গোলটেবিল:: জীবন্ত কঙ্কাল - মানবেন্দ্র পাল :: আলোচনা: সুলগ্না ব্যানার্জ্জী


জীবন্ত কঙ্কাল - মানবেন্দ্র পাল
আলোচনা - সুলগ্না ব্যানার্জ্জী

বইয়ের নাম: জীবন্ত কঙ্কাল, লেখক: মানবেন্দ্র পাল
প্রকাশক: দেব সাহিত্য কুটির, মূল্য: ৪০ টাকা

বাংলা সাহিত্যে ভৌতিক রস সৃষ্টির দক্ষতার জন্য যাঁদের নাম সর্বজনবিদিত তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানবেন্দ্র পালতাঁর লেখা মূলত শিশুসাহিত্যের অন্তর্গত হলেও নির্দ্বিধায় তা জয় করে প্রাপ্তবয়স্কদের মন।
জীবন্ত কঙ্কালএমন একটি ভৌতিক উপন্যাস যার পরতে পরতে রয়েছে শিহরণ, অন্তত শিশুসাহিত্য হিসেবে তো বটেই। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র পুলিশের বড়ো অফিসার শ্রীযুক্ত বাবু সুশান্তকুমার সরকারযার জবানিতেই সৃষ্টি এ কাহিনি। কাহিনি না বলে তাঁর অভিজ্ঞতা বললেও ভুল হবে না। বন্ধু প্রণবেশেসঙ্গে নেপাল বেড়াতে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হ এক ভয়ংকর ঘটনার। বর্ষাকালে নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘন্টাকর্ণনামক এক অপদেবতার পুজোর প্রচলন আছে এবং সেই পুজো দেখা নিষিদ্ধ জেনেও কথক সেখানে উপস্থিত হ। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস ঐ সময় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় প্রেতাত্মারা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেই ঘন্টাকর্ণ’-কে কিশোর বালকের রক্তে স্নান করিয়ে পুজো করেন তন্ত্রসিদ্ধ সাধুরা।
এমনই এক সাধুর হাত থেকে ঠিক বলি দেবার আগের মুহূর্তে এক কিশোরকে উদ্ধার করে সেই সাধুর বিষনজরে পড়ে যা প্রণবেশ ও সুশান্ত। কলকাতায় ফেরার আগের দিন রহস্যময়ভাবে হোটেলে হাজির হয় কঙ্কালসার চেহারার এক অদ্ভুত বালক। সুশান্তের ফরমায়েশ মতো হোটেলের বেয়ারা জং বাহাদুর একটি কাজের ছেলে খুঁজছিল, কিন্তু সাধুবাবার বিরোধিতা করায় সে তাদের ওপর যারপরনাই বিরক্ত। তাই সেদিন সেই অচেনা ছেলেটিকেই সে জোর করে গছিয়ে দিল ওদের সঙ্গে
ছেলেটিকে ঠিক পছন্দ না হলেও তাকে সঙ্গে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন দুই বন্ধু। সুশান্ত ছেলেটিকে নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে আসে যেখানে তার যৌথ পরিবার এবং স্ত্রী ও ছেলে ছিল। উদ্দেশ্য ছুটির বাকি কটা দিন সেখানে কাটিয়ে কলকাতায় ফেরা। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।
নেপাল থেকে আনা কঙ্কালসার চেহারার রাজু সুব্বাপারে না এমন কোনো কাজ নেই। ঘরকন্নার কাজ থেকে নোটনের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো, সব তার নখদর্পণে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সুশান্ত বুঝতে পারে রাজুর কোনো বিশেষ দক্ষতা আছে এবং সে সুশান্তকে পছন্দ করে না। তার সন্দেহ বিশ্বাসে বদলে যায় যখন তাকে দুবার মারার চেষ্টা করে হাতেনাতে ধরা পড়ে রাজু।
গ্রামের বিশিষ্ট জ্যোতিষ হেরম্ব ভট্টাচার্য এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ দেখায় সুশান্তকে জানান, এক মাসের মধ্যেই বিপদ ঘনিয়ে আসছে সুশান্তের। প্রথমে তা নিয়ে না ভাবলেও পরে সুশান্ত ক্রমশই রাজুর কাজকর্মে দরু নিজের প্রাণসংশয় অনুভব করতে পারে। প্রথমে সুশান্ত আন্দাজ করতে পারেনি, দেশের বাড়িতে এত লোকের মাঝে হেরম্ববাবুর এমন কথার কী মানে। পরে যখন অকস্মাৎ অনেকগুলো ঘটনার জন্য সুশান্তের স্ত্রী-পুত্রকেও কিছুদিনের জন্য অন্যত্র যেতে হয় তখন তাঁর মনে পড়ে হেরম্ববাবুর কথা। নিস্তব্ধ পুরীতে কেবলমাত্র তিনি আর রাজু সুব্বা’, এটুকু ভাবলেই ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার সুশান্তের বুক কেঁপে ওঠে।
ক্রমশই সুশান্তের নজরে আসে রাজুর আর অলৌকিক কার্যকলাপ। এক রাতে কেবলমাত্র কৌতূহলবশত রাজুর পিছু নিয়ে তিনি তাকে এক সাধুর সঙ্গে দেখা করতে দেখে ফেলে এবং ভালো করে লক্ষ করে বুঝতে পারে এই সাধুই নেপালের সেই ঘন্টাকর্ণমন্দিরের জল্লাদবেশী সাধু, এবং তার চেয়েও তাঁকে আশ্চর্য করে সাধুর সামনে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়া সুব্বা। ঠিক যেন একটা জীবন্ত কঙ্কালসে এবং তার মৃত শরীরে অন্য কারোর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে চালনা করছে সেই সাধু।
বাড়ি ফিরে এসে সে রাতেই সুশান্ত শিকার হ রাজুর। অলৌকিক শক্তি এবং মন্ত্রবলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজু। ফাঁকা বাড়িতে সুশান্তের যখন মৃত্যু আগত সেই সময় বাড়িতে পা দে প্রণবেশ। রাজুর এহেন কার্যাবলী নজর এড়ায় না তাঁরওতাঁরা দুজনেই নিশ্চিত হ রাজু সুব্বা কোনো মানুষ নয়; মানুষরূপী পিশাচ। পরের দিনই ফিরে আসে বাড়ির সবাই এবং রাজুর কাজকর্ম পর পর সাজালে তাদের মনেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না এ ব্যাপারে। সে রাতের পর থেকে রাজু বাড়ি না ফিরলেও পরদিনই কলকাতা ফেরার সিদ্ধান্ত নে সুশান্ত।
যখন তিনি পরিবার নিয়ে ট্রেনে ওঠে এবং ট্রেন কিছুটা গতি বাড়িয়ে ছেড়েও দেয় ঠিক তখনই সুশান্তের ছেলে নোটনের নজরে পড়ে কঙ্কালসার চেহারা, নেড়া মাথার রাজু সুব্বা লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে আসছে ট্রেনের পেছন পেছন।
কলকাতা ফেরার বেশ কিছু দিন পর প্রেততত্ত্ববিদ অম্বুজবরণ লাহিড়ীকে নিয়ে প্রণবেশ এসে হাজির হ সুশান্তের বাড়িতে। সব শুনে অম্বুজবাবু সহজেই বুঝে যান রাজুর প্রকৃত পরিচয়। সুশান্তকে তিনি সাবধানে থাকতে বলেন, কিন্তু সুশান্তের ধারণা কলকাতা তাঁর নখদর্পণে। অথচ পরের দিনই খবরের কাগজের একটি রহস্যময় খবরের ওপর সুশান্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রণবেশ। বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে সুশান্তের।
তবে কি তার মুক্তি নেই? অম্বুজবাবু কি পারবেন না সুশান্তকে রক্ষা করতে? শেষ পর্যন্ত কী হবে রাজু সুব্বা’-? ঘটতে থাকে একের পর এক টান টান উত্তেজনাময় ঘটনা।

কিশোর ভৌতিক উপন্যাস হিসেবে জীবন্ত কঙ্কালউপন্যাসটিকে লেখক মানবেন্দ্র পাল-এর এক সফল অনবদ্য রচনা হিসেবে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
----------

No comments:

Post a Comment