দেশবিদেশের গল্প:: আফ্রিকার লোককথা: সব গল্পই আনানসি’র - পৌষালী চক্রবর্তী


আফ্রিকার লোককথাসব গল্পই আনানসি
পৌষালী চক্রবর্তী

গোড়ার কথা
আফ্রিকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রধান অঙ্গ হল কথ্য সংস্কৃতি। বিভিন্ন কাহিনি আর মিথকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে কথকতা বা গল্প বলার বিপুল ঐতিহ্য। এর মাধ্যমে চিরায়ত প্রজ্ঞা, সামাজিক বিধি ও আচরণাবলী, যা সমাজ গঠনের অন্যতম উপাদান, তা পরম্পরায় ব্যক্ত ও বাহিত হয়। মাকড়শা আনানসির কাহিনি তেমনই ঘানার আসান্তে জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্ভব হয়ে কথকতার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়েছে। প্রায় সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ানে আনানসির কাহিনি জনপ্রিয়। আনানসি একটি কৌশলী চরিত্র যে তার শঠ বুদ্ধি দিয়ে সব পরিস্থিতিতে বিজয়ী হতে চায়। যেহেতু খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাল বুনতে পারদর্শী মাকড়শাকে একটি কৌশলী, আত্মনির্ভর প্রাণী মনে করা হয়, তাই বিভিন্ন গল্পকথায় এর অবতারণা বলে মনে করা হয়। আমাদের গল্পটিতে বৃহত্তর আকান জনগোষ্ঠীর (যাদের মধ্যে আসান্তেরা অন্তর্ভুক্ত) সর্বোত্তম দেবতা ন্যহ্-মেহ্-র কাছ থেকে নিজের বুদ্ধিমত্তায় কীভাবে সব গল্প-কাহিনি নিজের অধিকারে আনল আনানসি, সেই কথা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে।


সব গল্পই আনানসি
অজ্ঞাতনামা
 
শুরুতে সব কাহিনি ও গল্পই আকাশের দেবতা ন্যহ্-মেহ্র অধিকারে ছিল, কিন্তু সেই যে আনানসি নামে আমাদের মাকড়শা খুড়োর (ক্যোয়াকু) আকাঙ্ক্ষা জাগল যে জগতে যত প্রচলিত গল্প আছে, সবের মালিক সে হবে আর ন্যহ্-মেহ্র কাছে গিয়ে সে সবগুলো কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিল।
আকাশের দেবতা বললেন, আমি গল্পগুলো বিক্রি করতেই চাই, কিন্তু তার দাম যে খুব বেশি। অনেক লোক আমার কাছে এসে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু তাদের দামে পোষায়নি। ধনী ও ক্ষমতাশালী পরিবারগুলোই দাম দিতে পারেনি। তোমার মনে হয়, তুমি পারবে?
আকাশের দেবতাকে উত্তরে আনানসি বলল,আমি পারব। কী দাম চান?
আকাশের দেবতা বললেন, আমার তিনটে জিনিস চাই। প্রথমেই ম্মোহ্-বোহ্-রোহ্ নামের ভীমরুলদের চাই। তারপর আমাকে এনে দিতে হবে সেই বিরাট ময়াল সাপ ওহ্-নী-নী-কে। তারপর চাই চিতা ওহ্-সে-বোহ্-কে। এগুলোর বিনিময়ে আমি তোমাকে সব গল্প বলার অধিকার বেচে দেব
আনানসি বলল, আমি ওদের এনে দেব


সে বাড়ি গিয়ে একটা পরিকল্পনা ছকলপ্রথমে সে লতানে গাছ থেকে একটা লাউ কেটে নিয়ে তাতে একটা ছোটো ফুটো করল। তারপর সে একটা বড়ো কালাবাশ বা বড়ো লাউখোলের পাত্র নিল, আর তাতে জল ভরল। কিছু জল নিজের গায়ে ঢালল, যাতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যায়। আর কিছুটা জল সে ভীমরুলদের গায়ে ছিটিয়ে দিল, যাতে তারাও ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে যায়। তারপর কালাবাশটা মাথার উপর এমনভাবে রাখল, যেন ঝড়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছে। আর চেঁচিয়ে ভীমরুলদের ডাকল, তোমরা কি মূর্খ? এই বৃষ্টির মধ্যে কেন থাকছ?
ভীমরুলরা বলল, আমরা কোথায় যাব?
এখানে, এই শুকনো লাউখোলের মধ্যে এসো, আনানসি বলল তাদের।
ভীমরুলরা তাকে ধন্যবাদ দিল, আর ছোট্ট ফুটো দিয়ে লাউয়ের মধ্যে ঢুকল। যখন শেষ ভীমরুলটা ঢুকে গেল, আনানসি একটা ঘাসের বল দিয়ে ফুটোর মুখ বন্ধ করে দিয়ে বলল,এইত্তো! কিন্তু তোমরা না সত্যিই মূর্খ!
সে লাউখোল ভর্তি ভীমরুল নিয়ে আকাশের দেবতা ন্যহ্-মেহ্র কাছে এল, দেবতা তাদের গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, আরও দুটো আনা বাকি আছে



আনানসি বনে ফিরে এসে বাঁশের একটা লম্বা খুঁটি আর কিছু শক্তপোক্ত লতাগাছ কাটল। তারপর সে নিজের মনে এইসব বকবক করতে করতে ময়াল ওহ্-নী-নীর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল, আমার বউটা বোকা। আমি বলছি, ময়াল লম্বা আর শক্তিশালী, কিন্তু আমার বউ বলে সে ছোটোখাটো আর দুবলা আমি তাকে বেশি সম্মান দিই। বউ তাকে কম সম্মান দেয়। সে ঠিক না আমি ঠিক? আমিই ঠিক, সে লম্বাই। আমি ঠিক, সে তো শক্তিশালী
ওহ্-নী-নী যখন শুনল, আনানসি নিজে নিজেই বকে চলছে, সে বলল, কেন তুমি এভাবে নিজের মনে তর্ক করছ?
মাকড়শা উত্তর দিল, এহ্ হে, আমার তো বউয়ের সঙ্গে বাকবিতন্ডা চলছে বউ বলছে তুমি এই বাঁশের খুঁটিটার থেকে ছোটো আর দুর্বল। আমি বলছি তুমি লম্বা আর শক্তিশালী
ওহ্-নী-নী বলল, যখন তুমি নিজেই সত্যিটা যাচাই করে নিতে পার, এই তর্কাতর্কির তো কোনো মানেই হয় না। খুঁটি আনো, আমরা মেপে নিই
তখন, আনানসি খুঁটিটা মাটিতে রাখল, আর ময়ালটা খুঁটির পাশে এসে টানটান হল।
আনানসি বলল, তোমাকে সামান্যই ছোটো মনে হচ্ছে
ময়াল আর টানটান করল নিজেকে।
আর একটু, আনানসি বলল।
ওহ্-নী-নী বলল, আমি আর প্রসারিত হতে পারব না
আনানসি বলল, যখন তুমি এক প্রান্তে প্রসারিত হচ্ছ, অন্য প্রান্তে তখন গুটিয়ে ছোটো হয়ে আসছ। এসো, তুমি যাতে হড়কে না যাও, তাই তোমার সামনের দিকটা বেঁধে দিই।”
সে ওহ্-নী-নীর মাথার দিক খুঁটিতে বেঁধে নিল। তারপর অন্য প্রান্তে গিয়ে লেজটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল। যতক্ষণ না ময়াল সাপটা আর নড়তে চড়তে পারল, সে লতাগাছ দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে ওহ্-নী-নীর সারা শরীর বাঁধতে থাকল।
আনানসি বলল, ওহ্-নী-নী, দেখা যাচ্ছে আমার বউই ঠিক, আমিই ভুল ছিলাম। তুমি খুঁটিটার থেকে খাটো আর দুর্বল। আমার ভাবনা অবশ্য বউয়ের মতো ছিল না, কিন্তু তুমি আমার ভাবনার থেকেও বোকা, আর তাই দেখো, এখন আমার হাতে বন্দি।”
আনানসি ময়ালটাকে আকাশের দেবতা ন্যহ্-মেহ্র কাছে বয়ে আনল। দেবতা বললেন, আরও একটা বাকি আছে


এরপর হচ্ছে চিতাবাঘ ওহ্-সে-বোহ্-এর পালা। আনানসি বনের মধ্যে গেল আর যেখানে চিতাবাঘ ঘুরে ফিরে বেড়াত, সেখানে একটা গভীর গর্ত খুঁড়ে রাখল। ছোটো ছোটো ডালপালা আর পাতা দিয়ে গর্তটা ঢেকে দিয়ে তার ওপর এমনভাবে ধুলো ছড়িয়ে দিল, যাতে কেউ আর বলতে না পারে কোথায় গর্তটা ছিল। আনানসি সরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। মিশকালো রাত্তিরে ওহ্-সে-বোহ্ যখন শিকারের আশায় এল, সে আনানসির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলল, আর নিচে পড়ে গেল। চিতাবাঘের পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে আনানসি বলল, হায় রে, ওহ্-সে-বোহ্, তুমি হাফ-বোকা
ভোর হলে আনানসি গর্তের কাছে গেল, আর চিতাবাঘটাকে ওর মধ্যে দেখতে পেল।
সে জিজ্ঞেস করল,ওহ্-সে-বোহ্, তুমি এই গাড্ডার মধ্যে কী করছ?
আমি ফাঁদে পড়েছি,” ওহ্-সে-বোহ্ কাকুতিমিনতি করে বলল, আমাকে বার কর
তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুবই আনন্দ পেতাম,” আনানসি বলে উঠল, কিন্তু আমি নিশ্চিত, তোমাকে বাইরে আনলেই আমার আর কোনো দাম থাকবে না। তোমার খিদে পাবে, আর তারপর তুমি আমাকে আর আমার বাচ্চাদের খেতে চাইবে
ওহ্-সে-বোহ্ বলল, আমি দিব্যি করে বলছি, এরকম কিছু ঘটবে না
খুব ভালো। তুমি যেহেতু শপথ করছ, আমি তোমাকে বার করে আনব, আনানসি বলল।
সে একটা লম্বা, সবুজ গাছকে এমনভাবে বাঁকাল, যাতে গাছের ডগাটা ঠিক গাড্ডার ওপরে থাকে; আর এভাবেই সে ওটাকে বাঁধল। তারপর সে গাছের ডগায় একটা দড়ি বাঁধল, আর তার অন্য প্রান্তটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিল
এটা তোমার লেজে বাঁধো, বলল সে।
ওহ্-সে-বোহ্ দড়িটা লেজে বেঁধে নিল।
আনানসি জিজ্ঞেস করল,শক্ত করে বেঁধেছ তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শক্ত করে বেঁধেছি,চিতা উত্তর দিল।
আনানসি বলল, তাহলে তুমি শুধু হাফ-বোকা নও, তুমি গন্ডমূর্খ
তখন সে ছুরি বার করে, অন্য দড়ি যেটা গাছটিকে মাটির দিকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে রেখেছিল, সেটা কেটে দিল। গাছটা ওহ্-সে-বোহ্-কে গর্ত থেকে টেনে বার করে নিয়ে এক ঝটকায় সোজা হয়ে গেল। চিতা তো হেঁটমুন্ড ঊর্দ্ধপদ হয়ে শূন্যে ঝুলতে লাগল, এদিক ওদিকে দুলতে আর পাক খেতে থাকল। যখন সে এভাবে ঝুলছে, আনানসি নিজের অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যা করল।

তারপর সে চিতাবাঘের দেহটা আকাশের দেবতা ন্যহ্-মেহ্র কাছে বয়ে এনে বলল, এই হল তৃতীয়টা। এবার আমি কিন্তু আপনার পুরো দাম চুকিয়ে দিলাম
ন্যহ্-মেহ্ তাকে বলল, আনানসি খুড়ো, মহান যোদ্ধা আর মুখিয়ারাও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ পারেননি। তুমি পারলে। তাই আমি তোমাকে সব কাহিনিই দিয়ে দেব। আজকের পর থেকে, সমস্ত গল্পের উপর তোমার অধিকার থাকবে। যখনই কোনো মানুষ কোনো গল্প বলবে, সে সেই গল্পকে আনানসির গল্প বলে স্বীকৃতি দেবে
এভাবেই, যা যা গল্প বলা হল, সেই সব গল্পের অধিকারী হয়ে উঠল মাকড়শা আনানসি। এই সব কাহিনিই আনানসির।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment