গল্পের ম্যাজিক:: হোলির হলিডেতে - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস


হোলির হলিডেতে
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

আমাদের হোস্টেলের পেছনে, শিমুল পলাশের ছায়া ঢাকা লাল মোরামের রাস্তাটা সোজা গিয়ে মিশেছে হাইওয়েতে প্রফেসর বাংলো থেকে বিদায়ী আশীর্বাদ নিয়ে, বর-কনের গাড়ি সেই রাস্তায় কনের শ্বশুরবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল তখনও হোলির রং না মুছতে পারা বরযাত্রীদের বাস, কয়েক মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে দুটো গাড়ি মিলে মোরামের রাস্তায় লাল ধুলোর যে ঝড় তুলে গেল সেটা থেকে হোস্টেলের কমনরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো আমাদের চারজনের পাঞ্জাবি আর মাথার চুলগুলোও রেহাই পেল না
যে যার হাত উলটে শরীরের আর পোশাকের ধুলো ঝাড়তে গিয়ে হাতটা নাকের সামনে কয়েকবার আসা-যাওয়া করবার পর সকলে আর একবার স্বীকার করলাম যে কাল রাতে ওয়ার্ডেন স্যারের মেয়ের বিয়েতে আমরা চার জন অনাহুত অতিথি বেশ ভালোই খাওয়াদাওয়া করতে পেরেছি
আমাদের হাসিটা কি একটু জোর হয়ে গেল? কন্যাবিদায় করেই আমাদের হল ওয়ার্ডেন (খড়্গপুরে হোস্টেলকে হল বলা হয়) প্রফেসর চন্দ্রমৌলি ঘোষ ওরফে ছোটামোটা ঘোষ স্যার তাঁর সাইকেলে বেশ অসময়ে হলে ঢুকলেন গেট পার করবার সময়, একবার আমাদের ব্যালকনির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাবার পর, সোজা হল ওয়ার্ডেনের অফিসের দিকেই গেলেন
আজ রবিবারের ছুটির সকালে, তাও সদ্য কন্যাবিদায় করে ওয়ার্ডেন এসেছেন এর মানেই কালকের কাণ্ডের জন্য, ওয়ার্ডেনের অফিসে ফোর গ্যাংয়ের সবাইয়ের একসঙ্গে ডাক পড়বে আর সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা তবে উনি আমাদের বেশি কিছু বলতে বা শাসাতে পারবেন না সে জন্য তৈরি আছে জিজির নিজের হাতে অ্যাসেম্বল করা হাই ফিডেলিটি পকেট টেপ রেকর্ডার আর ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি
নানাবিধ নষ্টামি-দুষ্টামির জন্য বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ফোর গ্যাং হল ফার্স্ট ইয়ারের জিজি, পিজি, সেপ আর বিপ এই চারজন, যারা সবাই এই হোস্টেলের আবাসিক এই নামগুলো আমাদের স্বসৃষ্ট হলেও বেশিরভাগ সময় আমাদের চারজনকে একসঙ্গে দেখা যেত বলে আমাদের অন্য বন্ধুরা, অধ্যাপক এবং শিক্ষণ কর্মীরা আমাদেরকে ফোর গ্যাং বলে ডাকত
অসাধারণ মেধার অধিকারী জিজি নিজের বিষয় ছাড়াও আরও অনেক বিষয়েই দখল রাখত এর সঙ্গে নানারকম দুষ্ট বুদ্ধির প্ল্যানও তার মাথায় রীতিমতো চলত ফিরত সেগুলি এত মজার আর কিছুটা বুক কাঁপানো দুঃসাহসিক ছিল যে আমরা তিনজনও তাতে বিনা দ্বিধায় যোগ দিতাম এই কারণে সে ছিল আমাদের অবিসংবাদিত নেতা
সেইসব দুষ্টামি নষ্টামির ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো বলছি সেদিন আমাদের ওয়ার্ডেন ছোটামোটা যে কারণে আমাদেরকে তলব করেছিলেন তার মূল কারণ ছিল তাঁরই মেয়ের বিয়েতে সব রকমের কড়া পাহারাকে কলা দেখিয়ে অনাহুত ফোর গ্যাং বিনা বাধায় বেশ পেটপুরে ভোজ খেয়ে হোস্টেলে ফিরে গেছিল
এর আগে ফোর গ্যাং, উত্তেজনার আগুন পোহাতে বা নিছক মজা করবার জন্য, ক্যাম্পাসের প্রফেসর বা শিক্ষাকর্মীদের আবাসনে অনাহুত হয়ে অনুষ্ঠানবাড়ির ভোজ খেয়েছে তবে সব জায়গাতেই জিজি নিজের আঁকা অয়েল পেন্টিং, আমাদের সবাইয়ের তরফ থেকে উপহার দিয়েছে আপত্তি করা দূরে থাক, সবাই এইরকম অনাহুত অতিথিদের স্বাগত জানাত তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার লজ্জা পাওয়া স্বরে এও বলতেন, তোমরা এসে আমাদের অনেক উপকার করেছ আমার লোকবল নেহাত কম যদি কিছু মনে না কর, তাহলে তোমরা একটু বাকি সবাইকে দেখ, খুব উপকার হয় আমার আমরা পেটপুরে ভোজও খেতাম আবার পরিবেশনের কাজেও লেগে যেতাম
সংসারের সব জিনিসেই ব্যতিক্রম হয় এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী বিভাগীয় প্রধান এবং আমাদের হলের মুখ্য ওয়ার্ডেন প্রফেসর চন্দ্রমৌলি ঘোষ ছিলেন সেই ব্যতিক্রম বেঁটে, মোটা এবং অতি কৃপণ স্বভাবের এই অধ্যাপক তাঁর শরীরের আকৃতির জন্য ‘ছোটামোটা’ নামে বেশি সুপরিচিত ছিলেন সপরিবারে এসে হলের প্রতিটা উৎসব এবং ডিনারের খাবার আইটেমগুলো তারিয়ে তারিয়ে খেতে ছাড়তেন না, কিন্তু নিজের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে হলের একটি ছাত্রকেও ডাকতেন না কোনো এমার্জেন্সিতে তাঁর বাংলোতে গিয়ে দেখা করতে গেলে, তিনি ভেতরে ডাকতেন না পাছে যদি কেউ এক গ্লাস জল চেয়ে বসে
তাঁর মেয়ের বিয়েতে অভ্যাগতদের আপ্যায়নে সিকিউরিটির লোকজন মোতায়েন করবার আগাম খবর, উনি নিজেই আমাদের হোস্টেলে ছড়িয়ে দিয়ে, ব্যাপারটা বেশ চ্যালেঞ্জিং করে দিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, তিনি অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচন করেছিলেন বেশ মাথা খাটিয়ে যাতে পুরো ক্যাম্পাস থেকেই নিমন্ত্রিত অভ্যাগতের সংখ্যা কম হয়, কিন্তু উপহার পুরো হয় সেটা কীভাবে তা জিজি বুঝেছিল এবং চ্যালেঞ্জটার মোকাবিলা সে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উপায়েই করেছিল
সামনে হোলির জন্য দুদিন ছুটি, তার সঙ্গে আর একটি রাজ্য সরকারের ছুটির দিন আর সপ্তাহান্তের দু’দিন ছুটি, সব মিলিয়ে পাঁচ দিন ছুটি নিজের নিজের বিভাগীয় প্রধানকে ম্যানেজ করে, নির্ধারিত ছুটির দিনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে হোস্টেল খালি হতে শুরু করেছে আমাদের দোতলার ঘরের জানালা থেকে মেন গেট দেখা যায় আমাদের হলের একদল আবাসিক বিকেলের ক্লাস শেষে, কাঁধে ব্যাগ বেঁধে বাড়ি যাবার জন্য স্টেশনের দিকে যাচ্ছে জিজি তার ঘরের জানালা থেকে সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল,বাড়ি যাব, তবে একটা বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে আমার মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে, তোরা চাইলে জয়েন করতে পারিস
এবার তার টেবিলের দিকে চেয়ে দেখি সেখানে রাখা বইপত্রের ফাঁক থেকে একটা ক্যাটকেটে হলুদ রং-এর বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণলিপি আর ক্যাম্পাসের ম্যাপ উঁকি মারছে
আমাদের চার জনের মধ্যে বিপ সবচাইতে লম্বা, সোয়া ফিটের ওপরে টেবিল থেকে কার্ডটা ছোঁ মেরে হাতে তুলে বলে, “তাহলে ছোটামোটার মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন একা জিজি পেয়েছে!সেপ বলে, “শয়তান ছোটামোটা, আমাদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করছে
ক্যাম্পাসের ম্যাপটা হাতে নিয়ে বিরক্ত জিজি বলে, “তোরা চুপ কর সেটা যদি হত তাহলে এনভেলপে আমার নাম লেখা থাকত এটা ছাপাখানা থেকে অনেক কষ্টে গেঁড়িয়েছি হোলির দিনের আগেপিছে থেকে অনুষ্ঠানবাড়ির কাজের লোকজন পাওয়া মুশকিল আর পেলেও ডেকরেটর, ক্যাটারাররা চড়া দাম নেবে তা সত্ত্বেও, লাগাতার পাঁচ দিনের ছুটির সময়ে এবং দোলের দিনই ছোটামোটা তার মেয়ের ডেট এই জন্য ফেলেছে...আমি ওর কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, লাগাতার পাঁচ দিন ছুটির জন্যে, সব হলের ছাত্ররা আর ক্যাম্পাসে অনেক স্যারেরা সপরিবারে হয় বাড়িতে না হয় ষাট কিমি দূরে দীঘাতে যাবে এই দিনে নেমন্তন্ন করলে অভ্যাগতদের আসবার সম্ভাবনা কম নিমন্ত্রিতের ভিড় কম হলে আমাদের মতো গেট ক্রাশ করে ঢুকে যাওয়া বেলাজ পার্টিদের উৎপাতের সম্ভাবনা কম কাজেই খাওয়ানোর খরচ কম হবেশেপ বললে,কিন্তু স্যারেরা বিয়ের অনুষ্ঠানে না আসতে পারলেও, চক্ষুলজ্জার খাতিরে দামি দামি গিফট দেবেনই
বিপ বলে, এই হল আসল কিপটের বুদ্ধি আমাদের হলের হেড কুক কিরুর দাদা বীরু ক্যাটারারকে, অনুষ্ঠান বাড়ির লোক খাওয়ানোর ভার দিয়েছে কিরু বলছিল যে ছোটামোটা তাকে বলেই দিয়েছে ষাটজন বরযাত্রী আর নিমন্ত্রিত বাড়ির লোক মিলে একশো দশ-পনেরোর বেশি লোক হবে না তখন বুঝিনি, এইবার ছোটামোটার হিসেব বুঝলাম
জিজি আমাদের কথা শুনছিল আর স্বভাবসিদ্ধ মিটিমিটি হাসছিল শেষটায় একটু হাসতে হাসতেই বলে, “আর এই বুদ্ধির চালেই ছোটামোটার চ্যালেঞ্জ হবে কুপোকাত
আমি বলি,সেটা কী রকম?”
জিজি বলে, “এটাও কি বুঝিয়ে বলতে হবে? হোলির দিনের রং মাখবার সুবিধেটা ভাব একবার তবে আমাদের প্ল্যান ফুলপ্রুফ করতে গেলে একটু ইনভেস্ট করতেই হবে এই শুনে সেপ বলে,গিফট কেনবার খরচ তো আমরা শেয়ার করবই
জিজি বলে, “সে খরচের কথা বলছি না এই ম্যাপটা দেখ পুরী লেভেল ক্রসিং গেটের পর আমাদের ক্যাম্পাসের মেন গেট সেটা পার হলেই ছেদির চায়ের দোকান বছরের মধ্যে এই একটা দিন এই দোকানে চায়ের বদলে ভাং-এর শরবত বা একই জিনিস নাম বদলে ঠান্ডাই হয় বরের গাড়ি কোথাও না থেমেই সোজা চলে যাবে ছোটামোটা স্যারের বাংলোতে সে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আমাদের এর একটু পরেই আসবে বরযাত্রীদের বাস আমরা বাস থামিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করব ছেদির বিখ্যাত ভাং-এর স্পেশ্যাল শরবত দিয়ে এরপর বরযাত্রীদের বাসে...
আমি, সেপ আর বিপ ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একসঙ্গে বলে উঠলাম,হুররে! সত্যিই ছোটামোটা তার নিজেরই চালাকির চালে কুপোকাত হবে এজন্য ছেদির দোকানে পঞ্চাশজন লোকের ভাং-এর শরবতের দাম মেটানো এমন কিছুই নয়
গভীর চিন্তার মধ্যে থেকে জিজি গম্ভীর স্বরে বললে, “এখনই এত নাচিস না সবাইকে একসঙ্গে খুব ঠান্ডা মাথায় কাজটা করে যেতে হবেএই কথা বলে জিজি ক্যাম্পাসের ম্যাপটা নিজের টেবিলে বিছিয়ে, আমাদের সবাইকে কাছে ডেকে পুরো প্ল্যানটা বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললে এবং আমরাও ভেবেচিন্তে কিছু পরিবর্তন করে প্ল্যানকে ফাইনাল করলাম
ক্যাম্পাসের অধিকাংশ প্রফেসর, শিক্ষা কর্মী এবং সমস্ত হলগুলির বেশির ভাগ আবাসিকরা যে নির্ধারিত ছুটিতে দলে দলে বাড়ি আর দীঘার দিকে যাওয়া শুরু করেছে এই খবরটা, ছোটামোটার প্রধান খবরি হেড ওয়ার্ড বয় দিনুর মারফত পেয়ে, নিজের আগাম আন্দাজ মিলে যাবার জন্য স্যার মনে মনে খুব উল্লসিত ফোর গ্যাং-এর সবাই যে হোলির একদিন আগেই বিকেলের দিকে হল ছেড়ে আমার গ্রামের বাড়িতে যাবে তার অনুমতিপত্র দিনুর হাত দিয়ে পাঠানো মাত্র ওয়ার্ডেন অফিস থেকে অনুমোদন চলে এল দিনু বললে যে কাল আমরা যেন স্পেশ্যাল লাঞ্চ খেয়ে তবে যাই ওয়ার্ডেন স্যার বলে পাঠালেন যে কাল তাঁর নিজের কাজে একটা স্টেশন ওয়াগন খড়গপুর স্টেশনে যাচ্ছে আমরা চাইলে সেই গাড়িতেই যেতে পারি
আমি জিজির দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমরা যে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি, সেটা উনি নিশ্চিত করতে এবং শেষটা কী হল তার ফিড ব্যাক নিজের পেটোয়া লোকদের মারফত জানতে চাইছেন
সেপ বলে, “ভালোই তো, আমাদের স্টেশনে যাবার অটো ভাড়া বেঁচে গেল খড়গপুর স্টেশন অবধি পৌঁছে দিলে ভালোই তো ওখান থেকে তো কয়েক কদম হাঁটলেই...জিজি সেপ-কে শেষ না করতে দিয়েই নিজের তর্জনী ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলে, “ধীরে, বন্ধু ধীরে মনে রেখো সবাই, ওয়ার্ডেন স্যারের খবরি কে যে নয় তা বলা খুব মুশকিল মনে হচ্ছে ওনার খবরি খড়গপুর স্টেশনের বোগদা টিকিট কাউন্টার থেকে সব জায়গাতেই মজুত থাকবে ঐখানে