গল্পের ম্যাজিক:: হোলির হলিডেতে - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস


হোলির হলিডেতে
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

আমাদের হোস্টেলের পেছনে, শিমুল পলাশের ছায়া ঢাকা লাল মোরামের রাস্তাটা সোজা গিয়ে মিশেছে হাইওয়েতে প্রফেসর বাংলো থেকে বিদায়ী আশীর্বাদ নিয়ে, বর-কনের গাড়ি সেই রাস্তায় কনের শ্বশুরবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল তখনও হোলির রং না মুছতে পারা বরযাত্রীদের বাস, কয়েক মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে দুটো গাড়ি মিলে মোরামের রাস্তায় লাল ধুলোর যে ঝড় তুলে গেল সেটা থেকে হোস্টেলের কমনরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো আমাদের চারজনের পাঞ্জাবি আর মাথার চুলগুলোও রেহাই পেল না
যে যার হাত উলটে শরীরের আর পোশাকের ধুলো ঝাড়তে গিয়ে হাতটা নাকের সামনে কয়েকবার আসা-যাওয়া করবার পর সকলে আর একবার স্বীকার করলাম যে কাল রাতে ওয়ার্ডেন স্যারের মেয়ের বিয়েতে আমরা চার জন অনাহুত অতিথি বেশ ভালোই খাওয়াদাওয়া করতে পেরেছি
আমাদের হাসিটা কি একটু জোর হয়ে গেল? কন্যাবিদায় করেই আমাদের হল ওয়ার্ডেন (খড়্গপুরে হোস্টেলকে হল বলা হয়) প্রফেসর চন্দ্রমৌলি ঘোষ ওরফে ছোটামোটা ঘোষ স্যার তাঁর সাইকেলে বেশ অসময়ে হলে ঢুকলেন গেট পার করবার সময়, একবার আমাদের ব্যালকনির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাবার পর, সোজা হল ওয়ার্ডেনের অফিসের দিকেই গেলেন
আজ রবিবারের ছুটির সকালে, তাও সদ্য কন্যাবিদায় করে ওয়ার্ডেন এসেছেন এর মানেই কালকের কাণ্ডের জন্য, ওয়ার্ডেনের অফিসে ফোর গ্যাংয়ের সবাইয়ের একসঙ্গে ডাক পড়বে আর সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা তবে উনি আমাদের বেশি কিছু বলতে বা শাসাতে পারবেন না সে জন্য তৈরি আছে জিজির নিজের হাতে অ্যাসেম্বল করা হাই ফিডেলিটি পকেট টেপ রেকর্ডার আর ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি
নানাবিধ নষ্টামি-দুষ্টামির জন্য বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ফোর গ্যাং হল ফার্স্ট ইয়ারের জিজি, পিজি, সেপ আর বিপ এই চারজন, যারা সবাই এই হোস্টেলের আবাসিক এই নামগুলো আমাদের স্বসৃষ্ট হলেও বেশিরভাগ সময় আমাদের চারজনকে একসঙ্গে দেখা যেত বলে আমাদের অন্য বন্ধুরা, অধ্যাপক এবং শিক্ষণ কর্মীরা আমাদেরকে ফোর গ্যাং বলে ডাকত
অসাধারণ মেধার অধিকারী জিজি নিজের বিষয় ছাড়াও আরও অনেক বিষয়েই দখল রাখত এর সঙ্গে নানারকম দুষ্ট বুদ্ধির প্ল্যানও তার মাথায় রীতিমতো চলত ফিরত সেগুলি এত মজার আর কিছুটা বুক কাঁপানো দুঃসাহসিক ছিল যে আমরা তিনজনও তাতে বিনা দ্বিধায় যোগ দিতাম এই কারণে সে ছিল আমাদের অবিসংবাদিত নেতা
সেইসব দুষ্টামি নষ্টামির ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো বলছি সেদিন আমাদের ওয়ার্ডেন ছোটামোটা যে কারণে আমাদেরকে তলব করেছিলেন তার মূল কারণ ছিল তাঁরই মেয়ের বিয়েতে সব রকমের কড়া পাহারাকে কলা দেখিয়ে অনাহুত ফোর গ্যাং বিনা বাধায় বেশ পেটপুরে ভোজ খেয়ে হোস্টেলে ফিরে গেছিল
এর আগে ফোর গ্যাং, উত্তেজনার আগুন পোহাতে বা নিছক মজা করবার জন্য, ক্যাম্পাসের প্রফেসর বা শিক্ষাকর্মীদের আবাসনে অনাহুত হয়ে অনুষ্ঠানবাড়ির ভোজ খেয়েছে তবে সব জায়গাতেই জিজি নিজের আঁকা অয়েল পেন্টিং, আমাদের সবাইয়ের তরফ থেকে উপহার দিয়েছে আপত্তি করা দূরে থাক, সবাই এইরকম অনাহুত অতিথিদের স্বাগত জানাত তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার লজ্জা পাওয়া স্বরে এও বলতেন, তোমরা এসে আমাদের অনেক উপকার করেছ আমার লোকবল নেহাত কম যদি কিছু মনে না কর, তাহলে তোমরা একটু বাকি সবাইকে দেখ, খুব উপকার হয় আমার আমরা পেটপুরে ভোজও খেতাম আবার পরিবেশনের কাজেও লেগে যেতাম
সংসারের সব জিনিসেই ব্যতিক্রম হয় এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী বিভাগীয় প্রধান এবং আমাদের হলের মুখ্য ওয়ার্ডেন প্রফেসর চন্দ্রমৌলি ঘোষ ছিলেন সেই ব্যতিক্রম বেঁটে, মোটা এবং অতি কৃপণ স্বভাবের এই অধ্যাপক তাঁর শরীরের আকৃতির জন্য ‘ছোটামোটা’ নামে বেশি সুপরিচিত ছিলেন সপরিবারে এসে হলের প্রতিটা উৎসব এবং ডিনারের খাবার আইটেমগুলো তারিয়ে তারিয়ে খেতে ছাড়তেন না, কিন্তু নিজের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে হলের একটি ছাত্রকেও ডাকতেন না কোনো এমার্জেন্সিতে তাঁর বাংলোতে গিয়ে দেখা করতে গেলে, তিনি ভেতরে ডাকতেন না পাছে যদি কেউ এক গ্লাস জল চেয়ে বসে
তাঁর মেয়ের বিয়েতে অভ্যাগতদের আপ্যায়নে সিকিউরিটির লোকজন মোতায়েন করবার আগাম খবর, উনি নিজেই আমাদের হোস্টেলে ছড়িয়ে দিয়ে, ব্যাপারটা বেশ চ্যালেঞ্জিং করে দিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, তিনি অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচন করেছিলেন বেশ মাথা খাটিয়ে যাতে পুরো ক্যাম্পাস থেকেই নিমন্ত্রিত অভ্যাগতের সংখ্যা কম হয়, কিন্তু উপহার পুরো হয় সেটা কীভাবে তা জিজি বুঝেছিল এবং চ্যালেঞ্জটার মোকাবিলা সে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উপায়েই করেছিল
সামনে হোলির জন্য দুদিন ছুটি, তার সঙ্গে আর একটি রাজ্য সরকারের ছুটির দিন আর সপ্তাহান্তের দু’দিন ছুটি, সব মিলিয়ে পাঁচ দিন ছুটি নিজের নিজের বিভাগীয় প্রধানকে ম্যানেজ করে, নির্ধারিত ছুটির দিনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে হোস্টেল খালি হতে শুরু করেছে আমাদের দোতলার ঘরের জানালা থেকে মেন গেট দেখা যায় আমাদের হলের একদল আবাসিক বিকেলের ক্লাস শেষে, কাঁধে ব্যাগ বেঁধে বাড়ি যাবার জন্য স্টেশনের দিকে যাচ্ছে জিজি তার ঘরের জানালা থেকে সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল,বাড়ি যাব, তবে একটা বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে আমার মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে, তোরা চাইলে জয়েন করতে পারিস
এবার তার টেবিলের দিকে চেয়ে দেখি সেখানে রাখা বইপত্রের ফাঁক থেকে একটা ক্যাটকেটে হলুদ রং-এর বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণলিপি আর ক্যাম্পাসের ম্যাপ উঁকি মারছে
আমাদের চার জনের মধ্যে বিপ সবচাইতে লম্বা, সোয়া ফিটের ওপরে টেবিল থেকে কার্ডটা ছোঁ মেরে হাতে তুলে বলে, “তাহলে ছোটামোটার মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন একা জিজি পেয়েছে!সেপ বলে, “শয়তান ছোটামোটা, আমাদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করছে
ক্যাম্পাসের ম্যাপটা হাতে নিয়ে বিরক্ত জিজি বলে, “তোরা চুপ কর সেটা যদি হত তাহলে এনভেলপে আমার নাম লেখা থাকত এটা ছাপাখানা থেকে অনেক কষ্টে গেঁড়িয়েছি হোলির দিনের আগেপিছে থেকে অনুষ্ঠানবাড়ির কাজের লোকজন পাওয়া মুশকিল আর পেলেও ডেকরেটর, ক্যাটারাররা চড়া দাম নেবে তা সত্ত্বেও, লাগাতার পাঁচ দিনের ছুটির সময়ে এবং দোলের দিনই ছোটামোটা তার মেয়ের ডেট এই জন্য ফেলেছে...আমি ওর কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, লাগাতার পাঁচ দিন ছুটির জন্যে, সব হলের ছাত্ররা আর ক্যাম্পাসে অনেক স্যারেরা সপরিবারে হয় বাড়িতে না হয় ষাট কিমি দূরে দীঘাতে যাবে এই দিনে নেমন্তন্ন করলে অভ্যাগতদের আসবার সম্ভাবনা কম নিমন্ত্রিতের ভিড় কম হলে আমাদের মতো গেট ক্রাশ করে ঢুকে যাওয়া বেলাজ পার্টিদের উৎপাতের সম্ভাবনা কম কাজেই খাওয়ানোর খরচ কম হবেশেপ বললে,কিন্তু স্যারেরা বিয়ের অনুষ্ঠানে না আসতে পারলেও, চক্ষুলজ্জার খাতিরে দামি দামি গিফট দেবেনই
বিপ বলে, এই হল আসল কিপটের বুদ্ধি আমাদের হলের হেড কুক কিরুর দাদা বীরু ক্যাটারারকে, অনুষ্ঠান বাড়ির লোক খাওয়ানোর ভার দিয়েছে কিরু বলছিল যে ছোটামোটা তাকে বলেই দিয়েছে ষাটজন বরযাত্রী আর নিমন্ত্রিত বাড়ির লোক মিলে একশো দশ-পনেরোর বেশি লোক হবে না তখন বুঝিনি, এইবার ছোটামোটার হিসেব বুঝলাম
জিজি আমাদের কথা শুনছিল আর স্বভাবসিদ্ধ মিটিমিটি হাসছিল শেষটায় একটু হাসতে হাসতেই বলে, “আর এই বুদ্ধির চালেই ছোটামোটার চ্যালেঞ্জ হবে কুপোকাত
আমি বলি,সেটা কী রকম?”
জিজি বলে, “এটাও কি বুঝিয়ে বলতে হবে? হোলির দিনের রং মাখবার সুবিধেটা ভাব একবার তবে আমাদের প্ল্যান ফুলপ্রুফ করতে গেলে একটু ইনভেস্ট করতেই হবে এই শুনে সেপ বলে,গিফট কেনবার খরচ তো আমরা শেয়ার করবই
জিজি বলে, “সে খরচের কথা বলছি না এই ম্যাপটা দেখ পুরী লেভেল ক্রসিং গেটের পর আমাদের ক্যাম্পাসের মেন গেট সেটা পার হলেই ছেদির চায়ের দোকান বছরের মধ্যে এই একটা দিন এই দোকানে চায়ের বদলে ভাং-এর শরবত বা একই জিনিস নাম বদলে ঠান্ডাই হয় বরের গাড়ি কোথাও না থেমেই সোজা চলে যাবে ছোটামোটা স্যারের বাংলোতে সে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আমাদের এর একটু পরেই আসবে বরযাত্রীদের বাস আমরা বাস থামিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করব ছেদির বিখ্যাত ভাং-এর স্পেশ্যাল শরবত দিয়ে এরপর বরযাত্রীদের বাসে...
আমি, সেপ আর বিপ ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে একসঙ্গে বলে উঠলাম,হুররে! সত্যিই ছোটামোটা তার নিজেরই চালাকির চালে কুপোকাত হবে এজন্য ছেদির দোকানে পঞ্চাশজন লোকের ভাং-এর শরবতের দাম মেটানো এমন কিছুই নয়
গভীর চিন্তার মধ্যে থেকে জিজি গম্ভীর স্বরে বললে, “এখনই এত নাচিস না সবাইকে একসঙ্গে খুব ঠান্ডা মাথায় কাজটা করে যেতে হবেএই কথা বলে জিজি ক্যাম্পাসের ম্যাপটা নিজের টেবিলে বিছিয়ে, আমাদের সবাইকে কাছে ডেকে পুরো প্ল্যানটা বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললে এবং আমরাও ভেবেচিন্তে কিছু পরিবর্তন করে প্ল্যানকে ফাইনাল করলাম
ক্যাম্পাসের অধিকাংশ প্রফেসর, শিক্ষা কর্মী এবং সমস্ত হলগুলির বেশির ভাগ আবাসিকরা যে নির্ধারিত ছুটিতে দলে দলে বাড়ি আর দীঘার দিকে যাওয়া শুরু করেছে এই খবরটা, ছোটামোটার প্রধান খবরি হেড ওয়ার্ড বয় দিনুর মারফত পেয়ে, নিজের আগাম আন্দাজ মিলে যাবার জন্য স্যার মনে মনে খুব উল্লসিত ফোর গ্যাং-এর সবাই যে হোলির একদিন আগেই বিকেলের দিকে হল ছেড়ে আমার গ্রামের বাড়িতে যাবে তার অনুমতিপত্র দিনুর হাত দিয়ে পাঠানো মাত্র ওয়ার্ডেন অফিস থেকে অনুমোদন চলে এল দিনু বললে যে কাল আমরা যেন স্পেশ্যাল লাঞ্চ খেয়ে তবে যাই ওয়ার্ডেন স্যার বলে পাঠালেন যে কাল তাঁর নিজের কাজে একটা স্টেশন ওয়াগন খড়গপুর স্টেশনে যাচ্ছে আমরা চাইলে সেই গাড়িতেই যেতে পারি
আমি জিজির দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমরা যে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি, সেটা উনি নিশ্চিত করতে এবং শেষটা কী হল তার ফিড ব্যাক নিজের পেটোয়া লোকদের মারফত জানতে চাইছেন
সেপ বলে, “ভালোই তো, আমাদের স্টেশনে যাবার অটো ভাড়া বেঁচে গেল খড়গপুর স্টেশন অবধি পৌঁছে দিলে ভালোই তো ওখান থেকে তো কয়েক কদম হাঁটলেই...জিজি সেপ-কে শেষ না করতে দিয়েই নিজের তর্জনী ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলে, “ধীরে, বন্ধু ধীরে মনে রেখো সবাই, ওয়ার্ডেন স্যারের খবরি কে যে নয় তা বলা খুব মুশকিল মনে হচ্ছে ওনার খবরি খড়গপুর স্টেশনের বোগদা টিকিট কাউন্টার থেকে সব জায়গাতেই মজুত থাকবে ঐখানে পৌঁছে আমাদের একজন বোগদা কাউন্টার থেকে মেদিনীপুর, শালবনী, গড়বেতা আর বাঁকুড়া এই চারটে স্টেশনের টিকিট চাইবে বেশ শুনিয়ে শুনিয়ে খবরির মাধ্যমে ছোটামোটা জানবেন যে আমরা চার জন একে অন্যের থেকে দূরে দূরে গিয়ে একদম আলাদা হয়ে গেছি আমাদের জন্য তাঁকে আর চিন্তা করতে হবে না টিকিট কেটেই রাস্তার উলটো দিকের ধোসার ঝুপড়িগুলোর কোনো একটায় চলে যাব ধোসা খেতে খেতে ঝুপড়ির পেছন দিক দিয়ে পান খাবার অছিলায় এক এক করে কেটে পড়ব এরপর আলাদা আলাদা হয়ে ট্রাফিক কলোনির রাস্তা ধরে বিপের কাকার বাংলোর দিকে বাংলোতে ঢুকে কেউ বেরোব না সারা রাত
এই প্ল্যানে আমি এবার একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম আমি বললাম, “আমরা চার জন মিলে বিপের কাকা, কাকিমাকে ব্যস্ত করে তুলব জিজি, এটা বোধহয় ঠিক কাজ হচ্ছে নাবিপ বললে,কাকা-কাকিমা পাঁশকুড়াতে আমাদের গ্রামের বাড়িতেই থাকেন কাকা যাওয়া-আসা করেন বাংলোতে সবসময়ের থাকার জন্য পাহারাদার থাকে রাতের রান্নায় কাকা তাকে চিকেন আর রুমালি রুটি বানাতে বলে দিয়েছেন
জিজির আন্দাজ ঠিকই ছিল বিকেলে আমরা ভিআইপি-দের মতো স্টেশন ওয়াগন থেকে নেমে টিকিট কাউন্টারের দিকে পা বাড়াতেই, ড্রাইভার মকবুল দাদা সবিনয়ে টিকিটগুলো কোথায় কোথায় কাটতে হবে বুঝে নিয়ে টিকিট আনবার জন্য টাকা নিয়ে এগিয়ে গেল
মকবুল বোগদা টিকিট কাউন্টারের দিকে অদৃশ্য হতেই সেপ বলে উঠল, “এই মকবুল দাদাও ছোটামোটার খবরি? হায় ব্রুটাস তুমিও!”
জিজি আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, “এখন আমরা আলাদা আলাদা হয়ে যাব মকবুল ফিরে আসার আগেই সবাই একটু দুঃখু, দুঃখু মুখ করে থাক ফোর গ্যাং কিন্তু ফ্রেসার ওয়েলকামে শর্ট স্কিটে সংলাপ, ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকাল আর যন্ত্রসংগীত, সব বিভাগেই সেরার প্রাইজ পেয়েছে, সেটা কিন্তু এখন থেকে আমাদের মনে রাখলেই চলবে না, দরকারের সময় বিজলির বেগে সেটা হাবভাবে, কথায়বার্তায় আনতে হবে এটাও কিন্তু আর একটা পারফরমেন্স এবং সেটা স্টেজ ছাড়াই কেউ যদি নার্ভাস বোধ কর তাহলে এখনও ফুটে যেতে পার বন্ধুত্ব কোথাও চিড় খাবে না, আমার গ্যারান্টি কিন্তু একজনের পা কাঁপলেই পুরো নাটক ফেঁসে যাবেআমরা সবাই একসঙ্গে হাতে হাত রেখে সবাই যেন দারুণ বিষণ্ণ সেই অভিনয় শুরু করলাম
মকবুল দাদা আমাদের বিষণ্ণ মুখগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই জিজির হাতে টিকিটগুলো দিয়ে বলে, “হাম তব ইজাজত মাঙ্গতে গোলবাজার সে প্রফেসর সাহাব কা সাদিঘর-কে সামান লেনি হ্যাঁয় অউর এক বাত, আপলোগ কা ট্রেন এক ঘণ্টা সে উপর লেট হ্যায়
স্টেশন ওয়াগনটা ধুলো উড়িয়ে খড়গপুর বাজারের রাস্তা ধরবার আগেই আমরা ধোসা-ঈডলির ঝুপড়িগুলোর দিকে পা বাড়ালাম হতে পারে যে, সন্ধের সময়ে মকবুলের মুখে সব কিছু শুনে ছোটামোটা স্যার - ‘আপদগুলো সব বিদেয় হয়েছে নিজের নিজের বাড়িতে’ এই ভেবে যখন স্বস্তিতে চায়ের কাপ মুখে তুলছিলেন, তখন কোথাও না গিয়ে বা আলাদা না হয়ে পুরো ফোর গ্যাং সেখান থেকে সামান্য দূরেই বিপের কাকার বাংলোতে একসঙ্গে আরাম করছিল কাকার বাংলোর চৌকিদার রূপচাঁদের হাতে বানানো, খাঁটি দেশি গরুর দুধের চা খেয়ে, কিটব্যাগগুলো থেকে যে যার রাতের পোশাকে জড়ানো পিয়ানো একর্ডিয়ান, মাউথ অর্গান, বাঁশি আর ছোটো ঢোলক বার করে টিউন করে নিচ্ছিলাম কাল সকালে আর সময় হবে না সুর মিলতেই জিজি কালকের মেক-আপের সব সাজ মিলিয়ে নেবার পর বলে,চায়ের পর তাহলে কালকে সকালের একটা গানের রিহার্সাল হয়ে যাক
গান এক রাউন্ড হবার পরও বাজনার সঙ্গত চলছিল সেইসময় বিপ আমাদের জানালার কাছে টেনে এনে বলে,গান আমরা সত্যি বেশ জমাটি বেঁধেছি ওই দেখ, বাগানে রূপচাঁদ কিন্তু বাজনার তালে নেচেই চলেছেআমরা খুব কষ্ট করে অট্টহাসিকে সামলে নিয়ে ফিক ফিক হাসিতে নামিয়ে আনলাম

সকালে আমাদের লুচি, আলুর দম আর রাজভোগের ঢাকা দেওয়া প্লেটগুলো টেবলে সাজিয়ে রূপচাঁদ তার বউ নিয়ে হোলি খেলতে বেরিয়ে গেছে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে মেক-আপ করতে বসে গেলাম সারা গায়ে হোলির রং-এর প্রলেপ আর তার ওপর মাথায় বিভিন্ন ধরনের পরচুলা দেখে আমাদের পাড়াগ্রামের শিবযাত্রার দল বলে মনে হচ্ছিল
সকাল সাড়ে সাতটা মাত্র রাস্তায় একটাও বাহন এমনকি রিকশাও নেই জিজি এটা আন্দাজ করেই কালকেই চৌকিদার রূপচাঁদকে দিয়ে দুটো রিকশাকে সকালেই আসবার জন্য অগ্রিম কিছু পয়সা দিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবার মনে হল, পয়সা তো গেছেই, রিকশাও আসবে না বাজনার সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের সঙ্গের কিটব্যাগগুলোর ওজন কম নয় সবার ওপর আমাদের হাতে সময় বেশ কম এখান থেকে ইনস্টিটিউটের মেন গেট অবধি হেঁটে যেতে গেলে খুব পা চালিয়ে গেলেও কমপক্ষে সোয়া ঘন্টার বেশি বই কম লাগবে না
জিজি যে কোনো সমস্যায় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে ওর বুদ্ধি অনুযায়ী, আমরা মেন রোডে বেরিয়ে, সেখানে আধ ঘন্টা অপেক্ষা করলে, কিছু একটা পাবার সম্ভাবনা আছে একটা বড়ো গাছের তলায় আমরা অপেক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে ঢোল, বংগো আর মাউথ অর্গান নিয়ে গালুডি থেকে আসা বরযাত্রীদের জন্য হোলির যে গান বাঁধা হয়েছিল সেটা শুরু করে দিলাম দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের গান শুনে একটা মিনি ট্রাক এসে দাঁড়াল তাদের মধ্যে গায়ক আছে, কিন্তু বাজনার দলটি পেছনে থাকায় তাদের গান তেমন জমছে না তারা ইনস্টিটিউটের বাইরের রাস্তা দিয়ে ডিভিসি কলোনি যাবে
আমাদের বাজনা আর তাদের গানে মিনিট দশেক আরও সেখানে কাটিয়ে আমরা মেন গেটের কাছে নেমে পড়লাম এরা খুশি হয়ে আমাদের একশো টাকা হোলির ইনাম দিচ্ছিল, অনেক কষ্টে সে থেকে রেহাই পাওয়া গেল
ছেদির চা-দোকানে এসে দেখি আর এক হুজ্জতি দোকান মালিক তখনও আসেনি, তার কর্মচারীরা কেউ আমাদের ঠিক করে চিনতে পারছে না ভাং-এর শরবত, তাও আবার পঞ্চাশ-ষাট জনের জন্য আমরাই অর্ডার করেছি তার অ্যাডভান্স স্লিপ দেখালেও তাদের সন্দেহ যায়নি মালিক না এলে তারা কিছুই যে দিতে পারবে না, এটা তারা খুব স্পষ্ট করে বলে দিল
মেন গেট পার হলেই যে পানের দোকান, সেখানে বিপ গেছিল বেশ কয়েকটা ভাং-এর ট্যাবলেট কিনতে চিনি মেশানো এই ট্যাবলেট ভাং-এর শরবতের নেশাকে তীব্রতম করে সেই দোকান মালিক বিপ’কে বলেছে যে প্রায় পনেরো মিনিট আগে ফুল দিয়ে সাজানো বরের গাড়ি থেকে দুজন স্থানীয় লোক এখানে সিগারেট কেনবার অছিলায় দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে বেশ কিছু ভাং-এর ট্যাবলেট কিনেছে তারা স্যারের বাড়িতেই বিয়ের বরকে নিয়ে যাচ্ছে যাবার সময় তাকে বলে গেছে, “আমাদের পেছন পেছন ঝাড়খণ্ডের নাম্বার প্লেট লেখা একটি ভলভো বাস বরযাত্রীদের নিয়ে আসছে তারা এখানে পান-সিগারেটের জন্য থামবে তুমি তাদের কাছে পান-সিগারেটের জন্য পয়সা নিও না সে বাবদ পয়সা আমরা এখনই দিয়ে দিচ্ছি তবে ভাং-এর ট্যাবলেট চাইলে বলে দিও যে কন্যাপক্ষের লোকেরা তাদেরই আপ্যায়নের জন্য অনেক ট্যাবলেট এখান থেকেই কিনেছে তারা গেস্ট হাউসে পৌঁছলেই তাঁদের জন্য ঠাণ্ডাই শরবত তৈরি থাকবে শুধু তাই নয় ওইখানে রং খেলবার আর নাচগান করবার সব আয়োজনও থাকবে দোকানি বাসের ড্রাইভারকে যেন প্রফেসর স্যারের বাংলো যাবার রাস্তা বুঝিয়ে দেয়
সৌভাগ্যের কথা, বিপ হোস্টেল থেকে এত দূরে সিগারেট বা পান কেনবার জন্য এই দোকানে কখনও আসেনি দোকানি তার রং-মাখা শরীর আর রাঙানো পরচুলো লক্ষ করে বললে, “তুমি কি ভাই প্রফেসর সাহেবের মেয়ের বিয়েবাড়ি থেকে আসছ? বরের গাড়ি একটু আগে বেরিয়ে গেছে তুমি বরযাত্রীদের জন্য হোলির নাচগানের দলের কেউ?”
বিপ সোল্লাসে মাথা নেড়ে বলে, “সামনেই ছেদির চা-দোকানে আমাদের সবাইকে জড়ো হতে বলে দেওয়া আছে ওনাদের বাস এলেই ওই দোকানের সামনের মাঠটায় ওনাদেরকে একবার রং খেলা আর নাচগানে খুশি করে নিয়ে যেতে হবেবিপের কথা শুনেই দোকানির চোখ চকচকিয়ে ওঠে তাকে দোকানি বলে, বরযাত্রীদের বাস আমার দোকানেই পান-সিগারেটের জন্য থামবে আমাকে পঞ্চাশ-ষাটটা পান আর যে যেরকম সিগারেট চান তা দেবার জন্য বরের গাড়ির লোক টাকা দিয়ে গেছে আমি জলদি সে সব মিটিয়ে ওনাদেরকে ছেদির দোকানে নিয়ে আসছি আপনি স্যার বাকি সব রেডি রাখুন
বিপ বলে, “সে আমরা গান-বাজনার যন্ত্রপাতি আর হোলি খেলার রং-পিচকারি নিয়েই এসেছিদোকানি বলে, “স্যার, সেই সঙ্গে ভাং-এর গামলা, বালতি আর গ্লাস এসব জোগাড় তো রেডি রাখতে হবে আমি স্যার ঢোল বাজাতে পারি আর হারমোনিয়ামও আমার একটা আছে শুধু ওই একটু এক গেলাস আপনাদের পেসাদ পেলেই হবে
বিপের সঙ্গে দোকানির এইসব কথা শেষ করতে না করতেই ছেদি তার লজঝড়ে সাইকেলে এসে হাজির তার ছেলেরা স্লিপ দেখলেও ভাং দেয়নি এই কথা শুনে সে হাতজোড় করে মাফ চাইল আর বিজলির মতো দ্রুতবেগে তার ছেলেরা উলটো দিকের মাঠে দুটো প্রকাণ্ড ডেকচিতে ভাং-এর শরবত, বেশ কয়েক রকম লাড্ডু, বৈদ্যনাথধামের পেঁড়া, ঝাল বড়া, ভেজিটেবল চপ আর জায়গায় জায়গায় রঙিন ছাতা টাঙিয়ে, একদম দারুণ একটা হোলি-মহালা বানিয়ে ফেলল খড়গপুরে, আমাদের ক্যাম্পাসে হোলি উপলক্ষ্যে জমায়েতের জায়গাকে হোলি-মহালা বলে
হোলি-মহালা সেজে উঠতেই, আমরা বরযাত্রীদের বাস আসবার জন্য আর অপেক্ষা না করেই ঢোলক, বংগো, মাউথ অর্গান আর পিয়ানো একোর্ডিয়ান বাজিয়ে হোলির একটা জমাটি গান - “এস খেলি হোলি/ ঘর ছেড়ে চলো গলি গলি” দিয়ে হোলি-মহালার উদ্বোধন করে দিলাম গানের অন্তরা চলছে, এই সময়ে জিজি তার বংগো ছেড়ে আমাদের থামতে ইশারা করল দেখি একটা প্রকাণ্ড ভলভো বাস ওই চা-দোকানে এসে থামল বাস থেকে পিলপিল করে বরযাত্রীরা নামছে তো নামছেই জিজি আগেই ভেবে রেখেছিল যে হোলির দিন হোক আর যেমনই হোক, ঝাড়খন্ড বা বিহারে বরযাত্রী সত্তরের ওপর হয় এটা তার দেখা জিনিস
তারা দোকানে কেউ ঢুকল না বাস থেকে দেখে নিয়েছে যে সামান্য দূরেই রঙিন ছাতা সাজানো আছে সবাই আমাদের দিকেই বেশ হনহন করে এগিয়ে আসছে সেই দোকানি তাদের কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কে শোনে তার কথা?
জিজির ইশারায় আমাদের আর একটা জমাটি গান, যার কথা আমার আর সুর জিজি-র শুরু করলাম আমরা সকলে ওনারা আসতেই আমরা পরস্পরকে হোলির রং মাখানো, পিচকারি দিয়ে রং দেওয়া শুরু করে দিলাম এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গানও চলতে লাগল বরযাত্রীদের দলে আমাদের বয়েসি অনেকেই আমাদের গানের সুরে সুর মিলিয়ে গাইছিলেন
গান শেষ হতেই জিজি তাঁদের সবিনয়ে বলে, “আমরা সকলে এখানে আপনাদের অভ্যর্থনা করতে এসেছি দীর্ঘ বাসযাত্রায় ভ্রমণক্লান্ত বরযাত্রীরা, হোলিখেলার পর একপ্রস্থ রং মেখে, রঙিন ছাতার তলায় বসে একটু জুড়িয়ে নিলেন গেলাস ভর্তি ঠান্ডাই আর মিঠাই খেয়ে তাঁরা কিন্তু কেউ এলিয়ে পড়লেন না, বরং আমাদের আর একটি বাজনার সংগতের সঙ্গে তাঁদের সবার ‘হোলি হ্যায়’ বলে বরকর্তাকে ঘিরে সে কী দারুণ ঘুরে ঘুরে নাচ বরকর্তা আর দেরি করতে চাইলেন না আমাদের সঙ্গে যাবার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও, কৌশলগত কারণে আমরা সবিনয়ে তাতে রাজি হচ্ছিলাম না বাসের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি তরুণ বরযাত্রীদের আমাদের দেখিয়ে বলেই দিলেন, “এনারা যদি বাসে উঠে আমাদের সঙ্গে যেতে আর কোনোরকম বেগড়বাই করে তবে এনাদেরকে চ্যাংদোলা করে বাসে তুলবিছেলেছোকরারা বলে ওঠে,সে আর তোমাকে বলতে হবে না জেঠু এনাদের সঙ্গ আর আপ্যায়ন না পেলে আজ যে হোলির দিন তা ভুলেই যেতাম
একরকম টানতে টানতে তরুণ বরযাত্রীরা আমাদের জোর করে বাসে নিয়ে তুলল আমরা তো এইটাই চাইছিলাম বাসে ঢুকতেই আমরা চার জন সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম আমরা যে সবসময় একসঙ্গে থাকি এইটা যেমন আমাদের সম্পদ তেমনি আমাদের পরিচয়ও এই কারণে জিজির খুব কড়া নির্দেশ ছিল যে আমরা এই মিশনে কখনওই যেন চার জন একসঙ্গে না থাকি একসঙ্গে থাকলে কেউ না কেউ সন্দেহ করে শেষটায় আমাদের চিনে ফেললে পুরো জিনিসটা কেঁচে যেতে পারে
ভাং-এর নেশা থিতু হতে একটু সময় লাগে বাসে বসতেই বরকর্তা আমাদের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও আমাকে নীলু আর জিজিকে লালু বলে ডাকতে শুরু করলেন উনি বার বার বলছিলেন, “হ্যাঁ রে লালু, আমাদের নীলু খুব লাজুক তুমি একটু খেয়াল রেখো যেন ঠিক করে খায়একটু পরে কী কথায় তাঁর যেন হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের বাবা কেন এল না বল তো? নিজের ভাইপোর বিয়ে বলে কথা একজন এসে নিম্নস্বরে বলে গেল তাঁকে, “জেঠু, ছোটোকাকা তো একবছর আগে মারা গেছেএবার জেঠু মানে বরকর্তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেপকে ডেকে বললেন, “কেষ্ট, সেই সুটকেসটা দ্যাখ তো, ঐটাতে কনের লজ্জাবস্ত্র আর সিঁদুরদানের চুবড়ি আছে দেখিস বাবা, আমি বিয়ের আসরে চাইলেই যেন পাইআমাদের লালু, নীলু, কেষ্ট বলে ডেকে উনি আমাদেরকে নিজের ভাইপো বানিয়ে দিয়েছেন আমরা এখন ঘরের লোক ছোটামোটা স্যার আমাদের তাঁর পাইক-পেয়াদা দিয়ে আটকাতে পারবেন না
বরযাত্রীদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে বিশ্বেশরাইয়া গেস্ট হাউসে সে পথে একটু গোলকধাঁধা আছে নতুন লোকেরা এদিক ওদিক ঘুরেফিরে বেশ মুশকিলে পড়তে পারেন একথা মনে হতেই পেছনে বসা আমাদের বয়েসি ছেলের দল চেঁচিয়ে বলে, “জেঠু, পেছনের গাড়িগুলোর জন্য আমাদের এইখানে দাঁড়াতেই হবেএই কথা শুনে ভাং-এর নেশার ঘোর কাটিয়ে জেঠু চিৎকার করে উঠলেন, “তার মানে? তোরা করেছিস কী? লোক বাড়ল কী করে? আরও ক’টা গাড়ি?” একজন জবাব দেয়, “জেঠু, এরা সব বিক্রমদা’র বন্ধু আর ওর মামাবাড়ির লোক দুটো বোলেরো গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে ড্রাইভার নিয়ে মাত্র কুড়ি জন
বিক্রম নামটা শুনেই জিজির ঘরে দেখা কার্ডের কথা মনে এল আমি অদূরে বসা বিপকে বুঝিয়ে দিলাম যে বিক্রম হচ্ছে এই বিয়ের বর
সামান্য এগিয়েই যে মোড় পড়বে, সেখান থেকে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলেই গেস্ট হাউস আর এই মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তায় ঘড়ি ধরে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথের দূরত্বে বিয়েবাড়ি এই কথাটা বোঝানোর জন্য বিপ ড্রাইভারের কেবিনে ঢুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু তা না করেই ফিরে এল আর ডান হাত দু’বার ঘুরিয়ে, পেটে হাত বুলিয়ে আমাদের তিনজনকে কোড মেসেজ দিল যে ছোটামোটা মোড়ের মাথাতেই বরযাত্রীদের রিসিভ করবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ আমাদের এইবার সতর্ক হতে হবে, ধুরন্ধর ছোটামোটা স্যার আমাদের চিনে না ফেলে
মোড় পার করে ডানদিকে ঘুরে, বাস দাঁড়াতেই ছোটামোটা বাসে উঠে আমাদের বয়েসি একজনকে অবিনবাবু বলে ডাকতেই, সাড়া এল মাঝের দিকে বসা বরকর্তার থেকে প্রায় সবারই মাথায় রং মাখা পরচুলো আর সারা শরীরে বিভিন্ন রঙের প্রলেপ বুঝলাম কাউকে চিনে ফেলা এখন ছোটামোটা স্যারের পক্ষে সম্ভব নয়
বরকর্তার কাছে এগিয়ে আসবার সময়, উনি ভর্তি বাস দেখে বেশ হতাশ হয়েছেন মনে হল, কিন্তু আরও বড়ো ধাক্কা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল বড়ো ভলভো বাসকে দাঁড়াতে দেখে ততক্ষণে তার পেছনে দুটো নয়, চার-চারটে বোলেরো জিপ আর একটা মিনিবাসও দাঁড়িয়ে গেছে বাসের পেছনের দিকের বড়ো কাচের জানালায় তাদের বেশ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে নার্ভাস হয়ে ছোটামোটা স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “পেছনে ওই গাড়িগুলো কি আপনাদের সঙ্গে, মানে বরযাত্রীদের?” বিব্রত অবিনবাবু বললেন, “বিক্রমের মামারা, ওর সব বন্ধু আর আমাদের গ্রামের কিছু লোক, তারাও প্রথমে হোলির দিন আসবে না বলেছিল, কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে তারা সব নিজের নিজের গাড়িতে চলে এসেছে কী আর করা যায়?”
স্যার বিনয়মাখা গলায় আপ্লুত হয়ে বললেন, “তা বেশ করেছেন, বেশ করেছেন বিক্রমের বন্ধুদের বা আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, এঁরা কি আর না এসে পারেন? আমি ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিয়েছি, আপনাদের ইন্সটিটিউটের গেস্ট হাউসে নিয়ে যাবে ওখানে আমার লোকেরা আছে আমার এখন ওই নান্দীমুখ থেকে অনেক কিছু মাঙ্গলিক কাজ আছে চললাম, সন্ধে হতে না হতে না হতেই বিয়ের লগ্ন আপনারা সব তাহলে সূর্য ডুবলেই চলে আসবেন আমার বাংলোতে বিয়ের আসর তো ওখানেই খাওয়াদাওয়ার সব ব্যবস্থা একটু বাড়াতে হবে
স্যার মুখে হাসি টেনে বললে কী হবে, তাঁর ভেতরে যে কি ফাটছিল সেটা আমরা তো জানি আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় স্যার তো প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন, বাসের একটা হ্যান্ডেল ধরে কোনোরকমে নিজেকে সামলালেন জিজি এইসময় একটা অনেক বড়ো রিস্ক নিয়ে, আর একটি ছেলের সহায়তায়, ওনাকে বাস থেকে নিচে নামিয়ে বাড়ি অবধি এগিয়ে দেবে কিনা জিজ্ঞেস করে উনি বেশ রূঢ়ভাবে প্রত্যাখান করে এগিয়ে যান
মানুষ ভুল করলে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার মাধ্যমে সে নিজেকে সংশোধন করে নেয়, কিন্তু স্যার বদলাননি, যদিও পরবর্তী পাঁচ বছরে ওনার জীবনে ঈশ্বর সংশোধনী ঘটনাপ্রবাহ কম ঘটাননি
বাস এগিয়ে যেতেই দেখলাম সামনের কালভার্টের চওড়া গার্ডওয়ালের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন আমাদের স্যার এই দৃশ্যটা বাস, মিনিবাস আর বোলরোগুলোর সব বরযাত্রীরা বেশ উপভোগ করতে করতে গেস্ট হাউসে পৌঁছে গেছিলেন একজনও মিস করেননি তারা সবাই কারও কারও মারফত আগেই জেনে গেছিলেন যে উনি প্রচন্ড হাড়কৃপণ লোক এইরকম কঞ্জুস লোক যখন বাধ্য হয় তার হিসেবের অনেক বেশি সংখ্যার প্লেট সাজিয়ে খাওয়াতে, তখন সে প্লেট থেকে রাজভোগ খেতে বড়ো মধুর লাগে গেস্ট হাউসে পৌঁছে বরযাত্রীরা সবাই হেসে হেসে জলখাবার খাচ্ছিলেন আর এই কথা বলছিলেন
কম লোক আর বরযাত্রী হবে এই ভেবে, দোলের লাগাতার পাঁচ দিন ছুটির সময় মেয়ের বিয়ের দিন করিয়ে দারুণ প্ল্যানিং করেছিলেন বরযাত্রী আসার আগে পর্যন্ত মনে হয় খুশির ফানুসে উড়ছিলেন হোলি উপলক্ষ্যে বাংলো আর হলগুলো খালি চারটে মহা বজ্জাত শয়তান ছেলের দলটা বাড়ি গেছে নিমন্ত্রিত সহকর্মী অধ্যাপকেরা সপরিবারে বিয়ের ভোজ না খেয়ে বেড়াতে গেছেন, তবে যাবার আগে সবাই তাঁর মেয়েকে দামি উপহার দিয়ে গেছেন তাঁর সব প্ল্যানিং ঠিকঠাক চলছিল তিনি ভেবেছিলেন যে হোলির উৎসবের দরুন ঝাড়খন্ড থেকে বরযাত্রীও পঞ্চাশের জায়গায় অর্ধেকও হবে না সে জায়গায় বিশাল ভলভো বাস, মিনি বাস আর চারটে বোলেরো ভর্তি বরযাত্রীদল পৌঁছে গিয়ে তাঁর সব গেমপ্ল্যান উলটে দিল
জীবনে তিনি কখনও কাউকে কোনো উপলক্ষ্যে বোধহয় একটা রসগোল্লাও খাওয়াননি সেরা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদের পুরস্কার শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পেলেও কেউ এক কাপ চা খেতে চায়নি ওনার কাছে এমন লোককে যদি প্রত্যাশিত পঁচিশ জন বরযাত্রীর জায়গায় একশোর কাছাকাছি বরযাত্রীকে, তাও চার বেলা, ভালো ভালো খাবার খাইয়ে আপ্যায়ন করতে হয় সেটা বেশ আঘাত পাবার কথা এই শোক তাঁর কাছে এতটাই যে হয়তো কাল সকালে কন্যা বিদায়ের দুঃখে ততটা ম্রিয়মাণ হবেন না
সূর্য ডোবার আগেই বর বরযাত্রী তাঁর বাংলোতে পৌঁছে গিয়েছিল অবশ্য তার আগেই তাঁর দুঃখ কম করার ব্যবস্থা বরকর্তা অবিনবাবু করেছিলেন সকালে ছেদি যে মিষ্টি আর ভাং-এর সরবতের ব্যবস্থা করেছিল তা থেকে প্রচুর বেঁচে গেছিল অবিনবাবু বিকেলের দিকে হোলির আবির মাখাতে তাঁর হবু বেয়াইকে সেই শরবত আর মিষ্টি খুব খাইয়েছিলেন শুধু তাই নয়, অনাহুতদের আগমন আশঙ্কায়, ছোটামোটা স্যার যে সব পাহারাদারদের গেট এবং বাংলোর চারপাশে লাগিয়েছিলেন, তাদেরকেও উদার হাতে বিলি করেছিলেন
অবিনবাবুর আবিরে না ছেদির শরবত আর মিষ্টিতে কিংবা সব মিলিয়েই কিছু একটা জাদু করেছিল অমন একটা হাড়কৃপণ লোক, গরদের ধুতি আর উড়নি গায়ে দিয়ে নিজের হাতে সবাইকে বড়ো বড়ো মিষ্টির প্লেট এগিয়ে দিচ্ছিলেন তাতে কিন্তু আমরাও বাদ পড়িনি বস্তুতঃ তিনি নিজে সামনে এসে এক এক করে আমাদের সবাইকে হাসিমুখে মিষ্টির থালা ধরিয়ে দিচ্ছিলেন কন্যাদান শেষ হতেই অবিনবাবুর পরামর্শে বরযাত্রীদের সবাইকে খেতে বসিয়ে দেওয়া হল স্যার নিজে এসে জিজিকে জোর করে বড়ো বড়ো দুটো রাজভোগ খাইয়ে দিলেন এই বিরল দুঃসাহসিক দৃশ্য আমি ক্যামেরার স্মৃতিপটে চিরস্থায়ী করেছিলাম
এত কাছে এসেও, ছোটামোটা স্যার আমাদের কাউকেই নিশ্চিতরূপে চিনতে পারেননি সেটা মেক-আপের গুণ না তখন পর্যন্ত রয়ে যাওয়া কয়েক প্রস্থ হোলির রংয়ের প্রলেপ অথবা স্যারের ওপর ভাং-এর সরবতের প্রভাব, সে রহস্য আমরা ভেদ করতে পারিনি
তবে বরযাত্রীদের ওপর ভাং-এর প্রভাব বেশ ভালোই পড়েছিল নেশার ঘোরে এসে তারা এক একজন তিরিশ-চল্লিশটা রসগোল্লা, কেউ কেউ প্রচুর পরিমাণে মাংস, মাছ খেয়েই চলেছিল ব্যাপারটা এতটাই হয়েছিল যে অন্য নিমন্ত্রিত আর বাড়ির লোকেদের জন্য ক্যাটারারকে আবার জিনিস আনিয়ে দুটো কাঠের চুল্লি বেশি লাগিয়ে তড়িঘড়ি নতুন রান্না করতে হয়েছিল ছোটামোটা স্যার সব জানতে পেরে, মনের দুঃখে রণে ভঙ্গ দিয়ে, বাংলোর আউট হাউসের একটা রুমে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন আমরা এইসব গোলমালের খবর পেয়ে চুপি চুপি এক এক করে কেটে পড়ি, নিজেদের হলের দিকে

দুপুর বারোটা পার হয়ে গেছে ওয়ার্ডেন ছোটামোটা স্যার সেই যে ওয়ার্ডেন অফিসে এসেছিলেন তারপর থেকে এখন অবধি আমাদের ডাক আসেনি, অথচ সহকারী দুজন ওয়ার্ডেন, নিশ্চয় স্যারের ডাক পেয়ে তবেই এসেছেন এই ছুটির দিনে শেষটায় আমাদের অবাক করে ছোটামোটা স্যার, তাঁর লজঝরে সাইকেলে করে গেট পেরিয়ে গেলেন
তার ঠিক পরেই সহকারী ওয়ার্ডেনরা বেরিয়ে এলেন, তবে তাঁরা গেট পেরোলেন না গেটের আগেই যে বিশাল বাঁধানো গাছতলা আছে, সেখানে বসলেন আর দু’জনেই হাসিতে ফেটে পড়লেন প্রায় ওখান থেকে আমাদের ব্যালকনিতে দেখতে পেয়ে, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন আর একটা ইশারা করলেন আমরা বুঝতে পেরে কাল বিয়েবাড়ি থেকে আসবার সময় যে চার প্যাকেট মিষ্টি এনেছিলাম, সেগুলো নিয়ে ওনাদের কাছে এলাম ওনারা দুজনেই তখনও হাসছেন
একজন বললেন, “আমরা তো বিয়েবাড়িতে ছিলাম তোমরা যতই রং মাখো আর যেমনই মেক-আপ নাও আমার চোখকে ধোঁকা দিতে পারবে না তোমরা যে বরযাত্রী হয়ে ঢুকে পড়েছ এটা জানার পর আমরা দুজনেই চুপ ছিলাম, কেননা সেটা তো গেট ক্র্যাশিং নয় যা তোমরা অন্য জায়গায় করে থাকো আমরা যাবার সময় এও দেখেছি যে তোমরা প্রত্যেকে এক এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে কেটে পড়ছ তোমরা বরযাত্রী হয়ে এসেছ তাদের বিদায়ীতে প্রাপ্য এক বাক্স মিষ্টি নিয়েও তোমরা অন্যায় কিছু করোনি আমরা সেই কথাই ওনাকে বোঝালাম, ওরা কোনো শৃঙ্খলাভঙ্গ করেনি বা ইন্সটিউটের ছাত্রদের কোড অফ কনডাক্ট ভাঙেনি আপনি ওদের লাল চিঠি দিন, তবে তাতে আমরা সহমত দেব না অন্যজন ততক্ষণে মিষ্টির প্যাকেট খুলে খেতে খেতে বললেন,সত্যি, কথায় যে বলে কঞ্জুষের বাড়ির মিষ্টির স্বাদই আলাদা, সেটা একশোভাগ সত্যি
----------
ছবি - সুকান্ত মণ্ডল

No comments:

Post a Comment