গল্পের ম্যাজিক:: টাইটানের টিকিট - মৃদুল সামই


টাইটানের টিকিট

মৃদুল সামই

ট্রেনটা সবে টাটানগর জংশন পেরোল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গগনবাবু দেখলেন, সন্ধে আটটা পনেরো গগনবাবু গণিতের শিক্ষক পাশাপাশি একটি বিজ্ঞান পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাড়ি কলকাতায়। যাচ্ছেন ছত্তিসগড়। প্রসন্নবাবু বলে তার একজন প্রতিবেশী রায়পুরে থাকেন। গত মাসে বাড়ি এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, “সামনের মাসে ছুটিতে কী করছেন? তেমন কোনো প্রয়োজনীয় কাজ না থাকলে চলে আসুন না আমার ওখানে। রায়পুর থেকে বাসে করে জগদলপুর, একটু হয়তো সময় লাগে, কিন্তু বাস পরিষেবা খারাপ নয়। এতদিন ছত্তিসগড়ে থাকলেও চিত্রকূট জলপ্রপাত এখনও দেখা হয়ে ওঠেনি। সামনের মাসে আমারও কাজের চাপ একটু কম থাকবেচলে আসুন। একবার বেড়িয়ে আসি। আপনারও হাওয়া পরিবর্তন হয়ে যাবে
না, তেমন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ নেই। তাছাড়া অনেক দিন হল কোথাও যাওয়া হয়নি গগনবাবুর তাই তিনি ঠিক করলেন যাবেন। রিজার্ভেশন কনফার্ম হতেই সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রসন্নবাবুকে। প্রসন্নবাবু স্টেশনের মেন গেটের কাছে সময়মতো পৌঁছে যাবেন বলেছেন। ট্রেন কাল সকালে রায়পুরে পৌঁছবেস্লিপার ক্লাসের টিকিট .সি.তে রিজার্ভেশন পেলেন না। তবে স্লিপারে যাওয়ার অভ্যেস আছে গগনবাবুর। তাই তার কোনো প্রবলেম নেই। স্লিপারে মাঝে-সাঝে একটু ভিড় হয়, এই যাযদিও আজ গগনবাবুকে একটু অবাকই হতে হল, কেননা এখনও অবধি এই কামরায় তার সহযাত্রী বলতে একজনই এক পঁচিশ-ছাব্বিশের তরুণছেলেটি এই একটু আগে টাটাতে উঠল

ট্রেন যখন চক্রধরপুর স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল, ততক্ষণে গগনবাবুরও ডিনার কমপ্লিট। সঙ্গে একটি সায়েন্স ম্যাগাজিন ছিল। সেটাতেই চোখ বোলাতে বোলাতে ঘন্টাখানেক কেটে গিয়েছিল তার। ডিনারের পর ব্যাগ থেকে বেডশিটটা বের করে সিটের উপর পেতে নিলেন তিনি। এরপর রেস্ট। না, এই স্টেশনেও আর কোনো যাত্রী ওঠেনি এই কামরায়। একদিকে ভালোই হয়েছে। নিরিবিলিতে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাবেযদিও রাউরকেলা এলে এই নিরিবিলি পরিস্থিতি থাকবে কিনা, বলা মুশকিল। বাকি ছয়টি সিট হয়তো সেখান থেকেই বুকিং হয়েছে। যাক গে, সে যাই হোক। এখন তো একটু ভালো করে রেস্ট নেওয়া যাক। এই ভেবে শুয়ে পড়তে যাবেন গগনবাবু, ঠিক তখনই কথা বলে উঠল সহযাত্রী ছেলেটি।
তা এবার ঘুমোবেন নাকি?
এতক্ষণ ছেলেটির সঙ্গে একটিও কথা হয়নি গগনবাবুর। আসলে ছেলেটি ট্রেনে ওঠা থেকেই ব্যস্ত ছিল, কী জানি কী একটা যন্ত্র নিয়ে। একটা সেল ফোনের মতো কিছু হবে। যদিও ওটা যদি সত্যি সত্যি সেল ফোন হয়, তাহলে বলতেই হয় যে, তিনি অন্তত এইরকম টাইপের সেল ফোন দেখেননি। সে যাই হোক, এখন ছেলেটির কথার জবাবে গগনবাবু বললেন, ঘুম তেমন হয়তো হবে না, তবে এই একটু রেস্ট নিয়ে নিই আর কিফাঁকা কামরা। বেশি ভিড় নেই। রেস্ট নেওয়ার উপযুক্ত কন্ডিশন। সে যাই হোক , তোমার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
এই সামনে রাউরকেলা-তেই নেমে যাব। যদিও আপনি বলছেন ভালো কন্ডিশন! কিন্তু অনেক দিন সত্যি এরকম  জার্নি  হয়নিজাস্ট বোরিংসাধারণত যে গতিতে যায় ট্রেন, আজ সেভাবে যাচ্ছে না কেন কে জানে! পঁচিশ শতকের ছেলে আমি, এতদিন ট্রেনে যাতায়াত করছি, কিন্তু এইরকম তো কখনও হয়নি। তিনশো কিলোমিটারের গতিবেগ হঠাৎ করে আজ এতটা কমে গেল কী করে?
ছেলেটি হয়তো ভুল করে একুশ শতক বলতে গিয়ে পঁচিশ শতক বলে ফেলেছে। আজকালকার ছেলেদের অনেকেই নিজেকে ওভারস্মার্ট দেখাতে গিয়ে ভুলভাল বলে ফেলে। যেমন অনেকেই ভুলভাল ইংরেজি আউড়ে যায়। এসব গা সওয়া হয়ে গেছে গগনবাবুর, কিন্তু একটা কথা শুনে বেশ অবাক হতে হল তাঁকেএই ট্রেনের বেগ তিনশো কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়! গগনবাবু জানেন তিনি যে ট্রেনে যাচ্ছেন, তার বেগ সত্তরের মতো। ছত্তিসগড় পৌঁছতে লেগে যাবে নয়-দশ ঘন্টা। হ্যাঁ, এটা ঠিক, এ দেশেও দ্রুতগতির ট্রেন চালু হওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দেড়শো কিলোমিটার বেগে ট্রেন চললে অর্ধেকেরও কম সময় লাগবে। অদূর ভবিষ্যতে সারা দেশ জুড়েই এই ব্যবস্থা চালু হবে। অনেক সুবিধা হবে যাতায়াতের। তখন আর দিনের পর দিন ট্রেনে বসে থাকতে হবে না মুম্বাই কিংবা চেন্নাই যেতে যদিও পুরো দেশ জুড়ে সে পরিকাঠামো গড়ে উঠতে এখনও অনেকটা টাইম লেগে যাবে, মনে হল গগনবাবুর। কিন্তু এ ছেলে বলে কী? সাধারণত তিনশো কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেনে সে যাতায়াত করে, আর তাই আজ ওর এরকম মনে হচ্ছে! আচ্ছা, ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো? না, এর সঙ্গে এখন আর বেশি বকে লাভ নেই। এই ভেবে গগনবাবু সিটে গা এলিয়ে দিলেন। ছেলেটি যদিও আবার কথা বলে উঠল।
তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বেড়াতে?
আপাতত রায়পুর,” অনুচ্চ সুরে বলে উঠলেন গগনবাবু।
হুম, বেড়ানোর মধ্যে যে অনুভূতি আছে, তা আর কোনোকিছুতেই নেই। আবার যদি তা হয় মহাকাশ যাত্রা। সত্যি টাইটানের অ্যাডভেঞ্চারটা যা হল, লাইফের শ্রেষ্ঠ অভিযান হিসেবে থেকে যাবেসেই মিথেনের সাগর, হাইড্রোজেন গ্যাস নিয়ে বেঁচে থাকা সব জীব... তারপর মানুষ নয়, কিন্তু খানিকটা মানুষেরই মতো দেখতে প্রাণীর সঙ্গে পরিচয়, উফফ! আরও কত কী! ভাবা যায়! তবে হ্যাঁ, টাইটানের টিকিট পেতে বেশ কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আসলে বাৎসরিক মহাকাশযান তো, তাই। তবে, এখন যে সাধারণ মানুষেরাও মঙ্গল, চাঁদ এমনকি শনির চাঁদ টাইটানে পৌঁছে যেতে পারছে, এটাই এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার
এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে একটু থামল ছেলেটি। আর গগনবাবুর মনে হল, এবার তিনি বোধহয় সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবেন। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে একটা প্রশ্ন করে বসলেন তিনি, “আচ্ছা, তোমার মতে এটা কত সাল?
কেন? ২৪২১!” ভাবলেশহীনভাবে দ্রুত উত্তর দিল ছেলেটি
না, এরপরে আর কোনো কথা চলে না। ছেলেটি সত্যি বদ্ধ উন্মাদ। তারপরেই গগনবাবুর মনে হল যে, আচ্ছা ছেলেটি তার সঙ্গে মশকরা করছে না তো? তার সঙ্গে মশকরা! তাও আবার প্রায় অর্ধেক বয়সের একটা ছেলে! না, সত্যি, জেনারেশনটা যে কোনদিকে যাচ্ছে? একে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে করলেন, কী দরকার এরকম একটা ছেলেকে কিছু বলে, বরং এর সঙ্গে আর কথা না বলাটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, ছেলেটি সত্যি সত্যি ছিটগ্রস্ত। না, এবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করা যাক। এই ভেবে গগনবাবু দু’চোখের পাতা বন্ধ করলেন, যদিও একদমই ঘুম আসছে না। বার বার ছেলেটির কথাগুলোই মনে পড়তে লাগল গগনবাবুর। তার মনে হল, ছেলেটি যদি পাগলই হবে, তাহলে সে মহাকাশ যাত্রা, টাইটান এত কিছু বলছে কী করে? আবার ও বলছে এটা পঁচিশ শতক। এইরকম ভুলটাও করছে কী করে! আচ্ছা, তিনি নিজে ভবিষ্যতে এসে পড়েননি তো? কারণ বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে চলছে, পঁচিশ শতকে এইরকম কিছু হতেই পারে। কিন্তু কলকাতা, দিল্লি থেকে চাঁদ কিংবা টাইটানে যাওয়ার টিকিট! আর ভাবতে পারলেন না গগনবাবু। এসব কী ভাবছেন তিনি? কেনই বা ভাবছেন, বোধগম্য হল না তার নিজেরই

কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে একটা আলোর ঝলকানি এসে পড়লে, চোখ খুলে গগনবাবু বুঝতে পারলেন স্টেশন এসেছে। লোকজনের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। এটাই রাউরকেলাট্রেনটা এইমাত্র থামল তার মনে হল, যাক ছেলেটা এবার নেমে যাচ্ছে, বাঁচা গেলসামনের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ছেলেটি নেই মানে নেমে গেছে সে। ঠিক এই সময় সিটের কোনায় একটা ডায়েরি চোখে পড়ল তার। এটা বোধহয় ওই ছেলেটারআশ্চর্য ছেলে একটা! যাই হোক জানালা দিয়ে ডেকে ওর ডায়েরিটা ফেরত দিয়ে দেওয়া যাক, এই ভেবে গগনবাবু ডায়েরিটা হাতে করে তুলে বাইরের দিকে তাকালেন, কিন্তু ছেলেটিকে দেখতে পেলেন না। কী করবেন এখন? গেট দিয়ে নেমে প্লাটফর্মে একবার কি দেখবেন? কিন্তু এখন গেট দিয়ে ব্যাগ মালপত্র নিয়ে বেশ কয়েকজন যাত্রী এই কামরাতেই উঠছে। সুতরাং এখন নামা যাবে না, এই ভেবে গগনবাবু ডায়েরিটি যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দেবার কথা ভাবলেনপরে রেলের গার্ড এলে একটা ব্যবস্থা হবে এখন। ঠিক এই সময় ডায়েরি থেকে এক টুকরো কাগজ বেরিয়ে এসে পড়ল গগনবাবুর সিটের উপর। কাগজের টুকরোটা হাতে তুলে নিতেই গগনবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে, তার উপর লাল কালিতে লেখা তিনটি অক্ষর, ‘মাননীয় গগনবাবুর উদ্দেশে’এবার কাগজের ভাঁজ খুলে বুঝতে পারলেন, এটি একটি চিঠি। চিঠিটি এইরকম

মাননীয় গগনবাবু,
পত্রিকায় আপনার ছবি দেখেছি। তাই আপনাকে চিনতে অসুবিধে হয়নি। আপনাদের পত্রিকার নতুন বিভাগে, মানে সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসিতে এর আগে পাঁচবার গল্প পাঠিয়েছি। যদিও আমার কোনো লেখাই প্রকাশের জন্য আজ অবধি বিবেচিত হয়নি। আমি যে কাহিনি আপনাকে একটু আগে শোনাচ্ছিলাম, ওটাই আমার নতুন লেখা গল্পের আউটলাইনপুরো গল্পটা ডায়েরিতে আছেজানি না, আপনি আমার উপর রেগে যাবেন কিনা? কিন্তু যদি গল্পটি একটিবার পড়েন, তাহলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। গল্পে অবশ্য আমার ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয়েছে, ‘মিঃ মিথেন’
ইতি,
বিউটেন বিশ্বাস

গগনবাবু প্রথমে কিছুক্ষণ ডায়েরিটির দিকে হতভম্বের মতো চেয়ে রইলেন। তারপর কী মনে করে নিজের মনেই একটু হেসে ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলেন! প্রথম পাতার শুরুতেই চোখে পড়ল শিরোনামটা, ‘টাইটানের টিকিট’ট্রেনও তখন দুলুনি দিয়ে আবার চলতে শুরু করেছে।

----------
ছবি – অতনু দেব

No comments:

Post a Comment