গল্পের ম্যাজিক:: নিঃশ্বাস - অরিন্দম ঘোষ


নিঃশ্বাস
অরিন্দম ঘোষ

বিগত কদিন ধরেই গরমটা পড়েছিল অসহ্যরকম, চৈত্রের শেষ সপ্তাহে এমন গরম অবশ্য পড়তে দেখেছি অন্য অন্য বছরেও অনেক বার মনটা তখন সব সময় কামনা করতে থাকে একটা আকাশ কালো করা বৃষ্টির জন্যে কিন্তু আজকের আকাশটা কেমন যেন থম মেরে আছে, গুমোট গরম, সেই সঙ্গে গাছের একটা পাতাও নড়ছে না হাওয়ায় রোজকার অভ্যাসমতো বিকালে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম চওড়া হাতল দেওয়া ইজিচেয়ারটায়, রাস্তায় মানুষজনের, গাড়ির চলাচল দেখছি স্ত্রী এসে চায়ের কাপটা চেয়ারের হাতলের উপর রেখে চলে গেল প্রতিদিনের মতো গরম চা-টা দেখেও খেতে ইচ্ছে করছে না যেন, এর বদলে এক গ্লাস শরবত পেলে যেন শরীরটা ঠান্ডা হত মনে হয়
তারপর হঠাৎ করেই সে এল, যার জন্যে গত কয়েকটা দিন অধীর অপেক্ষায় ছিলাম, সেই কালবৈশাখী ঈশান কোণটা কালো হয়ে ছিল দুপুর থেকেই, কখন সেটা পলকের মধ্যে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল খেয়াল করতে পারিনি হঠাৎ করেই পর পর দুটো বাজ পড়ার প্রচণ্ড আওয়াজ, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এল মুষলধারে বৃষ্টি শুকনো মাটিতে জল পড়ে হালকা ধোঁয়ার মতো উঠতে লাগল, আর অদ্ভুত একটা মন ভালো করে দেওয়া সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে তখনই এল ঝমঝমিয়ে শিলাবৃষ্টি এমন শিলাবৃষ্টি অনেক দিন হয়নি এক মুহূর্তের মধ্যেই রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা পাশের বাড়ির দোতলার ছাদের কিছুটা টিনের শেড দেওয়া আছে, সেখানে শিলাবৃষ্টির দাপটে কান পাতা দায় সামনের বাড়িতে দুটো বাচ্ছা ছেলে থাকে, ওরা দোতলার ব্যালকনিতে আনন্দে লাফাচ্ছে এইরকম শিলাবৃষ্টি ওরা আগে দেখেছে বলে মনে হয় না ছিটকে ভেতরে ঢুকে আসা বরফকুচিগুলো ছুটে ছুটে গিয়ে কুড়োচ্ছে দু’জনে ওদের বাবা একটা ছাতা নিয়ে এসে ব্যালকনির বাইরে উলটো করে মেলে ধরে, মুহূর্তের মধ্যে জমা হয়ে গেল তাতে কিছু বরফ ছাতাটা ঢুকিয়ে আনতেই দু’ভাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল, বাবাহাঁ হাঁকরে চেঁচিয়ে বারণ করার আগেই টপাটপ মুখে তুলতে লাগল দু’জনে বরফগুলো ওদের কাণ্ড দেখে আমারও যেন ইচ্ছে করছিল হঠাৎ যদি কোনোভাবে আবার একবার ছোটোবেলার দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া যায় পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল সেই ভীষণ স্মৃতি

ছেলেবেলার শিলাবৃষ্টির অনেকগুলো স্মৃতি আজও মনে আছে, কিন্তু ভাবতে বসলে সবগুলো রোমাঞ্চকে যেন পিছে ফেলে দেয় একটা অদ্ভুত ঘটনা এখনও মনে আছে সেদিন ছিল শনিবার, আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি স্কুল ছুটির পর আমাদের সুরেন্দ্রমোহন হাই স্কুলের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ ছিল সেদিন ম্যাচ শেষ হল যখন, দেখি আকাশ কালো হয়ে এসেছে আমি আর সঞ্জয় খেলা শেষ হতেই তাড়াতাড়ি জার্সি প্যান্ট বদলে রওনা হলাম বাড়ির দিকে সঞ্জয় আর আমার বাড়ি একই পাড়ায়, কিন্তু সেটা স্কুল থেকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে, হেঁটে যেতে আধ ঘন্টার বেশি লেগে যেত আর তখন আমরা এ রাস্তাটা রোজ হেঁটেই যাতায়াত করতাম দুই বেলা
কিছু দূর এগিয়েছি মাত্র, আধা রাস্তাও নয়, এমন সময় এসে গেল ঝড় চোখ মুখ ধুলোবালিতে ভরে গেল পলকের মধ্যেই দু’জনেই বুঝলাম আর এগিয়ে লাভ নেই, পুরো ভিজতে হবে তাহলে তাই এখানেই কোথাও মাথা গুঁজে দাঁড়ানো দরকার রিচার্ড সাহেবের বাংলো বলে একটা পুরোনো আধভাঙা পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল ঐখানেই সঞ্জয় ওদিকে ছুটতে যেতেই আমি ওর কনুইটা খামচে ধরলাম বাড়িটাতে বহু দিন কেউ থাকে না, তবু নাকি রাতে নানা ধরনের আওয়াজ শোনা যায়, সবাই বলত বাড়িটার ভূতুড়ে বলে বদনাম শুনেছিলাম, সেই জন্য এমনকি সকাল বেলাতেও রোজ আমরা দ্রুত পায়ে ঐ জায়গাটা পার হয়ে যেতাম সঞ্জয় বলল, “ভয় পাস না, ভূত বলে কিছু হয় না” তার পর আমার হাত ধরে বলল, “চল, ছোটবলতে বলতেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল আমরা দু’জন ব্যাগ দুটো  মাথায় চাপা দিয়ে এক ছুটে বাগান পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম বাড়িটার সদর দরজার সামনে মাথা ঢাকা জায়গাটায় আমরা ঢুকলাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হল শিল পড়া
জায়গাটা লম্বায় আট ফুটের মতো হবে, ওড়ায় বড়োজোর ফুট ছয়েকের বেশি নয় তার মধ্যে দেখি একটা কুকুর এর মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে এসে, তাই অন্য দিকটায় আমরা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে রইলাম পিছনের দিকে একটা পুরোনো জীর্ণ ভারী কাঠের দরজা, ভিতর বাড়ির সঙ্গে ঐ জায়গাটাকে আলাদা করে রেখেছে সেটার একটা পাল্লার নিচের দিকটা অনেকটা ভাঙা, সেখান দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে পাল্লা দুটোর কড়া একটা বহু পুরোনো বেশ বড়োসড়ো লোহার তালা দিয়ে আটকানো ছিল দমকা হাওয়ার ধাক্কাতে দরজাটা থর থর করে কেঁপে উঠছিল মাঝে মাঝে, মনে হচ্ছিল হয়তো তালা ভেঙে দিয়ে সেটা ছিটকে খুলে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে শিলাবৃষ্টির দাপটে কয়েক মিনিটের মধ্যেই জায়গাটার তাপমাত্রা বেশ খানিকটা ঠান্ডা হয়ে গেল বাইরেটা তখন প্রায় অন্ধকার, তার মধ্যেই বেশ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে ঘাস, মাটি, রাস্তা সব কিছু শিল জমা হয়ে সাদা হয়ে গেছে সেই সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ায় ভর করে বৃষ্টির ছাঁট আমাদের সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিল হঠাৎ সেই সময় একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল, স্পষ্ট মনে হল ওখানে আমরা দু’জন ছাড়া যেন আরও কেউ রয়েছে কেমন যেন একটা অন্যরকম গন্ধ আসতে লাগল কুকুরটা হঠাৎ করে কয়েকবার জোর গলায় ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল, তার পরেই তার স্বর নিচু হয়ে গেল লেজটা হঠাৎ পিছনের পা দুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে কেঁউ কেঁউ করে কয়েকবার ডাক দিল, তার পর ঊর্ধ্বশ্বাসে এই নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে ঐ প্রবল বৃষ্টির মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে গেল অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমাদের সারা শরীরের সমস্ত রোম যেন খাড়া হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে স্পষ্ট মনে হচ্ছিল ঐ ঠান্ডা বাতাস ভেদ করে ঘাড়ের কাছে যেন কার গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছি কান দুটো কেমন ভোঁ ভোঁ করতে লাগল দু’জনে একে অপরের হাত দুটো শক্ত করে ধরে আমরা চোখ বুজে ঠাকুরের নাম স্মরণ করতে লাগলাম পরক্ষণেই একটা তীব্র আলোর ঝলকানি আর কান ফাটানো আওয়াজের সঙ্গে আমাদের থেকে বড়োজোর দুশো মিটার দূরে সামনের বাগানের একটা শুকনো নারকেল গাছের মাথায় একটা বাজ পড়ল কড় কড় শব্দ করে চমকে চোখ খুলে দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে গাছটার মাথা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল
ঐ তীব্র আওয়াজে আর আতঙ্কে আমরা দু’জনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম তখনই জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আশেপাশে অনেক লোক ঘিরে আছে আমাদের তাদের মধ্যে কেউ নিশ্চয়ই আমাদের চিনত, তারাই আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি আমিসেদিন, জ্বর এসে গিয়েছিল রাতে সঞ্জয়ের অবস্থাও একইরকম
তার পর থেকে বেশ কিছু দিন পর অবধি আমি কিছুতেই একা থাকতে পারতাম না একা থাকলেই সেই সন্ধ্যার ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত, ঘাড়ের কাছে সেই গরম নিঃশ্বাসটা যেন পরিস্কারভাবে অনুভব করতে পারতাম জ্বর সারলে এরপর কিছু দিন ভয়ে একা স্কুল যেতে পারিনি, কাকা সাইকেল চাপিয়ে দিয়ে আসা নিয়ে আসা করত দুই বেলা পরের বছর স্কুল বদল করে দেয় বাবা

জানি না সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল বাড়িটার সম্বন্ধে আগে শোনা গল্পগুলো আর কুকুরটার হঠাৎ করে ঐরকম অস্বাভাবিক ভয় পাওয়াটাই আমাদের মনে অকারণে আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল কিনা জানি না কিন্তু আজ এত বছর পরেও ঐ দিনের কথা মনে পড়লে যেন সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায়, কান মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, আর ঘাড়ের কাছে যেন অনুভব করতে পারি সেদিনের সেই হালকা গরম নিঃশ্বাসটা
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল

No comments:

Post a Comment