গল্পের ম্যাজিক:: ছায়ার স্কুল - সৌমন্তী সিনহাবাবু

ছায়ার স্কুল
সৌমন্তী সিনহাবাবু

পৃথিবীতে অনেক রকমের স্কুল আছে, রোদ-বৃষ্টির স্কুল, কুয়াশার, মেঘের কিংবা কিছু কিছু স্কুল জ্যোৎস্নারও হয় কিন্তু পুরো তিনটে প্রান্তর ছড়ানো সাদা ফুল-ফুল নকশাকাটা ঘাস পার করে, নাম-না-জানা গাছটার হরিণরঙা গুঁড়ির পাশ দিয়ে যখন ন’বছর বয়সে প্রথম আমাদের বালিকা বিদ্যালয়টার ফটকে পা রাখলাম, কান ছাড়িয়ে অনেক গভীরে লালচে-বেগুনিরঙা আলোর মন নামের যে হাওয়ামহলটা আছে, সেখানে একপশলা মুষলধারা বাতাস ছুট্টে এসে বলেছিল, “এ তো ছায়ার স্কুল!” এবার এইটুকু বললেই সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করবে হয়তো, সেদিন নয় আকাশে আঁধারি নদী থমকেই গিয়েছিল, সেদিন নয় মেঘেরা বর্শার ফলা হাতে দুমদাম উড়ে আসছিলই দরজার মুখের হলুদ কাগজে জড়ানো পাঁচিল-দেয়াল টপকে ভেতরের সবজেটে বোর্ডটা পর্যন্ত, ও স্কুলে কি কখনোই রোদ ওঠেনি তা বলে? না উঠেছে তো, পরের দিন থেকেই দিব্যি একেবারে পাশের গলির বুড়ো ফেরিওয়ালা দাদু ঠেলাগাড়ি নিয়ে মোমবাতি বিক্রি করতে আসার আগেই, ঝকঝকে গাজররঙা, ঝিঙেফুলী আর বসন্তবৌরী রোদ মিলিয়ে মিশিয়ে সূর্যটা ছিটিয়ে দিয়ে গিয়েছে ছাদে, কার্নিশে, জানালায়, আমরা যখন পা রাখলাম তখন তা হলুদে-কমলার সমুদ্র পুরো! কিন্তু, ওই যে, ফটকের বাইরে থেকে ওইটুকুই মনে হয়, ভেতরটা এক্কেবারে আলাদা!
এমনিতে কিন্তু ছায়ার স্কুলকেও অন্য স্কুলের মতোই লাগবে, ওখানেও সেই দূর দূরান্তের গ্রাম ঝাপসা করে দেওয়া ধোঁয়া-ধোঁয়া নীল বৃষ্টির দুপুরে পিওনদিদি দুঃখ-দুঃখ গন্ধের অঙ্ক খাতার স্তূপ রাখবে টেবিলের উপর, সেই লাল-কালো ছাতাগুলো খুলে মেলে দেওয়া হবে নিঝুম শেষের বেঞ্চে এবং আর পাঁচটা বালিকা বিদ্যালয়ের মতোই অবধারিতভাবে কোনো বেলার শখের ঘন গোলাপি ছাতাটা হুট করে হারিয়ে কিংবা উড়ে যাবে! ছাতাপরিদের রাজকুমারী কিনা ওরা ছাতাপরিদের কথা জানা নেই? ওই যে ছায়ার স্কুলের কথা কিনা ওইসব, তাই হয়তো…!
ওই ছাতাপরিদের মতোই অনেক গল্প থাকে ছায়ার স্কুলের, যার বেশিরভাগই বাইরের কাউকে বলা বারণ তাও চুপি চুপি কলমের শব্দ না করে ওরকম স্কুল চেনার খুচরো দুটো উপায় লিখে দেব? এক, ওই স্কুলে যখন-তখন পাতার বাঁশি বাজে, কথায় কথায় বড়দির হারমোনিয়ামটা পিয়ানোর মতো সুর তোলে ওখানে যদি কোনো কুকুর থেকে থাকে, তার ডাকটাও হবে একটু আলাদা, একটু সুরেলা সুরেলা আর দু’নম্বরটা খুব সোজা, স্কুলবাড়িটার পাশে থাকতেই হবে একটা ঘন বুনো রাস্তা, যে সে বন নয়, সবুজ অন্ধকার দেবদারুদের বন!
আর কে না জানে, দেবদারু বনে অনেক ব্যাপার থাকে স্কুলের এক্কেবারে কাছের যে বেগুনি রূপকথাগোছের বাড়িটা, যার দেয়াল জোড়া সারি-সারি জানালা রাত্রি নামলেই হলুদ হয়ে যায়, সেইখানে মাঝে মাঝে ঝাড়লন্ঠন জ্বলা ঘরে বসে উল বোনেন রুম্পা-ঝুম্পার ঠাকুমা রুম্পা কতবার বলেছে আমাদের কাছে এসে, সেইসব রাতে ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়লে ঝড় ওঠে, তারপর এক বুড়ি এসে বানিয়ে রেখে যায় সোয়েটার ঠাকুমা উঠে ভুলেই যান যে তিনি কুড়ি ঘর বুনেই স্বপ্নে পৌঁছে গিয়েছিলেন হরিদ্বারের ঘাটে, খেয়ালই থাকেনি সবুজ উল নেই বাড়িতে আরেকবার তো ছোটোবেলায় ঝুম্পা দেখেছিল, দেবদারু বনের গা ঘেঁষে একটা ছোট্ট ডাকবাক্স রাখা, সে এই আছে তো এই নেই!
তবে আসল কাণ্ডটা তো ঘটল আমাদের স্কুলে ভরতি হওয়ার বছর দুয়েক বাদে সেই সপ্তাহে এমন কান্নাকাটি শুরু করেছিল আকাশটা আর মাঝে মাঝে চাপা গর্জন যে টানা তিন দিন বন্ধ ছিল আমাদের খেলাধূলা, এমনকি চতুর্থ দিনে স্কুলটাও বন্ধ হয়ে গেল! এই সময়েই হঠাৎ গল্পের চরিত্র হয়ে গেল হোস্টেলের চাঁপাদিদি অথচ ওর কিন্তু স্কুলের গল্পে তেমন ঝোঁক ছিল না একে তো বেচারি বাড়ি ছাড়া থাকতেই পারে না, জোর করে আটকে রাখতে হয় হোস্টেলে, তার উপর পড়াশোনায় কবেই বা মন বসেছিল তার? রবিবার ভোরে তাকে পাওয়া গেল ওই জঙ্গুলে রাস্তায়, অজ্ঞান অবস্থায় তার পর হাসপাতাল বাড়ির লোকজন ডেকে আনা স্যালাইন একগাদা ওষুধপত্রের সঙ্গে যখন ফিরল চাঁপাদিদি, স্কুলে যেন অদ্ভুত কুয়াশা দিন দুয়েক পর দুপুরে হঠাৎ একলা ক্লাসে বসে আছি, আমার টিফিনবক্স থেকে একটা খেজুর তুলে নিয়ে আমাদের ক্লাসের মনি হঠাৎ ফিসফিস করল, “জানিস চাঁপাদিকে পাগলের ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে, চাঁপাদি কী সব দেখেছে দেবদারু বনে!” কী দেখেছে জিজ্ঞেস করতে মনি বলতে চাইল না কিছুতেই, ওদের হোস্টেলের কথা বাইরে বলাই বারণ
সেই রাত্রে আরও একদফা প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি, কোথায় নারকেল পাতায় তার লেগে ছিঁড়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের পাড়ায় কারেন্টই এল না আর সকালে উঠে আর পড়া তৈরি করা সম্ভব নয়, ভাবতে ভাবতেই স্কুলের সামনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ চোখে পড়ল বাইরে ভীষণ জটলা, স্কুলের পূর্ব দিকের একটা ঘরকে দেখাচ্ছে সবাই ভিড় ঠেলে মিনিট কতক পরে বড়দি আসার পর খবর পেলাম, একটা মেয়ে নাকি একা একা স্কুল এসেছিল একটু আগে, দোতলার তালা খোলা ছিল বলে সে উঠেছিল উপরে, তার নিজের ক্লাসের কাছে গিয়ে দেখে শুধু ওদের রুমটাই খোলা তা খোলা তো খোলা, সেও অনায়াসে ব্যাগ রেখে বসেছে ফার্স্ট বেঞ্চে, হঠাৎ প্রচণ্ড ক্যাঁচ ক্যাঁচ আর দুম করে একটা শব্দ! অবাক হয়ে মেয়েটা জানালায় তাকিয়ে দেখে, তাকে ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল একটা মেয়ে, আমাদের স্কুলের মতো নীল-সাদা না, অনেকটা কালো-সাদা ইউনিফর্ম পরা, মুখ ঢাকা এলোমেলো চুলে সেই দেখে বন্দি মেয়েটি প্রচণ্ড চিৎকার করেছে, ছুটে গেছে জানালার ধারে, কিন্তু ওই সাদা-কালো মেয়ে একটু দূরে গিয়েই তালতলার কোণের রুমে যেন মিলিয়ে গেল চিৎকার শুনে পিওনদিদি ছুট্টে গেছে, তার মতে সত্যিই ওই ঘর তালা দেওয়া ছিল, এই মেয়ে ঢুকল কী করে ভেতরে তাই বুঝে উঠতে পারছে না সে যাই হোক, এই মেয়েকেও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শেষমেশ, যাওয়ার আগে যেটা বলে গেছে সেটা শুনেই আমি স্পষ্ট দেখলাম বড়দির মুখের রঙ বদলে গেল, “সাদা-কালো পোশাকের মেয়েটার নাকি আসলে এগিয়ে যেতে যেতে ছাই চামড়ার হয়ে গিয়েছিল!” ছায়ার স্কুল তাই ছাই-ছাই রঙ আর কি!
তবু ছাইরঙা আকাশ সাক্ষী রেখে দাঁড়াই চাতালে, সুর-তাল কেটে গান ধরেন বড়দি, ক্লাস ফাইভের অনিন্দিতা আর টেনের তিতলিদিদি, সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলাই আমরা স্কুলব্যাগ পিঠে প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর একটু থেমে বড়দি বললেন, “আজকে সব ক্লাসের সব সেকশন একসঙ্গে বসবে, নিচে টিফিনে ছুটি হবে” নিচে? আমাদের যে ওপরে ক্লাস! ভরা দিনের আলোয়ও কেমন ভয়ে কাঁটা হয়ে যাই আমরা কয়েকশো মেয়ে, বন্ধু হয়ে এ আর বি সেকশন ক্লাসে ঢোকে হাত ধরাধরি করে প্রথম ক্লাসে বাংলার রুটিন না মেনে শুরু হল ইতিহাস দিয়ে, তারপর টানা দুটো ভূগোল শেষে একটা ইংরেজি অন্যদিন যে আমাদের মাঝে নিজের গলার শব্দ খুঁজতে ডাস্টার ঠোকা ছাড়া গতি থাকে না ইংরেজির সীমা ম্যাডামের সেই আমরাই অনুভব করছি, সীমা ম্যাডামের কন্ঠস্বর ঠিক মাইকের মতো, ভাবা যায়?
ছুটির পর দক্ষিণের পাড়া ধরে বাড়ি ফিরছি, সাদা পাথরের মন্দির পার করে দেখি রুম্পা আকাশি সাইকেল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাড়ির সামনে, আমাকে ঠিক চিনতেই পারছে না যেন, কপালে গভীর ভাঁজ আচ্ছা, ওকে এমন দেখতে লাগছে কেন, কালচে ধরনের? সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তাও রুম্পা তাকাল না, লক্ষ করলাম ওর হাতে একটা কাচের বাটিতে গোটা কতক নীল মাছ, এক মহিলা স্থির হয়ে তা জরিপ করছেন রুম্পাদের লাল মাছ আছে একবার দেখেছিলাম, এখন নীলও নিচ্ছে নাকি? যাক, চিনতে যখন চাইল না কিচ্ছু করার নেই ভাবতে ভাবতে কিছুটা এগিয়ে গেছি, হঠাৎ ঘোর ভাঙল ঝুম্পার ডাকে, “এই, বাড়ি যাসনি এখনও?” চোখ তুলেই এক চমক, এ কী! ঝুম্পাও মাছ নিয়ে এসেছে আকাশি সাইকেলে? পাশে তাকিয়ে দেখি সাদা মন্দিরটা একরকম দাঁড়িয়ে আছে চমকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, রুম্পাও বেরিয়েছে না তোদের নীল মাছ নিয়ে?” ঝুম্পা হতবাক, “কী বলছিস, আমাদের তো লাল সব মাছ, নীল কবে থেকে এল? আর রুম্পা? ওর তো মাথা ব্যথা করছে বলল, শুয়ে রইল তাই” আমি কথা ভুলে তাকিয়ে থাকি ঝুম্পা- রুম্পা যমজ বোন, কিন্তু দেখতে অনেকটাই আলাদা এ আবার কেমন কথা! আবার এই মন্দিরের কাছে গোলকধাঁধা আছে কবে থেকে? এত বড়ো ভুল হবে? ঝুম্পা কিন্তু বিরাট পাত্তা না দিয়েই ঢুকে গেল গলির ভিতরে, সেই বাড়িটাতেই না ঠিক সেই বাড়িটাই নয়, সেটা একইরকম, শুধু তাতে ছিল কমলা পাঁচিল, এইটা সবুজ!
যাই হোক, পরের সকালে বাসন মাজতে বসে আমাদের কাজের পিসির মুখে শুনলাম চাঁপাদিদির গল্পটা হোস্টেলের রাঁধুনি নাকি বলেছে শুনে আরও মাথায় যেন বাজ পড়ার অবস্থা! ওরকম শান্ত-নিরীহ মেয়ে, বড়ো দিদিরা তো দূর, নতুন ভর্তি হওয়া ছোটো ছোটো মেয়েগুলো পর্যন্ত যার পাটালি-সন্দেশ কেড়ে নেয়, সেরকম মেয়ের যে হুট করে ঝড়-জলের ভোরে সবাইকে লুকিয়ে বাড়ি পালিয়ে যাওয়ার শখ হবে তা কে জানত? তবু অসীম সাহসে সাদা রেনকোট ঢেকে সেই ভোরে গ্রিল বেয়ে নেমে এক দৌড়ে বাসরাস্তায় পৌঁছেছিল চাঁপাদিদি, কিন্তু দূর থেকে সবুজ আলো ফেলে এসে যেই সেই দূর গ্রামের বাস এসে দাঁড়াল, ওঠা হল না তার আর তাতে কী করে ওঠে, ব্যাগটাই তো নেই, অত জিনিসপত্র কিচ্ছুটি না কিন্তু আগে খেয়ালই বা হয়নি কেন হাত খালি বলে? ওই সময়ে যদিও অত ভাবা যায় না, চাঁপাদিদিও না ভেবে ফিরে গিয়েছিল হোস্টেলের রাস্তায়, মৃদু গাছে-পাতায় লেপটে থাকা আলোয় খুঁজতে একবার ব্যাগটাকে, আর কী অদ্ভুতভাবে পাওয়াও গেল সেটাকে নাকি, সব থেকে বড়ো দেবদারুটার গায়ে ঠেস দিয়ে অতশত মাথায় না এনে দিদি নাড়াতে যাবে ব্যাগটাকে, মনে হয় সেটা যেন আরও বেশি ভারী! তারপরে যা দেখেছিল সেটা বলতে গিয়ে চাঁপাদিদি বার বার চমকে চমকে উঠেছে, চমকে ওঠারই কথা, যদি ওরকম ভোর-রাতে দুম করে ব্যাগ থেকে আস্ত বেড়ালির আকারের গোটা তিনেক আর অগুনতি কুচোকাচা কাঠবেড়ালি বেরিয়ে আসে! তারপরে নাকি সে মাটিতে পড়ে যায়
সেদিন থেকে স্কুল কিন্তু ঠিকই সময়ে শুরু হল, ঠিকই জায়গায় দোতলায় উঠতে প্রথম প্রথম ভয় করলেও বড়দি গম্ভীর মুখে পাঠিয়ে দিলেন সবাইকে ওপরে তবুও ওই ভয়ানক ঘরগুলোর থেকে আমাদের ক্লাসটা দূরে এই যা! প্রথম ক্লাস যথারীতি আগের দিনের মতো ইতিহাস তাও কেউই ঠিক মন বসাতে পারল না ক্লাসে ঘন্টা পড়ার পর ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মৌমিতা ম্যাডাম বলে গেলেন, “কয়েকজন আসবেন, কয়েকটা জাদু দেখাবেন এইখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখো” জাদু? একবার একজন সাদা রুমাল দিয়ে পায়রা বানানোর জাদু দেখিয়েছিল, তাতেই কী উৎসাহ ছিল আমাদের সবার তাও তো নিচে রোদে ভিড় করে দেখা আর এমনি করে ক্লাসে দেখানো হবে, তাতেও যেন কারও খেয়াল নেই, সত্যিই ভয় বড়ো বিষম বস্তু!
যাই হোক, একটু পরে ওরা ঢুকল বড়দি আর অন্য দু-তিনজন ম্যাডামের সঙ্গে, আমরা দেখে আরেকটু অবাক এ যে দুটি দিদি মাত্র, বড়োজোর বাইশ-তেইশ বছর বয়স কিন্তু ম্যাজিক নিখুঁত, লাঠি থেকে ফুল বের করা, পুতুলকে দিয়ে কথা বলানো কিংবা মূর্তির জল খাওয়া তারপরে কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা কায়দা, জাদুকরদের মতো জাদুর কথা না বলে সব কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা দিয়ে গেল এক দিদি, আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে তুলে দেখাতে লাগল জাদুর সরঞ্জাম “ওঁরা বিজ্ঞান মঞ্চ থেকে এসেছেন,” ঘোষণা করলেন কমলা ম্যাডাম আমাদের স্কুলে খুব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বরাবর, তাই এই ব্যবস্থা এই দিদিরাও অনেকে এসেছে, বিভিন্ন ক্লাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারপর সে এক লম্বা বক্তৃতা চাঁপাদিদি, সেই মেয়েটি, এর আগে কবে যেন কারা দেখেছিল দেবদারু গাছে পা দুলিয়ে কে বসে আছে - সব কিছুর ব্যখ্যা দুটোই জিনিস দিদিরা বার বার বলল, দৃষ্টিভ্রম আর হ্যালুসিনেশেন মিলিকে ডেকেও এক দিদি জিজ্ঞেস করল, “চশমা খুলে একবার তাকাও তো ক্লাসের শেষে, দেখতে পাচ্ছ কেমন?” তখনও মিলি ছাড়া আমাদের কারও চোখেই চশমা থাকেনি তা সেও চশমা খুলে, একটু চোখ ঘষে বলল, “মিষ্টুকে দুটো দেখাচ্ছে যেন!” দিদিরা ওকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের বোঝাল, যাদের চশমা পরতে হবে তাদের যেমন ভুল দেখার সম্ভাবনা থাকে, ঠিকঠাক দৃষ্টি থাকলেও ভুল দেখা যেতে পারে আর মনের ভুল তো হয়ই
বড়োদের মুখে হাসি-হাসি ভাব, আমরাও একটু একটু যেন জোর পেয়েছি ক্লাসটা শেষ হতে যাবে, ঝুম্পা হঠাৎ খোঁচা দিল, “কালকের কথাটা বলবি?” ওরকম কথা কি বলা যায় নাকি, এক্ষুনি সবাই ঠাট্টা করবে! আমি চুপ করে থাকি তাই, চুপ করে দিন গড়িয়ে যায় রাতে, রাত গড়ায় নতুন দিনে নতুন সকালে সবার নতুন উদ্যম, চাঁপাদিদিও নাকি বাড়ি থেকে ফোনে জানিয়েছে স্কুলে, সে ভালোই আছে মাঠে নেমে, করিডোরে হালকা হালকা লুকোচুরি এমনিতে আমি টিফিনে একা ঘরে বসে থাকতাম, সেদিন যে কী হল, হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে গোটা স্কুলভর্তি একগাদা মেয়ে, সবার গলার আওয়াজ পাচ্ছি, ভয় আর কীসের? শেষ সিঁড়ি ডিঙিয়ে সবে মাঠের দিকে এগোতে যাব, দেখি কোথাও কেউ নেই! এরকম কী করে হয়? পেছন ফিরে নাইন বি-এর ক্লাসে আরেক চমক এখন কমলা ম্যাডাম ওখানে ক্লাস নিচ্ছেন? ঘন্টা তো পড়েনি দৌড়ে উপরে উঠে আমাদের দরজায় দাঁড়ালাম, এই সিঁড়ির দিক থেকে তিন নম্বর কিন্তু দরজার উপরে রোমান এগারো সপ্তম শ্রেণি থেকে সোজা একাদশ? ভেতরে উঁকি দিই, অনেক দিদি বসে, কেউ ক্লাস নিচ্ছেন না আর ওদের কেমন সাদা-কালো গোছের দেখাচ্ছিল প্রচণ্ড আতঙ্কে পিছন ফিরলাম, তালতলা এইখানে? মুহূর্তে অদ্ভুত ঘটনা, মৃদু একটা ঝড় উঠতে উঠতে থমকে গেল যেন তালগাছে, সঙ্গে সঙ্গে ফুটফুটে রোদ, সব আগের মতো! এর পরে ঘন অন্ধকার, আর ঠিক কী হয়েছিল মনে নেই
জ্ঞান ফিরতে দেখি একটা সাদা দেয়াল, পাশে জানালার সবুজ পর্দা ঝুলছে কাছেই চেয়ারে বসে আছেন একজন বয়স্কা নার্স আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে মাকে আসতে বললেন ভেতরে, সঙ্গে বড়দি আর তুলিকা ম্যাডাম এই তুলিকা ম্যাডাম তখন আমাদের স্কুলে একেবারে নতুন, ভৌতবিজ্ঞান পড়াতে এসেছেন, আমরা একদিনও ক্লাস করিনি মা একটু বসে চুলে হাত বুলিয়ে চলে যেতেই তুলিকা ম্যাডাম খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তোমাকে আমি কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না শুধু একটাই প্রশ্ন, তুমি কি তোমার ক্লাসের নামটা বদলে যেতে দেখেছ?” খুব অসুস্থ অবস্থায় কি মানুষ অবাক হয়? আমি আস্তে মাথা নাড়লাম বড়দি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “ওই রুমটা ইলেভেনকে দেব ভেবেছিলাম আগে
পরে শুনলাম, শুধু আমি নই, ফাইভের নূপুরও নাকি আমারই মতো একই জিনিস দেখেছে, কিন্তু ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি, চিৎকার করেছিল ভীষণ ওদের কাছেই সবটা শুনেছেন ওঁরা কয়েকদিন অসুস্থতার জন্য স্কুল থেকে ছুটি দেওয়া হল আমাকে, কিন্তু আশ্চর্য, সেই ছুটিটা আমার ঠিক কীভাবে কেটেছিল ভাবলে মোটেও মনে পড়ে না খালি একদিন রুম্পা এল ওই নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি, শুধু এত ঝাপসা স্মৃতির ভিড়ে মনে পড়ে, খেয়াল হয়, ও বলেছিল, “খুব শিগগির আমরা নীল মাছ কিনছি রে” আরেকটা খবর পেয়েছিলাম কাজের পিসির কাছে, কমলা ম্যাডামও নাকি একদিন দেবদারুতলা দিয়ে যেতে যেতে টের পেয়েছিলেন, পাশের গাছ থেকে কিছু যেন তাঁকে দেখছে তাকাতেই দেখেন, একটা কাঠবেড়ালির মতো ছোট্ট বেড়াল! উনিও নাকি খুব ভয় পেয়েছেন সেদিন
তবু ফিরতেই হয়, আমাদের ছোট্ট শহরে যে আর কোনো স্কুল নেই ফেরার আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম জেগে জেগে জানালার ধারে, সেদিন খুব পাতা ঝরছিল সেগুনের, মনে আছে মিহি রোদে একটু দেরি করে ভেতরে ঢুকতেই দেখেছিলাম বড়দি দাঁড়িয়ে আছেন জাতীয় সঙ্গীতের আয়োজন নিয়ে প্রার্থনার পর আমাদের ডাক পড়ল হলঘরে একেবারে বাঁ দিকের ফার্স্ট বেঞ্চটায় যদিও আলাদা করে আমাদের শুধু বসতে দেওয়া হল, আমি, চাঁপাদি, ফাইভের নূপুর, সাদা-কালো পোশাকের ছাত্রীকে দেখা ওই মেয়েটা যার নাম শুনলাম পিউ আর একেবারে শেষে এসে বসলেন আমাদের সঙ্গে কমলা ম্যাডাম গোটা ক্লাসে ভীষণ নীরবতা, ব্যাগের চেনে চেনে ধাক্কা লাগলেও শোনা যায় একটু পরে উঁচুমতো জায়গাটাতে উঠে বড়দি বললেন, “শোনো, একটা সত্যি বলি, ওই বাঁদিকের ফার্স্ট বেঞ্চের পাঁচজনের মতো আমিও নতুন নতুন এই স্কুলে এসে এইসব দেখেছি কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি বিশ্বাস করতে হবে এমন কোনো কথা নেই, অবিশ্বাস করারও কিছু নেই কথাটা একটু অদ্ভুত লাগছে তোদের শুনতে জানি, তবে বাকিটা তুলিকা বলবে
বাইরে কোথায় যেন একঘেয়ে ডাকা শুরু করেছে কুকুরটা তুলিকা ম্যাডাম আস্তে আস্তে এক হাতে একবার মাইকের তারটা একটু দেখে নিয়ে শান্তমুখে এসে দাঁড়ালেন ওপরে তার পর আমাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আমি যদি এই স্কুলে না আসতাম, তাহলে আজকের এই সভাটা কি হত? কেউ বলতে পারবে?
এ আবার কেমন প্রশ্ন! সঙ্গে সঙ্গে সরব সবাই তুলিকা ম্যাডাম একবার মুন্নিকে জিজ্ঞেস করলেন, মুন্নি মাথা নিচু করে নিল চন্দ্রা বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হয়, তবু চন্দ্রা যখন বলল, “যদি বলে কিছু হয় কি?” তুলিকা ম্যাডাম একটু হেসে ঘাড় নাড়লেন, হয়নি “আচ্ছা পিউ?” পিউ যেন ভয়ে ভয়েই ছিল, কোনোক্রমে চোখ তুলল, “আজকের সভাটা নাও হতে পারত!” হঠাৎ আমার যেন কী হল, বলে উঠি, “বা আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকতেন!
তুলিকা ম্যাডাম উজ্জ্বল চোখে তাকান কাচের ভেতর থেকে “ঠিক, এগুলোই চাইছিলাম তাহলে দেখো, সবগুলোই সম্ভব ছিল এইবার যদি আমি বলি, এই সবগুলোই হচ্ছে এখন? যেমন বড়দি আসলে সেভেনের ক্লাসটা ইলেভেনকে দিতে চাইছিলেন, সেইটা যদি সত্যিই উনি কোথাও দিয়ে থাকেন!” সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের কথা মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার তুলিকা ম্যাডাম ততক্ষণে রুম্পা-ঝুম্পাকে ডেকে নিয়েছেন
“এই দেখো, এরা যমজ কিন্তু ঠিক একরকম নয় আবার একটু মিল আছে মনে করো, ব্রহ্মাণ্ডটাও এরকম, অনেকগুলো দুনিয়া আছে এতে এদের একটু মিল, একটু অমিল হতে পারে না? অনেকগুলোতে হয়তো এই আমরাই আছি, আবার অনেকগুলোতে এই নামে কেউ নেই কোথাও হয়তো নামই নেই রুম্পা-ঝুম্পার মতো একটু একটু আলাদা হয়ে হয়ে গেছে হয়তো সব আছে, খালি আমরা যাতে গুলিয়ে না ফেলি কোনটা আমাদের জীবন তাই চট করে দেখা যায় না হতে পারে না? একে একটা বাংলা নামে ডাকা হয়, ‘সমান্তরাল মহাবিশ্ব’, অনেক মহাবিশ্ব আর তারা জ্যামিতির মতো সমান্তরালে ছড়িয়ে আছে
একটু চুপ করে থাকেন তুলিকা ম্যাডাম, তার পর আবার বলেন, “হয়তো সত্যিই সত্যি বলে কিচ্ছু নেই যাই হোক, এর বিজ্ঞান এখনও অনেক দূরে, তবু মনে রেখো, বাস্তব সব সময়ে, সব জায়গায় বাস্তবই!
সেদিনের সব ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ কেন জানি না দাঁড়িয়ে ছিলাম দরজার কাছে একটু পরে তুলিকা ম্যাডাম এসে হাত রেখেছিলেন মাথায়, “তুমি পারবে না, সত্যিটা খুঁজতে? আলোর পৃথিবী যেমন, আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এই স্কুলটা যেমন, ছায়াও তো তেমনই, তাই না?
না, অনেকগুলো ছায়া-ছায়া বছর পার হয়ে গেছে, ভুলভাল করিডোরে হাঁটতে হাঁটতেও আমি পারিনি আগে হলে হয়তো লিখতাম হেরে গেছি, কিন্তু এখন জানি হেরে যাওয়া বলে কিছুই হয় না এখানে এখন নাই বা পারলাম, কোথাও না কোথাও হয়তো ঠিক…! আসলে ছায়ার স্কুলে পড়লে খুব বিশ্বাস করতে শেখা যায়!
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment