গোলুর পক্ষীরাজ
ঈশিতা রায় ব্যানার্জি
সাইকেল চালাতে আমি দারুণ ভালোবাসি। সুযোগ
পেলেই টিফিন ব্রেকে কোনো না কোনো বন্ধুর সাইকেল নিয়ে দৌড়ে বেড়াই স্কুলময়। সেবার
ঘেঁটুর সাইকেলটা নিয়ে চালাচ্ছিলাম। দারুণ সুন্দর সাইকেল। চড়লেই
মনে হয় যেন পক্ষীরাজের ঘোড়া, কিন্তু বিধি বাম। একদিন এমন আছাড়
খেলাম, সাইকেলের
অবস্থা তখন বারোটা দশ। আমারও ডান পা-খানা ভাঙল বটে, তবে তা
সাইকেলের থেকে প্রিয় বস্তু মোটেই ছিল না। আসলে, পা
গেলে বাঁধানো পা পাওয়া যাবে, বাঁধানো দাঁতের মতন, কিন্তু এমন
সাইকেল বহু তপস্যায় মেলে। পা ভাঙার ফলে সারা পাড়া জুড়ে আমাকে
নিয়ে শুরু হল মহা হইচই। মা, বোন, দিদা এমন কান্না জুড়ল, পারলে
নাকি সুরে একটা ‘মঙ্গলকাব্য’ লিখে ফেলে। ওদিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘেঁটু ওর বাবা
ভবেন কাকার কাছে এমন উত্তম মধ্যম মার খেল, ওর অবস্থা তখন সাইকেলের থেকেও খারাপ।
কাজেই শয্যাশায়ী আমি ঘেঁটুর পক্ষীরাজকে বিদায় জানাতে বাধ্য হলাম।
শুয়ে শুয়ে দিন কাটতেই চায় না। কী করব ভাবতে ভাবতে মাথার চুল
অর্ধেক হল। তবুও জুতসই কোনো প্ল্যান মাথায় এল
না। উপরন্তু, একটু নড়লে চড়লেই ভয়ানক ব্যথা শুরু হয়ে যায়। হাড়ের ডাক্তার গোবিন্দ
বর্মার কড়া নির্দেশ, “দু’মাস বিছানা থেকে এক পা-ও নড়বে না।
নড়েছ কি রামধোলাই। পা ঝুলিয়ে রেখে দেব কড়িবরগার সঙ্গে।”
বোন গুটুর মুখে একবার শুনেছিলাম - এককালে
আমাদের মামার বাড়ি হাড়ঠিকড়ে গ্রামের ডাকাতে জমিদার ছিলেন ডাক্তার গোবিন্দ বর্মার
পিতৃপুরুষ। ডাকাতি করেই বিশাল সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ওনারা মোটেই
সহজ মানুষ ছিলেন না। জমিদার নামের কলঙ্ক। এক কথায়, যাকে বলে
হাড় বজ্জাত। এমন হাড়-জ্বালানি জমিদার বিশ্ব চরাচরে নাকি দুটি ছিল না। হাড্ডিসার,
দুঃস্থ প্রজাদের হিড়হিড় করে টেনে এনে ডাকাতে কালী মায়ের সামনে হাঁড়িকাঠে বলি দিতেন
তাঁরা। তারপর, সেই মৃত ব্যক্তিদের হাড়গোড় একটা একটা করে
জুড়ে মায়ের গর্ভমন্দির গড়ে তুলেছিলেন। সেটাই নাকি
ছিল ও বাড়ির হাড় হিম করা রীতি। ডাকাতে
কালী মায়ের স্বপ্নাদেশ। ওনাদের হাড়ে হাড়ে তাই হাড় জোগাড়ের
হিড়িক। আমি অবশ্য কথাগুলো মোটেই বিশ্বাস করিনি। শুনে হো হো করে হেসেছিলাম। মা কালীর
খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ভক্তবৃন্দের নাকি হাড়-মাস পছন্দ করে! যত পাগলের
প্রলাপ। যাই হোক, ছোটো
বোন বলে বেশি আর কথা বাড়াইনি। ডাক্তার
গোবিন্দ বর্মাকেও বিন্দুমাত্র ভরসা করে না। ওর কথায়, “দাদাভাই, লক্ষ্মীটি
সাবধানে থাক। ঐ হাড়কিপটে, নীরস ডাক্তারের উপর কোনো ভরসা নেই। কে বলতে
পারে তোর হাড়গোড় নিয়ে কোনো গবেষণা শুরু করবে না! এমনটা যদি হয়, তবে কিন্তু আর
রক্ষে নেই! সবটাই ওদের বংশের ধারা, যাকে বলে
হেরিডিটি। হাড় হাতে পেলে তবেই ওদের হাড় জুড়ায়। সেহেতু, উনি যা বলছেন
তুই বাপু চুপটি করে কয়েকদিনের জন্য মেনে চল।”
ভেবেছিলাম, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াব। ছেলের
দল প্রতিদিন বিকেল বেলায় সাইকেল চড়ে হই হই করে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে; কী
ভালোটাই না লাগে ওদেরকে। যেন এক ঝাঁক মুক্ত বাতাস। ছুটির ঘণ্টা শুনে তাদের আহ্লাদ
আর ধরে না। ফুরফুরে পালকের মতন হাওয়ার গাড়িতে
চেপে উড়ে বেড়ায়। সেই ছেলেগুলো তো আদপে আমারই মতন বাউন্ডুলে, বাঁধনছাড়া মেজাজের।
আর, ভীষণরকম সাইকেলপ্রেমী। সাইকেল
চালিয়েই বিশ্ব জয় করবে একদিন। ওদেরকে দেখে জানলা দিয়ে হাত নাড়ালে নিশ্চয়ই ওরা খুব আনন্দ
পাবে। আমাকে দেখে খুশিমনে উঁচু গলায় আমার কুশল-মঙ্গল জানতে চাইবে, “কী রে গোলু,
খবর ভালো তো? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ। সাইকেল চালাতে হবে তো!” প্রত্যুত্তরে আমিও
গলা চড়িয়ে সহাস্যে জবাব দেব, “ভালো আছি বন্ধু। আগের থেকে অনেকখানি ভালো।
অবশ্যই সাইকেল চালাব।”
ভেবেছিলাম, এমন খুশির জোয়ার আমার গৃহবন্দি দশাকে প্লাবিত করবে। সাইকেলের ক্যাঁচম্যাঁচ
শব্দ চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে মনটা শান্ত হবে। ডাক্তার গোবিন্দ বর্মার নির্ধারিত দু’মাস
হই হই করে পেরিয়ে যাবে। এমন কত কিছু ভাবলাম, কিন্তু শেষমেশ লবডঙ্কা। পায়ের তীব্র
যন্ত্রণায় প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। ঘরের জানলাগুলো আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেয়ালে ঝুলে
ছবির মতন দাঁড়িয়ে রইল। আমার আর জানলা দেখা হল না। অগত্যা, সাইকেল দেখার সাধ ভুলতেই
হল। পক্ষীরাজ তখন যেন নাড়ুচোরা গোপাল
ঠাকুর। চুপিসারে একবারটি এসে মনের মাঝে এক ঝলক উঁকি দেয়, অমনি খরগোশের মতন লাফিয়ে
ঝাঁপিয়ে পালায়। ধরা সে কিছুতেই দেবে না।
ভাবলাম, বাংলা বইয়ের কবিতাগুলো পাতা উলটে
পড়তে পড়তে মুখস্থ করে রাখি। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুখস্থ প্রক্রিয়া বেশ চলছিল। “বঙ্গভূমির
প্রতি”, “আদর্শ
ছেলে”, “খুকু
ও খোকা”,
“হারানো টুপি” - এইরকমভাবে তিন-চারটে কবিতা পর পর বেশ মুখস্থ করলাম। হঠাৎ
একদিন মনটা হু হু করে উঠল। কবিতা
আর মাথায় গাঁথল না। মাথাটা আবারও ভবঘুরে। তখন ভাবলাম, কবিতা থাক। শুয়ে
শুয়ে কমিকস পড়ি। প্রফেসর শঙ্কুর ‘নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো’ বেশ জমে উঠেছিল, যখন প্রায়
শেষ হব হব মনটা আবারও চিড়বিড়িয়ে উঠল। কোনোরকমে
বইটা শেষ করে কমিকস পড়াও বন্ধ করলাম। মনের এমনই চাঞ্চল্যকর অবস্থা যে কোনো কিছুতেই
নিজেকে শান্ত করতে পারছি না। মনে হল, আমার পা নয়, মনের হাড়গোড় যেন ভেঙেছে।
ডাক্তার বর্মার কথায় - অনেক সময় স্ট্রেস থেকে এমনটা হয়; এ তো
সামান্য ব্যাপার, ওষুধ দিচ্ছি, দিন কয়েকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।
ওষুধ এল ঠিকই, কিন্তু মনের ঝড় কি এত সহজ বস্তু? পড়াশোনা তাই পায়ের সঙ্গে সঙ্গে একরকম
শিকেয় উঠে গেল।
বাড়িতে মা-বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ বেশ টের পেলাম। মুখে না
বললেও হাবেভাবে বুঝতে পারছিলাম। ‘সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।’
যেটুকু পড়াশোনা এগিয়ে রাখা যায় সেটাই তো ভালো! জ্ঞান এতটা টনটনে হলেও কাজের বেলায়
মনটা খাঁচায় ভরা পাখির মতন ছটফট করল। দিনে-রাতে
শুধু পক্ষীরাজ মাথার মধ্যে বনবন করে ঘুরছে, যেন একটা
কানা মাছি। বাইরের গরম থেকে রেহাই পেতে ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে জিরোতে এসেছে। যত
আমি দূর দূর করে তাড়াতে চাইছি, ততই যেন ডানা ঝাপটানো বেড়েই চলেছে। এমনই
এক বৃহস্পতিবারের রাতে দুটো রুটি আর আলুর তরকারি খেয়ে মুখ শুকিয়ে শুয়ে আছি। মনে
মনে জোর করে আওড়াচ্ছি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাল-তারিখ। এগুলোই
তো বেশি জ্বালায় পরীক্ষায়।
- “ঋগবেদের
রচনাকাল আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কলিঙ্গ
যুদ্ধ ২৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হয়েছিল মহামতি অশোক ও কলিঙ্গ রাজের মধ্যে। হিদাস্পিসের
যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার ও পুরুর মধ্যে। আলেকজান্ডারের
মৃত্যু খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে। অশোকের
সিংহাসন আরোহণ ২...৭৩ খি...খি...খিস্টপূবো... চন্দ্র...চ...চ...চন্দ্রগুপ্ত... গুপ্ত...
সিং...হ... সিংহ...”
এইভাবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি হুঁশই নেই আমার। চন্দ্রগুপ্ত
সিংহে চড়ে বেড়াতে চলে গেল। দেখছি একটা
গভীর জঙ্গল। এমনিতে আমি খুব সাহসী, কিন্তু পশু-পাখির প্রতি কোনো প্রীতি
নেই। বরং, ভীতিটাই একটু বেশি, যাকে বলে জুফোবিয়া। বোন গুটু আমার এই দুর্বলতাকে যখন-তখন
খোঁচা দিয়ে বলে, “দাদাভাই, কী বললি তুই? একটু বেশি! কথাটা হবে - বরাবরই সাংঘাতিক। মনে নেই সেই ছোটোবেলার কথা!”
গুটু সে যাই বলুক না কেন, অতটা কিন্তু নয়। ছোটোবেলাতে
কাঠফাটা গরমে মশা উড়লে আমি কাঁথা ঢাকা দিয়ে ভয়ে শুয়ে যেতাম। রাতের বেলায় আলো দেখে
যদি কখনও একরত্তি চামচিকি ঘরের মধ্যে ঢুকে যেত, ভয়ে
খাটের তলায় গা ঢাকা দিতাম। অবশ্য, লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এগুলো সবই ছোটোবেলার ঘটনা। বর্তমানের
সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই। চামচিকিকে
এখনও ভালো না লাগলেও মশাকে এখন আর ভয় পাই না।
সেই আমি বনেজঙ্গলে ঘুরছি। সঙ্গে রয়েছেন রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। দু’জনেই
বসেছি সিংহের উপর। উনি বড়ো সহৃদয় মানুষ। ভালোবেসে আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে
বললেন, “দ্যাখ
গোলু, তোর
পা ভেঙে গেছে, তাই সিংহটাই ভালো। হাতি-টাতি নিয়ে এলে বেজায় বিশ্রী ব্যাপার হত। তখন
আবার আলাদিনের জিনের মতন কাউকে ডাকতে হত। তবেই না
হাতির পিঠে চাপতে পারতিস? আর, আজকাল
দিনকাল বড্ড খারাপ। পৃথিবী জুড়ে করোনা। ঐ জিন আসবে সেই মধ্য প্রাচ্যের কোন্ এক দেশ
থেকে। তাছাড়া,
লোকের আদেশ পালন করাই ওর কাজ। পরোপকারে ব্যস্ত হয়ে কোথায় কোথায় চরকির মতন ঘুরে
বেড়াচ্ছে কে বলতে পারে! শেষে যদি তোদের অচিনপুরে এসে করোনা ছড়িয়ে যায়, তখন কী হবে? জিনের
আবার ঘটোৎকচের মতন অত বড়ো শরীর, একবার হাঁচি-কাশি শুরু হলে ও ব্যাটা
থামতেই চায় না। যত বলি মুখে কাপড় দে, মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে কাশ, কিচ্ছুটি কানে
ঢোকে না। একবার হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় শুরু হলে আমফানের
মতো চলতেই থাকে। তাই এই সিংহখানাই ভালো। বড়ো লক্ষীমন্ত। কোনো
সাতে-পাঁচে থাকে না। বেচারা খোকা
হয়ে আমার ঘরের কাছে বসে থাকে। বাটি ভরে দুধভাত খায় আর প্রভুর নাম গায়।”
আমি বিজ্ঞের মতন ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “সবই তো মানলাম রাজা চন্দ্র। তবে
সিংহ দুধভাত খায়? নিরামিষাশী? সত্য যুগের
সিংহ নাকি?
সিংহ নাকি বেড়াল?”
রাজা চন্দ্র কিন্তু বেজায় খচে গেলেন। স্বনামধন্য
বিষ্ণুগুপ্ত বা চাণক্যের শিষ্য হলেও রাগ আছে ষোলো আনার পর আঠারো আনা। রাগটা
যেন নাকের ডগায় ঝোলে। আমাকে কেইমেই করে বলে উঠলেন, “তোদেরকে নিয়ে বড়ো সমস্যা গোলু। আজকালকার ছেলেছোকরা তোরা,
কোনো কিছু মানতেই চাস না। তোরা এলিয়েন মানিস। জাদুকে মানিস। ‘এল ডোরাডো’ গপ গপ করে
পড়িস। ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ নিয়ে কত
গবেষণা তোদের, আর তোদের ঐ হ্যারি পটার, তাকে নিয়ে তো তোর বোন গুটুর আর তোর আদিখ্যেতার
শেষ নেই। পারলে বোধ হয় তোদের হাড়ঠিকড়ে গ্রামের মামার বাড়িখানা ভাড়া দিস হ্যারির হগওয়ার্টস স্কুলকে। অথচ, যত
দোষ আমার সিংহখানার। মগধের রাজা আমি। আলেকজান্ডারের দুর্ধর্ষ সেনাপতিরা আমার ভয়ে থরহরিকম্প।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে ওদেরকে গোহারান হারিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার
করেছি। একটা সিংহকে বশ মানানো - এমনটা তো আকছার ঘটতেই পারে। ভালোবেসে
ডাকলে কে না সাড়া দেয়? তখন রাজা হয়ে যায় প্রজা। প্রজা
হয়ে যায় গজা। গজা হয়ে যায় খাজা।”
আমার তো রাজা চন্দ্রর আবেগখানা বেশ ভালোই লাগছিল। গলায় বেশ
দরদ আছে। কথাগুলোও বেশ জবর। বড়ো জ্ঞানী। সকলের খোঁজখবর রাখেন। তবুও
মজা করতে কী দোষ? তাই টুকুস করে ফোড়ন কেটে বললাম, “হ্যাঁ রাজা চন্দ্র! বুঝলাম, ভালোবাসলে
সিংহ হয় বেড়াল! তা বাবা সিংহ মিউ মিউ করে দেখাও তো দেখি!”
“হয় বই-কি! তবে তোর কথাতে মিউমিউ করবে না।
আমি বললে করে দেখিয়ে দেবে। তুই বলতে যাস
না, কী মুডে আছে বলা তো যায় না!”
“মিউ... মিউ... মিউ... কিছু বলছেন রাজামশাই! মিউ... মিউ...
মিউ...”
“যা বাবা! তাজ্জব ব্যাপার! ইনি কিনি? রাজা
চন্দ্র, এ
যে আবার কথাও বলে!”
“মিউ... মিউ... মিউ...”
“আজ্ঞে গোলু কুমার! আমার সিংহ কথাও বলে। ঐ যে বললাম, ভালোবেসে
চাইলে এ জগতে কী না হয়! হ্যারি যদি নারকেলের ঝ্যাঁটায় চড়ে ত্রিভুবন চক্কর কাটতে
পারে, তো
আমার সিংহ কেন পারবে না? বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ভালোবাসাতেই চলে বৎস!”
আমার কিন্তু ব্যাপারখানা দারুণ লাগল। মনে মনে ভাবলাম, আমি এত
ভালোবাসি ঘেঁটুর পক্ষীরাজকে, তো কই আমার কপালে তো তেমন একটা
সাইকেল জুটছে না। রোজ রোজ কেউ না কেউ নতুন সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসে, আর
আমি কিনা চরণবাবুর ট্যাক্সি চড়ে টুকুর টুকুর করে যাই। সেদিন
তো খোগু বলেই দিল, “নিজের নেই যখন অন্যের সাইকেলে নজর দিবি না। মগের মুলুক
নাকি সাইকেল চড়তে দেব! যা এখান থেকে।” আমি যেন
অপমানে-লজ্জায় এঁটো পাতার মতন হাওয়ায় এলোপাথাড়ি এদিক-ওদিক ভাসতে লাগলাম। সেদিন
টিফিনের পর ক্লাসেও ঢুকলাম মাথা নামিয়ে। ক্লাস চলাকালীন খোগুদের বেঞ্চের দিকে চোখ তুলে
তাকাতেই পারলাম না। যেই ছুটির ঘন্টা বেজেছে অমনি একছুটে ক্লাসের বাইরে। মনে মনে
বার বার বললাম, “পৃথিবীটা তালগোল পাকিয়ে যাক। একটা
বড়ো মাপের উল্কাপিণ্ড এসে স্কুলটাকে উড়িয়ে দিক। আর যেন এই লজ্জার মুখোমুখি না হতে
হয়। আর যেন এই স্কুলে ফিরে আসতে না হয়।”
ভগবান কোথায় যেন ঘাপটি মেরে বসে আমার কথাগুলো মন দিয়ে
শুনছিলেন। উনি তো দয়ার সাগর! আমার মনোবাঞ্ছা তাই নির্দ্বিধায় পূরণ করলেন। তবে একটু
অদলবদল করে। খবরে শুনলাম, উল্কাপাত হয়েছে, তবে
অচিনপুরে নয়। সুদূর ভ্যাটিকান সিটিতে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য
হয়নি ওখানে। যতই হোক পোপের দেশ বলে কথা। অন্যদিকে, ঐ
দিনের পর থেকে আমাকেও স্কুলমুখো আর হতে হয়নি, কারণ সেদিনই
তো বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল থেকে আছাড় খেলাম। মটমট করে পা
ভাঙল, আর আমার
প্রিয় বন্ধু ঘেঁটুর পক্ষীরাজ বেহাল দশায় প্রায় মরো মরো। এই
তো আমার প্রতি ভগবানের ভালোবাসা! কী আর বলব!
বেশ অনেকক্ষণ সিংহের পিঠে চেপে ঘুরছি মগধের জঙ্গলে। সিংহটা
কিন্তু মোটেই ছোটোখাটো নয়। যেমনটা দেখি ডিসকভারি চ্যানেল বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে,
তেমনটা মোটেই নয়, আর চিড়িয়াখানার সিংহরা ওর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারবে না। এমনই এই
সিংহের রূপ-লাবণ্য। বুঝতেই পারলাম, রাজার সিংহ। ব্যাপার-স্যাপার
তাই পুরোই আলাদা। একেবারে খাতে পিতে ঘরের সিংহ। সেহেতু, এ যেমন লম্বা তেমনই চওড়া, আর
তেমনই উচ্চতা। হাতি দেখলেও লজ্জা পাবে। সিংহের
পিঠে চাপবার পর ওর চেহারাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল, যেন পদ্ম ফুলের পাপড়ি। যেই
সূর্যালোক পেয়েছে, অমনি হাই তুলে একটু একটু করে পাপড়ি মেলে নিজেকে তুলে ধরেছে। এমন
অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে, অবাক হয়ে দেখতে
দেখতে আমি যেন গভীর ভালো লাগায় হারিয়ে গেলাম। তখনই রাজা চন্দ্রের কন্ঠস্বরে সংবিৎ
ফিরে এল, “কী হে গোলু মশাই! কী এত ভাবছিস? পক্ষীরাজের
কথা মনে পড়ছে?
ওর কথা ভাবিস না, ও এখন ভালোই আছে।”
“রাজা চন্দ্র, আপনি আমাদের পক্ষীরাজের কথা জানেন?”
“আরে! আমাকে রাজা বলে ডাকছিস, আর জানব না। আমি সকলের খবর রাখি।”
“তা তো ঠিকই। যাক, পক্ষীরাজ ভালো আছে জেনে খুব ভালো লাগছে।
ঘেঁটু এসেছিল আমাকে দেখতে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে।
কেমন আছি না আছি - এসব ছাড়া অন্য কোনো কথা বিশেষ হয়নি। ওর মুখখানা বড্ড থমথমে লাগছিল। ভবেন
কাকার ভয়ে পক্ষীরাজের কথা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।”
“হুম... বুঝলাম গোলু কুমার। এরপর পক্ষীরাজের সঙ্গে আর হয়তো
দেখা হবে না। তোদের ভবেন কাকা আর ওকে বাড়ির বাইরে বেরোতে দেবে না। ঘেঁটু এখন
স্কুলে যায় চরণবাবুর ট্যাক্সিতে। তোরই মতন হাল।”
“জানি তো আমারই মতন অবস্থা। সেদিন আমার মন ভালো করতে গিয়ে
আজ ওর যত বিপত্তি। আমিই যত নষ্টের গোড়া। মন
তাই সবসময় খারাপ আমার। আপনি এলেন তাই একটু বেড়াতে বেড়িয়েছি। মনের কথা বলে একটু যেন
হালকা লাগছে।”
“হুম... তোমার চাই পক্ষীরাজ? কী বলো গোলু,
নেবে নাকি পক্ষীরাজ?”
“ঘেঁটুর পক্ষীরাজ আমি কেন নিতে যাব...?? কী
যে বলছেন এসব...”
“ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... কী রে দাদাভাই আর কত
ঘুমাবি। চোখ খোল।
চেয়ে দ্যাখ।”
সক্কাল সক্কাল গুটুর চেঁচামেচিতে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল।
সেই ছোটো থেকে ওর এই এক রোগ। ভোর ভোর সাত তাড়াতাড়ি ওঠে। তারপর থেকেই মাথা খাওয়া
শুরু। নিজেও ঘুমাবে না, আমাকেও ঘুমাতে দেবে না। এমন চিৎকার করে, তাড়াতাড়ি নামতে না
পারলে ট্রেন যেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে এখনই। লটবহর নিয়ে পারলে ঝাঁপিয়ে নামো ট্রেন
থেকে। ওর চিৎকারে এক ঝটকায় ঘুম ভেঙে নড়েচড়ে উঠলাম। আবার পেলাম সেই শব্দ। শব্দটা
যেন সেঁধিয়ে বসেছে আমার ঘরে। আমাকে ছাড়া কিচ্ছুটি চেনে না। ক্রিং... ক্রিং...
ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং... আমি তো হতবাক। মা, বাবা, গুটু বোন
সবাই একসঙ্গে
বলে উঠল, “সারপ্রাইজ
গোলু। সারপ্রাইজ দাদাভাই।”
সত্যিই, আমি
বিস্ময়াবিষ্ট হলাম। এমনটা যে কখনও হতে পারে, আমি
তো কল্পনা করতেও সাহস পাই না। একটা
নীল রঙের সুন্দর পক্ষীরাজ আমার ঘরের মধ্যে ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং করে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। গুটুর নিয়ন্ত্রণে বেশ বশ মেনেছে। এমন অপূর্ব দৃশ্যে সকালটা নিমেষেই ঝলমলিয়ে
উঠল। মনে হল, আমার মতো সৌভাগ্যবান এ জগতে
আর ক’জন আছে! হঠাৎই চোখ পড়ল - পক্ষীরাজের সুন্দর নীলরঙা গায়ে খোদিত সোনালি এক টুকরো
লেখনীর উপর - “অনেক ভালোবাসাসহ রাজা চন্দ্র। ভালোবেসে
ডাকলে কী না হয়!”
ছবি - শ্রীময়ী
No comments:
Post a Comment