গল্পের ম্যাজিক:: মাস্টারমশাই - শেলী ভট্টাচার্য


মাস্টারমশাই
শেলী ভট্টাচার্য

অফিস অফিস করে এবার মাথাটাই না খারাপ হয়ে যায় দরকারে একটা দিন যে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বের হব, তার জো নেই বিরক্তিতে আপনমনে বিড়বিড় করছিলাম আমি ঠিক তখনই জানলার পাশ থেকে পর পর দুজন উঠে যাওয়ায়, হেঁচড়ে গিয়ে জানলার কাছে বসলাম মনে মনে ভাবলাম, আর তো তিনটে স্টেশন কতক্ষণই বা! তাও বসা যাক না হয় লোকাল ট্রেনের জানলার হাওয়ায় নিজেকে একটু তৃপ্ত করা যাবে আজকাল তো এই নিপাট সহজ সরল সুখগুলোকে আর ছোঁয়াই যায় না অফিস ক্যাবের যান্ত্রিক সুখে মাথা এলিয়ে দিয়ে রোজকার যাতায়াত চলে প্রকৃতিকে তেমনভাবে আর পাওয়া যায় কোথায়! ভাবতেই আমার খেয়াল হল, বাইরের শীতল হাওয়ায় আমার শরীরের সঙ্গে মাথাটাও দিব্যি শান্ত হয়ে গেছে বাঁ হাতের কবজি উলটে একবার দেখে নিলাম ঘড়িতে দশটা দশ বাজে আমি আসব জেনে সুদীপ্ত বলেছিল, দশটার দিকে স্টেশনে থাকবে আমার কভার ডিজাইনিং করা কবিতার বইটার এক কপি নেবে সেই মতো বন্ধুর জন্য এক কপি চটি কবিতার বই সঙ্গে এনেছি কবি খুব স্বনামধন্য না হলেও, আজকালকার ফেসবুক জগতে টুকটাক পরিচিত তেমন কেউকেটা কবি হলে, আমার এই উঠতি সখের সঙ্গতই বা দেবে কেন? এখনকার সব সাহিত্যিকরাই তো কম বেশি সৌখিন নিজের লেখার প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি নামী শিল্পীকে দিয়ে নিজের বইয়ের কভার করাতে কার্পণ্য করেন না ভাবতে ভাবতেই কাঁধের ব্যাগ থেকে কবিতার বইটা বের করলাম উপরের কভারে লেখা নিজের নামটার উপর হাত বুলিয়ে আবার সেই সুখটা অনুভব করলাম আমি
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার তাগিদে, অনেকগুলো বছর আমার প্রিয় রঙ-তুলিকে বেমালুম ভুলে ছিলাম আজ এক-দেড় মাস হল, ছেলের স্কুলের আর্ট এণ্ড ক্রাফটের প্রজেক্টের জন্য, আবার কী মনে করে রঙ-পেনসিলে হাত দিয়েছি মোম পেনসিল দিয়ে শেড কালার করতে গিয়েই মনে পড়ে গেছে তুলি প্যালেট জলরঙের কথা এভাবে ধীরে ধীরে পুরোনো ভালোবাসার নেশাটাও আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে এখন প্রায়ই ছুটির দিনের দুপুরে ছেলের সঙ্গে বসে পড়ি আঁকার খাতার রঙিন জগতের মধ্য দিয়ে বাপ বেটা কল্পনার হাত ধরাধরি করে দিব্যি হেঁটে চলি আমি খেয়াল করেছি, ছেলেটার মধ্যেও আমার মতো আঁকার প্রতি একটা টান আছে
 
পকেটে বাজতে থাকা ফোনে সংবিৎ ফিরল আমার অনুভব করলাম, ট্রেনের গতি ধীর হয়ে এসেছে বাইরের দিকে চেয়ে দেখি, ট্রেনটা ডানদিকে রেলপাড়ের বস্তির মাথাটা ক্রস করেছে মানে স্টেশনে ঢুকছে গাড়ি ফোনটা বের করে দেখি সুদীপ্তর কল বাবার সেই অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে আমি ট্রেনে ওঠানামার সময়টাতে খুব একনিষ্ঠ হয়ে থাকি মনে মনে ঠিক করলাম, এখন ফোনটা ধরব না একেবারে স্টেশনে নেমেই বন্ধুকে কল করব
প্রায় সাত বছর পর এসময় এই স্টেশনে নামলাম চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্মৃতির ভিড় জনহীন নিস্তব্ধ বলেই বোধ হয়, সেগুলো আরও বেশি চোখে পড়ছে প্লাটফর্ম জুড়ে আমাদের কলেজ লাইফের সময়ের আড্ডার মুহূর্তগুলো যেন আজও সিমেন্টের বেঞ্চে লেপটে রয়েছে মনে হচ্ছে ওখানে বসে একটু ছুঁয়ে দিলেই, আবার আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে সেদিনকার হাসির কল্লোল বিমলদার সিগারেটের দোকান, বিশুকাকুর ফুচকার আধভাঙা তক্তাপোশ, আর টিকিট কাউন্টারের বাঁদিকের লটারির দোকানটার বন্ধ ঝাঁপ যেন একসঙ্গে আমার দিকে চেয়ে চুপিসারে বলছিল... কত বড়ো হয়ে গিয়েছিস অংকু! সত্যিই বোধ হয় অনেকটা বড়ো হয়ে গেছি আজ তাই অতীতের সুঘ্রাণ নেওয়ার জন্য রাজারহাটের ফ্ল্যাট ছেড়ে হাসনাবাদের দিকে এক রাতের জন্যও আর আসা হয়ে ওঠে না
 
কলকাতার মতো এদিকটাতে অনেক রাত অবধি দোকানপাট খোলা থাকে না বরাবরই দশটার দিকে বন্ধ হয়ে যায় তবে এখন বোধ হয়... ভাবতেই ফোনে চোখ রেখে মনে হল, আরে সুদীপ্তকে তো কল করা হল না চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেখলাম শুনশান স্টেশনে আমি আর দুটো নেড়ি কুকুর ছাড়া তেমন কেউ নেই একটু এগিয়ে গিয়ে ছাউনির তলার বেঞ্চে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে, বন্ধুকে কল করলাম আমি কিন্তু, লাইনটা আনঅ্যাভেয়লেবল বলল ভুরু কুঁচকে ভাবলাম, তবে কি আমার দেরি দেখে সুদীপ্ত ফিরে গেল? পরমুহূর্তেই ভাবলাম, এদিককার যা টাওয়ারের অবস্থা, আরেকবার করে দেখি বরং কিন্তু দ্বিতীয়বারও সেই একই কথা বলল
সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে প্রায় ফিলটারের কাছে এসে পড়েছে বার দুয়েক সুখটান দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম নিজের বুটের নিচে আগুনের শেষ হলকাটাকে পিষে দিয়ে সামনের দিকে চাইলাম ঠিক তখনই খেয়াল হল একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় আমর চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে আকাশের দিকে উঁকি মেরে দেখলাম, তারাদের কোনো হদিশই নেই
সর্বনাশ! যে মেঘ করেছে ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল নাকি? কে জানে! তাই হয়তো এতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারদিকটা ভাবতেই খেয়াল হল আমার, ছাতা আনা হয়নি এত রাতে রিকশা বা ভ্যান-ট্যান কিছু পাব বলেও তো মনে হচ্ছে না হাঁটা পথে বাড়ি পৌঁছতে প্রায় তেরো-চোদ্দো মিনিট এখনও না, সুদীপ্তর জন্য আর অপেক্ষা করে কাজ নেই কাল তো বেলার দিকের ট্রেন ধরব সকালের দিকেই না হয় ওর সঙ্গে একবার দেখা করে নেব ভেবে জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম কয়েক পা এগোতেই একটা বিশ্রী ধূলিঝড় শুরু হল স্টেশনের উপরের ধূলোগুলো এলোমেলো হয়ে চোখেমুখে এসে পড়ছিল একপাশের বড়ো অশ্বত্থ গাছটার শুকনো পাতাগুলোও উড়ছিল সেই হাওয়ায় কাঁধের ব্যাগটাকে দু’হাত দিয়ে মুখের সামনে ধরে কোনোরকমে চোখ বাঁচিয়ে এগিয়ে চললাম আমি চোখের ভারী চশমার বোঝ কমাতে ক’বছর হল কনটাক্ট লেন্স ব্যবহার করি আমি ধুলো পড়লেই একনাগাড়ে কচকচ করতে থাকবে জোরে পা চালাতে গিয়ে আমার অনুভব হল বাতাসে শীতলতার ভাব বেড়ে যাচ্ছে মানে বৃষ্টি নামার আর দেরি নেই ফলতঃ আরও জোরে পা ফেলতে থাকলাম কিছুটা এগিয়ে স্টেশনের ঢাল বেয়ে নামবার মুখে হঠাৎ থমকে গেল আমার চলন কানে পৌঁছাল ক্ষীণ কন্ঠের প্রশ্ন, “অঙ্কন না?
মুখের সামনে থেকে ব্যাগটা নামিয়ে সামনের দিকে তাকালাম আমি ভালো লাগা মানুষটাকে একপলক দেখেই চিনতে পারলাম খাকি রঙের প্যান্ট আর ছাই রঙের চেক শার্ট পরা মানুষটা আমার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন চোখে আগের মতোই মোটা ফ্রেমের চশমা মাথার তালুর চুল বেশ পাতলা হয়ে এসেছে তবে বয়সের ভারে তেমন নুয়ে যাননি কতই বা বয়স হবে বড়োজোর ষাট কী পঁয়ষট্টি
একঝলক নিরীক্ষণ করার পর আমার গলা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল সশ্রদ্ধ সম্বোধন, “মাস্টারমশাই
বাইরের ঝড়ের তাণ্ডবে স্টেশনের আলোগুলো তখন দপদপ করছিল
“এত রাতে স্টেশনে কেন এলেন?
বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে গেলাম আমি কিছুটা এগিয়ে নিচু হয়ে পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম
“তোমার কাকিমার আসার কথা আছে রাতের খাওয়া সেরে বাপের বাড়ি থেকে আসছে তো, তাই পৌনে এগারোটার ট্রেনটায় আসবে রাস্তাঘাট বড্ড অন্ধকার একা ফিরতে পারবে না তাই... বলে থেমে গেলেন বৃদ্ধ
আমি জানতাম, মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি তিন নম্বর প্লাটফর্মের ঠিক পেছন দিকে হেঁটে গেলে বড়োজোর দুই থেকে তিন মিনিট৷ যানবাহনের উপর ভরসা করতে হয় না তাই হয়তো এত রাতেও...
“তা তুমি এদ্দিন পর এদিকে... মাস্টারমশাইয়ের কথায় সংবিৎ ফিরল আমার
“গত মাসে কাকার ছেলে বিদেশ থেকে ফিরেছে চায় পৈতৃক বাড়িটার একটা গতি হোক মানে বিক্রি-বাট্টা করতে চায় আর কী। মায়ের তেমন ইচ্ছা নেই তবে, এদিকে আজকাল তো তেমন আর আসা হয় না মা মাঝেমধ্যে বাচ্চার মতো বায়না ধরলে আমি সকালের দিকে এসে দু-তিন ঘন্টার জন্য মাকে নিয়ে ঘুরে যাই সে সময় মা যত্ন করে ঝাড়পোঁছ করে যায় স্মৃতিগুলোকে তাও হয়তো বছরে এক-দু’বার এর বেশি রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে ওঠে না তাই আমিও ভাবলাম যদি...
“যদি অপ্রয়োজনীয় সম্পত্তি বেচে দিয়ে সব হিসাব চুকানো যায় আর কী!” বলেই মাস্টারমশাই জিভের আগাটাকে টাকরাতে ঠেকিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে চুক চুক করে আওয়াজ করে বললেন, “উঁহু, ভুল বলে ফেললাম সম্পত্তি আবার অপ্রয়োজনীয় হয় নাকি? অতীত ঘিরে থাকা স্মৃতিগুলোই বরং সামনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়
আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম বরাবরই আমি একটু অনুভূতিপ্রবণ ছেলে এই বাড়ির প্রতি মায়ের টানের পেছনের যুক্তিগুলোকে ভালোই বুঝতে পারি মাস্টারমশাইদের বয়সে আসার পর, পেছনের স্মৃতিচারণগুলোর মাধুর্য ঠিক কতখানি, সেটাও বেশ অনুভব করতে পারি আমি কিন্তু, এটাও সত্যি যে বর্তমানের ব্যস্ত জীবনের ঘড়ির কাঁটাগুলো বড্ড একগুঁয়ে পেছনের দিকে ফিরে তাকাবার ফুরসত নেই তাদের যার জন্য ছোটোবেলার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণও হয় না আর আমার মনে হল, এতেও অতীত স্মৃতিকে একরকম অবমাননাই করা হয় তাই শেষে ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সামনের সপ্তাহে প্রোমোটার লোক নিয়ে আসার আগে অপ্রয়োজনীয়তার ভিড়ের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে আর একবার নিজ হাতে বেছে নিয়ে যেতে চাই
ঠিক তখনই ট্রেনের আকস্মিক হুইসেলের চড়া আওয়াজে ঢেকে গেল মাস্টারমশাইয়ের গলাটা শোনা গেল মৃদু স্বরে... “আমি এগোই মৃদুলা আসছে বলে নেশাগ্রস্থর মতো আপনমনে প্লাটফর্মের ছাউনির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন বৃদ্ধ আমি কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মানুষটির দিকে
 
অতঃপর আকাশের দিকে চেয়ে আরেকবার অনুভব করলাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে পা চালিয়ে রেল লাইনের সমান্তরাল রাস্তাটা ধরলাম কিছুটা যাওয়ার পরেই, ঘুটঘুটে অন্ধকারের উপস্থিতি আমায় জানান দিল লোডশেডিং হয়েছে এই এলাকাতে সমস্যা আজকে নতুন নয় সেই ছোটো থেকে সন্ধের পর থেকেই হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম আমি এতক্ষণে পরবর্তী সমস্যাটার কথা আমার মাথায় এল এতদিন বাড়িতে না থাকার কারণে কোনো মোমবাতিও থাকবে না হয়তো অফিস ক্যান্টিন থেকে রাতের খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে এসেছি আমি কিন্তু বাড়ির তিনটে তালা খুলে হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার সারতে নূন্যতম এক ঘন্টা মতো সময় লাগবে ভেবে ফোনের স্ক্রিন অন করে দেখলাম ৪৭% চার্জ আছে
মনে মনে ভাবলাম, আজ কপালে দুঃখ আছে
বাড়িতে ঢোকার গলিতে পা দিতেই বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল প্রায় দৌড়ে গিয়েই দুটো বাড়ি পেরিয়ে নিজেদের বাড়ির ল্যাণ্ডিংয়ের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম তারপর মোবাইলটা বের করে ওর আলোতে একের পর এক তালাগুলোকে খুললাম ভেতরে ঢুকতেই অবচেতনে সুইচ বোর্ডে আমার হাত পড়ল টের পেলাম, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে অর্থাৎ কারেন্ট এসে গেছে এরপর দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা ধুলোবালির ধূসর গন্ধ আমার নাকে এসে ঠেকল সেই পাঁচ মাস আগে দিনের বেলা একবার মায়ের সঙ্গে এসেছিলাম
 
অতঃপর ঘরে ঢুকে বিছানা ঢাকা দিয়ে রাখা পুরোনো চাদরটাকে এক টানে সরিয়ে দিলাম তারপর সোফার নিচ থেকে ঝাঁটাটা বের করে এঘর ওঘরের মেঝের উপর একটু বোলালাম মা যখন এই বাড়িতে আসে, ঠিক এভাবেই ক্রমানুসারে কাজগুলো করতে থাকে তারপর হাত মুখ ধুয়ে এসে, সবচেয়ে দরকারি কাজটা করলাম তা হল ফোনটাকে চার্জে বসালাম স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখি এগারোটা বেজে গেছে চটজলদি রাতের খাবার খেয়ে পাশের ঘরে ঢুকলাম এই ঘরটা ছিল আমার পড়ার ঘর আঁকার মাস্টারমশাই এলে, এই ঘরের সেক্রেটারি টেবিলে বসেই আঁকা শেখাতেন ভাবতেই টেবিলের পাশের কাঠের আলমারিতে চোখ পড়ল আমার মা সেখানে যত্ন করে আমার আঁকার খাতাগুলোকে রেখে দিয়েছে সেদিন নিজের নাতিকে আমার আঁকার গল্প করছিল বসে সে সব শোনার পর থেকেই হয়তো আমার এই খাতাগুলোর প্রতি আবার একটা টান এসে পড়েছে
কাচের পাল্লাটা খুলে সবগুলোর মধ্যে থেকে আমার প্রিয় খাতাটাকে বের করলাম আমি তখন সবে সবে জলরঙে হাত পাকিয়ে তেল রঙ ধরেছিলাম৷ একের পর এক ছবিতে নিত্য নতুন কায়দায় তুলির টান দিতে চাইতাম আপন মনে এরই মধ্যে বাবা একদিন মাস্টারমশাইয়ের সামনে এসে বলেছিলেন, “এবার ফাইনাল বছর বোর্ড একজাম তাই এখন এসব একটু বন্ধ থাক মাস্টারমশাই
কথাটা শোনামাত্র আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে বলেছিলাম, “আমি পড়ার ক্ষতি করব না বাবা আমায় প্লিজ আঁকতে দাও
কিন্তু বাবা রাজি হয়নি বড্ড তেএঁটে ধরনের মানুষ ছিল যা একবার বলে দেবে, তাই শুনতে হবে সেদিন না খেয়ে এই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সারা রাত কেঁদেছিলাম আমি যদিও তাতে সিদ্ধান্তের এদিক ওদিক হয়নি দু’দিন পরে মাস্টারমশাই এসেই আমার গায়ে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, পরীক্ষা হয়ে গেলেই তেল রঙের বাকি পদ্ধতি উনি শিখিয়ে দিতে আসবেন
আমি নুয়ে যাওয়া কিশোর গলায় সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম, “সত্যি মাস্টারমশাই?
“নয়তো কী? তোমার নাম না অঙ্কন সে কি এমনি এমনি? তুমি আঁকাকে ভালোবেসে সেই শিল্পকে অনেকভাবে ফুটিয়ে তুলবে দেখবে, একদিন কতজন তোমার আঁকা ভালোবেসে হাতে তুলে নেবে তখন আমায় এক কপি দেবে তো? ভুলে যাবে না তো?
মাস্টারমশাইয়ের কথাগুলোকে তখন অলীক স্বপ্ন ঘেরা রূপকথা দেশের মতো মনে হয়েছিল আমার আমি হাঁ করে দু’চোখে লক্ষ আশার দীপ জ্বালিয়ে চেয়ে ছিলাম আমার গুরুর আত্মবিশ্বাসের দিকে
 
সেদিনের কথা মনে পড়াতে খাতাটায় হাত বোলাতে থাকলাম আমি আমার দু’চোখ কেন জানি ঝাপসা হয়ে আসছিল এখন বুঝতে পারি যে, প্রকৃত শিল্পী অপর কারও মধ্যে শিল্পী হওয়ার পিপাসা বা প্রবণতা দেখলে, কীভাবে তার পাশে দাঁড়িয়ে আপ্রাণ সচেষ্ট হতে চায় কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণ আর হয়ে ওঠেনি পড়াশুনোর উত্তরোত্তর বেড়ে চলা চাপের নিচে কোঁচকানো পুরোনো জামার মতো লেপটে গিয়েছিল আমার আঁকার নেশাটা৷ এক হাতে খাতাটাকে নিয়ে অপর হাতে সেক্রেটারি টেবিলের নিচের পাল্লাটা খুললাম আমি বের করলাম একটা মাথার বালিশ তারপর শোয়ার ঘরে গিয়ে, বালিশে আধশোয়া হয়ে ড্রয়িং খাতাটাকে খুললাম আলতো হাতে একটা ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করে অবশ হয়ে আসছিল আমার মন একের পর এক পাতা উলটে চলছিলাম বর্ষার দৃশ্য, মা দুর্গার আরতি, তিরঙ্গা পতাকা ঘেরা স্বাধীনতার ছবি সহ প্রথমদিকের কয়েকটা ছবি বেশ সম্পূর্ণই ছিল কিন্তু যত পেছনের দিকে যাচ্ছিলাম, ততই অসম্পূর্ণ ছবিগুলো আমার চোখে পড়ছিল মনে হচ্ছিল, শিল্প যেন পূর্ণতা পাওয়ার আশায় হাত বাড়িয়ে রয়েছে ঠিক সেদিন যেমন কিশোর অঙ্কন এক বুক আশায় বাবার দিকে চেয়েছিল একটু সুযোগের জন্য, শিল্পের সঙ্গত করার সুখলাভের জন্য ভাবতেই মনের ভেতরটা মুচড়ে উঠল আমার খাতাটা বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম মনে মনে ভাবলাম, কালই খাতাটা নিয়ে একবার মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাব এসব আঁকাগুলোকে কীভাবে সম্পূর্ণ করব, সবটা বসে জানব শিখব তার জন্য দেরি হলে, দরকার হলে সন্ধের দিকের ট্রেনে ফিরব এমন সময় বিশাল বাজ পড়ার শব্দ রাতের দুর্যোগের জানান দিল সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং হয়ে গেল ফোনটাকে বালিশের কাছে রেখে শুয়ে পড়লাম আমি
 
হঠাৎই একটা খস খস আওয়াজে আমার কান দুটো খাড়া হয়ে উঠল ইঁদুর ঢুকল নাকি, ভেবে নিজেকে সজাগ করলাম আমি পরমুহূর্তেই হেসে ভাবলাম, ইঁদুর নতুন করে আর কী ঢুকবে! ওরাই তো এখন এই বাড়ির হর্তাকর্তা, পাহারাদার ঠিক তখনই আওয়াজটার তীব্রতা আমাকে জানান দিল, সেটার দূরত্ব ক্রমশ কমছে এদিকে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে আলোর তরোয়াল মাঝেমধ্যেই আকাশের বুক চিরে ঝলসে দিচ্ছে অন্ধকারের ঔদ্ধত্যকে
খস্ খস্... খস্ খস্... পর পর বেশ কয়েকবার আওয়াজটাকে স্পষ্ট অনুভব করে উঠে বসলাম আমি এবার যেন আমার মনে হল, আওয়াজটা ইঁদুরের নয় মৃদু হলেও শব্দটার তীক্ষ্ণতা কোনো মানুষের পায়ের শব্দের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে ভাবতেই আমার সারাটা শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল বাবার মৃত্যুর পর, এই বাড়িতে একবারের জন্যও একা রাত কাটাইনি আমি দিনের বেলাতেও একা আসিনি তবে কি...?
মনের দ্বন্দ্বগুলোকে দূর করতে মাথাটা এদিক ওদিক করে একবার পুরো ঘরটায় দৃষ্টি বোলাবার চেষ্টা করলাম এমন সময় সামনের একটা দৃশ্য আমার সমস্ত অস্তিত্বকে চলনহীন জড় পদার্থে পরিণত করে দিল আমার চোখের মণিজুড়ে তখন সোফার উপর রাখা ব্যাগটার পাশের অবয়বটা ঘোরাফেরা করছে ‘কে’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে টের পেলাম আমার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে পায়ের শব্দটা এবার আরও নিকটবর্তী হতে থাকল খুব ধীর গতিতে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকল শীতল স্রোত হাত পা যেন মৃত মানুষের মতো বরফ হয়ে গেছে এমন সময় ডানদিকের জানলা দিয়ে গলে আসা বিদ্যুৎ চমকের রেখায় আঁতকে উঠলাম আমি শরীরের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে উঠে বসলাম একনাগাড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে আমি খেয়াল করলাম বাইরে ভোরের আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা দিয়েছে ঘর্মাক্ত শরীরে হঠাৎই টের পেলাম, সবটাই আমার স্বপ্নে দেখা অবাস্তবতা ছিল তারপর বিছানা থেকে উঠে অনেকটা জল ঢক ঢক করে খেয়ে আবার ঘুমাতে গেলাম
 
একটানা বাজতে থাকা ফোনের রিংয়ের শব্দে ঘুম ভাঙল আমার বাইরের দিকে চেয়ে দেখলাম, রাতের দুর্যোগ কেটে হালকা রোদের আলপনা ঢুকছে ঘরে
ফোনটা কানে দিয়ে ঘুমে জড়ানো গলায় বললাম, “বল সুদীপ্ত
“আরে কাল অফিস থেকে ফিরে দেখি লোডশেডিং ফোনে তেমন চার্জ ছিল না তাই সুইচড অফ হয়ে গিয়েছিল তার আগেই তোকে একবার কল করেছিলাম
“হ্যাঁ, ট্রেনটা তখন স্টেশনে ঢুকছিল, তাই আর তুলিনি,” সুদীপ্তকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
“আজ তো রবিবার ছুটির দিন আমাদের বাড়িতে চলে আয় দুপুরের খাওয়া সেরে বিকালের দিকে বেরিয়ে যাস বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মারা যাবে,” আন্তরিকতার সঙ্গে বলল সুদীপ্ত
“না রে, আজ ভাবছি একবার মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যাব আমার একটা আঁকার খাতায় অনেক অসম্পূর্ণ আঁকা...
“তুই কি সুমন্তবাবুর কথা বলছিস? প্রশ্ন করল সুদীপ্ত
মাস্টারমশাইয়ের আঁকার স্কুল ছিল বলে, কাছাকাছি সব পাড়ার ছেলেপিলেরাই এক ডাকে চিনত ওঁকে
“হ্যাঁ রে গতকাল আসার পথে ওঁর সঙ্গে স্টেশনে দেখা হয়েছিল টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছিল
“দাঁড়া, দাঁড়া তুই কী বলছিস, একটু খুলে বল তো তোর সঙ্গে সুমন্ত মাস্টারমশাইয়ের দেখা হয়েছিল?” আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল সুদীপ্ত ওর গলায় একরাশ বিস্ময়
“হ্যাঁ রে,” সাবলীল গলায় বললাম আমি
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নাকি চোখের পাওয়ার বেড়েছে? কাকে দেখতে গিয়ে কাকে দেখেছিস...
এবার কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম আমি, “আমার মাথা চোখ সবই ঠিক আছে মাস্টারমশাই বললেন, ওঁর স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে আসবেন বলে স্টেশনে ওঁকে নিতে এসেছেন
“কে কাকে নিতে এসেছে? বলে ফোনের ওপারে ব্যাঙ্গাত্মক ইঙ্গিত দিল সুদীপ্ত
কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, “তোর কি মনে হচ্ছে, আমি তোর সঙ্গে মশকরা করছি?
“আরে ভাই রাগিস না যা সম্ভব নয়, তা বললে মশকরা করা ছাড়া আর কীই বা ভাবব বল?
কথাটা বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলতে থাকল সুদীপ্ত, “মাস্টারমশাইয়ের বউ দু’বছর হল মারা গিয়েছেন শুনেছিলাম বাপের বাড়িতে গিয়ে কী একটা কঠিন জ্বরে পড়ে হঠাৎ করেই মারা গিয়েছিলেন তারপর থেকে মাস্টারমশাইয়ের মাথায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল নিঃসন্তান দম্পতি একে অপরের মানসিক শারীরিক নির্ভরতা হয়ে বেঁচেছিলেন কাকিমা বাপের বাড়ি গেলে রাতের দিকে পৌনে এগারোটার ট্রেনে করে ফিরতেন বলে মাস্টারমশাইও প্রায় রোজ সেই সময় স্টেশনে গিয়ে বসতেন এই এক মাস আগে একদিন বোধ হয়, সে সময় স্টেশনে যেতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল পৌনে এগারোটার ট্রেনটা তখন স্টেশনে ঢুকবে ঢুকবে করছে সে সময় লাইন ক্রস করতে গিয়েই পড়ে গিয়ে... থেমে গেল সুদীপ্ত
এমন সময় জানলা দিয়ে আসা একটা আলগা হাওয়ায় আমার ড্রয়িং খাতার পাতাগুলো এলোমেলোভাবে উলটাতে লাগল খাতার শেষের দিকের ছবিগুলো দেখে দিনের আলোতেও আমার সারা শরীরে যেন শিহরণ খেলে গেল আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, খাতার একটি ছবিও আর অসম্পূর্ণ নেই
ফোনের ওপারে সুদীপ্ত বলেই চলেছে, “ঘটনাটা রেলের গার্ড সে সময় দূর থেকে দেখেছিলেন খবরাখবর হতেই ভোরের আগেই মাস্টারমশাইয়ের ছিন্নভিন্ন দেহটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল রেলের ডোমরা পুলিশও এসেছিল নাকি...”
এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদীপ্ত আমাকে বলল, “তুই ওঁর খুব প্রিয় ছাত্র ছিলি তাই হয়তো তোর সঙ্গে দেখা করতেই কাল...
কথাটা শুনে আমার হঠাৎই মনে পড়ে গেল ভোর-রাতের স্বপ্নটার কথা মাস্টারমশাই আমার বিছানার কাছে এই খাতাটির দিকে যখন আসছিলেন, ওঁর বাঁ হাতে কী একটা বই ছিল যেন!
“তুই ফোন রাখ সুদীপ্ত আমি পরে কল করছি,” বলে চটজলদি বিছানা থেকে উঠে সোফার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি ওখানে রাখা আমার ব্যাগটার চেন খুলে দেখলাম আমার কভার ডিজানিং করা কবিতার বইটা আর নেই ব্যাগের এপাশ ওপাশের ছোটো বড়ো সব চেনগুলোকে এক এক করে খুলে চেক করার পর ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম আমি মনে পড়ে গেল বহু বছর আগে মাস্টারমশাইয়ের বলা কথাগুলো...
“দেখবে একদিন কতজন তোমার আঁকা ভালোবেসে হাতে তুলে নেবে তখন আমায় এক কপি দেবে তো? ভুলে যাবে না তো?
বড্ড ভুল করে ফেলেছিলাম আমি কাল স্টেশনেই মাস্টারমশাইয়ের হাতে বইটা তুলে দেওয়া উচিত ছিল আর যাই হোক, এটা তো বুঝতেই পারছি কাল আমার সঙ্গে দেখা করতেই তো এসেছিলেন মানুষটা ভাবতেই মুহূর্তে শিউরে উঠলাম আমি
----------
ছবি – অতনু দেব

No comments:

Post a Comment