জেলিফিশ বিজ্ঞানী ও রঙিন দুনিয়া
সৌমিত্র চৌধুরী
জেলিফিশ। শরীরটা
থকথকে জেলির মতো। সামুদ্রিক জীব। সমুদ্র
সৈকতে প্রাণীর মৃতদেহ অবহেলায় পড়ে থাকে। দীঘা পুরী কিংবা দক্ষিণ ভারতের সাগরতীরে
নজরে পড়ে। কেউ বলে বিষাক্ত, অনেকের বিচারে আবার
খাদ্য বস্তু। কী ভাবে খায়, কেমনই বা রন্ধন প্রণালী, সে অন্য কাহিনি।
এখন জেলিফিশের ভিন্ন গল্প। বিস্ময়কর!
সমুদ্রের গভীরে বিচরণ করে প্রাণীটি। শিকার ধরে। সেই
শিকার খেয়ে বেঁচে থাকে। আর এক আশ্চর্য কথা, জেলিফিশের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে রঙিন
আলো! লাল, নীল, সবুজ বহু রঙের ছটা। সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মানুষ।
সুন্দর রঙের বিভায় চোখে ঘোর লেগে যায়।
জেলিফিশ প্রাণীদের বলা হয়
মেডুসা। সমুদ্রের গভীরে লাল গোলাপি হলুদ কত রকমের জেলিফিশ। প্রায় দুই হাজার
প্রজাতি এদের। মাথাটা ছাতার মতো। শরীরের নিচের
দিকটা যেন সরু সুতোয় বোনা জাল। ইংরাজিতে বলে টেন্ট্যাক্ল। মেডুসা
তার টেন্ট্যাক্লগুলো দিয়ে সাঁতার কাটে। আর টেন্ট্যাকলের মধ্যে থাকে ‘নেমাটোসিস্ট’,
এক ধরনের হুল। হুল কাজে লাগিয়ে জেলিফিশ শিকার ধরে।
প্রাচীন প্রাণী জেলিফিশ। জন্ম
বহু কোটি বছর আগে। এদের পর্ব, গণ, গোত্র সবই লিপিবদ্ধ
করেছে আধুনিক বিজ্ঞান। সিন্ড্রিয়া (cnidaria)
পর্বের, আর মেডুসোজা উপপর্বের প্রাণী জেলিফিশ। ঠিকানা সমুদ্রের গভীরে, আবার উপরতলেও।
জেলিফিশ মানুষের নজরে এসেছে অনেক
কাল আগে। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি তখন। প্রাণীটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর
বিচ্ছুরণ দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছে মানুষ। উজ্জ্বল
রঙের দিকে তাকিয়ে অপার বিস্ময়ে শুধু প্রশ্ন করেছে। কেমন
করে রংবেরঙের আলো ছড়িয়ে সমুদ্রের তলদেশে বিচরণ করে জেলিফিশ? খুঁজেছে উত্তর।
প্রাণী-শরীরে রঙিন আলোর সৃষ্টি-রহস্য।
উজ্জ্বল রঙের উৎস খুঁজে বের
করতে গবেষণায় নামল আধুনিক বিজ্ঞান। চলল একশো বছর ধরে অন্বেষণ।
আলোক রশ্মির জ্বলজ্বল করে ওঠা
প্রক্রিয়াটির নাম প্রতিপ্রভ, ইংরাজিতে ফ্লোরেসেন্স (Fluorescence)। সহজ
কথায়, প্রতিপ্রভ এক ধরনের আলোর স্ফুরণ। বস্তুর গায়ে
আপতিত আলোর রশ্মির চাইতে কম শক্তি মাত্রার বিকিরণ। শুধু জেলিফিশ নয়। স্থলে জলে
অন্তরীক্ষেও নজরে আসে প্রতিপ্রভ। অনেক গাছের
ফুলে পাতায় পাওয়া যায় আলো বিচ্ছুরণকারী পদার্থ। অন্ধকারে হিরা মাণিক জ্বলে। আকাশ
ভরা সূর্য তারা, সেখানেও বিচ্ছুরিত হয় ফ্লোরেসেন্স।
পাঁচশো পঞ্চাশ বছর আগে, তখন
আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি, কিন্তু ফ্লোরেসেন্স সম্পর্কে জানতে পেরেছিল মানুষ। পর্যবেক্ষণে
ধরা দিয়েছিল ফ্লোরেসেন্স বিকিরণকারী খনিজ - রুবি হিরা ক্যালসাইট। গাছের
বাকলে, ফুলে, বৃষ্টি-ভেজা বৃক্ষ-শাখায় প্রতিপ্রভা নজরে এসেছিল।
একুশ শতকেও বহু বিজ্ঞানী, প্রকৃতিপ্রেমিক
রঙিন ফ্লোরেসেন্ট আলোর নেশায় মশগুল। স্থলে জলে
গিরি-গুহা-কন্দরে আলোক বিকিরণকারী প্রাণীর সন্ধান করেন তাঁরা। এমন প্রাণী সংখ্যায়
অগুন্তি।
চিত্র ১ ।। জেলি ফিসের শরীর থেকে নির্গত সবুজ উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্স |
আমাদের গল্পের বিষয় এক বিশেষ
ধরনের জেলিফিশ। সবুজ উজ্জ্বল আভা (Green fluorescence) নির্গত
হয় এর শরীর থেকে (চিত্র ১)। আলোর
সৌন্দর্যে শিহরিত বৈজ্ঞানিকরাও। ভাবতে থাকেন
কী এই আলো, কেমন করে তৈরি হয়?
দেশ বিদেশে চলতে লাগল
অন্বেষণ। ধীরে ধীরে উঠে এল উত্তর। জানা গেল প্রাণীটির শরীর থেকে প্রতিপ্রভা নির্গমণের
কারণ। জেলিফিশের শরীরে থাকে এক ধরণের
প্রোটিন। নাম, গ্রিন ফ্লোরোসেন্ট প্রোটিন (GFP)। এর
ক্রিয়াতেই ঘটে সবুজ রঙের বিচ্ছুরণ।
কোথায়, কেমন করে তৈরি হয়
জিএফপি? প্রাণীর দেহ-কোষে জিনের ক্রিয়াতেই উৎপন্ন হয় যাবতীয় প্রোটিন। জিএফপি
প্রোটিনটিও তৈরি হয়েছে জেলিফিশের দেহ কোষে জিনের ক্রিয়াতেই।
বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন আর চিন্তা
কখনোই থেমে থাকে না। অনেকে ভাবতে বসলেন, কোনো কাজে কি ব্যবহার করা যায় এই আলোক
রশ্মি? একদল বিজ্ঞানী ভাবলেন, জিএফপি প্রোটিনকে যদি অন্য প্রাণীর শরীরে ঢুকিয়ে
দেওয়া যায়! কিংবা মানুষের কোষের ভিতর? কোষের ভিতর ঢুকে রঙের কারসাজিতে অনেক অজানা
সংবাদ কি জানাতে পারবে সে?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন। উত্তর
জানতে গবেষণা চলতে লাগল বছরের পর বছর। এক সময় জিএফপি প্রোটিনকে অনেকটা চিনতে পারা
গেল। তার ধর্ম, কেমন তার আকার বুঝে নেওয়া সম্ভব হল।
কিন্তু জেলিফিশের সেই
প্রোটিনকে আলাদা করে নিয়ে অন্য প্রাণীর শরীরে কি ঢুকিয়ে দিতে পারলেন বৈজ্ঞানিকরা। পারলেন।
কেমন করে?
বৈজ্ঞানিকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়
সম্ভব হল সেই কাজ। বলতে হবে জীব বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে। বিষয়টির শুরু অণুবীক্ষণ
যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ (Microscope) আবিস্কারের
মধ্য দিয়ে। ক্ষুদ্র জিনিসের আকার বাড়িয়ে নজরে আনতে
পারে এই যন্ত্র। যন্ত্র দিয়ে দেখা যায় অতি ক্ষুদ্র
বস্তু - জীবাণু, কোষ। কোষের বিভিন্ন উপাদানকেও সনাক্ত করেছে
এই যন্ত্র। কাজে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন রঙ (Dye), রঙিন আলো আর ফ্লোরেসেন্স প্রক্রিয়াও।
এ কাজ সাড়ে তিনশো বছরের পরিশ্রমের
ইতিহাস। কোষের বিভিন্ন উপাদান এবং গঠন-বৈচিত্র্যের
জ্ঞান শুধু নয়, জিনের ক্রিয়াকর্মও এখন জানতে পারছি আমরা।
ফ্লোরেসেন্স প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে এ কাজ সম্ভব হয়েছে ইদানীং।
রঙের ব্যবহার আধুনিক
জীববিজ্ঞান বিষয়টির উন্নতি ঘটিয়েছে অনেক। টিস্যুর প্রকৃতি বুঝতে রঙের সাহায্য
জরুরি। অনেকগুলো কোষ দিয়ে তৈরি হয় কলা, ইংরাজিতে টিস্যু (Tissue)। অণুবীক্ষণ
যন্ত্রে টিস্যুর প্রকৃতি জানতে রঙ বা রঞ্জক পদার্থ কাজে লাগানো হয়। প্রুসিয়ান ব্লু
নামের রঞ্জক (Dye) দিয়ে কোষ রাঙিয়ে তুলবার কাজ শুরু
হয়েছিল অনেক কাল আগে, অষ্টাদশ শতকে (1774)। আর
হিমাটক্সিলিন এবং ইয়োসিন নামের রঞ্জক খুব পুরানো হলেও (1875-1878) এখনও ব্যবহার
করা হয়।
ডাই (Dye) বা রঞ্জক পদার্থ কোষের ভিতর কোনো বিশেষ প্রোটিনের
উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি জানিয়ে দিতে পারে। কোষের প্রোটিনের সঙ্গে সেই রঞ্জক
পদার্থটি রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়ে গেলে রং দিয়ে তাকে চেনা যায়। মাইক্রোস্কোপের
সাহায্য নিয়ে দেখতেও পাওয়া যায়। কাজটি কিন্তু সহজ নয়। প্রোটিনের সঙ্গে রাসায়নিক
পদার্থ যুক্ত করে বা ট্যাগ (Tag) করে অনুসন্ধান
চালানো বেশ জটিল কাজ। কারণ প্রোটিনের সৃষ্টি জিনের ক্রিয়াকর্মের ফলেই, আর জিনের
অবস্থান ক্ষুদ্র কোষের অতি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে। ক্রোমোজোমের
ভিতর।
জিনের গঠন জানতে গবেষণা হয়েছে
অনেক। সাফল্য সহজে আসেনি। বর্তমান দশকে সম্ভব হল এক অসম্ভব কাজ। কী সেই কাজ? গ্রিন
ফ্লোরেসেন্ট প্রোটিন (বা অন্য ফ্লোরেসেন্ট জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ) ডিএনএ-র সঙ্গে (Base pair) যুক্ত করে দিতে পারলেন বৈজ্ঞানিকরা। ডিএনএ সব প্রাণীর
বংশগতির ধারক। জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ডিএনএ-র অংশই হল জিন। ডিএনএ-র মধ্যেই
শরীরের বহু রহস্য লেখা থাকে সংকেতের মাধ্যমে। ডিএনএ-র সঙ্গে ফ্লোরেসেন্ট জাতীয়
রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত করা সম্ভব হবার পরেই জিন বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঘটে গেল
যুগান্তকারী পরিবর্তন।
গ্রিন ফ্লোরেসেন্ট প্রোটিনটির
আবিষ্কার ঘটেছে বহু দশক আগে (1970)। প্রোটিনটিকে
জেলিফিশের (Aequorin) শরীর থেকে আলাদা করেন বিজ্ঞানী
অসামু শিমুমুরা। পরিশুদ্ধও করেন। পরিশুদ্ধ (পিওর) প্রোটিনটির দ্রবণের রং হলুদ। আর
ঘরের বাইরে রোদে রাখলেই সেটি উজ্জ্বল নীল আভা ছড়ায়। কেন এমন হয়? সূর্যালোকের অতিবেগুনি
রশ্মি শোষণ করে প্রোটিনটি কম শক্তির সবুজ আলো নির্গত করে। বিজ্ঞানীরা বললেন এটি ‘রেডিমেড
প্রোটিন’। অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজেই কাজ করতে
পারে। কিন্তু তাতে কী হল?
বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন এক অমিত
সম্ভাবনা। ভাবতে লাগলেন জীবিত কোষের ভিতর যদি এই প্রোটিনকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়? তেমন
সম্ভব হলে তো রঙিন আলোর সিগন্যাল পাঠিয়ে এই প্রোটিন জানিয়ে দিতে পারবে কোষের
ভিতরের খবর - কোষের ত্রুটি বিচ্যুতি, অনেক রোগের সংবাদ। অতএব,
শুরু হল জোরদার গবেষণা। বহু পরীক্ষার পর বড়ো আকারের জিএফপি প্রোটিনকে (238
অ্যামিনো অ্যাসিড) ব্যাকটেরিয়ার কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব হল (1994)। কিন্তু
সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। ব্যাকটেরিয়া কোষ থেকে উন্নত মানের ফ্লোরেসেন্স বেরিয়ে এল না। অর্থাৎ
‘রেডিমেড প্রোটিন’-কে কাজে লাগানোর সুযোগ অধরাই রয়ে গেল। ব্যর্থতার আঁধারে ডুবে
গেল সম্ভাবনাময় এক আবিষ্কার।
চিত্র ২ ।। বিজ্ঞানী রজার ইয়ংসিয়েন চেন |
কিন্তু ব্যর্থতাই তো শেষ কথা
নয়। কয়েক বছর পর নতুন ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন বিজ্ঞানী রজার ইয়ংসিয়েন চেন (Roger Youngchien Tsein, চিত্র ২)। প্রথমেই
প্রোটিনটির রাসায়নিক গঠনে কিছু পরিবর্তন (Mutation) ঘটিয়ে ফেললেন তিনি। পরিবর্তিত
প্রোটিনটি কিন্তু সাফল্য এনে দিল। এটি ব্যবহার করে পাওয়া গেল উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্স। অর্থাৎ
কাঙ্খিত সাফল্য হাতে এল। জীবিত কোষের মধ্যে ঢুকে এই প্রোটিন
পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা রঙের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারল। অনেকটা
গুপ্তচরের কাজ।
কেমন করে সম্ভব করলেন এ কাজ?
রঞ্জক পদার্থ দিয়ে কোষের অংশবিশেষ চিহ্নিত করবার কথা আগে বলা হয়েছে। রঞ্জক দিয়ে
কোষ রং করা আর জিএফপি ট্যাগিং সম্পূর্ণই ভিন্নরকম। কোষকে রাঙিয়ে তুলবার আগে কাচের
স্লাইডে স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে হয়। এর নাম স্থায়ীকরণ বা ফিক্সিং (Fixing)। স্থায়ী টিস্যুর অংশবিশেষকে অর্থাৎ
মৃত কোষকে রং মাখানো সহজ, কিন্তু ফ্লোরেসেন্স ট্যাগিং কাজটি খুবই জটিল। কারণ কাজটি
জীবিত কোষে বা জীবন্ত প্রাণীর শরীরে করা দরকার। মৃত কোষে নয়।
ফ্লোরেসেন্স ট্যাগিং-এর কঠিন কাজটি
জীবিত কোষে ঘটিয়ে ফেললেন রজার চেন। তবে একটু অন্যভাবে। জিন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। রঙিন
প্রতিপ্রভা (Colored fluorescence) তৈরি করে যে
জিন, তাকে ঢুকিয়ে দিলেন প্রাণীর শরীরে। এ ভাবে ‘ফ্লোরসেন্ট ট্যাগিং’ সম্ভব করলেন
অধ্যাপক চেন।
আরেকটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
জেলিফিশের শরীরে জিএফপি উৎপন্নকারী বিশেষ জিন থাকে। এই
জিন অন্য প্রাণী বা জীবিত কোষের ভিতর ঢুকিয়ে দিলেই নির্গত হবে সবুজ প্রতিপ্রভা (Green fluorescence)। এ ভাবেই পরীক্ষাগারে
সবুজ আলো বিকিরণকারী ইঁদুর, শুকর, গিনিপিগ তৈরি হয়েছে। জিন
ঢুকিয়ে দেবার এ কাজ ইদানীং তেমন কঠিন বিষয় নয়।
কেমনভাবে করতে হয় এই কাজ? প্রথমে
কোনো ভাইরাস বা প্লাসমিডের (ভাইরাসের শরীরে থাকা ক্রোমোজোমের বাইরে ডিএনএ-র
অংশবিশেষ) শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই জিন।
ভাইরাস এখানে বাহক বা ভেক্টর। যেমন
ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের (প্লাসমোডিয়াম ফলসিপেরাম) বাহক (ভেক্টর) আমাদের অতি
পরিচিত অ্যানোফেলিস মশা। বাহক বা ভেক্টরের মধ্য দিয়ে জীবন্ত কোষের মধ্যে জিন প্রতিস্থাপন
করা হল। তারপর? ওই কোষে অতিবেগুনি রশ্মি আপতিত হলেই সবুজ আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠবে
(Green fluorescence, চিত্র ৩) সেটি। আর
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা এই আলোই জানান দেবে কোষের প্রকৃতি।
চিত্র ৩ ।। জিএফপি ট্যাগ করা জীবন্ত কোষের ছবি |
শক্তিশালী অতিবেগুনি রশ্মির (ultraviolet) প্রভাবে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাই কম শক্তির আলো আজকাল ব্যবহার করা হয়। এ
ব্যাপারেও পথপ্রদর্শক রজার চেন। জিনের পরিবর্তন
ঘটিয়ে অন্য রঙের প্রতিপ্রভাও সৃষ্টি করেছেন। তাঁর আবিষ্কারের ফলে রঙের সাহায্য
নিয়ে দ্রুত ক্যানসার কোষ চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়েছে। অন্য
কিছু রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও কাজে লাগে বিজ্ঞানী রজার চেনের এই আবিষ্কার। তাঁর
অবদানের কথা না বললে কোষ বিজ্ঞান এবং আণবিক জীববিদ্যা বিষয়ে যে কোনো আলোচনা
অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
অতিবেগুনি আলোর নিচে জিএফপি-র
প্রোটিন ব্যবহারের কৌশলটি প্রথম শেখালেন বিজ্ঞানী রজার চেন। প্রোটিন
অণুর গঠনে আরও কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সজীব ক্যানসার কোষ শনাক্ত করবার উপায়ও
আবিষ্কার করলেন। অর্থাৎ ক্যানসার কোষের মার্কার
হিসাবে জিএফপি ব্যবহারের উনি প্রবক্তা। জিএফপি-র সাহায্য নিয়ে কোষ ও জিনের ত্রুটি
শনাক্ত করবার কাজই শুধু নয়, মস্তিষ্কের কোষ বিষয়েও রজারের অবদান উল্লেখযোগ্য।
ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে দীর্ঘ তিন দশক অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন রজার
চেন। সঙ্গে গবেষণা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ে - ফার্মাকোলজি, কেমিস্ট্রি এবং
বায়োকেমিস্ট্রি। ক্যানসার এবং অ্যালঝাইমার্স রোগের চিকিৎসায় রজার চেনের অবদান
সর্বজনস্বীকৃত।
চিন রাজবংশের উত্তরাধিকারী
রজারের জন্ম আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। অসুস্থতার
কারণে শৈশবে গৃহবন্দি থাকতে হত। আমেরিকায়
কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার পিতা বাড়িতেই রজারের জন্য গবেষণাগার বানিয়ে দেন। আট বছর বয়স
থেকেই রজার শুরু করেন রসায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞানে স্নাতক
এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন হার্ভার্ড আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন দশকের গবেষণা। জীবনব্যাপী বহু বিষয়ে
গবেষণা করেছেন তিনি। প্রকাশিত বিজ্ঞান গবেষণাপত্র দুশো পঞ্চাশের অধিক। একক ও যৌথভাবে
তাঁর পেটেন্ট শতাধিক। দেশ-বিদেশের বহু সম্মানে ভূষিত। ফ্লোরেসেন্সের
প্রয়োগ ঘটিয়ে কোষ ও জিন বিজ্ঞান গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছেন। তাঁর
অসামান্য অবদানের যোগ্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ফ্লোরেসেন্ট মার্কার তৈরির জন্য রসায়ন
বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন (ওসামু শিমোমুরা ও মারটিন শালফির সঙ্গে
একযোগে) 56 বছর বয়সে (2008)।
রজার চেনের শিল্পী চোখে ছিল
রঙের নেশা, মননে বিজ্ঞান - পদার্থবিদ্যা,
রসায়ন, কোষ বিদ্যা। দৃশ্যমান প্রকৃতির রংবাহারের নেপথ্যে বৈজ্ঞানিক
কারণ কী? ছোটোবেলা থেকেই উত্তর খুঁজতেন রজার।
রসায়নের জ্ঞান দিয়ে কোষ
বিজ্ঞানকে রঙিন করে তুলেছেন তিনি। রসায়ন বিজ্ঞান আদতে রঙের কারবার। বিক্রিয়ায় নতুন
বন্ধনী (Bond) তৈরি হলে রঙের তারতম্য ঘটে। বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে রঙের দুনিয়ায় চোখ
মেলেছিলেন রজার। বলেছেন, ‘আমি সব সময় রঙের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। রঙই আমার কাজকে
আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। ...আমি বর্ণান্ধ হয়ে জন্মালে হয়তো এই কাজ করতেই পারতাম না।’
রজার চেনের বয়স যখন 64, হঠাৎ নেমে এল দুর্ঘটনা। কর্মব্যস্ত
ও সৃজনশীল এই বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু ঘটল (24 অগাস্ট 2016)।
হৃদয় বিদারক ঘটনা এবং বিজ্ঞান জগতের অপূরণীয় ক্ষতি।
আলো বিকিরণকারি এক সামুদ্রিক
প্রাণীর কথা বলতে গিয়ে কোষ ও জিনবিজ্ঞান প্রসঙ্গ উঠে এল। জানাতে হল এক বিজ্ঞানীর
বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সামান্য পরিচয়। সাড়ে তিনশো
বছরের কোষ বিজ্ঞনের ইতিহাস, বর্তমানের জিন বিজ্ঞান এবং ফ্লোরেসেন্সের রঙিন জগৎ
রজার চেনকে শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখবে।
----------
[লেখক পরিচিতিঃ ডঃ সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিজ্ঞানী ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন
জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থান, কলকাতা]
----------
ছবি - আন্তর্জাল
সুন্দর সাবলীল লেখা। অনেক কিছু জানলাম।
ReplyDelete