কান্তিবাবুর ক্যামেরা
সম্বিতা
তখন অনেক
রাত। কান্তিবাবু হোটেলের রিসেপশনে বসে বসে রেডিও শুনছিলেন। হঠাৎ জনৈক ভদ্রলোক এসে
হাজির তার হোটেলে। লম্বা, গায়ের রঙ মাঝারি, চোখে চশমা, বেশ ভারি গোঁফ। তিনি বললেন, “আমি
অবিনাশ মল্লিক। রাতের শেষ ট্রেনটা মিস করেছি। কলকাতায় ফেরার ট্রেন আবার কাল আছে। আজ
রাতে থাকার মতো ঘর পাওয়া যাবে?”
কান্তিবাবু
তার মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে দেখে একটু হেসে বললেন, “নমস্কার,
আমি কান্তি বোস। হ্যাঁ, পাওয়া যাবে।
চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”
করিডোর দিয়ে
যেতে যেতে কত মানুষের ছবি দেয়ালে সাজানো দেখে অবিনাশ খুব অবাক হয়ে গেল। এরা কারা? কেন
এত মানুষের ছবি দেয়ালে ঝোলানো? অবিনাশ বলল, “রেজিস্টার
দিন, সই করে নিই।”
কান্তিবাবু
বললেন, “তার
দরকার নেই। আমাদের এখানে অন্য নিয়ম আছে।”
“মানে?”
“এখানে
যারা যারা আসে তারা কেউ সই করেন না। তাদের ছবি তুলে রাখা হয়। আমার আবার খুব ছবি তোলার
সখ। আর তাদের স্মৃতিও থাকে।”
“ওহ!
তাই বুঝি এত ছবি দেয়ালে।”
কান্তিবাবু
শুধু হাসলেন,
কিছু বললেন না। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশের একটি ঘরের চাবি খুলে দিয়ে কান্তিবাবু
বললেন, “রাতে
অড়হর ডাল,
ইলিশ মাছের ঝোল আর ভাত হয়েছে। আপনি হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিন। আমি কিছুক্ষণের
মধ্যেই খাবার নিয়ে আসছি।”
রাতে
খাওয়াদাওয়ার পর অবিনাশ বেশ আরাম করে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অনেক
মানুষের কথাবার্তা তার কানে এল। খুব ভালো করে শুনলে বোঝা যায় কারা যেন বলছে, “চলে
যান এখান থেকে,
যদি বাঁচতে চান তো পালিয়ে যান।” কথাগুলো ভেসে আসছে ঘরের বাইরে থেকে।
অবিনাশ বেশ ভয় পেয়ে গেল। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখল কেউ নেই ঘরে। সব
আবার চুপ। সে আবার শুয়ে পড়ল, কিন্তু আলো বন্ধ করে দিলেই কারা যেন একই কথা বলে উঠছে
বার বার। সে দরজা খুলে এবার বাইরে এসে দেখল, কান্তিবাবু
তার হাতে একটা বড়ো ক্যামেরা নিয়ে তার ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছেন। অবিনাশ কিছু বলতে
যাচ্ছিল, কিন্তু কান্তিবাবু বাধা দিয়ে বললেন, “আপনার
ছবিটা তুলতে ভুলে গেছিলাম। চলুন তুলে নিই এখন।”
“এত
রাতে? কাল
তুললে হয় না?
আমি অন্য কারণে বাইরে এসেছিলাম।”
“না
হয় না, সময়
বড়ো কম,
চলুন পাশের ঘরে, দু-মিনিটের তো ব্যাপার।”
অগত্যা
অবিনাশ কান্তিবাবুর সঙ্গে চলে এল পাশের ঘরে। সেই ঘরের দেয়ালে ঝোলানো অনেক ফাঁকা
ফটো ফ্রেম। অবিনাশকে পুরোনো একটা চেয়ারে বসতে বলে কান্তিবাবু তার ক্যামেরাটা চোখের
সামনে ধরলেন। সেটা খুব পুরোনো আমলের একটা অ্যান্টিক বললে বেশি বলা হবে না।
কান্তিবাবু বললেন, “রেডি? থ্রি... টু... ওয়ান...” হঠাৎ ক্লিক
আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঝলসে উঠল, আর অবিনাশ খেয়াল করল সে একটা কাচের ঘরে বন্দি।
হাত-পা নাড়তে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কথা বলতে পারছে না। সে এখন সেই ঘরের একটা দেয়ালের
কিছুটা উপরে একটা ফ্রেমের ভেতর। সে ‘কান্তিবাবু’ ‘কান্তিবাবু’ বলে অনেক ডাকল,
কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পেল না। ঘরের আলো জ্বললে সেই ফটো ফ্রেমের কাচ ভেদ করে কোনো
শব্দ বাইরে আসে না।
রাত তখন
বারোটা, কান্তিবাবু
হোটেলের রিসেপশনে বসে বসে মশা মারছিলেন। এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা এসে হাজির। তিনি
বললেন, “আমার
গাড়িটা খারাপ হয়েছে কিছু দূরে, এত রাতে কোথায় যাব? এখানে আজ রাতের মতো থাকার ঘর হবে?”
কান্তিবাবু
একটু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, হবে, চলুন আমার সঙ্গে।”
কান্তিবাবুর
ঠোঁটে হাসি,
চশমার ফাঁক দিয়ে তার চোখ চকচক করে উঠল।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment