যত
কাণ্ড মিল নিয়ে
চিত্ত
ঘোষাল
আমাদের মতো
বুড়োরা – তোমাদের ঠাকুরদা-দাদুরা – কে না ছেলেবেলায় দু-চারটে পদ্য লিখেছে! তোমাদের
বাবা-কাকা-জেঠু-মাসি-পিসিরাও লিখেছে, তোমরাও লিখছ। লিখতে লিখতে কেউ কেউ কবি হয়েছে,
ছড়াদার হয়েছে। সবাই হয়নি ভাগ্যিস! সবাই লিখলে পড়বে কে?
তোমরা দেখেছ
অনেক কবিতা-ছড়ার পর পর দুটো লাইনের শেষে একটা শব্দের মিল থাকে, যার জন্যে
কবিতা-ছড়া শুনতে এত মিষ্টি হয়। একে বলে অন্ত্যমিল। অন্ত্য মানে শেষ। তাহলে
অন্ত্যমিল হল শেষের মিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মালা’ কবিতা থেকে কয়েকটা লাইন তুলে
আমরা বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
আষাঢ়
শ্রাবণ অবশেষে
গেল
ভেসে
ছিন্নমেঘের
পালে
গুরু
গুরু মৃদঙ্গ তার বাজিয়ে দিয়ে আমার গানের তালে।
এইবার
দ্যাখো এক নম্বর লাইনের শেষ শব্দ ‘অবশেষে’ আর দু’নম্বর লাইনের শেষ শব্দ ‘ভেসে’ এক
রকম একটা মিলের সুর নিয়ে আসে কানে। আবার তিন নম্বর লাইনের শেষ শব্দ ‘পালে’ আর চার
নম্বর লাইনের শেষ শব্দ ‘তালে’-র ব্যাপারেও একই কাণ্ড। একেই বলে অন্ত্যমিল।
এখন কথা
হচ্ছে কবি কী করে এটা ঘটায় তা আমরা বোঝার চেষ্টা করি। শেষ শব্দের শেষ বর্ণটির
ধ্বনি মিলতেই হবে। যেমন এক নম্বর লাইনের ‘ষে’-এর সঙ্গে দু’নম্বর লাইনের ‘সে’। আবার
তিন নম্বর লাইনের ‘লে’-এর সঙ্গে চার নম্বর লাইনের ‘লে’।
এ কাজটা
করার সময় কবিকে খেয়াল রাখতে হয় যেন সে সমান বা প্রায়-সমান উচ্চারণের বর্ণ ব্যবহার
করে। যেমন প-এর সঙ্গে প তো চলবেই, ফ-ও চলবে। ক-এর সঙ্গে খ-ও চলে, ব-এর সঙ্গে ভ, এই
রকম আর কী।
আর-একটা
দরকারি কথা বলি। এক নম্বর লাইনের ‘অবশেষে’-এর সঙ্গে দু’নম্বর লাইনের ‘ভেসে’ যে
সুন্দর সুর-তাল কানে নিয়ে এল তা কিন্তু ‘ভেসে’-এর জায়গায় ‘ভাসে’ লিখলে হবে না। কেন
এমনটা হয়? ব্যাপারটা ভারী মজার। শুধু শেষ বর্ণটির ধ্বনির মিল হলেই হবে না, তার
আগের বর্ণটির সঙ্গে যুক্ত স্বরধ্বনিরও মিল থাকতে হবে। যেমন ‘ভে’ কী করে হয়? ভ+এ
তো? তাহলে ‘ভেসে’ হল ভ+এ+সে। সেই রকমে ‘ভাসে’ হল ভ+আ+সে। দ্বিতীয়
লাইনের ‘ভে’-র এ, আগের লাইনের ‘ষে’-র এ-এর সঙ্গে মিলে সুন্দর একটা
সুরতাল তৈরি করল। এ-র জায়গায় আ আনলেই আর সুরতাল থাকবে না। কী মজার
কাণ্ড!
মিল নিয়ে
আরও অনেক কথা আছে। বড়ো হয়ে জানবে। এখন যেটুকু আমরা
জানলাম তা-ই দিয়ে আমি একটা পদ্য লেখার চেষ্টা করি। হেসো না, প্লিজ।
আকাশে
উড়ছিল একটা চিল
মারলাম
ছুড়ে একটা ঢিল,
লাগল
না তার গায়ে
পড়ল
এসে বড়ো কাকুর টাকে
পা
ছড়িয়ে বড়ো কাকু কাঁদতে কাঁদতে
মাকে
কেবল ডাকে।
বেশ বুঝতে
পারছি তোমরা মুখ টিপে টিপে হাসছ। কী আর করব ভাই, সেই ক্লাস ফাইভে পড়বার সময়
দু-চারটে লিখেছিলাম। তারপর আশি বছর বাদে আজ আবার লিখলাম একটা। যতই হাস, মিলের ভুল
কিন্তু পাবে না।
মিল নিয়ে
একটা গল্প বলে আজকের মিলনমেলা শেষ করব।
আমাদের
সঙ্গে পড়ত ভুনটু – মহা বিচ্ছু ছেলে। দুষ্টু দুষ্টু বুদ্ধিতে মাথাটা ছিল ঠাসা।
বাংলার মাস্টারমশাই রবিবাবু পড়ার বইয়ের বাইরের অনেক জিনিসও আমাদের শেখাতে চেষ্টা
করতেন। একদিন অন্ত্যমিল নিয়ে আমাদের একটু একটু শিখিয়ে বললেন, “এবার তোরা একটা ছড়া
লেখ, যার প্রথম লাইনের শেষ শব্দটা হবে ‘নীলিমা’। নীলিমার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে
লিখতে হবে। আচ্ছা, প্রথম লাইনটা আমি বলে দিচ্ছি। আহা কী সুন্দর আকাশের নীলিমা।
লেখ, তোরা...”
আমরা মাথার
চুল ছিঁড়ছি, পেনসিল কামড়াচ্ছি। লেখা এগোচ্ছে না এক লাইনও।
হঠাৎ উঠে
দাঁড়াল ভুনটু, “হয়ে গেছে স্যার।”
“বাঃ বাঃ,
পড় শুনি,” রবিবাবু স্যার খুশি হয়ে বললেন।
ভুনটু পড়তে
শুরু করল –
আহা
কী সুন্দর আকাশের নীলিমা
কেলে
কেলে মেঘ এসে করে দিল কালী-মা
তাই
দেখে ছুটে এল কাকিমা
তাকে
দেখে এসে গেল মাসিমা
তাকে
ডেকে নিয়ে এল জেঠিমা
দেখাদেখি
ছাদে ওঠে পিসিমা
তার
পিছু পিছু আসে মামিমা
সবার
পেছনে আসে দিদিমা...
- এই
পর্যন্ত হয়েছে স্যার।
রবি স্যার
হাসতে হাসতে বললেন, “বাঁদর কোথাকার। কোথা থেকে তোর মাথায় আসে এসব? আমাকে ঠাট্টা
করে লেখা হয়েছে বুঝি! কাছে আয়...”
“আসছি।
মারবেন না তো স্যার?” ভুনটু বলল।
“যদি
ঠাট্টার সঙ্গে মিলিয়ে একটা শব্দ বলতে পারিস তাহলে মারব না।”
“গাঁট্টা
স্যার,” চটপট উত্তর দিল ভুনটু।
“যাঃ,
এবারের মতো বেঁচে গেলি,” হেসে উঠলেন রবিস্যার।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment