নজর
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
বাগানের গাছপালা দেখাতে দেখাতে উত্তেজিত হয়ে পড়ল সুদীপ। অদ্ভুত ছেলে, আর বাগানখানাও
তেমনি! ভারতবর্ষের হেন প্রান্তের এমন ফলদায়ী গাছ নেই যা তার বাগানে পাওয়া
যাবে না। গুটিকয়
বিদেশি গাছও আছে, কিন্তু তাদের প্রতি ও কেমন যেন উদাসীন।
অবাক হয়ে দেখছিলাম। গাছগাছালির ব্যাপারে তেমন দুর্বলতা আমার নেই। বাজারে যা চলতি সবজি
পাওয়া যায়, সে সব বাদে পেয়ারা কুল আম জাম ছেড়ে বড়োজোর তেঁতুলগাছটাকে চিনতে পারি। তার বাইরে সবকিছু এদিকওদিক
করে পেঁপে গাছের মতোই মনে হয়। এক কথায় ঘোর আনাড়ি। তাই হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম
সব।
সুদীপ বলল, “তুই তো কখনও আসিসনি এর আগে, গরমকালে এলে একটা জিনিস
খাওয়াতাম।”
আমি কৌতূহলী হয়ে তাকাতে বলল, “একরকমের আম - পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ ফল - কলম করে বসিয়েছিলাম, এই দেখ গাছগুলো।” বলে যে গাছগুলো দেখাল, ওগুলো
আমের গাছ হলেও উচ্চতা আট-ন ফুটের বেশি নয়, তবে পাতা-টাতা আছে
বেশ।
সুদীপ গাছগুলোকে দেখিয়ে বলল, “ভাবতে পারিস, এই সাইজের কচি কচি
গাছে আম ফলেছে, তাও এই সাইজ!” ও যে মাপটা দেখাল, তা বিঘতখানেক ছুঁয়ে
যায়।
আমার চোয়াল ফাঁক হয়ে ঝুলে রইল, বললাম, “বলিস কী রে!”
সুদীপ মনে হল আমাকে অবাক করে দিতে পেরে খুশি, বলল, “হ্যাঁ
স্যার! - তবে ফলন বেশি হয়নি, চারটে গাছ মিলিয়ে, ধর কিলো
বিশেক। কিন্তু
তাতেই ফাটিয়ে দিয়েছি একেবারে! লণ্ডনের একটা কম্পিটিশনে কিলো দুয়েক পাঠিয়েছিলাম স্যাম্পেল। ফার্স্ট তো হলই, কিন্তু
বিপদও হল। ঘন ঘন
ফোন আসতে লাগল ইউরোপ আমেরিকা থেকে, সবাই অর্ডার দিতে চায়, এক-আধ কেজি
নয়, একেবারে কুইন্টালে!”
তারপরে বলল, “তবে আমিও জানিয়ে দিয়েছি, ভালো জিনিস নিয়ে অত
খাই খাই করলে চলে না। এসব আমের এক-আধ স্লাইসই যথেষ্ট। তবে বুঝলি কিনা, ডিম্যাণ্ড
হয়েছে তো, তাই ওপাশের বিঘাখানেক জমিতে স্রেফ ওই আমগাছ লাগিয়েছি। ফল দিতে বছর দুয়েক। চল, ওদিকটা
ঘুরে আসি একবার।”
খানিক দূর হেঁটেই যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে পুকুরকাটা মাটি দিয়ে একটা
পাহাড়ের ঢালের মতো করা হয়েছে। সেখানা দেখিয়ে সুদীপ বলল, “এই দেখ, আমার চা
বাগান...।”
গেলবার ডুয়ার্সে গিয়ে বিস্তর চা-বাগান দেখেছি, এইজন্যেই
এতক্ষণ ধরে গাছগুলোকে চেনা চেনা ঠেকছিল।
“আবার ছায়াগাছও লাগানো
হয়েছে দেখছি!” বললাম আমি।
একথায় সুদীপের কোনো উত্তর না পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি চা-বাগানের
ঢালের নিচটাতে একটা মাঝারি সাইজের পাথরের উপর ঝুঁকে পড়ে একমনে কী যেন দেখছে। হঠাৎ সে শঙ্কিত মুখে
উঠে দাঁড়াল। বলল, “কে এটাকে
উলটেছে - সকালেই দেখেছিলাম সোজা ছিল।”
বললাম, “কী ওটা?”
সুদীপ এদিক ওদিক তাকাল, যেন কাউকে খুঁজছে, তারপর আস্তে আস্তে
বলল, “এটা মন্ত্র-পাথর।”
পাথরটার দিকে এবার ভালো করে চোখ গেল, নিছক পাথর নয়। হলুদ আর সিঁদুর লেপা
রয়েছে একটা আঙ্গিকে। মনে পড়ল, বাগানে ঘুরতে ঘুরতে আরও কয়েক জায়গায় দেখেছি অমন পাথর। বাগানের মালি-টালিরা
দেবতাজ্ঞানে পুজো করে ভেবে, ও নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি।
“কী বলছিস এসব? তোর কি
ভীমরতি ধরল নাকি!”
সুদীপ পাথরটাকে সোজা করে স্থাপন করেছে। আমার কথায় গা না করে, অন্যমনস্কভাবে বলল, “পরে সব
বলছি, এখন একবার চল, নজরবাবাকে নিয়ে আসতে হবে এক্ষুনি।”
পরে, কলকাতা থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে
সুদীপের বাগান থেকে ওর এক লঝ্জড়ে মারুতি ৮০০-এ চেপে, নজরবাবার আশ্রমের দিকে -
“নজরফোঁটা জানিস?” গাড়ি স্টার্ট
দিয়ে বলল সুদীপ।
“জানব না কেন! মায়েরা কপালের কোনায় কাজলের ফোঁটা দেয় যাতে কারও নজর না
লাগে।”
“নতুন বাড়ি করার সময়
বাড়ির বাইরে বাঁশের আগায় পুরোনো ঝুড়ি, ছেঁড়া জুতো আর মুড়ো ঝাঁটা বেঁধে
ঝোলাতে দেখেছিস কখনও?”
“ও তো হামেশাই দেখি - কারণ -”
“কারণটা হল, যাতে হিংসায়
জ্বলে পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া ঈর্ষাকাতরের কুনজর না পরে - তাই তো? একইভাবে
দক্ষিণ ভারতের বাড়ির সামনে রাক্ষসের মুখোস টাঙানো থাকে ওই কুনজর থেকে বাঁচবার জন্যে -”
এতক্ষণে ‘নজরবাবা’ নামটার মানে আমার কাছে পরিষ্কার হল।
বুঝলাম গ্রামে থেকে থেকে ভয়ানক হাল হয়েছে সুদীপের! সব ছেড়েছুড়ে অবশেষে
ইট পাথরের বিশ্বাস গলায় ঝুলিয়ে বসে আছে।
মেজাজটা আমার খিঁচড়েই গেল। বললাম, “গাছপালায় নজর লাগা আটকাতে তুই ওইসব ইট পাথরে সিঁদুর লেপা
শুরু করেছিস শেষকালে -”
“ওইভাবে বলিস না রুপু,” সুদীপ
আহত গলায় বলল, “নজর লাগা কাকে বলে তুই বোধহয় জানিস না ঠিক -”
আমার বিরক্তি লাগছিল, বললাম, “জানিস তো, ছোটোবেলায় পেটে ব্যথা হলে মা-পিসিরা
বলত - ‘খাওয়ার সময় নজর লেগেছে’ - খাওয়ার সময় কেউ উপস্থিত হলে নির্দেশ ছিল খাবার একটু খুঁটে শুঁকে
বাইরে ফেলে দেওয়ার। কতবার
তো দিয়েছি, কিন্তু পেট ব্যথা কি আটকানো গেছে? কখনও যায়?”
সুদীপ হাসল, বলল, “বিষয়টা তর্ক করার নয়, তর্ক হলে আমি জিততেও
চাই না। কিন্তু
আমার কিছু অবজারভেশন ছিল - বিশ্বাস
হোক, বা না হোক - তা হল, সত্যি নজর লেগেছিল একসময়। বাগানের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায়
সবরকম প্রজাতির এক একটা গাছ কুঁকড়ে যাচ্ছিল এমনভাবে, যেন প্রচণ্ড তাপ তাদের
পুড়িয়ে দিয়েছে।
“প্রথমে মনে হয়েছিল অসুখ, সেইমতো বিশেষজ্ঞদের ডেকেছিলাম। গাছের রস থেকে শুরু করে মাটি
পরীক্ষা, সব কিছু হলেও কাজের কাজ কিছু হল না। রোগ ধরা গেল না। একটার বদলে এবার তিনটে
করে গাছে বিপর্যয় শুরু হল। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যিটা ওইরকমই, সব প্রজাতির
তিনটে করে গাছ অসুস্থ হয়ে পড়ছিল - একটা কমও
নয়, বেশিও নয়।
“মাথায় আগুন জ্বলে গেল যেন, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে অমন তিন-তিনটে করে অনেকগুলো গাছ
উপড়ে ফেললাম গোড়া থেকে, তারপর কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলাম সব ক’টায়। গাছগুলো যখন পট্পট্ করে পুড়ছে, আমার গায়ে
একটা অদ্ভুত শিরশিরানি শুরু হল তখন। কাঁপুনি লাগল সমস্ত শরীরে। মনে হল কেউ যেন শয়তানি হাসি হাসছে
আমার দিকে তাকিয়ে। কাউকে
দেখিনি, কিন্তু মনে হচ্ছিল, সে এই সমস্ত বাগান জুড়েই আছে।
“পরেরদিন সকালে বাগানে গিয়েই আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এ কী দেখছি! বাগান
জুড়ে সমস্ত প্রজাতির পাঁচখানা করে গাছের পাতা কুঁকড়ে গেছে একেবারে। যে সব গাছের তিনটে
করে আগের দিন পুড়িয়েছি, সেখানেও নতুন করে পাঁচটা আক্রান্ত।
“বাগানের প্রধান মালি সহদেবদা সঙ্গেই ছিল, বলল - ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না, বুঝলেন - নজর লেগেছে মনে হচ্ছে।
“- নজর লেগেছে!! কে দিল নজর?
“অবিশ্বাস্য কথাটাকে বিশ্বাস না করেও যেন আমার উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল, নজর লাগা
সম্ভব। মনে হচ্ছিল, সত্যি
কারও লালসায়িত চোখের শাণিত বিষ পাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে পাতার
সমস্ত কোষকলাকে।
“কিন্তু কে সে? কার হাসি শুনেছিলাম আগের দিন? সত্যিই শুনেছিলাম কি? চারপাশে
তো কেউ ছিল না!
“বুকের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কার কাঁপুনি লাগল।
“সহদেবদা বলল - কত লোকই তো যায় বাগানের
পথ দিয়ে। এই বাগান
দেখে দেখে, কার বুকে এত দুঃখু এত বেদনা, এত না পাওয়ার হিংসে
জমে আছে, বলা মুশকিল! তবে এমন হলে গাছের গায়ে হাওয়া লাগে। সে হাওয়া বড়ো খারাপ - কেউ মানে, কেউ মানে না, কিন্তু
মানুষের গায়েও অমন নজর লাগে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের গ্রামের মতি দফাদারের
অমন ফুটফুটে নাতিটা, শুকিয়ে শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল। - বলে হাতের আঙুলটা কাছাকাছি এনে
একটা লাড্ডুর মতো সাইজ দেখাল সহদেবদা।
“মনের মধ্যে ভয় শিহরণ মেশা অদ্ভুত অনুভূতি, তবুও সহদেবদার দেখানো
মতি দফাদারের নাতির অন্তিম সাইজটা দেখে হেসে ফেললাম। বললাম - তাহলে উপায় কী!
“সহদেবদা বিন্দুমাত্র না ভেবে বলল - কাল একবার
নজরবাবার কাছে চলুন, সব ঠিক করে দেবেন উনি।
“নজরবাবার নাম শুনেছিলাম, পরের দিনই গেলাম তাঁর আশ্রমে,” সুদীপ
বলতে লাগল, “সহদেবদাই তখন একমাত্র ভরসা। আর কোনো উপায় ছিল না বলে তার
কথা উড়িয়ে দিতে পারিনি।
“দেখলাম, নজরবাবা মস্ত তান্ত্রিক। সব কিছু শুনে বললেন - নজর তো
লেগেছেই, তবে বাইরের কেউ তো নয়, ও তো তোমারই নজর, বাবা।
“- আমি!!! আমার নজর!!!
“আকাশ থেকে পড়াও বোধহয় এর থেকে কম বিস্ময়ের।
“কিন্তু সহদেবদা হাঁউমাউ করে উঠল - দেখেছেন
তো, কতদিন আপনারে বলছি, আঙুল সোজা করে ফুল বা গাছের দিকে
দেখাবেন না, ওতে ওরা মরে যায়। আঙুলটা একটু বাঁকিয়ে কিংবা কড়ে আঙুল দিয়ে দেখান, কিন্তু
শুনবেন না। এখন দেখুন, শেষতক
আপনারই নজর লাগল - হায় হায় -!
“যাই হোক, আমার বিস্ময় তখনও কাটেনি। নজরবাবা অবশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে - আপনার নিজের সৃষ্টি কোনো জিনিসের দিকে যদি অতীব মুগ্ধ
হয়ে তাকিয়ে থাকেন, চোখ ফেরাতে না পারেন বা নজর সরালেও বার বার ফিরে ফিরে
যান তার কাছে, তাহলে ধরে নিন আপনি একাত্ম হয়ে গেলেন ওর সঙ্গে। তখনই হয় বিপদ। গাছপালার ক্ষেত্রে
তো আরও সাংঘাতিক। আপনার
সঙ্গে একাত্মতার দরুন ধরে নিন, প্রতি মুহূর্তের বায়োলজিক্যাল কাজকর্মগুলোও বন্ধ করে দেয়, তখন তো
পাতা কুঁকড়ে যাবেই!
“নজরবাবা আমার বাগানে এসে হোমযজ্ঞও করেছিলেন। সব শেষে ন’টা পাথরে
মন্ত্র দিয়ে বাগানের জায়গায় জায়গায় অর্ধেকটা করে পুঁতে সাবধান করে বলেছিলেন - এগুলো যেন উপড়ে না ফেলে কেউ। উপড়ালে বাগানের যা হওয়ার তো হবেই, উপরন্তু
যে উপড়াবে তারও সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যাবে।
“কতদিন হয়ে গেল, পাথরগুলো একইরকমভাবে থেকে গিয়েছিল। সবাই জানত, তাই কেউ
ওদের ধারেকাছে যেত না। এখন কী সর্বনাশ হয় কে জানে!”
“কী আবার হবে! কিচ্ছু
হবে না, নিশ্চিন্ত থাক।” ভেঙে পড়া সুদীপকে অভয় দিতে চেষ্টা করলাম। বললাম, “তান্ত্রিক
ঠাকুর নজর লাগার তত্ত্বটা বেশ ভালোই খাড়া করেছেন, ডক্টরেট পেতে পারেন!”
সুদীপ কথাটায় আমল দিল না। তীব্র চোখে একবার তাকিয়ে গাড়িটাকে ঝাঁকুনি মেরে দাঁড় করিয়ে
বলল, “নে, নাম এখন - আশ্রম এসে গেছে।”
কৌতূহল যে ছিল না তা নয়, মনে হচ্ছিল নজরবাবার তামাশাটা একবার নিজের চোখেই দেখে
নেওয়া যাক, কিন্তু আশ্রম দেখেই চক্ষু চড়কগাছ।
চারদিকে পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট্টো ফালি জমির মাঝখানে একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া
কুঁড়েঘর। দাওয়ায়
বসে আছে যে লোকটা, তার বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তরের মধ্যে যে কোনো কিছু হতে পারে। খালি গায়ে সাদা লুঙ্গি
পরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছেন।
এক আটপৌরে ভদ্রলোক। সুদীপের ইশারায় বুঝলাম, উনিই নজরবাবা।
বইতে পড়া বা সিনেমায় দেখা তান্ত্রিকের সঙ্গে কোনো মিল নেই। রুদ্রাক্ষ-টুদ্রাক্ষ
তো দূ্র অস্ত, একগোছা দাড়িও নেই কোথাও।
ছিপছিপে চেহারা, চৌকো মতন মুখ, উজ্জ্বল চোখ, ঠোঁট দু’খানা
লাল হয়ে আছে পানে।
বুঝলাম, সাবেক বেশ আর কায়দা আজকাল চলছে না দেখে ভোল বদলেছে বাবাজি।
সাদামাটা পোশাক, কিন্তু গুঢ় গুঢ় বিষয়ের উপর তুখোড় বাক্চাতুরি, তার সঙ্গে
দু-চারটে ইংরেজি শব্দও বেরোয় ঝুলি থেকে - তাতেই ভড়কে যায় মানুষ। এরকম কত বাবার কাছে কাতারে কাতারে
লোক সারেন্ডার করছে!
বুঝলাম, সুদীপও বেশ খেয়েছে ব্যাপারটা।
আমার কিন্তু গোড়া থেকেই সব কিছু সাজানো মনে হচ্ছে। কোথাও যেন একটা ষড়যন্ত্র আছে!
বেড়ার দরজা ঠেলে সবে ভিতরে ঢুকেছি, পিছন দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে
একটা লোক ঢুকল, কাঁধে তার ছোট্টো একটা ধামা। যেতে যেতেই সুদীপের দিকে তাকিয়ে
হাসল, বলল, “ভালো আছেন ভাই? সহদেবদাকে দেখছি না
যে কিছুদিন ধরে - শরীর-টরির ঠিক আছে তো?”
সুদীপ ব্যস্ত হয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, “না-না, সে সব
কিছু না, সহদেবদা বাড়ি গেছে ক’দিন হল।”
লোকটা জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নজরবাবার ঘরে ঢুকে গেল।
সুদীপ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইনি নজরবাবার প্রধান শিষ্য – সহদেবদার বন্ধু – একই গ্রামে
বাড়ি।”
আমি ‘হুঃ’ বলে চুপ করে গেলাম।
এতক্ষণে তবে দুয়ে দুয়ে চার হল! ঠিকই বুঝেছি, সহদেবদা, ওই লোকটা
আর ওই মার্কা মেরে বসে থাকা নজরবাবা - এই তিনে
মিলে একটা কুচক্র বসিয়েছে এখানে।
ফিসফিস করে সুদীপকে বললাম, “এখান থেকে সরে পড় – সব গট-আপ।”
“মানে?”
“মানে হল, সব কিছু
এই বাবাদের চালিয়াতি।”
সুদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দেখলাম নজরবাবা দাওয়া থেকে নেমে এসেছে।
আমাকে দেখিয়ে সুদীপকে বলল, “আহা কী রূপ! এই সৌম্যদর্শন যুবাটি বোধহয় তোমার
বন্ধু হয়? এসো, এসো, ভেতরে এসো বাবারা।”
সুদীপ ঘাড় হেলিয়ে গদগদ চিত্তে যেভাবে নজরবাবার সঙ্গে হাঁটা লাগাল, আমি আর
আটকাতে পারলাম না ওকে। তেতোমুখে পেছন পেছন গেলাম।
মনে হল, ঢঙ জানে কিছু লোকটা - মিষ্টি
কথায় ভোলাতে জানে। অথচ দাড়িবিহীন
এমন লোক কিছুতেই সুবিধার হয় না!
প্রধান শিষ্যের মাধ্যমে সহদেবদাকে হাত করে যে ওই লোকটাই আগাছা মারার স্প্রে দিয়ে
নিয়ম করে গাছ মারিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর ওই সহদেবদাকে দিয়েই নজর
লাগার গল্প ফাঁদিয়ে, বাগানের পয়সাওলা মালিককে ফুসলিয়ে এনেছে নিজের কাছে। কী, না পাথর
পুঁতে গাছের প্রাণ বাঁচাবেন ঊনি! বুজরুক আর কাকে বলে! আর সুদীপটাও এমন বোকারাম, দিব্যি
পা দিল ওই ফাঁদে!
একটা অসহায় রাগ মাথার মধ্যে আছড়ে আছড়ে পড়ছিল ক্রমাগত। এদিকে নজরবাবার সঙ্গে আড়ালে গিয়ে
কীসব ফিসফাস চলছে দু’জনে। জানি না, কে আমাকে সুদীপের থেকে আলাদা করে দিল, সুদীপ
নিজেই না নজরবাবা, তাই ভাবছিলাম। এমন সময় নজরবাবার প্রধান শিষ্য এক কাপ চা এনে আমার হাতে
ধরিয়ে দিল।
দুধ ছাড়া চা আমার বড়ো প্রিয়। আর চায়ের রংটা দেখেই মনে হচ্ছিল চা-টা খুবই
উৎকৃষ্ট। নজরবাবার
শিষ্য যেন আমার মনের কথা শুনতে পেল। বলল, “গুরুজির এই একটাই বিলাস। দামি দার্জিলিং চা-এর ভীষণ ভক্ত
উনি। অবশ্য
চা গাছের সবকিছুই ওঁর ভালো লাগে। ওপড়ানো মরা শুকনো চা গাছ দেখেছেন কখনও? এই ঘরে
শুকনো গুঁড়ি আর ডালপালা দিয়ে তৈরি একটা ছোট্ট টেবিল আছে গুরুজির ভীষণ পছন্দের, একবার
দেখে নেবেন। অমনটা
কখনও দেখেননি।”
গেলবার ডুয়ার্সে গিয়ে চা গাছের গোড়া দিয়ে তৈরি টেবিল দেখেছি, শুকনো গুঁড়ি
থেকে বেরিয়ে আসা অনেকগুলো গুলি গুলি ডালের উপর কাচের স্ল্যাব বসানো। দেখে কেমন যেন রূপকথার
রঙিন বইয়ের মলাটে দেখা রাক্ষসের লোমশ হাতের মতোই লাগছিল। দেখে বেশ অস্বস্তি হয়েছিল।
আমার চায়ে চুমুক দিলাম। আর তখনই দেখলাম, ঘর থেকে বেরিয়ে সুদীপ
আর নজরবাবা উঠোনের দিকে নেমে আসছে।
নজরবাবার হাতে শুকনো চা গাছের তৈরি একটা ছড়ি। গুলি গুলি গাঁটওয়ালা, আমার যা
সবচেয়ে অস্বস্তিকর লাগে। সুদীপের মুখটা বেশ খুশি খুশি, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে
মনে হচ্ছে। বুজরুক
বাবা-টি আরও কিছু যা তা প্রায়শ্চিত্ত নিদান দিয়েছে নিশ্চয়ই। এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, এদিকে
সুদীপ আর নজরবাবা এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। হঠাৎ একটা অবাক হওয়ার বোধ এল। মনে হল নজরবাবাকে এত অবিশ্বাস
করছি কেন? তার সঙ্গে আমার কীসের শত্রুতা? মানুষকে না জেনেই তার
সম্বন্ধে মনগড়া ধারণা করাও যে এক রকমের ঘোর অন্যায় তা তো ছোটো থেকেই জানি! কথাগুলো
মনে হতেই বুকটা হালকা হয়ে গেল। যেন বহুদিনের লুকিয়ে রাখা গোপন কোনো কথা নিশ্চিন্ত আশ্রয়
পেয়ে বেরিয়ে গেছে বুক থেকে!
নজরবাবা কাছে এসে মৃদু হাসলেন, বললেন, “গাছের সমস্যাটা সমাধান হল, কিন্তু মন্ত্র পাথর
কে উপড়েছে সেটা না জানতে পারলে তাকে বাঁচানোর কোনো উপায় দেখছি না।”
আমার যে কী হল কে জানে, ফিসফিস করে বললাম, “বাবা, আপনি কত
ভালো। নইলে যে
পাথর উপড়েছে তার ক্ষতির আশঙ্কাতেও আপনি এত বিচলিত হন!”
নিজের মুখে এরকম কথা শুনে আমার অবাক লাগল না, কিন্তু সুদীপ বেশ ঘাবড়ে
গেল। বলল, “কী বলছিস
রে তুই!”
তারপর নজরবাবার দিকে ফিরে বলল, “আসলে কিন্তু ও ঘোর নাস্তিক! নজর যে সত্যিই লাগে
এতে ও বিশ্বাস করে না, বলে কুসংস্কার।”
নজরবাবার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক, বললেন, “লাগে বাবা
লাগে - নজর লাগে কখনও কখনও! নিজের উপর নিজের নজর
লেগে যায়। যেমন ধরো, তুমি এত
রূপবান - আমার তো ভয় হয়…”
নজরবাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুদীপ বলল, “ওকেও একটা রক্ষাকবচ
দিন না বাবা!”
নজরবাবা উদাসভাবে দূরের দিকে তাকিয়েছিলেন, বললেন, “আমিও তাই
ভাবছি - কিন্তু রাখতে পারবে তো?”
আশ্রম থেকে বেরিয়ে পথে অম্বিকা বিশ্বাসের নার্সারি থেকে বেশ কিছু নতুন ধরনের
গোলাপ চারা কিনে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল।
নজরবাবার রক্ষাকবচ আমার বাহুমূলে বাঁধা। একদম বিনামূল্যে উনি ওটি দিয়েছেন
আমাকে। গাড়িতে
আসতে আসতে ভাবছিলাম, হয়তো ভালোই হল। চতুর্দিকে এত অভিশাপ, বিষাক্ত
নজরের কথা তো তলিয়ে ভাবিনি কখনও। সেই কোন ছোটোবেলায় মা, কপালের এক কোণে কাজলের
ছোট্ট একটা ফোঁটা লাগিয়ে দাঁতে আঙুল কাটত আর বলত, ‘আর কারও নজর লাগবে
না।’ সেই মা তো মরে গেছে কবে। তবে কে আমায় বাঁচাবে এখন!
চোখ বুজে আরামে গাড়ির সিটে গা হেলিয়ে ভাবছিলাম এসব। এই রক্ষাকবচটা হাতে থাকায় অদ্ভুত
এক সুখানুভূতি হচ্ছিল। যেন গরমকালের খর দুপুরে হঠাৎ করে বৃষ্টির আগে ঠান্ডা হাওয়া বইছে।
বেশ ভালোই লাগছিল, কিন্তু সেই অনুভূতি ক্রমশ বদলে যেতে লাগল সুদীপের বাগানের কাছাকাছি
এসে। আশ্রমের
সেই মধুর ভাবটা যেন উবে যাচ্ছে।
বাগানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই টের পেলাম ভীষণ গরম লাগছে শরীর জুড়ে। যদিও এখন গরমকাল, গরম লাগা
অস্বাভাবিক নয়। এ সময়
দিনে বার চারেক স্নানও আমি করি। তাই গরমের কষ্টে প্রথমেই স্নানের কথাটা মনে হল।
সুদীপ টর্চ নিয়ে বাগানের দিকে গেছে, নড়ে যাওয়া মন্ত্র
পাথরের নিচে নজরবাবার দেওয়া মন্ত্রপূতঃ পুঁটলিটা রাখবে বলে।
আমি বাথরুমে গিয়ে এক বালতি জল মাথায় গায়ে ঢেলে দিলাম। জলের ধারা মাথা ভিজিয়ে গায়ে
পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেন ঘোর থেকে জেগে উঠলাম।
বদলে যাওয়া আমি থেকে সত্যিকারের আমিটা ছিটকে বেরোল।
তখনই চোখে পড়ল কবচটা। বাঁ হাতের বাহুমূলে লাল কার দিয়ে বাঁধা। সমস্ত শরীর রি রি করে
উঠল ঘৃণায়। আমার এতদূর
অধঃপতন হয়েছে!
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে আমার হাতে গলায় কোমরে কেউ একটা মাদুলি পর্যন্ত বাঁধতে
পারেনি, একটা আংটি পরাতে পারেনি কোনোদিন, সেই আমি জ্ঞানগম্যি
জলাঞ্জলি দিয়ে কোথাকার কোন ভণ্ড বাবার মন্ত্র নিয়ে আদিখ্যেতা করছি!
বজ্রপাত হয়ে গেল মাথার ভেতর। এক টানে ছিঁড়ে ফেললাম শক্ত কার দিয়ে বাঁধা কবচটা। টানাটানিতে হাতেও কেটে
গেল একটুখানি। কিন্তু
আমার তখন সেদিকে তাকানোরও সময় নেই। প্রচণ্ড রাগে বাথরুমের ঘুলঘুলি দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম
মন্ত্র কবচ।
ভেতরে ভেতরে আমার অজান্তে যে কতক্ষণ ধরে নিজের সঙ্গে ধুন্ধুমার চলেছে, বলা কঠিন। তবে কবচখানার গতি হওয়ায়
মনে ভারি একটা স্বস্তি এল।
রাত হলে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ টেনে আসছিল, কিন্তু আমি জোর করে
তাদের খোলা রাখছিলাম।
জানলা দিয়ে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না থই থই বাগান। এত স্পষ্ট যে, শুয়ে শুয়েই
তাদের প্রতিটি পাতা থেকে পাতার জালক, মৃদুগতি রসের প্রবাহ - সব যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ চাঁদ ঢলে পড়ল জানলার কোলে। অদ্ভুত উজ্জ্বল এক চাঁদ, যা আমি কখনও দেখিনি, এই মুহূর্তে
মায়াময় আলো ছড়াচ্ছে বাগান জুড়ে।
আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। নেমে এলাম বাগানে। সমস্ত গাছে গাছে সতেজ ভাব জেগেছে, যেন কথা
বলতে চাইছে প্রত্যেকে। আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, সমস্ত শব্দ বুঝতে পারছিলাম, যেন আমি
ওদেরই একজন। আশেপাশে
কোথাও নজরবাবার মন্ত্রপূত পাথরের চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পেলাম না।
কোন নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে হাঁটতে
লাগলাম।
আমায় যেন নেশায় পেয়েছে আজ। হাঁটার নেশা। বাগান আর শেষ হয় না। গাছেদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে
আমি হেঁটেই যাচ্ছি শুধু। একদিকে মশগুল হয়ে আছি চন্দ্রমায়, আরেকদিকে ভেবে ভেবে
আশ্চর্য হচ্ছি, কত বড়ো বাগানখানা বানিয়েছে সুদীপ!
এমন সময় কোনো কিছুতে হোঁচট লেগে হুমড়ি খেতে খেতেও টাল সামলে নিলাম।
তখনই অবাক কাণ্ড! গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে আয়নার মতো ওটা কী দেখছি সামনে! এ যে টলটলে
জলের এক স্বচ্ছ পুকুর। পুকুরটার কথা সুদীপ বলেছিল বটে।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম পাড়ে। ঘাট বাঁধানো রয়েছে চমৎকার। লাল রঙের সিমেন্টের ঘাট।
জলে গোড়ালি ডুবিয়ে বসে পড়লাম সেখানে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! জলে আলোড়ন উঠল না কোনো!
জলের দিকে ঝুঁকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল চাঁদের আলোয়। কিন্তু চাঁদ কোথায়! জলের মধ্যে
থেকে চাঁদের মতো আলো ছড়াচ্ছে যে আমার মুখ! এ তো আমারই প্রতিবিম্ব।
কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এখন!
নজরবাবা বলেছিল বটে আমি রূপবান। নিজেকে প্রতিনিয়ত আয়নায় দেখেও তাই মনে হত। কিন্তু এ যে অভাবনীয়।
ওই তো আমার বলিষ্ঠ গলার নিচে চওড়া কাঁধ, বুকের ছাতির মাংসল
স্ফীতি। পেশিবহুল
হাত-পা, সরু কোমর। এ তো মাইকেল এঞ্জেলোর আঁকা ছবি দেখছি যেন! আমার রোগাসোগা
সরল বাঙালি মাপের গড়নের নিচে এই বিপুল শক্তি অপেক্ষা করেছিল তবে!
আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম আমারই প্রতিবিম্বের দিকে। কতক্ষণ তা কে জানে!
হঠাৎ জলে কাঁপন লাগল। হাওয়া চলছে না, তবু কাঁপন! আমার প্রতিবিম্বের
চাঁদটা যেন ফিকে হয়ে আসছে।
আমি চোখ কচলালাম। প্রতিবিম্বকে রক্ষা করতে হাত বাড়ালাম জলের দিকে।
জল সরে সরে যাচ্ছে। আমাকে ছুঁতে দিচ্ছে না - আমার সঙ্গে
খেলা করছে।
আমি আরও দীর্ঘ করে হাত বাড়াতে চাইলাম।
কিন্তু কী হল! আমার হাতের রঙ অমন কালো হল কীভাবে। আঙুলগুলো পরস্পরের
সঙ্গে জুড়ে গিয়ে বেলচার মতো হয়ে যাচ্ছে কেন? এই! এই দ্যাখো, কনুইটা
যেন কালো আঁবের মতো ফুলে উঠল!
হায় ভগবান, আমার হাত-পা সব খস্খসে আর কালো হয়ে উঠছে। আমি ওই বিচ্ছিরি মরা
চা-গাছের মতো হয়ে উঠছি! হয়ে যাচ্ছি, নজরবাবার
কোনো আসবাবের কাঠ।
আমি চিৎকার করে সুদীপকে ডাকতে গেলাম।
কিন্তু ততক্ষণে আমার জিভটাও উপড়ানো চা-গাছের মতো নিঃসাড় হয়ে
গেছে। কোনো আওয়াজ
বেরোলো না।
কাঁপুনি লাগল শরীরে। কাঁপুনি টের পেলাম বাগানের কোনায় কোনায়। মনে হল, কেউ যেন
অত্যন্ত শয়তানি হাসি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর ক্রূর সে
চোখ, ঠিক যেমনটা বলেছিল সুদীপ।
চারপাশের অসীম কুয়াশায় মাটির গভীরে যন্ত্রণাহীন ডুবে গেলাম আমি!
ছবি - নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment