গল্পের ম্যাজিক:: লোডশেডিং - কেয়া চ্যাটার্জি


লোডশেডিং
কেয়া চ্যাটার্জি

এখন সেভাবে লোডশেডিং হয় না। হলেও ঘরে ঘরে ইনভার্টার, জেনারেটর। মুহূর্তে সব কালো মুছে দিয়ে চারিদিক ঝলমলিয়ে তোলে। ফলে সময় নষ্ট হয় না। গল্প শোনা হয় না। স্কুলের সব পড়া শেষ করে ফেলতেই হয়। আমাদের ছোটোবেলায় লোডশেডিং ছিল ভারী মজার ব্যাপার। গ্রীষ্মকালের সন্ধেবেলা যখন পড়তে পড়তে হঠাৎ করে লোডশেডিং হয়ে যেত, আনন্দে আটখানা হয়ে এক লাফে মাদুর ছেড়ে বাইরে। বেরিয়ে দেখি পাড়ার প্রায় সবাই রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অফিস ফেরত কাকু জেঠুরা স্যান্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গি বা হাফ প্যান্ট পরে নিজেদের মধ্যে মশা মারতে মারতে খোশগপ্পে মশগুল। মহিলারা তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে রাজ্যের আলোচনায় ব্যস্ত। আর আমরা ছোটোরা, ওই অন্ধকারেই একটা লম্ফ বা হারিকেন জ্বালিয়ে, কখনও বা ক্ষীণ চাঁদের আলোয় চু-কিতকিত, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। সে ভারী মজার দিন ছিল।
এরকমই এক গ্রীষ্মের সন্ধেতে বাড়িতে হাজির হল চৈতিদি। চৈত্র মাসে জন্ম, তাই নাম চৈতি। ফুলদির স্কুলের বন্ধু। কিন্তু চৈতিদিকে আমরা খুব সমীহ করতাম। চৈতিদি তো আর যে সে কাজ করত না। সে ছিল বিউটিশিয়ান।  উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই নাকি এটা শিখেছে। খুব ডিমান্ড। আমরা দল বেঁধে জানলার গরাদে চোখ লাগিয়ে দেখতাম কীভাবে সুতো দিয়ে টেনে টেনে ফুলদির ঝাঁকড়া ভ্রু ছবির মতো সুন্দর করে দিত। ক্রিম মুখে ডলে ডলে চকচকে করত চামড়া। আমাদের দিকে মুচকি হেসে বলত, “বড়ো হলে তোদেরও এরকম করবআমরা হুড়মুড়িয়ে দিতাম দৌড়। বাবা গো! অমন সুতো দিয়ে ভ্রু তুলতে কী যে ব্যথা লাগে। এর চেয়ে ন্যাড়া হওয়া ভালো।
একদিন দৌড়োতে দৌড়োতে উঠোনে এসেই কী একটা জিনিসে হোঁচট খেয়েই মুখ থুবড়ে পড়লাম। আমার উপর পড়ল বুড়ো, তার উপর পুটলি। এরা সবাই আমার পাড়াতুতো বন্ধু তথা ভাই বোন। বুড়োর নাম বুড়ো কেন কেউ জানি না। কিন্তু পুটলিকে নাকি জন্মাবার পরে যারাই দেখতে গেছে তারাই নাকি প্রথম দর্শনে ভেবেছে জামাকাপড়ের পুটলি। তাই ওর নাম হয়ে গেছে পুটলি। তা পুটলি গায়ের ওপর পড়লে কোনো ব্যথা লাগত না। ওকে ওর মা যাই-ই খাওয়াতেন কিছুই ওর গায়ে লাগত না। কালবৈশাখী ঝড় এলে, কাকিমা, মেয়েকে পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন দাওয়ার খুঁটির সঙ্গেযাতে মেয়ে কোনো প্রকারে এদিক ওদিক ঝাপটা খেয়ে না পড়েকিন্তু আমার গায়ের ওপর এসে পড়েছে বুড়ো। ওর শরীরে সব খাওয়াই লাগে। সে খাবার হোক কিংবা মার। বুড়োর হাটুঁর গুঁতো খেয়ে আমি তো কঁকিয়ে উঠলাম। অমনি দেখি কুয়োতলা থেকে দৌড়ে আসছে জেঠু। জেঠু পুলিশে চাকরি করতপোস্টিং ছিল ব্যান্ডেলে। রোজ রোজ যাতায়াতের ঝক্কি এড়াতে তাই ওখানেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সপ্তাহান্তে আসত বাড়িতে। জমজমাট হয়ে উঠত সারা বাড়ি। জেঠু মানেই হুল্লোড়, জেঠু মানেই মজা, জেঠু মানেই ভালো ভালো খাবার রান্না আর হঠাৎ পিকনিক। মা, জেঠিমার থেকেও পাকা রাঁধুনি জেঠু। জেঠু ছুটে এসে আমায় কোলে তুলে আদর করে বলল, “ও সোনাই বুড়ি, কী হয়েছে?” আমি বুড়োর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটতেই জেঠু হো হো করে হেসে বলে উঠল, “বেশ, বুড়োকে এবার থেকে আমি ট্রেনিং দেবদু’দিনে রোগা করে তবে কাজে ফিরব।আমিও বিশ্বাস করতাম জেঠুর কথা।
জেঠু এলেই পাড়ার অনেকেই এসে দেখা করে যেত। কেউ সমস্যা নিয়ে কথা বলত, কেউ পরামর্শ চাইতে আসত, কেউ বা আবার অভয় বাণী আদায় করে নিয়ে যেত, যাতে বিপদে পড়লে যেন সাহায্য পায়। পরের দিন বাজার থেকে ফিরতি পথে জেঠুর দেখা হল গোস্বামী কাকুর সঙ্গে। জেঠুর হাতের ব্যাগে তখন দু’কেজি পাঁঠার মাংস সমেত পেঁয়াজ, আলু, আদা, রসুন, ডিম, পালং শাক, কেজি খানেক টমেটো চাপ বাড়িয়েই চলেছে। গোস্বামী কাকু সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে কান এঁটো করা হাসি হেসে বললেন, “এই তো স্বয়ং দারোগাবাবু যখন পাড়ায় এসে গেছেন তখন আর চিন্তা কীজেঠু অবাক হয়ে বলল, “কেন বলুন তো? কীসের চিন্তা?” তার উত্তরে কাকু যা বললেন তার মর্মার্থ দাঁড়াল গিয়ে, কাকু তাঁর একতলা বাড়িকে দোতলায় উন্নীত করছেন। এর জন্য প্রয়োজন ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট, লোহার রড ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু একটা সমস্যা ক’দিন ধরে তিনি টের পাচ্ছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিস পরিমাণে কমে যাচ্ছে। কখনও ইট, কখনও বালি। ফলে খরচ যাচ্ছে বেড়ে। জেঠু যদি এর কোনো বিহিত করে দেন। জেঠুর এতক্ষণ ভারী ব্যাগ ধরে থেকে হাতটা টনটনিয়ে উঠেছে। গোস্বামী কাকুর কথা শেষ হতেই জেঠু ‘উরি বাবা রে!’ বলে কঁকিয়ে উঠল। গোস্বামী কাকু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল নিমু বাবু? জেঠু ছুট লাগিয়ে বলল, পাঁঠায় বোধহয় গুঁতো দিল গো দাদা। সন্ধেবেলা কথা হবে। চলি।
জেঠুর হাতের কষা মাংস আর গরম ভাত খেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের তাড়নায় ভাতঘুমটা দিতেই হল। জেঠুর থেকে কথা আদায় করে নিলাম যে সন্ধেতে জেঠু আমাদের গল্প বলবে। সেইমতো সন্ধেবেলা সবাই গোল করে ঘিরে বসেছি। জেঠু সবে তাঁর গল্পের ঝুলি থেকে একটা গল্প ভেবেচিন্তে বের করে বলতে শুরু করেছেন, এমন সময় কোত্থেকে হাজির হল চৈতিদি। একগাল হাসি হাসি মুখ নিয়ে জেঠুর কোলের কাছে এসে বলল, “এই তো কাকু। কেমন আছে গো?
“আরে, চৈতি মা যে! আমি ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস বল?
জেঠু আর চৈতিদির মধ্যে আরও কিছু কুশল সংবাদ বিনিময় হতে লাগল। চৈতিদির বাবা-মা, ঠাকুমা, ওদের পাশের বাড়ির জেঠিমা, তার পিসতুতো দেওর, তার বন্ধু, বাড়ির পাশের মুদি কাকু, দুধওয়ালা মাসি জেঠু সবার খবর নিতে শুরু করলেন। আর চৈতিদিও তার জ্ঞানের ভাণ্ডার উজাড় করে সবার হাঁড়ির কথা পর্যন্ত বলে চলেছে। আমরা যে ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে নিচ্ছিলাম না তা অবশ্যই বলে দিতে হবে না। বুড়ো একবার হাই তুলল, পুটলি কান চুলকোলো, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে সদ্য ফোটা তারা গুনতে শুরু করলাম। কুশল বিনিময় আর শেষ হয় না। হঠাৎ আমাদের হতাশাকে বাড়িয়ে তুলে চৈতিদি জেঠুকে বলে বসল, “ইশ কাকু, রোদে পুড়ে কী কালো হয়ে গেছ গো। চলো তোমার ফেসিয়াল করে দিই।জেঠু আঁতকে উঠে বলল, “ফেসিয়াল? আমি? না না না... তার চেয়ে বরং তোর কাকিমাদের আর বন্ধুকে ধর।
“ওদের তো রোজই ফেসিয়াল করে দিই। দেখ তোমার স্কিনে কত ময়লা জমে আছে। বাড়ি এসেছ, একটু চকচকে হয়ে ফিরবে না!”
“ওরে আমার কাজই তো তাই। অযথা পয়সা নষ্ট করে কী হবে বল তো?
আমরাও বেগতিক দেখে জেঠুর সঙ্গে লেগে পড়লাম। আমি বললাম, “না না, ছেলেরা আবার ফেসিয়াল করে নাকি? ও জেঠু তুমি গল্পটা বলো তো।” চৈতিদি চোখ পাকিয়ে বলল, “ধুস, তোরা কিছু জানিস না। সিনেমার হিরোরা, অভিনেতারা সবাই ফেসিয়াল করে।আমরাও মানব না। জেঠুকে এইটুকু সময় পেয়েছি, সেটা চৈতিদির জন্য কিছুতেই ছাড়া যাবে না। রীতিমতো দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল দুই পক্ষে। বিষয় জেঠুঅবশেষে রণে ভঙ্গ দিল স্বয়ং জেঠুকথা দিল, চৈতিদি তো তার কাজ করেই চলে যাবে, গল্পটা তিনি আমাদের রাতে শোনাবেন এবং আজ রাতে বুড়ো, পুটলি আর আমি জেঠুর কাছেই ঘুমোবএরকম প্রতিশ্রুতি পেয়ে আর বিরোধিতা করা যায় না। তাই জেঠুকে ছাড়তেই হলচৈতিদি গদগদ হয়ে বলল, “তাই ভালো। তাছাড়া সব সময় তো আর পয়সার জন্য কাজ নয়, মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করাও দরকার। তুমি না হয় ক্রিমের খরচা বাবদ চল্লিশ টাকাই দিও।জেঠু ঘরে ঢুকে গেল। জেঠিমা আর ফুলদি হাসি চেপে তোয়ালে, বাটি, জল জোগাড় করে দিল। আমরা আবার জানালার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে দেখতে লাগলাম জেঠুর ফেসিয়াল পর্ব। মা কয়েকবার ঘুর ঘুর করে সময় নষ্ট না করে পড়তে বসার কথা বলে গেলেও জেঠু আর রবিবারের দোহাই দিয়ে সে আদেশ কাটিয়ে উঠে আবার ফেসিয়াল কর্ম দর্শনে মন দিয়েছি। ঘণ্টাখানেক পর মুখের দলাই মলাই, খোঁড়াখুড়ির পর যেই না চৈতিদি ফেসপ্যাক লাগিয়েছে অমনি ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার।
যাহ! লোডশেডিং!বলে সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। সকলে লণ্ঠন, লম্ফ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। জেঠু এদিকে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেই আছে। মাঝে মাঝে গলা তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ছে, “কিছু পেলি রে? নাকি আমি উঠব?
“তোমায় উঠতে হবে না।”
“বলি, আলো জ্বলল? চোখ যে বন্ধ।”
“জ্বলেছে। চুপ করে বসে থাকো।”
“কারেন্ট এল?
“না গো।”
“মুখটা কখন ধোয়া হবে? এসব আমার পোষায় না বাপু!”
“প্যাক শুকোলেই ধুয়ে দেবে।”
“আর কতক্ষণ লাগবে প্যাক শুকাতে?
এবং ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। চৈতিদিও তাল মিলিয়ে বলে যাচ্ছে, “জেঠু গো, কথা বোলো না, প্যাক ফেটে যাবে তো। আর একটু বস। পাখা চললেই তো শুকিয়ে যেতফুলি একটু হাতপাখা দিয়ে হাওয়া কর না রে।
আলো আসার কোনোরকম লক্ষণ না দেখে সবে উঠোনে মাদুর পেতে বসেছি, এমন সময়ে পাশের গলি থেকে কারা যেন বলে উঠল, “চোর, চোর। চোর এসেছে!আমরা সকলে সজাগ হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। খোলা দরজা জানলা বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঘরে ঢুকে ঢুকে দেখতে লাগলাম অকাঙ্খিত চোর বাবাজি খাটের তলায় ঢুকে বসে নেই তো। ঘুরতে ঘুরতে জেঠুর ঘরে ঢুকে দেখি চেয়ার ফাঁকা। জেঠু নেই। চৈতিদি উঠোনে ফুলদি আর অন্যান্যদের সঙ্গে গল্পে মত্ত। আমি গিয়ে শুধালাম, “ও চৈতিদি, জেঠু কোথায়? সবাই বলল ঘরেই দেখতে। আমি জানালাম ঘর ফাঁকা, কেউ নেই। এদিকে পাশের গলিতে হল্লার শব্দ আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। হঠাৎ মাথায় এল, জেঠু চোর ধরতে চলে গেল না তো? অগত্যা এবার মাঠে নামতে হল বাবা আর বড়দাকে। বড়ো টর্চ, হ্যারিকেন আর লম্বা একটা লাঠি নিয়ে তারাও চলল চোর আর দারোগার খোঁজে।
এদিকে বাবা আর বড়দা রাস্তায় বেরিয়ে দেখল গোস্বামী কাকুর বাড়ির সামনে জটলা। একদল মহিলা পুরুষ এসে জুটেছে। হাতে তাদের লাঠি, ঝাঁটা, শাবল, চপ্পল আরও কত কী! কাছে যেতেই গোস্বামী কাকুর উচ্চকিত কণ্ঠের বর্ণনা শুনে ব্যাপারটা কিছুটা বুঝল। ঘটনাটা হল এই যে, লোডশেডিং হওয়ার পরেই কত্তা গিন্নি হাওয়া খেতে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় তাদের বাড়ির পিছনে যেখানে বাড়ি তৈরির সামগ্রী রাখা সেখানে রডের ওপর কাদের যেন দাপাদাপি করতে শুনলেন। উনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কে? কিন্তু তার প্রতুত্তর এল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কে। এবারে দুপদাপ করে ছোটাছুটির শব্দ এলগোস্বামী কাকু বুঝলেন, এ খুব সহজ ব্যাপার নয়। কোনো কুমতলবে এসেছে কেউ বা কারা। ইতিমধ্যে তার বেশ কিছু জিনিসপত্র হাওয়া হয়ে গেছে। তিনি সন্দেহবশে প্রাণপণে চিৎকার শুরু করলেন চোর চোর বলেআর তাই শুনে আশপাশের লোকজনও সজাগ হয়ে উঠল।
এমন সময় পাড়ার মুদি কাকু কাকে যেন অন্ধকারে সরে যেতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “ওই তো চোর। আমাদের দেখে সরে পড়ল।” আরেক জন বলে উঠল, “দেখেছ কী সাহস! এখনো পালায়নি। তক্কে তক্কে আছে কখন আমরা বাড়ি ঢুকব, আর ও মাল নিয়ে সরে পড়বে।কেউ একজন গলা তুলে বলে উঠল, “চলো তো সবাই। ব্যাটাকে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে সিধে করে আসি।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দলটা গলির সেই প্রান্তে ছুটতে শুরু করল। একজন চলল হ্যারিকেন হাতে আগে, আরেকজন পিছু পিছু। প্রথম জন চেঁচিয়ে উঠল, “ওই তো, ওই তো ঐদিকে চলে গেল।দলও তাকে অনুসরণ করে ছুটল সেই দিকে। দেখা গেল সত্যিই একটি ছায়ামূর্তি ওদের দেখে সরে পড়ল। দলটিও ছুটে চলল তার পিছু পিছু। ছায়ামূর্তি যত ছোটে, দলও ততই ছোটে। অবশেষে দেখা গেল গোস্বামী কাকুর বাড়িকে কেন্দ্র করেই গোটা ছোটাছুটির ঘটনাটি ঘটতে লাগল। চোরও ছুটছে, পাড়ার লোকও ছুটছে। ইতিমধ্যে বুড়োর কাকা বুদ্ধি করে দলছুট হয়ে উলটো দিকে ছুটতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চিৎকার শোনা গেল। অকুস্থলে পৌঁছে দেখা গেল সে একটি লোককে চাদর চাপা দিয়ে জাপটে ধরে আছে আর চেঁচিয়ে লোকজন ডাকছে আর লোকটিও নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করছে। সকলে মিলে নিজ নিজ অস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে গেল। একজন ধাঁই করে লোকটির পিঠে কষিয়ে দিল এক ঘা। আর তক্ষুনি লোকটি পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠল। আরেকজন আরেক ঘা কষাতে যাবে এমন সময় বাবা বলে উঠল, “এই দাঁড়াও দাঁড়াও, গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে না? দেখি দেখি, চাদরটা তোলো তো!বুড়োর কাকু চাদর সরালে একজন একটা হ্যারিকেন এনে ধরল তার মুখের কাছে। সকলে ঝুঁকে পড়ল তার উপর। মুদি কাকু বলল, “মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মুখে সাদা সাদা কী মেখে আছে?” বেচু কাকু মানে বুড়োর কাকাও ঝুঁকে পড়ল, “মাটি মনে হচ্চে। কিন্তু মুখে কেন? মুখ লুকাতে?” একে একে সকলে ঝুঁকে পড়ল। একে একে ছুটে এল প্রশ্নবান। হঠাৎ লোকটি গোঙাতে গোঙাতে বলে উঠল, “চৈতি... চৈতিকে ডাকো।সকলে অবাক। চৈতি? চৈতি কেন? আবার প্রশ্ন ছুটে আসবে, এমন সময় চারিদিক আলোকিত করে জ্বলে উঠল রাস্তার হলুদ আলোর লাইট পোস্টগুলো। সেই আলোয় ধৃত ব্যক্তির মুখ দেখে সকলে সমস্বরে বলে উঠল, “এ কী!" ভিড়ের ভেতর থেকে একটা হাত এগিয়ে এলসেই হাতে ধরা একটা ভিজে রুমাল। সেই রুমাল এগিয়ে গেল ধৃত ব্যক্তির মুখের ওপর। পরম যত্নে মুছিয়ে দিল সেই সাদা সাদা মাটি। বেরিয়ে এল আসল মুখ। জেঠু! যে লোকটি মেরেছিল সে কপাল চাপড়ে বলে উঠল, “হায় হায়! শেষে কিনা দারোগাকেই চোর ভেবে ধোলাই দিলাম।ভিড় ঠেলে চৈতিদি এগিয়ে এসে হাসি হাসি মুখে বলল, “এই তো কাকুকে কী সুন্দর লাগছে। দেখ স্কিনটা কেমন গ্লো করছে।জেঠু কাতর স্বরে বললেন, “হ্যাঁ মা, কাল থেকে আর টর্চ নিয়ে চোর ধরতে বেরোব না। চামড়ার আলোতেই কাজ হয়ে যাবে।”
চৈতিদি মানে মানে কেটে পড়ল। চল্লিশ টাকা আর নিয়েছিল কিনা জানা নেই। জেঠুকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল বাড়ি। উঠোনে চৌকি পেতে বসানো হল। পিঠ ফুলে ঢোল। কাল হয়তো আর ডিউটি যেতে পারবে না। পিঠে জেঠিমা গরম চুন-হলুদ লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গোস্বামী কাকু বললেন, “ছি ছি! কী ভাবলাম আর কী হয়ে গেল। ছিঁচকে চোর ধরতে গিয়ে কিনা নিজের প্রতিবেশীকেই মার খেতে হল।বেচু কাকু বলল, “কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চোরটা গেল কোথায়? নিমুদা তুমি দেখেছিলে?” জেঠু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে জানালেন যে, না, তিনি দেখেননি। তারপর বললেন, “গোস্বামীদার আওয়াজ শুনেই তো আমি বেরিয়ে এলাম চোর ধরব বলে। সেইমতো এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করছি। এমন সময় তোমরা আমায় তাড়া করলে। আমি এদিকে মুখে মাটি লেপে বসে আছি। লজ্জায় মুখ লুকোতে ছুট লাগলাম, কিন্তু সময়মতো যে পাঁচিল টপকে বাড়ি ঢুকব সে সুযোগটাই পেলাম না। তার আগেই বেচু আমায় ধরে ফেলল। এত লোকজন দেখে হয়তো চোর ব্যাটা ভেগেছে।সবাই সম্মতি জানালঠিকই। না হলে এত দ্রুত কেউ পালাতে পারে না। এমন সময় আবার রডের ওপর আওয়াজ শোনা গেল। গোস্বামী কাকু উৎকর্ণ হয়ে শুনে বললেন, “আবার, আবার এসেছে মনে হয়। ময়দান ফাঁকা পেয়ে সুযোগের সদব্যবহার করতে এসেছে মনে হয়।এবার আর জেঠু বেরোল না। বাদবাকি সকলে বেরিয়ে এল নিজ নিজ অস্ত্র হাতে। এবার আর লুকোচুরি নয়। হাতেনাতে ধরা যাবে চোর বাবাজিকে। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে সকলের একগাল মাছি। রডের ওপর উপর ছোটো ছোটো পায়ে টলমল করে উঠছে দুটো ছাগল। একদম উপরে উঠে ঢালু জায়গায় তারা হড়কে দিচ্ছে নিজেদের। ঠিক পার্কে বাচ্চাদের স্লাইড চড়ার কায়দায়। এভাবে বারংবার ওঠানামায় তারা উল্লাসে বারে বারে ব্যা ব্যা করে ডেকে উঠছে। তাদের এহেন খেলা দেখে আফশোস করতে করতে সকলে বাড়ি ফিরল। টিভি চালিয়ে বসে পড়ল। টিভিতে শুরু হয়েছে শ্রী কৃষ্ণ সিরিয়াল। সুললিত কৃষ্ণা-আ-আ-আ কণ্ঠে মুখরিত হয়ে উঠল সন্ধেপুটলি আর বুড়ো ফিরে গেল বাড়ি। আমি মাদুরে শুয়ে রাতের তারা গুনতে গুনতে ভাবতে লাগলাম, জেঠুর কাছে গল্প শোনার মজাটা হাতছাড়া হওয়ার জন্য আমি ঠিক কার ওপর রাগ করব চৈতিদি, গোস্বামী কাকু, চোর, ছাগল না লোডশেডিং?
----------
ছবি – সুমিত রায়

No comments:

Post a Comment