অণুগল্প:: অমলবাবুর বন্ধু - সিদ্ধার্থ পাল


অমলবাবুর বন্ধু
সিদ্ধার্থ পাল

এ কী!
চমকে উঠলেন অমলবাবু। তাঁর চোখ আটকে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কামরূপ এক্সপ্রেসের এস১৩ কামরার দিকে। সামনের দরজা থেকে পাঁচটা জানালা পিছিয়ে এলে গরাদের ফাঁক দিয়ে যে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে, তাকে তিনি চেনেন। বাম গালের কুৎসিত জরুল, ভুরুর ওপরে কাটা দাগ, টিয়াপাখির ঠোঁটের মতন খাড়া নাক আর কোটরাগত দুটো চোখ। সবই মিলে যাচ্ছে। সমরেশ-কে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয় তাঁর। চকিতে নিজেকে গুটিয়ে বেঞ্চের পিছনে, প্ল্যাটফর্মের ধুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি। ট্রেনটা না যাওয়া পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মাঝেমধ্যে ভরদুপুরে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে এসে বসে থাকেন অমলবাবু। এখানে বেশিরভাগ সময় ঝ্যাং-ক্ল্যাং শব্দ করে মালগাড়িগুলো আসে। দু-একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ালেও বোতলে জল ভরার প্রয়োজন না থাকলে প্ল্যাটফর্মে কেউই সাধারণত নামে না। মিনিট পাঁচেকের হইচইয়ের পরেই শান্ত হয়ে যায় চারিদিক। ওভারব্রিজের মাথা ডিঙিয়ে রোদ্দুর মাখা আকাশে মনখারাপের ঘুড়ি যখন একলা একলা পাক খায় তখন চকচকে রেল লাইনগুলো যে কী লোভনীয় লাগে তা কেবলমাত্র অমলবাবুই বোঝেন। আজও তাঁর মন ভালো নেই। সকালে ভাড়াটে আর পাড়ার গুণ্ডারা মিলে দেদার গালিগালাজ, গলাধাক্কা উপহার দিয়েছে। দলিল না দিলে রাস্তায় ফেলে মারবে এরপরে। এমন নিঃসঙ্গ অসহায় পরিস্থিতিতে মানুষ বন্ধু খোঁজে। অথচ অমলবাবু বার বার মাথা ঝাঁকালেন। সমরেশ-কে তাঁর বেজায় ভয়। মা বলতেন, সে এলে বিপদ আরও বাড়ে।
ওকে শেষ দেখেছিলেন বছর চল্লিশ আগে। তিনসুকিয়া ছেড়ে চলে আসার সময় বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ টিপেছিল। অমলবাবুর বাবার চাকরি ছিল ডিগবয়ে। সেই সূত্রেই নর্থ আসামে বসবাস। মিশনারি স্কুলে চলত পড়াশোনা। কিন্তু কেউই মিশত না ওনার সঙ্গেবরং রাস্তাঘাটে ছেলেপুলেরা পিছনে লেগে অকারণে দুঃসহ করে তুলত বিকেলগুলো। সেই ঘরকুনো আঁধারেই একদিন হঠাৎ ছাদের সিঁড়িতে আলাপ হয়েছিল সমরেশের সঙ্গেএকেবারে বিপরীত স্বভাবের ছেলে। যত্রতত্র বেয়াড়াপনা করতে তার উৎসাহের কখনও ঘাটতি হত না। অবশ্যি এই চারিত্রিক বৈপরীত্যের জন্যেই হয়তো ওদের সখ্যতা এত গাঢ় হয়েছিল।
গোলমাল হল সেখানেই। তিনি যা পারতেন না, ও নিঃশব্দে সেরে আসত তা অবলীলায়। তাঁর কোনো বারণই কানে তুলত না সমরেশ। তবে ওর সকল দুষ্টুমির দায় অদ্ভুত ভাবে এসে পড়ত ওনার কাঁধেই। কঠিন সাজা পেয়েও মুখ খুলতেন না তিনি। স্থানীয় উপজাতি নেতার ছেলে দারুক বোরা একদিন ঢিল মেরে অমলের কপাল ফাটিয়ে দিল। তার দিন সাতেক পরেই কে যেন ছেলেটাকে পিছন থেকে বস্তায় পুরে জম্পেশ পেটাল টিঙরাই নদীর চরায়। স্বাভাবিকভাবেই ওরা দুষল কিশোর অমলকে। দাঙ্গা প্রায় বাঁধে বাঁধে। বেদম ঠ্যাঙানি খাওয়ার ভয়ে প্রথমবার বন্ধুর নাম ফাঁস করেছিলেন তিনি, কিন্তু কেউ সমরেশ-কে চিনল না। উলটে ডাক্তারজেঠু ওকে বললেন, ‘প্যাথলজিকাল লায়ারবাবা তাঁকে জলপাইগুড়িতে মামারবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। তারপরে বহু বছর কেটেছে। ঘুমিয়ে, ঝিমিয়ে মুছে গেছে অবশিষ্ট মেরুদণ্ড। বিস্মৃতির আড়ালে নিখোঁজ হয়েছে সমরেশও।
ঘন-ঘন দুবার হুইসেল দিয়ে ইঞ্জিন ড্রাইভার জানান দিল যে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। আবার হারিয়ে যাবে সমরেশ। তাকে শেষবারের মতো দেখবার আশায় অমলবাবু বেঞ্চের পিছন থেকে উঁকি দিলেন। আর তাতেই ওঁর বুক ধড়াস করে উঠল। জানালার রডে মুখ লাগিয়ে সোজাসুজি এইদিকেই চেয়ে রয়েছে সে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে লুকোচুরির কৌতুক।
পড়িমরি করে দৌড়ে নিকটস্থ শৌচালয়ে ঢুকে, দরজার আড়ালে দাঁড়ালেন অমলবাবু। ধরা পড়ে গেছেন তিনি। তবে দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকা হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তিনি অনুভব করলেন, মন খারাপ আর নেই। উলটোদিকে, আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছায়াতে রোজের মতো মুষড়ে পড়লেন না। দেখলেন, ফিরে এসেছে গর্তে ঢোকা চোখের উজ্জ্বলতা। বাম গালের জরুলটাকেও কুৎসিত দেখাচ্ছে না আর। সমরেশ নেমে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। এবারে নিশ্চিন্তি।।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment