গল্পের ম্যাজিক:: বন্ধু - নীলাঞ্জনা মল্লিক


বন্ধু
নীলাঞ্জনা মল্লিক

বুঁচি... ভালো নাম কমলা দাস কমলা নামটা তেমন কেউ জানত না আমি জানতে পেরেছিলাম স্কুল স্কুল খেলতাম বলে সেখানে তো ভালো নামটাই চলে আমি টিচার, বুঁচি ছাত্রী কখনও-সখনও বুঁচিও দিদিমণি হত সেদিন বুঁচির খুব মজা বলত, “একদিন তো সত্যি সত্যিই হব... এখন একটু প্র্যাকটিস করে নিই
বুঁচির এই দিদিমণি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না চিটেবেড়ার ঘরের মেয়ে, মা বাড়ি বাড়ি এঁটো বাসন মাজে - সে মেয়ের আবার নাকি স্বপ্ন!
বুঁচিও একটা সরকারি স্কুলে পড়ত আধময়লা কোনো এককালের সাদা রং ইউনিফর্ম, পায়ে আমার বাতিল করা জুতো পাড়ার কাকিমা জ্যেঠিমারা বলত, “মেয়েটার কোনো লক্ষণটা ভালো না অপয়া, অলক্ষ্মী, মুখ দেখলে দিন খারাপ যায়
এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি আমি খুঁজে পেতাম না ওর মুখ তো আমিও দেখি, রোজ আমি তো তেমন কিছু অনুভব করি না! দিন খারাপ যাওয়ার হলে এমনিই যাবে তার সঙ্গে বুঁচির মুখ দেখার কী সম্পর্ক? ওকে দেখতে খারাপ বলেই কি সবার এরকম মনে হত?
বুঁচি কিছু বলত না মাঝে মাঝে লোকজনের আচরণে রেগে যেত খুব আমার কাছে এসে মুখ গোমড়া করে বসে থাকত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ত চোখের জল রাগত স্বরে শুধু বলত, “দেখিস, বড়ো হয়ে দিদিমণি হয়ে দেখিয়ে দেব সবাইকে তোদের মতো বড়ো বাড়িতে থাকব

না সে স্বপ্ন পূরণ করবার সময় বা সুযোগ - কোনোটাই বুঁচি পায়নি হঠাৎ এক রাতে তেড়েপুড়ে জ্বর তিনদিন, চারদিন, পাঁচদিন - বুঁচি বিছানার সঙ্গে লেপটে গোঙাচ্ছে চোখ খোলবার ক্ষমতা নেই ওর মায়ের হাতে টাকা দিয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলল সবাই
ডাক্তার দেখিয়ে আসার একদিন পরেই সব শেষ আর গোঙানি নেই, ছটফটানি নেই, থেকে থেকে মা-কে ডেকে ডুকরে কেঁদে ওঠা নেই নিথর দেহে যেন তৃপ্তির ঘুম বরাবরের মতো ওপর পাটির উঁচু দুটো দাঁত ঠোঁট ভেদ করে বেরিয়ে আছে

ঘটনাটার একমাস পরের কথা শীত চলে গিয়ে মৃদু মৃদু ঠান্ডা বাতাসের আমেজটুকু রেখে গেছে সময় সকাল চারটের আশেপাশে ভোরের আলো তখনও তেমন প্রখর নয় অনেকক্ষণ যাবৎ একটা চেনা ডাক কে যেন ডেকে চলেছে আলতো স্বরে সময়ের ঘুম খুব গাঢ় হয় চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না তবুও বার বার একই আওয়াজ জোর করে চোখ খুলে তাকালাম যা ভেবেছি ঠিক তাই গলা শুনেই চিনেছি বুঁচিই তো! ঝাপসা দৃষ্টিতেও বোঝা যাচ্ছে আমি হতভম্ব এহেন পরিস্থিতিতে কী উচিত অনুচিত ভেবে পাচ্ছি না
আরও অদ্ভুত ব্যাপার, তড়াক করে জেগে উঠতেও পারছি না আজকের ঘুমটা যেন বড্ড বেশিই আচ্ছন্ন করে রেখেছে আধখোলা চোখ বুজে আসছে বার বার
বুঁচি নিচু গলায় বলল, “তোর নীল জামা-পরা পুতুলটা দে খেলব আমি নিরুত্তর আবার বলল, “কী হল? দিবি না? এরপর সকাল হয়ে গেলে কাকিমা জেগে যাবে তোর পুতুল নিয়ে আমাকে খেলতে দেখলে রেগে যাবে দে
সত্যিই তো আমার খেলনায় বুঁচিকে হাত পর্যন্ত দিতে দিত না মা খেলতে এলে রাগ করত খারাপ লাগলেও মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারতাম না আমি
গভীর ঘুমের ঘোরে আমার বইয়ের ছোটো শেলফটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম নিচের তাকে রাখা আছে সব পুতুল ছুটে গিয়ে নীল-জামা পুতুলটা হাতে নিল আমার যেন আপনা আপনিই চোখ বন্ধ হয়ে গেল ঘুমের মধ্যেই টের পাচ্ছিলাম, পুতুলটাকে খাওয়াচ্ছে, চুল বেঁধে দিচ্ছে, পড়তে বসাচ্ছে...
সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে আর বুঁচির কোনো চিহ্ন নেই পুতুল সেই আগের মতোই বুকশেলফের নিচের তাকে সাজিয়ে রাখা জানি, যে কেউ শুনে বলবে ওটা স্বপ্ন ছিল কিন্তু আমি মানতে নারাজ স্পষ্ট মনে আছে আমার বুঁচি এসেছিল সত্যি এসেছিল

এখানেই শেষ নয় তারপর থেকে বুঁচি বার বারই আসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথা বলে অনেকক্ষণ সময় কাটায় আমার সঙ্গে পড়তে বসে অন্যদিকে মন চলে গেলে ধমকের সুরে বলে, “মন দিয়ে পড় কোনো ফাঁকি চলবে না বড়ো হয়ে টিচার হতে হবে না?
আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শুনে চলি পড়ায় অমনোযোগ কমতে থাকে আমার সবসময় পাশে থাকে স্কুলে পরীক্ষার সময়ও মনে জোর পাই ওর জন্যে কিন্তু আশ্চর্য! আমি তো কোনোদিন টিচার হতে চাইতাম না! চাইত দিদিমণি হওয়ার স্বপ্ন ওর ছিল সেটা যে কী করে, কবে থেকে আমার হয়ে গেল কে জানে! যাই হোক, এখন জীবনের উদ্দেশ্যই বদলে গেছে বুঁচি বদলে দিয়েছে যে করেই হোক ওর স্বপ্ন আমাকে দিয়ে পূরণ করতে চায়
হোক না! মন্দ কী? বুঁচি চলে যাবার পরে খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল আমার লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম মনের মতন বন্ধু বলতে তো আমার ওই একজনই এই প্রসঙ্গে বলি, আমি স্বভাবগত দিক থেকে খুবই ভীতু আর গোবেচারা প্রকৃতির ছিলাম কথাও বলতাম কম কল্পনার জগতে ভেসে ভেসে থাকতাম অল্পেতেই ঘাবড়ে যেতাম, কেঁদে ফেলতাম সাধারণত আমার মতন স্বভাবের যারা হয়, তাদেরকে কেউ বন্ধু বানাতে চায় না হাসাহাসি করে টিটকিরি দেয় আমার ক্ষেত্রেও তাই হত হাতের সামনে নরম মাটি পেয়ে সবাই আঁচড় দিত ক্লাসের দাপুটে মেয়ে লম্বা চেহারার তামসী আমি ক্লাসরুমে ঢোকামাত্রই সামনে এগিয়ে এসে আমার পায়ের সঙ্গে ওর পাটা জড়িয়ে কী যেন একটা করত আমি পড়ে যেতাম মেঝের ওপর ক্লাসশুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠত কষ্টে রাগে দু’চোখ ভরা অন্ধকার তবুও কিছু বলতে পারতাম না প্রতিবাদ করবার মতন মনোবল বা গায়ের জোর কোনোটাই আমার ছিল না তাই আমি স্কুলে আগে আগে চলে গেলেও ক্লাসরুমে ঢুকতাম না প্রার্থনা শেষে ক্লাসটিচারের সঙ্গে ঢুকতাম
তো বুঁচি একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে আমার কানের কাছে এসে বলল, “আজ তুই একা যাবি ক্লাসে মিনতি ম্যাডামের সঙ্গে না
আমি চমকে উঠে বললাম, “কী বলছিস তুই? ওই তামসীকে চিনিস না? আবার আমার সঙ্গে ওরকম করবে
“ওই ভয়ে ভয়ে থাকিস বলেই সবাই এত সুযোগ পায় ওসব সহ্য করিস কেন? রুখে দাঁড়াতে পারিস না?
“না, পারি না ওর গায়ের জোর অনেক বেশি কিছু বলতে গেলে আরও মারবে
“মারুক তবুও বলবি এত দুর্বল ভাবিস কেন নিজেকে?
“আমি তো দুর্বলই
“মোটেও না মনে নেই, তোর দাদু বলতেন- প্রত্যেকের মধ্যেই নিজস্ব শক্তি থাকে সেটা ভুলে গেলে চলবে? এত ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে কী করে তুই টিচার হবি বল তো?
আমি আর কিছু বললাম না ওর কথামতো সেদিন আগে আগেই আবার ক্লাসে ঢুকলাম একা সবাই তখনও আসেনি চোখ চলে গেল তামসীর দিকে আমাকে দেখতে পেয়েছে মুচকি হাসছে আগের মতোই আমি বেঞ্চের দিকে পা বাড়াতেই এগিয়ে এল
কিন্তু এবার একটু অন্যরকম কিছু ঘটল আমার একটুও ভয় লাগছে না বরং অপেক্ষা করছি কখন আসে সামনে আসতেই আমি হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে খুব শান্ত অথচ বেশ জোর গলায় বললাম, “আর এক পা- এগোবি না তামসী এতদিন যা করেছিস করেছিস নিজের সীমার মধ্যে থাক নাহলে আমিও কিন্তু আর চুপ থাকব না
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললাম খুব অদ্ভুত লাগছে এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে তো কোনোদিন গর্জে উঠিনি! তামসী নিশ্চয়ই এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ মারধোর শুরু করবে! আর ওর আশেপাশের বন্ধুরাও নিশ্চয়ই হাসিতে ফেটে পড়বে আমার অবস্থা দেখে! সেটা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক
কিন্তু তা হল না সবাই কেমন ভয়ার্ত চোখে দেখছে যেন অলৌকিক অবাস্তব কিছু তামসীর এমন সন্ত্রস্ত রূপ তো এর আগে কখনও দেখিনি! হলটা কী? তামসী বিড় বিড় করে বলছে, “ওই... ওই শুনছিস? অন্য গলায় কথা বলছে রে! অন্যরকম গলা! ভূত নাকি রে! চল, চল পালাই...
সত্যি তো! আমি নিজেও অনুভব করলাম আমার গলা দিয়ে বুঁচির আওয়াজ বেরোচ্ছিল স্পষ্ট বুঁচির গলার স্বর রুক্ষ, খ্যানখ্যানে নিজেও কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন
তবে তারপর থেকে আর কখনও কেউ অন্যায় জোর খাটিয়ে দমিয়ে রাখতে পারেনি প্রতিবাদ করতাম তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে বুঁচির গলার আওয়াজ আশ্চর্য এক পরিবর্তন এল আমার মধ্যে পড়ায় ফাঁকি দিতাম না অঙ্ক করতে ভয় পেতাম না চোখ ভরানো আলো, মন ভরানো আত্মবিশ্বাস রেজাল্ট ভালো হতে শুরু করল বাবা-মা বেজায় খুশি

হ্যাঁ, শিক্ষিকা আমি হতে পেরেছি বুঁচির সাধপূরণ করতে পেরেছি কিন্তু বুঁচি আর নেই কোনোখানে নেই যেদিন প্রথম স্কুলে জয়েন করলাম মায়ের পাটভাঙা শাড়ি পরে, সেদিন সকালে সে এসেছিল শেষবারের মতো বলেছিল, “তুই ভীষণ ভালো দিদিমণি হবি দেখে নিস খুব মন দিয়ে কাজ করবি ভালো করে পড়াবি এগিয়ে যা অনেক এগিয়ে যা জানি পারবি আমি আর আসব না আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে চললাম
“চললাম মানে? আমাকে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই? কোথাও যেতে দেব না তোকে বুঁচিইইই...!!
হাজার ডাকের পরেও আর আসেনি অনেক চেষ্টা করেছি, কান্নাকাটি করেছি যদি একটিবার ওর গলা শুনতে পাওয়া যায়, একটিবার ওকে দেখা যায়... কিন্তু পাইনি

বুঁচির কথা কোনোদিন কাউকে বলিনি শুধু মাসতুতো বোন রুমিকে বলেছিলাম একবার সব শুনে বলেছিল, “এ সমস্তটাই আসলে তোর কল্পনা তুই হ্যালুশিনেট করতিস মেয়েটা মারা যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলি আসলে বুঁচির আত্মা নয়, ওটা তোর উইলপাওয়ার ছিল - যা তোকে ভীষণভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে
উত্তরে আমি কিছু বলিনি ওর জায়গায় যে কেউই ওই একই কথা বলবে ওগুলো আমার হ্যালুশিনেশান, বুঁচির কোনো অস্তিত্ব নেই... বুঁচির প্রেরণা নয়, আমার ইচ্ছাশক্তির জোরেই আসলে আমি নিজেকে এতটা বদলাতে পেরেছি...
কেউ কেউ হয়তো আমাকে নিয়ে মশকরাও করবে তাই আমি আর কাউকে এসব কথা বলতে যাই না কখনও
লোকে বিশ্বাস করুক আর না করুক আমি মানি, মানব চিরদিন -  বুঁচিই ছিল, আমার একমাত্র বন্ধুটা আমার বড্ড প্রিয় - রুগ্ন কালো অবহেলিত দাঁত উঁচু ছেঁড়া ফ্রক পরা বন্ধুটা
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

3 comments: