গল্পের ম্যাজিক:: মোহ - সুমন্ত্র ঘোষ


মোহ
সুমন্ত্র ঘোষ

আমি তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারে পড়ি ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস গোটা ভারত উত্তাল হয়ে আছে তখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে ক’দিন আগেই বাংলায় এই নিয়ে তখন প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে সকাল-সন্ধে আমার বাবা পার্টি মেম্বার ছিলেন বাবা যে শুধু মিটিং মিছিল করতেন আর পার্টি অফিসে বসতেন তাই না, তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন মার্ক্স আর লেনিনের ফ্যান বিয়ের পরে বাবা টান মেরে বাড়ি থেকে সব ঠাকুরদেবতার মূর্তি আর ফটো রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন কবচ বা মাদুলির ধার দিয়েও যেতেন না শুধু দুর্গাপূজা, ঈদ বা বড়োদিনের মতো উৎসবে আটকাতেন না আমাদের বলতেন উৎসব আর ধর্মান্ধতা আলাদা জিনিস বুঝতেই পারছেন আমাদের বাড়ির তখনকার আবহাওয়া
আমিও কলেজ থেকেই ইউনিয়ন করতাম, কিন্তু দেখতাম আমার রাজনীতি করা নিয়ে বাবা তেমন খুশি না বলতেন যে আদর্শ নিয়ে ওনারা রাজনীতি করতে শুরু করেছিলেন সেই আদর্শ চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে যাই হোক, আমি তাও লুকিয়ে যোগাযোগ রাখতাম ইউনিয়ান লিডারদের সঙ্গে আশেপাশের এক জায়গায় তখন রাস্তা থেকে কালো পাথর উঠেছে বলে সেটাকে শিব ঠাকুর বানিয়ে পুজো শুরু করেছিল কিছু লোক আমরা কয়েকজন দল বেঁধে গিয়ে রীতিমতো ঝগড়া করে সেই পাথর তুলে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম নর্দমায় এটা আমাদের বাড়িওয়ালা জেঠু দেখে ফেলেছিলেন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব উনি না আবার বাবাকে বলে দেন! দুরুদুরু বুকে বাড়ি ফিরে দেখি সব কিছু স্বাভাবিক তাহলে উনি বাড়িতে কিছু জানাননি! ঠিক করেছিলাম পরে ওনাকে একা পেলে ধন্যবাদ জানিয়ে দেব
পরের দিন আমি কলেজ থেকে ফিরছি বিকেলে, সেই সময় দেখি জেঠু লাঠি হাতে যাচ্ছেন কোথাও উনি বেশ শৌখিন মানুষ সব সময় ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে রুপোয় বাঁধানো ছড়িটা নিয়ে বাইরে বেরোন চুল গুছিয়ে ব্যাকব্রাশ করা দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো হাতে থাকে দামি সিগার ওনার ধারে কাছে এলেই সুগন্ধি তামাকের চমৎকার কড়া গন্ধ নাকে লাগে আমি ওনাকে আগের দিনের জন্য ধন্যবাদ দিতে উনি বললেন, “ওসব লাগবে না তোমার সঙ্গে বরং এটা নিয়ে একটু কথা আছে চলো বসে কথা বলা যাক
রাস্তার ধারে একটা বাড়ির রোয়াকে আমাকে নিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড-পয়েন্ট থেকে তুমি ঈশ্বর মানো না, সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু অন্য লোকে মানলে তোমার ক্ষতিটা কোথায়?
আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, “ঈশ্বর মানুষের একটা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে মানুষ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে ঈশ্বর মানুষকে না আদিম যুগে মানুষ যখন জানত না ঝড় কেন ওঠে, বাজ কেন পড়ে বা ভূমিকম্প কেন হয়, তখন ভুল করে ভাবত যে অজানা কোনো কারণে প্রকৃতি রেগে উঠেছে তাদের উপরে তাই তারা প্রকৃতিকে খুশি করতে পবন বা ইন্দ্রের মতো কিছু ঈশ্বরের গল্প বানিয়ে তাদের পুজো করা শুরু করে এখন তো সে সবের কোনো দরকার নেই আর তাছাড়া মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না থাকলে তো সব বড়ো বড়ো মন্দির মসজিদ বন্ধ করার অভিযানে নামতুম তা তো করিনি কিন্তু একটা পাথরকে শিব বানিয়ে মাথায় তুলে নাচাটা তো রীতিমতো কুসংস্কারের পর্যায়ে পড়ে এটা তো কবচ তাবিজ দিয়ে রোগ সারানোর সমান
আমি ভেবেছিলাম জেঠু এবার সেই চিরাচরিত তর্ক শুরু করবেন জানতে চাইবেন, তাহলে এই ইউনিভার্স তৈরি হল কীভাবে কিন্তু সে সব কিছু না করে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না যখন ভূতেও নিশ্চয় ভয় পাও না
আমি বললাম, “অফ কোর্স পাই না ভূত আবার কী? যত ভুলভাল কনসেপ্ট
উনি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “যদি প্রমাণ চাই দিতে পারবে? আমাদের বাড়ির পেছনে যে বট গাছটা আছে তার নিচে রাত বারোটায় দাঁড়াতে পারবে?
আমি হেসে উঠলাম জেঠু জানেন না যে আমি আর সামনের ঘরের দাদা রোজ রাত এগারোটা নাগাদ লুকিয়ে গাছের কাছেই সিগারেট খেতে যাই অনেক বছর আগে কে একটা গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল তারপর থেকে ওদিকে আর কেউ ঘেঁষে না রাতে তো আমরা কখনও দু-একটা কুকুরের বেশি কাউকে দেখিনি গাছতলায় দিনের বেলাতেও খুব দরকার না পড়লে লোকে এড়িয়ে চলে গাছটা আমাদের অত ভয় নেই, তাই ওদিকটায় গিয়ে সিগারেট খাই, গল্প করি কারও কাছে ধরা পড়ার কোনো ভয় থাকে না
আমি জেঠুকে বললাম, “কবে যেতে হবে বলুন? আজকে?
জেঠু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, যেতে হবে না তোমার সত্যি সাহস আছে কিনা সেটা পরখ করে দেখছিলাম তোমার বুকে বল আছে কিন্তু একটা কথা বলি তোমাকে নিজে যাচাই না করে কোনো কিছু উড়িয়ে দেবে না এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার এখনও কোনো ব্যাখ্যা হয় না
আমিও ছাড়বার পাত্র না বললাম, “তাই নাকি? বেশ তেমন একটা ঘটনা বলুন শুনি তবে প্লিজ রাশিয়া বা জার্মানির গল্প ফেঁদে বসবেন না আবার সেটা তো আর আমার পক্ষে যাচাই করে আসা সম্ভব না
জেঠু দু’চোখ ভালো করে কচলে নিয়ে বললেন, “আমি যেটা বলব সেটা যাচাই করতে পাড়ার বাইরেও বেরোতে হবে না তোমাকে ঘটনাটা আমাদের পরিবারকে নিয়ে
আমি বেকুবের মতো ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম উনি বললেন, “আমাদের পরিবারে একটা অভিশাপ আছে বলতে পার, বা আশীর্বাদ আমাদের কেউ যখন মারা যায় তখন তাকে নিতে আগের জন আসে বুঝলে?
আমি তো কিছুই বুঝলাম না ঘাড় নেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আগের জন মানে কে? আগের জেনারেশনের কেউ?
জেঠু বললেন, “বাড়িতে আগে যিনি মারা গেছেন তিনি আমি ছেলেবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিলাম প্রথম ঘটনাটা তখন অবশ্য আমার হাসি পেয়েছিল এরকম আবার হয় নাকি! পরে দেখলাম যে আমাদের পরিবারে প্রায় সবাই জানে ব্যাপারটা আমার জেঠু যখন মারা গেছিলেন যক্ষ্মায়, তখন নাকি অন্তিম সময়ে অনেকে আমার ঠাকুরদার জুতোর আওয়াজ পেয়েছিল ঠাকুরদার নতুন জুতোর খুব শখ ছিল এমনকি ঘরেও অনেক সময় জুতো মসমসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তেমনি আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল কয়েকজন এসব শুনে কী বলা উচিত বুঝতে পারিনি আমার বাবা অবশ্য যখন মারা গেছিলেন তখন আমরা আশেপাশে কেউ ছিলাম না উনি হার্টের ব্যামো নিয়ে ভরতি ছিলেন নার্সিংহোমে একদিন সকালে খবর আসে যে ভোররাতে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আমরা দৌড়ে যাই সবাই মিলে সেখানে বাবাকে রাতে দেখাশোনা করার জন্য একজন নার্স রাখা হয়েছিল তার থেকেই জানতে পারি যে বাবা মারা যাওয়ার আগে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে ‘সেজদা’ বলে একবার ডেকে অদ্ভুত একটা হেসেছিলেন নার্স পেছন ফিরে অবশ্য কাউকে দেখতে পায়নি এটা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল কারণ বাবার ‘সেজদা’ মানে আমার সেই জেঠু যিনি কয়েক মাস আগে যক্ষ্মায় মারা গেছিলেন
“এরপর কেটে গেছে অনেক বছর পর পর দুটো মৃত্যুর পরে আর তেমন কিছু ঘটেনি আমাদের বাড়িতে আমি তখন চাকরি করতে শুরু করেছি বিয়ে করে থিতু হয়েছি সংসারে আমার দু’ছেলে এক মেয়ে বড়ো হচ্ছে তোমার বাবা-মা ততদিনে ভাড়াটে হয়ে এসেছে আমাদের বাড়িতে কাজেই পরের ঘটনাটার সাক্ষী হিসেবে ওরাও আছে
“মা দীর্ঘদিন অসুখে ভুগছিল সমস্যাটা যে কী সেটাই কেউ ধরতে পারছিল না দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে মা চোখের দীপ্তি নিভে আসছে আস্তে আস্তে মা একদম বিছানা নিয়ে নিল আমরা কেউ জোর করে খাওয়ালে তবে কিছু পেটে পড়ে নাহলে মা নিজে থেকে কিছুতেই খেতে চায় না ডাক্তার আমাকে বলে গেলেন, ‘কেউ যদি নিজে বাঁচতে না চায় তাকে বাঁচাব কী করে বলো দেখি? আমি মায়ের কাছে গিয়ে জোর করে জানতে চাইলাম কী ব্যাপার মা কিছুতেই বলতে চাইছিল না শুরুতে অনেকবার জিজ্ঞেস করতে শেষে বলল, মাসখানেক আগে বাবা এসেছিলেন স্বপ্নে বলে গেছেন এবার মন তৈরি করতে সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে
“এটা শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলাম আমি বললাম যে এসব কথার কোনো মানে হয় না স্বপ্নে তো মানুষ কত কিছু দেখে সেটাকে সত্যি ভেবে বসলে জীবনে চলা মুশকিল আমি তো কতবার স্বপ্নে দেখেছি যে আমি একটা গর্তে পড়ে আছি আর আমার আশেপাশে অজস্র সাপ তাহলে তো আমাকেও সাপের ভয়ে কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে হয় মা আমার সঙ্গে তর্ক করেনি বলেছিল, ‘তুই এখন বুঝবি না খোকা তোর সময় এলে বুঝবি তোকে একটাই কথা বলতে পারি যে তুই মনটা শক্ত কর আর ক’দিন মোটে বাকি এই কথার উত্তরে কী বলা উচিত জানা ছিল না অনেক সাধ্যসাধনা করেও মায়ের মন ঘোরাতে পারলাম না আমি
“দিন চারেক পরে নিজের ঘরে বসে কাজ করছি, এমন সময় আমার মেয়ে দৌড়ে এসে বলল, বাবা ঠাম্মা সবাইকে ডাকছে বলছে শেষ দেখা দেখতে চায় আমি আর আমার স্ত্রী দৌড়ে গেলাম ছেলেরা পাড়ার কোথায় একটা ছিল মেয়েকে পাঠালাম তাদের খুঁজে আনতে নিচ থেকে সবাই দৌড়ে এল বোধহয় মেয়ের মুখ থেকে শুনে পাড়া থেকে শুধু ছেলেরা না, তাদের বন্ধুরাও এসে পড়ল সঙ্গে মাকে দেখে মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমি পায়ের কাছে বসে কাঁদছিলাম তোমার বাবা দৌড়ে গিয়েছিলেন আশেপাশে কোনো ডাক্তার যদি পাওয়া যায় তাঁকে আনতে
“মায়ের ঘরে বাবার কিছু পুরোনো জিনিস স্মৃতি হিসেবে রাখা ছিল যেমন বাবার পুরী থেকে খুব শখ করে কেনা বেতের ছড়ি, কিছু ধুতি পাঞ্জাবি আর লেখার খাতা, কলম, দোয়াত হঠাৎ দেখি দরজার পাশে ঘরের কোণে রাখা ছড়িটা পড়ে গেল আমরা চমকে উঠে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ তারপরে দেখি মায়ের মুখে ফুটে উঠেছে একটা আরামের হাসি আর চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে কয়েক ফোঁটা জল ওভাবেই মারা যান আমার মা
জেঠুর গল্প শুনে আমার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ছড়িটা ওভাবে পড়ে যাওয়াটা কো-ইনসিডেন্স আর যে বাড়িতে লোকজন ছোটো থেকে এসব গল্প শুনে বড়ো হয় তারা মৃত্যুর আগে যে তাদের পূর্বপুরুষদের হ্যালুসিনেট করবে আর আশ্চর্য কী? তবে একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু নিয়ে তর্ক করা আমার রুচির বাইরে তাই আমি ওনাকে কিছু বলিনি তাছাড়া জেঠুর গল্পটা কতটা সত্যি সেটা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল যদিও উনি দাবি করছেন শেষ ঘটনার সমস্ত কিছু আমার বাবা-মায়ের সামনে হয়েছে, ওঁরা তো আমাকে কখনও কিছু বলেননি ব্যাপারে যাই হোক, সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলাম আমি জেঠুর গল্প মাথা থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে দিলাম এই মার্ক্স ফ্রয়েড ইয়ুং-এর যুগে এসব গল্পকে পাত্তা দেওয়ার কোনো মানে হয় না

আমাদের বাড়িটা তখনকার বেশিরভাগ বড়ো বাড়ি যেমন হত তেমনি ছিল দোতলা বাড়ি মেন দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা খোলা উঠোন সেই উঠোনের চারদিকে সারি সারি ঘর নিচে মোট সাতটা ঘর ছিল তার তিনটে ভাড়া নিয়েছিলেন আমার বাবা আর বাকি চারটে ঘর ভাগাভাগি করে ছিল অন্য দুটো ফ্যামিলি উপরেও সাতটা ঘর জেঠুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বাকি দু’ছেলেও বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার পেতে বসেছে সারাদিন বেশ জমজমাট হয়ে থাকত আমাদের বাড়ি রাত ন’টার সময় থেকে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসত চারপাশ দশটার মধ্যে ডিনার করে শুয়ে পড়ত অধিকাংশ ফ্যামিলি আমার বাবা-মা শুতে যেতেন এগারোটা নাগাদ আমি আর আমার দিদি একটা ঘরে রাত জেগে পড়তাম বারোটার দিকে অবশ্য আমি একটু বাইরে বেরোতাম আরেক ভাড়াটে ফ্যামিলির এক ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত সেই দাদার সঙ্গে আমার বেশ ভাব ছিল আমরা পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে যেতাম সিগারেট খেতে আমার দিদি জানত সব আমাকে খুব একটা আটকাত না বরং সাহায্য করত কিছুটা
সেদিন রাতে আমরা দু’জনে বাড়ির পেছনে গেছি একটু দূরে বট গাছটা আছে সেদিন চমৎকার পূর্ণিমার রাত আশপাশ দেখতে কিছু অসুবিধে হচ্ছে না আমরা গাছটা থেকে একটু দূরে দাঁড়াই রোজ গাছের নিচে দাঁড়াতে পারলে ভালো হত গাছের ছায়ার অন্ধকারে আমাদের দেখতে পাওয়া অসম্ভব ছিল আশেপাশের অন্যান্য বাড়ি থেকে কিন্তু জেঠুদের একটা ঝুল-বারান্দা আছে ওদিকটায় কোনো কারণে কেউ রাতের বেলা বারান্দায় এলে গাছটা পরিস্কার দেখতে পাবে সেই ভয়ে ওদিকে যাই না সেদিন আমার গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে হল যে আমরা রোজ দু’জন আসি তাই, নাহলে রাতের বেলা একা গাছের নিচে যেতে একটু হলেও ভয় করবে বুঝলাম জেঠুর গল্প শুনে বিকেল থেকে আমার মনটা একটু দুর্বল হয়ে আছে আগে কখনও ভয়ের কথা আমার মাথাতেই আসেনি
একটা দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে সিগারেট ধরিয়ে একবার উঁকি মেরে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম দেখি চাঁদের আলোতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওখানে কেউ একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে জেঠিমা বা দুই বৌদিদের মধ্যে কেউ একজন হবেন নিশ্চয় আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ সরিয়ে এনে বললাম, “এই খেয়েছে রে! জেঠিমা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়, বা বৌদিদের মধ্যে কেউ হতে পারে আমাকে মনে হয় দেখে ফেলেছে দাদা বলল, “ধুর, এত দূর থেকে তোকে চিনতে পারে নাকি চাঁদের আলোয়? আমরা গাছের কাছে থাকলে হয়তো পারত দাদা উঁকি মেরে কাউকে দেখতে পেল না আমিও দেখলাম যে কেউ নেই দাদা বলল, “তোকে দেখে ভেবেছে পাড়ার লোফারগুলো আড্ডা মারছে তাই ভেতরে ঢুকে গেছে তাই হবে নিশ্চয়
কিন্তু সিগারেটে দু-চার টান দেওয়ার পরে আমার কেমন একটা খটকা লাগল যাকে দেখলাম তিনি রীতিমতো লম্বা ওরকম লম্বা মহিলা আমি আগে কখনও দেখিনি জেঠিমা বা বৌদিরা ওনার ধারে কাছে না তাহলে কাকে দেখলাম? বাড়িতে নতুন কোনো আত্মীয়ও তো আসেনি! আমি বুঝতে পারছিলাম আমার মধ্যে কেমন একটা ভয় চেপে বসছে কী যে হচ্ছে আমার! একতলার প্যাসেজে অনেক পুরোনো একটা গ্র্যান্ডফাদার' ক্লক ছিল সেটা প্রায় এক মানুষ লম্বা তিরিশ মিনিট ছাড়া ছাড়া বেজে উঠত ঘড়িটা খুব গুরুগম্ভীর আওয়াজ তার সেদিন সাড়ে বারোটার ঘন্টাটা বেজে উঠতে আমি বাইরে দাঁড়িয়েও সেটা শুনে চমকে উঠলাম দাদা জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার বল তো? তোকে আজ কেমন একটা লাগছে আমি বললাম, “আমার শরীরটা ঠিক লাগছে না দাদা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল, “চল তাহলে আজ ফিরে যাই
ফিরে অবশ্য এমনিও যেতে হত কারণ দোতলা থেকে আমরা চেঁচামেচির আওয়াজ পেলাম হঠাৎ দৌড়ে ঘরে ঢুকেছিলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমাদের বাইরে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা উপরে তখন হইচই চলছে ভালোমতো ভাড়াটেরাও সবাই ঘুমথেকে উঠে খোঁজ নিতে গেল জানতে পারলাম জেঠু রাতে একবার বাথরুম যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে কোথাও ঠোকা লেগে মাথার কাছটা কেটেছে অনেকটা মাঝরাতে পাড়ার ডাক্তারকে ডেকে এনে চিকিৎসা চলল কোনো একটা কারণে জেঠু খুব প্যানিকড কথা বলতে পারছেন না ভালো করে
শেষ রাতের দিকে একটুখানি ঘুমিয়েছিলাম আমরা যদিও আমার ঘুম ভালো হয়নি বার বার বারান্দায় দেখা লম্বা ছায়ামূর্তির কথা মনে পড়ছিল পরের দিন কলেজ গিয়ে অবশ্য বন্ধুদের সঙ্গে গল্প আড্ডায় কেটে গেল সময় মাথাটা একটু হালকা হল বাড়ি ফিরে দেখি কান্নার রোল উঠেছে জেঠু মারা গেছেন দুপুরবেলা আমি অবাক হয়ে বিছানায় বসে পড়লাম চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কত কিছু ঘটে গেল! কাল বিকেলে যে লোকটা দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিল, আমাকে এত কিছু গল্প শোনাল, সে আজ বিকেলে নেই! রাতের লম্বা মতন মহিলাটি কে? জেঠু কি তাকে দেখেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন? এমন একটা জায়গা থেকে দেখেছি ওনাকে যে আমি কাউকে বলতেও পারছি না ঘটনাটা বললেই সবাই জানতে চাইবে আমি অত রাতে কী করছিলাম ওখানে
সন্ধেয় জেঠুকে নিয়ে যাওয়া হল শ্মশানে তার দাহকাজ করে গঙ্গাস্নান সেরে বাবা আর বাকিরা সবাই ফিরলেন বেশ রাতে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম খেতে বসে মা বাবাকে বলে উঠল, “আজ বিশ্বাস হল তো তোমার, যে ওনাদের বাড়ির অভিশাপটা সত্যি?
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? জ্যেঠু কি মারা যাওয়ার আগে কিছু দেখেছে নাকি?
মা অবাক হয়ে গেল জানতে চাইল, “তুই এই ব্যাপারটা জানলি কী করে? তোকে তো আমরা কিছু বলিনি তোর দিদিও কিছু জানত না আজ দুপুর অবধি।”
আমি মিথ্যে করে বললাম, “কয়েকদিন আগে দাদার সঙ্গে গল্প করছিলাম বলেছে আমাকে
মা বলল, “ জানল কীভাবে? ওরা তো অনেক পরে ভাড়া এসেছে যাই হোক, তুই জানিস যখন বুঝতে পারবি তোর জেঠু আজ মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ হেসে উঠে বললেন, মা তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছ আমার খুব আরাম লাগছে এভাবে হাসিমুখে মারা গেছেন উনি
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “এটা যে উনি বলেছেন সেটা নিজের কানে শুনেছ তুমি? মা আমতা আমতা করে বলল, “না, তা শুনিনি আমি তো তখন রান্না করছিলাম হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনে উপরে গিয়ে দেখি দাদা মারা গেছেন আমি তো ছোটো বৌমার থেকে শুনলাম বাবা বললেন, “যা নিজে দেখনি, নিজে শোনোনি তা কখনও বিশ্বাস করবে না পাগলামির একটা লিমিট আছে এটা একটা বিশ্বাস করার মতো জিনিস হল? আর সবসময় এসব নাকি ওনাদের ফ্যামিলির লোকরাই ফিল করেন যত্ত সব হয় ওরা সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে, না হলে ফুল ফ্যামিলি জেনেটিক্যালি পাগল মা মোটেই মানতে চাইল না বাবার কথা বলল, “আর ওনার মা যখন মারা গেলেন তার ঠিক আগে লাঠিটা পড়ে গেল যে ঠক করে সেটা তো আর মিথ্যে না তুমি না হয় ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলে, কিন্তু আমি তো নিজের চোখে দেখেছি পাড়ার অনেকেই দেখেছে বাবা বললেন, “আরে ওটা কো-ইনসিডেন্স লাঠিটা পড়ল বলেই হয়তো উনি ওনার স্বামীকে হ্যালুসিনেট করলেন মা রেগে গিয়ে বলল, “তোমরা তো একটাই কথা শিখে রেখে দিয়েছ কো-ইনসিডেন্স কোনো কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝাতে না পারলেই কো-ইনসিডেন্সের নামে চালিয়ে দাও
বাবা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি ঝগড়া থামানোর জন্য মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “জেঠুর মা দেখতে কেমন ছিলেন? মা বলল, “কোনো মেয়ে যে এত লম্বা হতে পারে তা তুই না দেখলে বিশ্বাস করবি না যেমন লম্বাচওড়া চেহারা তেমনি তাঁর মেজাজ
মায়ের কথা শুনে ভাত আমার হাতেই থেকে গেল আমি হাঁ করে বসে রইলাম বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল কী তোর হঠাৎ? আমি বললাম, “কাল রাতে আমি ওনাকে দেখেছি জেঠুর মাকে বাবা বিরক্ত হয়ে খেঁচিয়ে উঠলেন, “মারব থাপ্পড় এবার কি তুই পাগল হয়ে গেলি, নাকি মজা করছিস? ওনার মা তোর জন্মের আগে মারা গেছেন
আমি বললাম, “তুমি আমার কথাটা একটু ভালো করে শোনো আমি কাল রাতে পড়তে পড়তে রুমের বাইরে গেছি টয়লেট যাব বলে এই ধরো বারোটার সময় উঠোনে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছি, হঠাৎ চোখ পড়ে গেল দোতলায় যাবার সিঁড়ির মাথায় সেখানে শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে খুব লম্বা মতন কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ওখানে আমি তাকাতেই উনি কয়েক পা পিছিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এতটা লম্বা কে এসেছে ওনাদের বাড়িতে! হবে হয়তো কোনো আত্মীয়া তাই তখন অত পাত্তা দিইনি
আমার কথা শুনে সবাই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ বাবা গম্ভীর মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই সত্যি বলছিস? আমি কিছু বলার আগেই দিদি বলল, “ এই ব্যাপারে মিথ্যে বলবে না বাবা আমি চিনি ওকে” সেদিন আর ভালো করে খাওয়া হল না আমাদের
রাতে বিছানা করার সময় মা বাবাকে বলল, “আমি কাল কিছু ঠাকুরের ফটো কিনে এনে পুজো শুরু করব তুমি বাধা দিলেও মানব না বাবা কিছু বললেন না বেশ বুঝতে পারলাম এই ঘটনাটা বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে বাবাকে রাতে দিদি আমাকে বলল, “তুই এখন ক’দিন সিগারেট খেতে বাইরে যাস না আমি ভয়ে মরে যাব দিদির বলার দরকার ছিল না রাতে বাইরে কোথাও যাবার ইচ্ছে আমার পুরোপুরি চলে গিয়েছিল

একটা ঘটনায় যতই ভয় লাগুক, সে সব জানবে আস্তে আস্তে কেটে যায় এসব নিয়ে মাসকয়েক ঘরে খুব আলোচনা হল সিরিয়াসলি আমি কলেজেও বন্ধুদের বললাম ঘটনাটা কয়েকজন বিশ্বাস করল বাকিরা হেসে উড়িয়ে দিল আমিও মাথা থেকে ওসব সরিয়ে পড়ায় মন দিলাম বাবা এতদিন বলেও যে কাজটা করতে পারেনি, এবার আমার মধ্যে সেটা ন্যাচারালি এল আমি পড়ায় মনদিলাম বাবা ছোটো একটা চাকরি করত তাই বাড়িতে ভাড়া থাকতে হত আমাদের আমি ঠিক করেছিলাম ভালো করে পড়ে বড়ো একটা চাকরি পেতেই হবে আমাকে, যাতে সবাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যেতে পারি নিজের একটা বাড়ি করতেই হবে আমাকে
তারপরে কেটে গেছে তিন বছর ইউনিভার্সিটি পাশ করে আমি তখন টুকটাক কোর্স করছি, সেই সঙ্গে চাকরি খুঁজছি বিভিন্ন জায়গায় ফর্ম ভরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি ভালো করে কাজেই আমি বাড়িতেই থাকি বেশিরভাগ সময় দিদি তখন একটা প্রাইভেট স্কুলে অফিসিয়াল কাজের জন্য যোগ দিয়েছে কাজেই সারাদিন আমার হয় বই নিয়ে কাটে, না হলে মায়ের সঙ্গে গল্প করে
এরকম অবস্থায় জেঠিমার ক্যানসার ধরা পড়ল ওনাকে নিয়ে সবাই অনেক ছোটাছুটি করলেন বিভিন্ন জায়গায় ঠাকুরপুকুরে রেখেবেশ কিছুদিন চিকিৎসাও চলল, কিন্তু কিছুতেই লাভ হল না ডাক্তার জবাব দিয়ে দিলেন ঘরে শুয়ে দিন গোনা ছাড়া আর রাস্তা নেই শেষের দিকে জেঠিমার দিকে আর তাকানো যেত না ব্যাথায় কাতরাতেন প্রায় সব সময় ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হত ওনাকে ঘুম ভেঙে গেলেই যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতেন তিনি আমরা নিচ থেকে শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন জেঠিমা গ্রীষ্মকালে আট-দশ বয়াম করে আমের আচার বানিয়ে আমাদের প্রত্যেক ভাড়াটেকে এক বয়াম ভর্তি আচার দিয়ে যেতেন তার সঙ্গে যখন তখন তিলের বা নারকেলের নাড়ু বানিয়ে খাওয়ানো তো লেগেই আছে আমাদের কখনও ভাড়াটে মনে করে মিশতেন‌‌ না আমরা প্রায় ওনার বাড়ির লোক হয়ে গিয়েছিলাম
যাই হোক, একদিন দুপুরে আমি পড়ছি, এমন সময় উপরে জেঠিমার গলার আওয়াজ পেলাম উনি কাকে যেন ডাকছেন একটু পরে মা দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে বলল, “জেঠিমা সবাইকে দেখতে চাইছেন একবার তাড়াতাড়ি চল আমি যাব কিনা একটু দ্বিধা করছিলাম গিয়ে আবার কী দেখব তার ঠিক নেই, আর তাতে এক মাস আমার ঘুম উড়ে যাবে কিন্তু না গেলেও মায়ের মুখ দিয়ে জানতে তো পারব তাই না গিয়েও শান্তি নেই মায়ের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি উপরে গেলাম
উপরে তখন অনেকে জড়ো হলেও সবাই নেই বাড়ির ছেলেরা অফিস গেছে তারা টেলিফোনে খবর পেলেও তাদের আসতে দেরি হবে বাবা আর দিদিও ছিল না বাকি ভাড়াটেদের অবস্থাও তাই জেঠিমা আমাদের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, “তোদের অনেককে দেখে যেতে পারলাম শান্তি উনি চোখ বুজলেন নিঃশ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওনার বুক ওঠানামা করছে দেখতে পাচ্ছি আজ কোনো কারণে যন্ত্রনায় চিৎকার করছেননা জেঠিমা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেনখুব আরামে পাড়ার ডাক্তার এসে পালস চেক করে বুকে স্টেথো দিয়ে গম্ভীর মুখে মাথা নিচু করে বসে রইলেন হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদম চুপ করে গেলেন জেঠিমা দেখলাম বুক আর ওঠানামা করছে না ওনার ডাক্তার ওনার পালস দেখে নাকের নিচে হাত দিয়ে আমাদের ইশারায় বোঝালেন সব শেষ আর ব্যাগ খুলে প্রেসক্রিপশন খুলে কিছু লিখতে গিয়ে চমকে উঠলেন উনি সেই সঙ্গে আমরাও চমকে উঠলাম প্রায় একসঙ্গে কারণ পরিষ্কার আমাদের সবার নাকে এসে লাগছে সুগন্ধি তামাকের কড়া গন্ধ যেমনটা ঠিক আমরা জেঠুর আশেপাশে পেতাম
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল

1 comment:

  1. বাহ্, গল্পের ফ্লো বেশ ভালো। শেষ পর্যন্ত চুম্বকের মতো টেনে রেখেছেন।

    ReplyDelete