আমার প্রথম অভিনয়
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
বাড়ির সামনের বাগানটাতে বসে
বসে চুইংগাম চিবোচ্ছি, অমনি দেখি এসে উপস্থিত বটতলার
দার্শনিক ছাগলটা।
বলল, “গালে
হাত দিয়ে কী এত ভাবছ?”
বললাম, “ম্যাজিক
ল্যাম্পের ‘আমার গল্প’
সংখ্যায় একটা গল্প লিখব ভাবছি।”
“আমার গল্প সংখ্যা? সে
আবার কেমন?”
“কেমন মানে? ‘আমার
গল্প’ - মানে গল্প লিখতে হবে উত্তম পুরুষে। উত্তম পুরুষ জানো তো?”
“তা জানব না আবার! রোজই তুমি
স্যারের কাছে উত্তম-মধ্যম খাও, জানলা দিয়ে দেখি তো।”
“তুমি না আমার বন্ধু! আমি
উত্তম-মধ্যম
খাই আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখ?”
“তা কী করব বলো? তুমিও
তো স্কুলের জানলা দিয়ে মাঠে হেডস্যারের ছাগল তাড়ানো দেখ।”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “হেডস্যার
যে খুব খারাপ তা তো আগেই বলেছি। ছাত্র আর ছাগল তাড়ান বলেই তো ওঁকে আমরা ছাতা স্যার
বলি। যাক গে যাক, কী থেকে কী। উত্তম
পুরুষে গল্প লেখার কথা হচ্ছিল।”
“উত্তম পুরুষ বললেই আমার
উত্তম কুমারের কথা মনে পড়ে।”
“যাহ! তুমি উত্তম কুমারকে
দেখেছ নাকি?”
“দেখব না! আলবাত দেখেছি।”
“হতেই পারে না।
তোমার বয়স কত?
ছাগল কতদিন বাঁচে?”
বলেই আমি হিসেব করতে বসলাম।
“তা জানি না কত বয়স। যবে থেকে
চোখ খুলল, সূর্য উঠছে ঘাস খাচ্ছি ঘুমোচ্ছি সূর্য ডুবছে, আবার পরদিন
সূর্য উঠছে...”
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “থাক
থাক, কীভাবে
দেখলে সেটাই বলো।”
“‘একটি রাত’ সিনেমায় যে কুকুরটা
ঝুনু সোনার অভিনয় করেছিল সে আমার বাবার দূর সম্পর্কের পিসি। তারই সঙ্গে দেখতে
গিয়েছিলাম।”
“ছাগলের পিসি কুকুর?”
“বেড়াল বাঘের মাসি হতে পারে
আর ছাগলের পিসি কুকুর হতে পারে না? বললামই তো দূর সম্পর্কের।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তারপর কী হল?”
“তারপর আর কী? শ্যুটিং-এর
শেষে যখন সবাই কচি পাঁঠা চাই, কচি পাঁঠা চাই করে হাঁক পাড়ল, পিসি
বলল,
বুবুন তুই পালিয়ে যা, পালিয়ে যা।”
“তোমার নাম বুঝি বুবুন?”
“আমার অনেক নাম।”
“তা উত্তম কুমারকে কেমন দেখলে
বলো?”
“মিথ্যে বলব না, নাকটা একটু
খ্যাঁদা, কিন্তু হাসিটা বেজায় ভালো। তোমার চেহারার সঙ্গে চোখ, কান, গাল
বাদ দিয়ে অনেকটাই মিল।”
“সত্যি বলছ? আমারও
খুব শখ ছিল জানো অভিনয় করার। তা একদিন ছোড়দার খুব ডাইরেক্টর হবার সাধ হল হঠাৎ করে।
আমাকে বলল, ‘অপু
তোর জন্য একটা ভালো রোল আছে। শর্ট ফিল্ম।
ইউটিউবে রিলিজ করব।’
“আমি তো ভীষণ উত্তেজিত,
কিন্তু তবুও লজ্জা লজ্জা করে বললাম, ‘সত্যি বলছ? আমি তো একেবারে
অর্ডিনারি,
সাধারণ দেখতে। আমাকে দিয়ে কি চলবে?’
“ছোড়দা জোর দিয়ে বলল, ‘আরে
অর্ডিনারিই চাই। নইলে তো উলটোডাঙার স্বপন হালদারকে বলতাম। রিয়ালিস্টিক মুভি করছি
যে। একেবারে ফেল করে করে বেহাল হয়ে গেছে এরকম একটা চেহারা। হতাশায় ডুবে
যাওয়া। ক্লাস এইটে ফেল করে নায়ক আত্মহত্যা
করতে যায়। তখন তার প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম হওয়া বুদ্ধিমান ছোড়দা তাকে আশ্বস্ত করে
বলে – শোন, এটাই জীবনের শেষ নয়। ছোড়দার রোলটা স্বপন হালদারকে দেব। ছোকরা
শ-পাঁচেক টাকা চাইছে, সে দিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ইনস্পায়ারিং রোল যে করবে তাকে তো
সুন্দর হতেই হবে।’
“আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘যাহ!
তাহলে তো স্বপন হালদারই হিরো।’
“ছোড়দা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দ্যাখ
অপু, তুই সিনেমার কিস্যু বুঝিস না সেটা বুঝতেই পারছি। রোলটা করলে একটা এগ চিকেন
রোলও তোকে খাওয়াতে পারি, কিন্তু না করলে তোদের স্কুলে কি গবা ছেলে কম আছে নাকি? ঠিক
হিরো পেয়ে যাব।’
“আমি শেষমেষ অনেক ভেবেচিন্তে
রাজি হয়ে গেলাম।
“ছোড়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেকাপ-টেকাপ
লাগবে না?’
“ছোড়দা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না,
একদম ঠিক আছে, বরং গলায় গালে যে সাদা সাদা পাউডার লাগিয়ে এসেছিস বেশ বোঝা যাচ্ছে।
মুখটা ধুয়ে আয়।’
তারপর হাত দিয়ে চুলটা এলোমেলো
করে দিয়ে বলল, ‘এবার বেশ লাগছে। মোবাইলেই
শ্যুট করব, বুঝলি। মোবাইলে মুভি তৈরি করে সেটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অবধি প্রাইজ
পেয়ে যাচ্ছে,
আমারটাও পাবে। খালি রিলিজ হতে যা দেরি। মুভির
নাম রেখেছি – ‘পাশ
না ফেল’, দিয়ে
কোয়েশ্চেন মার্ক। দর্শক একটা প্রশ্ন নিয়ে দেখা শুরু করবে। তাতে আগ্রহটা বজায় থাকবে।’
‘আর আমার নাম কী হবে?’
‘অপু, তোর নাম
অপুই থাকবে। বেশ পয়মন্ত নাম। এখন খালি স্বপন হালদার এলেই হয়। আজই তো আসতে বলেছি।
ব্যাটার পাত্তা নেই।’
“সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি
ছোড়দার নির্দেশে, শুধু কয়েকটা শুকনো মুড়ি চিবিয়েছি, নইলে নাকি ফিল আসবে না দৃশ্যে।
তা সেই স্বপন হালদার এল সেই বিকেলবেলা। রোগা চেহারা, সরু গোঁফ।
এই নাকি দারুণ। এমন কী ভালো দেখতে?
“ছোড়দা বলল, ‘আবৃত্তি
করে। গান গায়,
ছবি আঁকে,
ভরতনাট্যম জানে।’
“ছোড়দা আমাদের ডায়ালগ বুঝিয়ে
দিল। শ্যুটিং হবে ছাতের ওপর।
“আমার একটাই ডায়ালগ –
‘দাদা আমি মরতে চাই।’
“আর স্বপন বলবে, ‘না
অপু না। এ কেমন কথা? জীবনে এমনভাবে হেরে গেলে চলে না।’
“কিন্তু সে যে কী সমস্যা।
স্বপন হালদার যতবারই সংলাপ বলে, ছোড়দা বলে, ‘হচ্ছে
না স্বপন। হচ্ছে না। অতিনাটুকে হয়ে যাচ্ছে। ওই শেষের
না-টা নাআআআ করে টানছ কেন? এটা কি যাত্রা? আর অপু... ‘মরতে চাই’ - এটাই তো
মেজর লাইন। এখানে ইমোশন কই গেল তোর? ‘মরতে চাই’ কথাটা একশো বার আয়নার
সামনে প্র্যাকটিস করতে বলেছিলাম। র আর ড়-এর উচ্চারণ তো তোর ঠিকই হল না। জিভটা এত
আড়ষ্ট কেন?’
“এইরকম বার চারেক হওয়ার পরেই
দেখি স্বপন হালদার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, ‘এই নাও
তোমাদের পাঁচশো টাকা। এমন অপমান আমার আগে কখনও হয়নি।’ বলে দুম দুম
করে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল।
“‘যাহ,’ বলে ছোড়দা
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।
“পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ছোড়দা
আমাকে বলল, ‘অপু, দারুণ প্লট পেয়েছি, এখানে তোকে আর কোনো সংলাপই বলতে হবে না। তুই
অলরেডি মরে গেছিস। সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছিস। বাকিটা পুরোটাই আমি বলে দেব।’”
এতটা বলার পর দেখলাম ছাগলটা
ঘুমিয়ে গেছে। নাঃ, এই গল্পটা পাঠালে পাঁঠা যখন ঘুমিয়ে পড়ল পাঠক মনে হয় ঘুমিয়েই
পড়বে।
দীর্ঘশ্বাস।
----------
ছবি – সুমিত রায়
ছবি – সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment