গল্পের ম্যাজিক:: মনোরঞ্জন বাবুর ব্যারাম - সুরঞ্জনা মুখোপাধ্যায়


মনোরঞ্জন বাবুর ব্যারাম
সুরঞ্জনা মুখোপাধ্যায়

সোনা দাদু এবার বেশ অনেকদিন পর এলেন। আগে খুবই ঘন ঘন আসতেন, এখন সেটা কমে গিয়ে সপ্তাহে একবারে এসে দাঁড়িয়েছে। বললেই বলেন, “বয়স তো হচ্ছে রে, সব দিন কি আর সমান যায়? তবে আমি আর রিম্পি একরকম অলিখিত নিয়ম করে দিয়েছি দাদুকে, প্রত্যেক রবিবার সন্ধ্যায় আসতেই হবে, না হলে কঠোর সাজা হবে।
দাদু চুপ করে থেকে মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, “কী সাজা হবে একটু শুনি দিদিভাই?
আমি বেশ রাগি রাগি মুখ করে বলেছিলাম, “তাহলে পরের সপ্তাহে তোমাকে একটার জায়গায় দুটো গল্প বলতে হবে।”
দাদু বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন।
“কিন্তু আমি তো গল্প বলি না দিদিভাই, সবই তো আমার অভিজ্ঞতা। তাকে তোমরা বানানো গপ্প বললে আমি কিন্তু খুব দুঃখ পাব।”
তারপর থেকে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে কিনা কে জানে, দাদু নিয়মিতই আসছিলেন, গত সপ্তাহে শরীরটা হঠাৎ খারাপ হওয়ায় আসতে পারেননি। আজ কি তাকে সাজা দেওয়াটা ঠিক হবে?

সোনা দাদু আমার নিজের দাদু নন, বাবার দূর সম্পর্কের মামা। সোনা দাদুর পুরো নাম ডাঃ সমীর কুমার মুখোপাধ্যায়। মেডিকেল কলেজে থেকে পাশ করে পরে সেখানেই বহুদিন অধ্যাপনা করেছেন। কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ছিলেনবছর দশেক আগে রিটায়ার করেছেন, তারপরও বেশ কিছুদিন নিজের বাড়িতে চেম্বার করেছেন। সম্প্রতি সে সব ছেড়ে সারাদিন বইপত্র নিয়েই থাকেন।
সোনা দাদু এলেই আমাদের তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে নানারকম গল্প শোনান। কখনও এনাটমি হলের ক্যাডাভার ডিসেকসানের গল্প, কখনও বা মর্গের গল্প, আবার কখনও বা বিচিত্র সব পেশেন্টদের গল্প।
বলা বাহুল্য আমরা সেগুলো খুব উৎসাহ নিয়ে শুনি, আর উপভোগ করি। দাদুর ভাষায় আমরা তাঁর গুণমুগ্ধ শ্রোতা।
সোনা দাদু ঘরে এসে বসতেই মা এসে প্রতিদিনের মতো চা জলখাবার দিয়ে গেলেন। তার পর আমার দিকে ঘুরে বললেন, “রিম্পি ডিম্পি, দাদুর কিন্তু শরীর ভালো নেই, তোমরা আজ দাদুকে একদম বিরক্ত করবে না।”
এই কথাটা শুনেই আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রত্যেক সপ্তাহে এই একটা দিনের জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে বসে থাকি। হোমওয়ার্কগুলোও আগের থেকে করে রাখি যাতে রবিবার সন্ধ্যায় দাদুর কাছে গল্প শুনতে পারি। কিন্তু কী আর করা যাবে? একজন অসুস্থ মানুষকে তো আর জোর করা যায় না গল্প বলার জন্য।
রিম্পির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও আমার মতোই ব্যাজার মুখে বসে আছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ফিসফিস করে বলল, “অ্যাই দিদি, দাদু কি সত্যি আমাদের আজ গল্প বলবে না রে?
আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই দাদু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “আজ আমি তোদের একটা অদ্ভুত পেশেন্টের গল্প বলব। সারাজীবনে ওইরকম পেশেন্ট আমি আর দুটো পাইনি।”
আমরা দুই বোন উৎফুল্ল হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম। দাদু চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প আরম্ভ করলেন...
...
তখন আমার প্র্যাকটিস জীবনের একদম শুরুর দিক। খুব একটা পসার জমেনি তখনও। টুকটাক পেশেন্ট দেখছি, পড়াশোনা করছি। সেরকমই একদিন চেম্বার শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে সবে একটু শুয়েছি। সারাদিনের ক্লান্তির পর পেটে দুটো ভাত পড়তেই আরামে চোখ বুজে আসছিল।
হঠাৎ জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ঘুম গেল ভেঙেএত রাত্রে আবার কে এল? দরজা খুলতেই উদভ্রান্তের মতো এক ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। ভদ্রলোককে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। এ পাড়ায় নতুন হয়তো। বাইশ-তেইশ বছর বয়স, মুখশ্রী সুন্দর, তবে এখন বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছিটকিনি আটকে আমার পড়ার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা ঘরের মাঝখানে শব্দ করে টেনে নিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন। আমি তখন ভদ্রলোকের মতিগতি দেখে হতভম্ব, কিছুই বুঝতে পারছি না তিনি কী উদ্দেশ্য এসেছেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি থেমে থেমে বললেন, “একটা বিপদে পড়েছি ডাক্তারবাবু। আপনি বাঁচান।”
আমি তখনও চুপ করে আছি। ভদ্রলোক নিজেই সবটা বলবেন জানি, তার আগে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিচ্ছেন।
“এক গ্লাস জল হবে?
আমি ঘরের এক কোণে রাখা কলসি থেকে একটা গেলাসে জল ঢেলে দিলাম। এক নিঃশ্বাসে পুরো জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন।
“আমার নাম প্রভাত মজুমদার। একটা ছাপাখানায় কাজ করি, খুব বেশিদিন হয়নি কলকাতায় এসেছি। স্ত্রীকে নিয়ে একটু দূরে বাড়ি ভাড়া করে থাকি। বাবা-মা ছোটোবেলাতেই গত হয়েছেন, নিজের বলতে পিসিমা পিসেমশাই। দিন দুয়েক আগে আমার পিসেমশাই মনোরঞ্জন হালদার কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন, উনি বর্ধমানের একটি ইস্কুলে মাস্টারি করেন। আজ ভাবলাম সবাই মিলে একটু ভিক্টোরিয়া ঘুরে আসি, সেইমতো গেছিলামও। কিন্তু ফেরার পর থেকে পিসেমশাই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমার যে কী করণীয় কিছুই বুঝতে পারছি না।”
আমি তাকে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, “অত চিন্তা করবেন না। কী হয়েছে আপনার পিসেমশাই-এর?
উনি কেমন বিমর্ষভাবে বললেন, “এ কি আর সামান্য জ্বর সর্দি কাশি ডাক্তারবাবু? আসার পর থেকে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, আর সমানে প্রলাপ বকছেন। আমার স্ত্রীকে রানি ভিক্টোরিয়া বলে ডাকছেন, আর তাকে দেখলেই হাত জোড় করে প্রণাম করছেন। আমাকে বলেই চলেছেন রানির একটা মূর্তি বানিয়ে দে, আমি পুজো করব। পিসেমশাই-এর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি? আমার ব্যাপারটা একদম ভালো ঠেকছে না, আপনি শিগগির একবার চলুন ডাক্তারবাবু।”
হিপোক্রেটিক ওথ নিয়েছি, না গিয়ে উপায় নেই।
...
রিম্পি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হিপোক্রেটিক ওথ কী গো দাদু?
হিপোক্রেটিক ওথ কী আমি জানতাম। তাই গল্পের মাঝে ছেদ পড়ায় আমি একটু বিরক্ত হলাম। সোনা দাদু কিন্তু একটুও বিরক্ত হলেন না, বরং বেশ খুশিই হলেন। দাদুর বক্তব্য, গল্পের মাঝে শ্রোতা প্রশ্ন করার অর্থ হল সে বক্তার কথা মন দিয়ে শুনছে।
দাদু বেশ প্রসন্ন মুখে বলতে শুরু করলেন, “হিপোক্রেটিস-এর নাম শুনেছ? একজন প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে অপরিসীম অবদানের জন্য তাঁকে ‘ফাদার অফ্ মেডিসিন’ বলা হয়। প্রত্যেক ডাক্তারকেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পরে এক ধরণের শপথ নিতে হয়। একজন প্রকৃত ডাক্তারের ধর্ম কী হওয়া উচিত তাই আছে তাতে। ধারণা করা হয়, এটিও হিপোক্রেটিসেরই দেওয়া নিয়মাবলী। সংক্ষেপে বলতে গেলে তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, যে কোনো অবস্থায় ডাক্তারের কাছে সবার আগে রোগীর গুরুত্ব হওয়া উচিত। একেই হিপোক্রেটিক ওথ বলা হয়।”

দাদু আবার গল্পে ফিরে গেলেন, “আমি তখনই তৈরি হয়ে নিয়ে প্রভাতবাবুর সঙ্গে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি প্রভাতবাবু যা বিবরণ দিয়েছেন, মনোরঞ্জনবাবুর অবস্থা তার থেকেও খারাপ। ভদ্রলোক তার নাম-ধাম কিছুই মনে করতে পারছেন না, উন্মাদের মতো উলটোপালটা বকে যাচ্ছেন। পালস রেট চেক করে দেখলাম তা অস্বাভাবিক বেশি। প্রেসারও বেশি। কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলাম, আর কয়েকটা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বললাম। বেশি বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভরতি করতে বলে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলাম।”
এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থামলেন আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম, “তারপর?
“ভদ্রলোক এলেন আবার দু’দিন পরে। সেদিনের তাড়াহুড়োতে আমার ফিজ দিতে ভুলে গেছিলেন, বার বার মার্জনা চেয়ে নিয়ে তাই বাড়ি বয়ে এসেছেন ফিজ দিতে। মনোরঞ্জনবাবু কেমন আছেন জানতে চাওয়াতে বললেন ভালোই আছেন, পরদিনই বর্ধমানে ফিরে গেছেন। আগের দিনের কথা কিছুই মনে করতে পারছিলেন না। প্রভাতবাবু অবশ্য আমার করতে বলা সমস্ত পরীক্ষা করিয়েছেন পরের দিনই, রিপোর্টগুলো আমাকে দেখাতে এনেছিলেন। সেগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে সব রিপোর্ট নর্মাল দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।”
“পরে কি আর উনি ফিরে এসেছিলেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সোনা দাদুকে হঠাৎ বড্ড অন্যমনস্ক লাগছিল। স্মৃতিচারণ ‌করতে করতে যেন উনি ‌অতীতের দিনগুলোতে পৌঁছে গেছেন...
...
প্রভাতবাবু আবার এসেছিলেন মাস ছয়েক পর। এবারের ব্যাপার আরও গুরুতর। ওনারা সপরিবারে গিয়েছিলেন আগ্রা বেড়াতে। প্রভাতবাবুর স্ত্রীর অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল তাজমহল দেখার। ওনাদের সঙ্গে মনোরঞ্জনবাবুও গিয়েছিলেন। অনেকদিন পর বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন। খানিকক্ষণ ঘোরার পরে উনি অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন, তারপর সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর থেকে আবার প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন, নিজেকে শাহজাহান ভাবছেন আর তাঁর পিসিমাকে মমতাজ বলে ডাকছেন। আগ্রাতে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপাতি খেয়ে এখনও অবধি সুস্থ রয়েছেন ঠিকই, রিপোর্টও নর্মাল, তাও উনি আর ঝুঁকি নিতে চাননিতাই সেখান থেকে পিসেমশাইকে নিয়ে একেবারে কলকাতা চলে এসেছেন আমার কাছে দেখাবেন বলে। প্রথম সাক্ষাতের পরেই প্রভাতবাবুর মনে আমার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে যে মনোরঞ্জনবাবুকে কেউ যদি সম্পূর্ণ সুস্থ করতে পারে তা একমাত্র আমি।
এদিকে আমি পড়েছি মহা ফাঁপরে। রোগের কিছু লক্ষণ আছে ঠিকই, কিন্তু সব রিপোর্ট নর্মাল। যদি ধরেও নিই যে আমার ভুল ছিল, তাহলেও আগ্রার ডাক্তার যে রিপোর্ট করতে দিল সেখানেও কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এ কী করে হয়? রোগের ডায়াগনোসিসই যদি ঠিকমতো করতে না পারি তাহলে তার চিকিৎসা করা তো একপ্রকার অসম্ভব।
অনেক সময় এমন হয়, ‌কোনো জিনিস হয়তো চোখের সামনেই আছে, কিন্তু তা অতীব সূক্ষ্ম হওয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সেটা এড়িয়ে যায়, ফলে আমাদের চোখে পড়ে না সেটা। তেমনই হয়তো আমারও কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে, তাই ব্যাপারটা ধরতে পারছি না। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না, বিশেষত প্রভাতবাবু যখন এতটা বিশ্বাস করে তাঁর পিসেমশাই-এর চিকিৎসার সম্পূর্ণ ভার আমার মতো নবীন ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাই একদম প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
পরের দিন প্রভাতবাবুর বাড়ি গিয়ে মনোরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলে তাঁর কেসটা রেকর্ড করলাম ভালো করে।‌ খিদে, ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, শরীরে আর কোনো অস্বস্তি হচ্ছে কিনা, ছোটোবেলা থেকে এই পর্যন্ত বড়ো কোনো রোগ হয়েছে কিনা, বংশে কারোর কোনো রোগ ছিল কিনা ইত্যাদি। সেখানেও কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা পেলাম না।
মেডিকেল জার্নাল নিয়মিত পড়ার অভ্যাস আমার ছিলই, তা থেকে আমি অনেকসময় এমন সব চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছি যা আমার ডাক্তারি জীবনে বহুবার কাজে লেগেছে।
সারা দিন-রাত এক করে তারপর দেশ বিদেশের মেডিকেল জার্নাল পড়তে শুরু করলাম। হয়তো এমন কোনো রোগ আছে যা এখনও অবধি এদেশের মাটিতে হানা দেয়নি, কিন্তু বিদেশে এরকম কিছু হয়েছে, সেক্ষেত্রে মেডিকেল জার্নাল সে সবের হদিস দিতে পারবে। কিন্তু তাতেও লাভ বিশেষ হল না।
দীর্ঘ এক মাস কেটে গেল, কিন্তু আমি যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রইলাম। প্রভাতবাবু এর মধ্যেই বার তিনেক এসেছিলেন বটে, কিন্তু আমি আনত মুখে তাঁর থেকে আরও সময় চেয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি।
অবশেষে একদিন হতাশ হয়ে শরণাপন্ন হলাম আমার প্রফেসর ডাঃ সূর্যমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। শুধু দেশের মাটিতেই নয়, বিদেশেও ওনার প্রচুর নাম-ডাক আছে। স্যার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আমায় সাহায্য করতে পারবেন।
স্যারকে তাঁর বাড়িতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেদিন কোনো কারণে আমার ভাগ্যদেবী আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন, তাই তাঁকে বাড়িতেই পেলাম, খাটে বসে একমনে বই পড়ছিলেন।
স্যারকে প্রণাম করতেই স্যার ভারী গলায় বললেন, “বসো
আমি সামনে রাখা চেয়ারে বসতেই উনি পাশের টেবিল থেকে একটা চুরুট ধরিয়ে একই রকম ভারী গলায় বললেন, “বলো
স্যারকে সবটা খুলে বলতে শুরু করলাম। উনি চোখ বন্ধ করে সবটা মন দিয়ে শুনছিলেন, মাঝে মাঝেই ওনার কপালে যে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠছিল তা আমার চোখ এড়াল না। সবটা শোনার পর উনি প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, “জার্নাল কিছু দেখেছ?
আমি এই প্রশ্নটির জন্য তৈরি ছিলাম। এক পাশে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।
“পেয়েছ কিছু?
আমি নেতিবাচক ভঙ্গিতে দু’দিকে ঘাড় নাড়লাম
স্যার চুরুট থেকে কিছুটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “স্টেনডাল সিনড্রোমের নাম শুনেছ?
এ আবার কী! কস্মিনকালেও এ জিনিসের নাম শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
আমি আবার দু’দিকে ঘাড় নেড়ে না বললাম।
তারপর স্যার আমাকে যা বললেন, শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এও সম্ভব?
...
“স্যার কী বললেন দাদু? আমি জানতে চাইলাম।
দাদু চায়ের কাপে থাকা বাকি চা-টা এক চুমুকে শেষ করে বলতে শুরু করলেন, “স্টেনডাল সিনড্রোম খুব অদ্ভুত এক ধরনের রোগ, খুব একটা বেশি দেখাও যায় না। কোনো ব্যক্তি যখন  শিল্পকলার সংস্পর্শে এসে আলাদা এক আত্মিক টান অনুভব করে, এবং তা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় তার শরীরে নানা প্রকার অস্বস্তি হতে থাকে। বারবার মূর্ছা যাওয়া, হ্যালুসিনেশন হওয়া, বমি বমি ভাব, প্রলাপ বকা, হৃদস্প্দনের গতি অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পাওয়া এগুলোই হল এ রোগের প্রধান উপসর্গ।
“রোগটির নামকরণ হয়েছিল উনবিংশ শতকের ফরাসী লেখক মেরি হেনরি বেইল-এর ছদ্মনাম স্টেনডালের নামে। তিনি তাঁর একটি ব‌ইতে বর্ণনা করেছেন, তিনি তখন সান্তা ক্রসের বাসিলিকা যান, যেখানে মাইকেলেঞ্জেলো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি সমাধিস্থ হয়েছেন, তখন তিনিও অদ্ভুতভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। ইতালিতে ফ্লোরেন্স শহরের উফিজি গ্যালারি, নবজাগরণের শিল্পকলায় সমৃদ্ধ, সেখানেও গিয়ে অনেকে এই রোগের শিকার হয়েছে, তাই একে ফ্লোরেন্স সিনড্রোমও বলা হয়ে থাকে। মনোরঞ্জনবাবুরও এই বিরল রোগটি হয়েছিল। তাই প্রথমবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং দ্বিতীয়বার তাজমহল গিয়ে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।”
“আচ্ছা দাদু, যার এই রোগটা আছে, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম গেলেও তার এরকম হতে পারে? রিম্পি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আলবাত পারে।”
“সত্যিই এরকম হয় বুঝি মামাবাবু? মা যে কখন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। তার মানে মা-ও আমাদের মতো সোনা দাদুর গল্প শুনছিল?
দাদু চুপ করে থেকে হা হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, “হ্যাঁ, সত্যিই এরকম হয়। আমার কাছে এ সম্বন্ধে কিছু বইপত্র আছে, তোমাকে দেব, পড়ে দেখোভালো লাগবে। কিন্তু ব‌উমা, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গল্প শুনছিলে তা তো আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।”
মা অপ্রস্তুত হয়ে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে ফেলল।
“মনোরঞ্জনবাবু কি শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছিলেন? আমি কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম।
দাদু উত্তরে শুধু ‘হুঁ’ বললেন। তারপর স্তিমিত স্বরে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু মনোরঞ্জনবাবু সবটা শোনার পর মিউজিয়াম, গ্যালারি, মনুমেন্ট বা ওই জাতীয় জায়গায় আর কোনোদিন যাননি। অতএব আমি আজও বলতে পারব না আমার ওই কেসটায় আমি সফল হয়েছি না ব্যর্থ হয়েছি।”
অচিরেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সোনা দাদুর মুখ থেকে।
সোনা দাদু এরপর আর বসলেন না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে, “অনেক রাত হল, আজ উঠি” বলে ব্যস্ত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
বারান্দা দিয়ে আমরা এক দৃষ্টে সোনা দাদুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, না জানি আবার কী আজগুবি গল্প সোনা দাদু পরের সপ্তাহে আমাদের উপহার দেবেন।

----------
ছবি - শ্রীময়ী

No comments:

Post a Comment