অনীশ দেব স্মরণে:: অনীশ দেব থেকে অনীশদা - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী


সাহিত্যিক অনীশ দেব থেকে অনীশদা
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

‘তোমাকে আরও অনেক বেশি করে লিখতে হবে। শুধু বছরে কয়েকটা ভালো লিখলে হবে না। অনেক বেশি লিখতে হবে। সব ভালো পত্র-পত্রিকায় লিখতে হবে, যাতে আরও বেশি করে পাঠকের কাছে পৌঁছোতে পারো
যখনই দেখা হত অনীশদার সঙ্গে, অন্য অনেক কথার মাঝে এটা বার বার বলতেন আমাকে। বিশেষ করে সেই সময় যখন লেখক হিসেবে খুব পরিচিত হয়ে উঠিনি, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি সে কথা আমি রাখতে পারতাম না। সেজন্য দেখা হলে লজ্জিত হতাম।
এত দূরে থাকলেও বা নিয়মিত কোনোরকম যোগাযোগ না থাকলেও আমাকে যে কেন এত স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন জানি না।
আরও কিছু বছর আগে চলে যাই। এটা সেই সময়ের কথা যখন পাঠক আমাকে চিনত না। ঠিক যেমন আমি চিনতাম না এক কিংবদন্তি সাহিত্যিকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অসামান্য মানুষকেসেই প্রথম আলাপের কথায় আসি।
খুব সম্ভবত ১৯৯৬ সাল। আনন্দমেলার দপ্তর থেকে আমাকে তৎকালীন সম্পাদক দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে বললেন কল্পবিজ্ঞান, ভয়, রহস্য, থ্রিলার জগতের কিংবদন্তি সাহিত্যিক অনীশ দেব আমার একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প চান। আমি তখন সবে কয়েক বছর লেখা শুরু করেছি। কিছু গল্প আনন্দমেলা, কিশোর ভারতীতে লিখেছি। তাঁর মধ্যে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান। শুনলাম উনি কল্পবিজ্ঞানের এক সংকলন সম্পাদনা করছেন। আমার লেখা পড়েছেন। সেজন্যই চাইছেন।
আমি তাড়াতাড়ি করে একটা লেখা পাঠাই। কিন্তু সে লেখা নির্বাচিত হয়নি। আমার প্রায় তিরিশ বছরের লেখক-জীবনের একমাত্র অনির্বাচিত গল্প দিয়ে অনীশ দেবের সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়। পরে যখন লিখেছি, তখন বুঝেছি কেন কল্পবিজ্ঞানের গল্পসংকলনে সেই গল্পের স্থান হয়নি। বুঝতে পেরেছি সার্থক সম্পাদক হিসেবে উনি ঠিক কাজই করেছিলেন
এর পরে চলে যাই এক যুগ পরে। ২০০৭ সাল। কিছুদিনের জন্য তখন আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছি। কিশোর ভারতীর সম্পাদক ত্রিদিবদার কথামতো পত্রভারতীর দপ্তরে প্রথমবার অনীশ দেবের মুখোমুখি হলাম। এর মধ্যে ওঁর বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞানের, ভয়, রহস্যের গল্প পড়ে ফেলেছিলাম। উনি হয়ে উঠেছিলেন আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক। কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র মিত্র ও উনি ছিলেন আমার সবথেকে প্রিয় সাহিত্যিক। টানটান লেখা, নিখুঁত ডিটেলিং, মৌলিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনা, বিশ্বমানের লেখা ওঁকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। একই সঙ্গে ওঁর লেখায় কিছু বাজার চলতি ভাষার ব্যবহার আমার ভালো লাগত না। সেজন্য সেই প্রথম সাক্ষাৎটা ছিল আমার কাছে খুবই স্পেশাল।
উনি সেবারেই প্রথম আমাকে বললেন উপন্যাস লিখতে। অবাক হয়েছিলাম। তার আগে এক যুগ ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প লিখলেও কখনও উপন্যাস লিখিনি। তাও আবার সরাসরি শারদীয়া কিশোর ভারতীতে?
অবাক হলাম যখন দেখলাম উনি আমার মতো অনুজ লেখকের প্রায় সব লেখাই পড়েন ও সে জন্যই রীতিমতো রিসার্চ করার পরে আমাকে এর জন্যে নির্বাচন করেছেনসেই আমার প্রথম অনিলিখার উপন্যাস¾ সংকেত রহস্য। সত্যি কথা বলতে কী উনি যদি আমাকে লিখতে না জোর করতেন, আজও হয়তো আমি আমার আলস্য কাটিয়ে কোনো উপন্যাস লিখে উঠতে পারতাম না।

আসলে অনীশ দেব শুধু অসামান্য সাহিত্যিক ছিলেন না, উনি সাহিত্যকে খুব ভালোবাসতেন। খুব ভালোবাসতেন কল্পবিজ্ঞান, রহস্য, থ্রিলার, ভয়ের গল্পের ধারাকে। সবসময় ভাবতেন কীভাবে বাংলা সাহিত্যের এই ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। জানতেন বাংলা ভাষায় এ ধারাকে জনপ্রিয় করে তুলতে উপযুক্ত মেধার দরকার। জানতেন যে খুব কম লেখকই এ ধরনের লেখা লিখতে পারেন। বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবসময় নতুন লেখকদের উৎসাহ দিতেন, স্বাগত জানাতেন, অভিভাবকের মতো গাইড করতেন একই সঙ্গে খুব ভালো পাঠক হওয়ায় দেখা হলেই কিছু ভালো উপন্যাস সাজেস্ট করতেন।
এত দূরে প্রায় যোগাযোগ না থাকলেও আমাকে কেন যে এত স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন জানি না। যখনই কথা হত, বুঝতাম অনেক কিছু শেখার আছে। সেই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অনীশ দেব, কবে যে আমার প্রিয় অনীশদা হয়ে উঠেছিলেন তা টের পাইনি। অথচ আমার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে সব মিলিয়ে বড়ো জোর কয়েক ঘণ্টার। অনেকের কাছে শুনেছি উনি আগ বাড়িয়ে তাদের সবাইকে আমার লেখা পড়তে বলতেন। এরকম বড়ো মনের সাহিত্যিক সত্যি মেলা ভার।
একই সঙ্গে উনি ছিলেন স্পষ্টবক্তাতাই ওঁর কিছু মন্তব্য নিয়ে হয়তো বিতর্কও হয়েছে। উনি চাইতেন বাংলা সাহিত্যে প্রকাশনা জগতে পেশাদারিত্ব আসুক। ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলতে দ্বিধা করতেন না।
এত পণ্ডিত মানুষ বাংলা সাহিত্যে খুব কম এসেছে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত অনেক শীর্ষস্থানীয় মানুষের সঙ্গে আমার আলাপের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এরকম স্তরের প্রজ্ঞা খুব কম-জনের মধ্যে দেখেছিসেটা ছিল বলেই ওঁর বিচারবোধ এত গভীর ছিল। একই সঙ্গে প্রচুর বই পড়তেন, মনে রাখতেন। সেজন্য কোন লেখাটা কতটা মৌলিক, সেটাও বুঝতে পারতেন।
সাহিত্যিক অনীশ দেবের চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যে সত্যি অপূরণীয় ক্ষতি। এরকম সাহিত্য প্রতিভা খুব কমই আসে, শুধু বাংলায় নয়, সারা বিশ্বেকী হারালাম সেটা আমরা আগামী তিন দশকে আরও বেশি করে বুঝতে পারব। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা অনীশ দেবকে নতুন করে খুঁজে পাবে বলে আমার মনে হয়। ততদিন নামী দৈনিকের সাংবাদিকরা ওঁর মৃত্যু-সংবাদ জানানোর জন্য তৃতীয় পাতায় দুই লাইন বরাদ্দ করবে। ততদিন বাংলাসাহিত্যের কিছু পণ্ডিত সাহিত্যিকরা (যাদের নিজেদের ওঁর মতো একটা লেখারও ক্ষমতা নেই), তারাও অনীশ দেবের লেখাকে সাহিত্যগুণবর্জিত বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেসেটাই স্বাভাবিক। অনীশ দেবকে বুঝতে হলে পড়াশোনা লাগে, মেধা লাগে।

----------
ছবি - সংগৃহীত

1 comment:

  1. দারুন লেখা। বিশেষ করে শেষ লাইনটা, অনীশ দেবকে বুঝতে হলে সত্যিই মেধার দরকার

    ReplyDelete