করায় তারপর ‘খুড়িমা’ বলে ডাকতে আমি ছুটে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড আজ সকালে রঘু গুনিনকে ডেকে এনে ঝাড়ফুঁক করিয়ে ওর হাতে তাবিজ-কবচ বেঁধে দিতে হারু আস্তে আস্তে সুস্থ হয়
ঠাকমার মুখে এসব শুনে আমার গা-টা ছম-ছম করতে লাগল, কিন্তু মাকে কিছু বললাম না মা আবার আমাকে গল্প শোনার জন্য বকাবকি করবে মায়ের মুখে শুনেছিলাম আমারও জন্মের আগে হারু ঘোষের বউ ওই ঘোষপুকুরে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল হারু ঘোষের মা নাকি বউটাকে খুব অত্যাচার করত একদিন হারুও মায়ের পক্ষ নিয়ে বউকে মেরেছিল সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে বউটা ওই পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল তারপর বেশ -বছর ওই পুকুরে কেউ নাইতে যেত না পরে সব ঠিক হয়ে যায় মন থেকে ভয় কেটে যায় আবার সবাই ওই ঘোষপুকুরে নাইতে যায় আমরাও ওই পুকুরে নাইতে যাই শান বাঁধানো পুকুর ওই পুকুরের জলে রান্নাবান্না হয় ওই পুকুরটাই আমাদের বাড়ির কাছের পুকুর কই কোনোদিন তো কিছু দেখিনি গল্প-গুজব করে ঠাক্মা চলে গেল আমিও খেলতে গেলাম হারুর বউ-এর কথা মন থেকে কোথায় হারিয়ে গেল
পরের দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে ওই ঘোষপুকুরে চান করতে গেলাম গ্রামের ছেলে মেয়েরা সবাই কম-বেশি সাঁতার জানে আমিও সাঁতার শিখেছি কিন্তু ওই ঘোষপুকুরের গভীরতা খুব বেশি, তাই মা আমাকে একা ছাড়ে না হয় নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, না হলে দিদির সঙ্গে পাঠায় শান বাঁধানো পুকুর, তাই ধাপে ধাপে নিচে নামা যায় আমি দু-তিন ধাপ নেমে ডুব দিয়ে চান করে নিলাম মা আমার গা-হাত-পা ঘষে দিল তারপর মা বলল, “তুই ডুব দিয়ে গা মুছে উপরে গিয়ে দাঁড়া, আমি দুটো ডুব দিয়ে উঠে আসছি
আমি ডুব দিয়ে উঠে গা-টা মুছে ওপরে উঠে দাঁড়াতেই পুকুরপাড়ে বাঁশবাগানের দিকে আমার চোখ পড়ে গেল আর হারু ঘোষের বউয়ের কথা মনে পড়ে গেল আমি যেন দেখতে পেলাম সাদা কাপড় পরা ঘোমটা দেওয়া হারু ঘোষের বউ বাঁশবাগানের মধ্যে ঢুকে গেল ভয়ে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল আমি থর-থর করে কাঁপতে লাগলাম ভূত ভূত বলে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে ছুট লাগালাম মা তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে এই কী হয়েছে, এই কী হয়েছেবলে আমার পিছন পিছন ছুটতে লাগল আমি উঠোনে এসে দাঁড়াতে মা আমাকে ধরে ফেলল তখনও আমি ঠক্‌-ঠক্করে কাঁপছি মা আমাকে জড়িয়ে ধরেকী হয়েছে বাবা, কী হয়েছে আমায় বল্‌’ বলতে বলতে আমাকে ঘরের দিকে নিয়ে গেল আমি শুধু অস্পষ্টস্বরে বললাম, “আ-মি হা-রু ঘো-ষের বউ-কে দে----
আমি আর কিছু বলতে পারিনি মায়ের হাতের উপর শরীর ছেড়ে দিয়েছিলাম মা আমার ভিজে জামা প্যান্ট ছাড়িয়ে ভালো করে গা-হাত-পা মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল দিদি কোথায় খেলছিল, ছুটে এসে -মা, কী হয়েছে মা, ভাইয়ের কী হয়েছে মা - বলে আমার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল মা আমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগল দিদি আমার হাত-পা ঘষতে লাগল কিছুক্ষণ পরে আমার জ্ঞান আসতেই আমি আবারভূত-ভূতবলে জ্ঞান হারালাম দেখতে দেখতে গায়ে জ্বর এসে গেল
সারা দিন সারা রাত ওই ভাবেই কাটল যখনই একটু জ্ঞান আসছে, ‘ভূত-ভূতবলে আবার জ্ঞান হারাচ্ছি পরের দিন সকালে বাবা রঘু গুনিনকে ডেকে আনল রঘু গুনিন ঝাড়-ফুঁক করে আমার হাতে তাবিজ-কবচ বেঁধে দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমার কিছুই হল না যখন জ্ঞান ফিরছে তখন শুধুমা-মাকরে ডাকছি মা কাছে আসতেই মায়ের হাতটা নিয়ে বুকের উপর রাখছি, যেন মায়ের হাতটাই আমার সবচেয়ে বড়ো ভরসার জায়গা আবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর চোখ বন্ধ হলেই আমি সাদা কাপড় পরা ঘোমটা দেওয়া হারু ঘোষের বউকে দেখতে পাচ্ছি আর ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছি দুপুর হতে একটু চেতনা এল মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি এখন শুয়ে আছি কেন মা?
মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল, “তোর যে জ্বর হয়েছে বাবা তাই শুয়ে আছিস্ নে, এবার ওঠ দেখি বাবা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু কিছু খেয়ে নে বাবা
সারা দিন কাটল, সারা রাত কাটল, জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই মা বাবাকে বলল, “এভাবে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না তুমি যাও, নগেন ডাক্তারকে যেভাবেই হোক ডেকে আনো
নগেন ডাক্তার আমাদের অঞ্চলের একমাত্র অভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তার, পাঁচ-সাতটা গ্রামের ভগবান
বাবা নগেন ডাক্তারের ওখান থেকে ফিরে এসে বলল, “ডাক্তারের ওখানে প্রচুর রোগী অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলে এসেছি রোগী দেখা শেষ হলে আসবে বলেছে
দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ ডাক্তারবাবু এলেন আমার নাড়ি দেখলেন, চোখ টেনে দেখলেন, থার্মোমিটারে জ্বর দেখলেন কিছুক্ষণ চিন্তা করে গম্ভীর গলায় বললেন, “লক্ষণটা ভালো ঠেকছে না মনে হচ্ছে টাইফয়েড তা বাঁধাল কী করে?”
মা বলল, “ও ভয় পেয়েছে ডাক্তারবাবু ভয় পেয়ে এমনটা হয়েছে
নগেন ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, “হুঁ, আতঙ্ক থেকেও টাইফয়েড হয় ঘাবড়ানোর কিছু নেই বেশ কিছু দিন ভুগতে হবে এখন কিছু ওষুধ আমি দিয়ে যাচ্ছি সন্ধেবেলায় এসো, আরও কিছু ওষুধ দেব তিন দিন পরে কেমন থাকে আমাকে জানাইও
তখন তো আর এখনকার মতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নগেন ডাক্তারের ওষুধ খেয়েই চলেছি জ্বর কমছে আর বাড়ছে ছাড়ছে আর না ডাক্তারবাবু মাঝে মাঝেই ওষুধ বদলে দিচ্ছেন শেষে একদিন জ্বর ছাড়ল
ভয় পেয়ে সেবার আমাকে টানা একুশ দিন ভুগতে হয়েছিল
----------
ছবি – সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment