মেক্সিকারাই গড়ে তুলেছিল আজটেক
সভ্যতা
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
দ্বাদশ শতকের শুরু থেকে
মেক্সিকো উপত্যকায় এক নতুন জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটে। এরা নাহুয়াটল ভাষায় কথা বলত।
এরা এসেছিল উত্তরের মরু অঞ্চল থেকে। এই যাযাবর জনগোষ্ঠীটি স্বভাবে ছিল অত্যন্ত
হিংস্র ও লড়াকু। এরা প্রথমে তেকসকোকো হ্রদের উপকন্ঠে আনাহুয়াক উপত্যকায় ছোটো ছোটো
দলে ভাগ হয়ে বসতি স্থাপন করে। সেই সময় ওই অঞ্চলে টোলটেকরা রাজত্ব করত। শক্তি
সামর্থ্যের দিক থেকে এরা টোলটেকদের তুলনায় ছিল অতি নগণ্য। তাই
এদের বসতি স্থাপনের সময় টোলটেকরা তেমন বাধা দেয়নি।
এই নতুন জনগোষ্ঠী সেই সময়
আজটেক নামে পরিচিত ছিল না। তাহলে কী
নামে তারা নিজেদের পরিচয় দিত? এদের উপকথা (অবিন কোডেক্স, Aubin Codex)
থেকে জানা যায়, আজৎলান নামে কোনো এক স্থানে এরা বসবাস করত। তীব্র খাদ্যাভাব দেখা
দিলে স্ব-ভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশে যেখানে খাদ্যের অভাব নেই। এই
গোষ্ঠীর দেবতা হুইৎজিলোপোচিটলি-র আদেশ ছিল নতুন জায়গায় গিয়ে তারা যেন নিজেদের
আজটেকা বলে পরিচয় না দিয়ে মেক্সিকা বলে পরিচয় দেয়। কারণ আজটেকা তাদের রাজার নাম।
ইতিহাসবিদদের মতে মেক্সিকা
গোষ্ঠী চাহুলতেপেক এলাকায় প্রবেশ করেছিল ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সেই সময়ে মেক্সিকো
উপত্যকায় বেশ কয়েকটি শহর ছিল। সামরিক শক্তিতে এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী শহর ছিল
পশ্চিমের আজকাপোৎজালকো এবং দক্ষিণের কুলুয়াকান।
আজকাপোৎজালকোর তেপানেক শাসকেরা মেক্সিকাদের চাহুলতেপেক এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়।
লড়াকু মেক্সিকাদের ভবিষ্যতে সৈন্যবাহিনীতে কাজে লাগানো যেতে পারে এই কথা ভেবে ১২৯৯
খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণের কুলুয়াকান রাজা কোকোক্সতলি এদের তিজাপান নামক এক অনুর্বর
এলাকায় বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। এরপর থেকে মেক্সিকারা কুলুয়াকান সংস্কৃতি গ্রহণ
করতে শুরু করে। কারণ তারা বুঝেছিল টোলটেকরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ও সভ্য।
নিজেদের নাহুয়া দেবতাদের সঙ্গে টোলটেক দেব-দেবীদেরও তারা আপন ধর্মে গ্রহণ করে নেয়।
মেক্সিকাদের মধ্যে একটা
লোকগল্প প্রচলিত আছে। গল্পে বলা আছে একটি বিশাল ঈগল পাখি পিয়ার ক্যাকটাস গাছে বসে
আছে, তার নখে গাঁথা একটা প্রকাণ্ড সাপ। এর অর্থ, মেক্সিকাদের দেবতা হুইৎসিলোপোকৎলি
তাদের এই এলাকায় বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিজেদের শহর গড়ে তোলার আদেশ দিচ্ছেন।
কিন্তু টোলটেকদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তারা হ্রদ অঞ্চলের পূর্বে, পশ্চিমে বা
দক্ষিণে কোনো শহর গড়ে তুলতে পারল না। অবশেষে তারা তেকসকোকো হ্রদের উত্তরে এক জলা
দ্বীপে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তেনোকতিতলান শহরের গোড়াপত্তন করে। এরপরে প্রায় ৫৩ বছর
ধরে তারা আশেপাশের দ্বীপগুলিতে এবং অগভীর অঞ্চলগুলি ভরাট করে বসতি বিস্তার করতে
থাকে। ১৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকারা তাদের প্রথম হুয়েই ত্লাতোআনি অর্থাৎ প্রধান
শাসক বা রাজা নির্বাচিত করেন। প্রথম এই রাজা বা নেতা-শাসকের নাম আকামাপিকৎলি।
আকামাপিকৎলি মেক্সিকাদের রাজা
নির্বাচিত হলেও তিনি স্বাধীন রাজা ছিলেন না। টোলটেকদের শক্ত ঘাঁটি আজকাপোৎজালকোর
রাজার অধীনে ছিল। প্রতি পূর্ণিমায় ধার্য কর পৌঁছে দিতে হত তেপানেক রাজাকে। ১৪২৬
খ্রিস্টাব্দে আজকাপোৎজালকোর রাজার মৃত্যু হলে ক্ষমতা দখল করেন তাঁর ছেলে মাক্স্ৎলা।
রাজা হয়েই তিনি মেকসিকা-শাসককে হত্যা করেন। সেই সময়
মেক্সিকাদের নেতা ছিলেন চিমালপোপোকা। ভবিষ্যৎ নিষ্কন্টক করার জন্য মাক্স্ৎলা
তাঁর নিজের ভাই নেজাহুয়ালকোয়োৎলকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন।
সেই সময় আজকাপোৎজালকো ছিল
টোলটেকদের প্রধান শক্তি। একক প্রচেষ্টায় তাদের পরাজিত করে নিজেদের শাসন-অঞ্চল উদ্ধার
করা যে সম্ভব নয় সেটা মেক্সিকারা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। তাই মাক্স্ৎলার
বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের জন্য চিমালপোপোকার উত্তরাধিকারী ত্লাতোআনি ইৎজকোআতল্
গোপনে বিতাড়িত তেকসকোকো রাজা নেজাহুয়ালকোয়োৎল এবং ত্লাকোপান এর রাজার সঙ্গে
যোগাযোগ করেন। আলাপ আলোচনার পর তিন শক্তির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই
চুক্তি ত্রিশক্তি নামে ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছে। এই ত্রিকোণ জোট ধীরে ধীরে এক
বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের শাসনের আওতায় নিয়ে আসে। এই সময় মেক্সিকারা নিজেদের আজটেক
নামে পরিচয় দিতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত হয় আজটেক সাম্রাজ্য।
আজটেক সাম্রাজ্য একটি মাত্র
জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে ওঠেনি। এদের সাম্রাজ্যে বহু জনজাতির বাস ছিল। প্রত্যেকের জীবনযাপন
পদ্ধতি, ভাষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ ভিন্ন ভিন্ন ছিল। ফলে এদের কোনো কেন্দ্রীয় শাসন
ব্যবস্থা ছিল না। বিকেন্দ্রীকৃত শাসন ব্যবস্থাই এদের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত।
প্রতিটি জনপদ শাসনের দায়িত্ব থাকত স্থানীয় শাসকদের উপরে। তাঁদের শাসন-ব্যবস্থায়
কেন্দ্রীয়-শাসক অর্থাৎ আজটেক সম্রাট হস্তক্ষেপ করতেন না। জনপদ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে
ধার্য কর সম্রাটের কোষাগারে পৌঁছে গেলে সে জনপদটি সম্রাটের অনুগত বলে ধরে নেওয়া
হত। দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য বস্ত্র, খাদ্য ইত্যাদির পাশাপাশি পালকের পোষাক, রত্ন,
প্রভৃতির মতো বিলাসসামগ্রীও কর হিসাবে গ্রহণ করা হত। কোনো জনপদের অধিবাসীরা
বিদ্রোহ করলে বা সময়মতো কর প্রেরণ না করলে তবেই সম্রাট সৈন্য পাঠাতেন তাদের দমন
করার জন্য। প্রতিটি জনপদের শাসকেরা তাদের বংশধারা বা উত্তরাধিকার সূত্রে নির্বাচিত
হত। বস্তুসামগ্রী কেনা-বেচার জন্য আজটেকরা কাকাও দানা মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করত।
এই কাকাও থেকেই কোকো বা চকলেট তৈরি করা হয়ে থাকে।
দ্বাদশ শতকে আজটেক সভ্যতার
আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল। বহুসংস্কৃতি মিশ্রিত এই সভ্যতার অন্তিম দিন ঘনিয়ে এল
ষোড়শ শতকে। কোর্তেস-এর নেতৃত্বে স্প্যানিয় আক্রমণে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়ে যায়
মেসোআমেরিকায় গড়ে ওঠা ওলমেক, জাপোটেক, মায়া, টোলটেক ইত্যাদির মতো কয়েকটি প্রাচীন
সভ্যতার শেষ সভ্যতাটি। স্প্যানিয়দের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় কিছু জনজাতি নেতা।
পতন হল আজটেক সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট মনতেজুমার। সেই সঙ্গে শেষ হল প্রাচীন সভ্যতার
শেষ অধ্যায়টি।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment