গল্পের ম্যাজিক:: যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা - বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়


যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা
বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

ছোটোরা যে ভাবনা-চিন্তা করে কতরকম মজার খেলা তৈরি করতে পারে, তার কোনো শেষ নেই আমিও যখন ছোটো ছিলাম তখন মজার মজার খেলার চিন্তা-ভাবনা আমার মাথাতেও আসত
ছোটোবেলায় আমার প্রিয় বন্ধু ছিল টাকলু নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে টাকলু আসলে একজনের ডাকনাম ভালো নামটা আপাতত উহ্যই থাক ডাকনামেই মূল গল্পটা বলি
আমার-টাকলুর সেই ছোটোবেলায় টিভিতে রামায়ণ দেখাত বলাই বাহুল্য, বড়োদের সঙ্গে আমরা ছোটোরাও সেই টিভি সিরিয়াল দেখবার সুযোগ পেতাম রাম-রাবণের যুদ্ধে উড়ন্ত তিরের বৃষ্টি দেখে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল যদি আমিও বেশ এমন একটা যুদ্ধ করতে পারি কিন্তু যুদ্ধটা করব কার বিরুদ্ধে? মনে পড়ল টাকলুর কথা সেই আমার প্রিয়তম বন্ধু, আবার সেই আমার নিকটতম শত্রু তার সঙ্গেই ঝগড়া, মারামারি, আবার বন্ধুত্ব, ভালোবাসা
তির-ধনুক দিয়ে যুদ্ধের কথাটা এক বিকেলে টাকলুকে জানালাম টাকলু খানিক মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করল, “যুদ্ধটা করবি ঠিক আছে, কিন্তু যুদ্ধের জায়গাটা কোথায় হবে? আমি কিন্তু লঙ্কা অবধি গিয়ে যুদ্ধ করতে পারব না বাড়ি থেকে অতদূর যাওয়ার অনুমতি দেবে না
আমি ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম, “কোনো চিন্তা নেই যুদ্ধটা আমাদের এই বিল্ডিঙের সামনের মাঠেই হবে এবং সকালের জলখাবার খেয়েই যুদ্ধ শুরু করে দেব দুপুরের আগেই যুদ্ধ শেষ
আমার কথা শুনে টাকলু কিছুক্ষণ ভাবল তারপর বলল, “ঠিক আছে, তাহলে যুদ্ধ করব তবে আমার একটা শর্ত আছে
“কী শর্ত?
“আমি রাম হব, তুই রাবণ
এখন, ভিলেন হতে কোনো শিশুই চায় না তার ওপর আবার এই খেলার পরিকল্পনা আমারই আমি রাবণ হতে যাব কোন দুঃখে? আমি সরাসরি মুখের উপর বললাম, “উঁহু, হবে না আমি রাম আর তুই রাবণ
টাকলু সঙ্গে সঙ্গে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তাহলে যুদ্ধ করব না
টাকলু এমনিতে আমার সঙ্গে প্রচুর মারপিট করলেও, সে যে এমনভাবে যুদ্ধ ছেড়ে শান্তিকামী হয়ে যাবে, এটা আমি ভাবতেও পারিনি কিন্তু কী আর করা যাবে! আমি রাবণ কোনোভাবেই হব না
দু’জনের মতের মিল যখন হল না, তখন আর যুদ্ধ হবে কীভাবে? সেদিনের মতো যুদ্ধ করার প্রস্তাব ভেস্তে গেল

কিন্তু রামায়ণের যুদ্ধের ফন্দিটা আমার মাথার মধ্যে কেমন ইঁদুরের মতো দৌড়ে দৌড়ে বেড়াতে লাগল কয়েকদিনের মধ্যে আমি একটা বুদ্ধি বের করে ফেললাম টাকলুকে বোঝালাম যে যুদ্ধের আগে কিংবা যুদ্ধ চলাকালীন কেউই রাম নয় বা রাবণ নয় যে যুদ্ধে হেরে যাবে সেই রাবণ, আর যে জিতবে সে রাম টাকলু কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “হুম তাহলে যুদ্ধ করতে পারি
ব্যস, আমাদের যুদ্ধ করার মানসিকতা ফাইনাল হয়ে গেল এবার অস্ত্র জোগাড় করার পালা আমি আর টাকলু মিলে অস্ত্র খুঁজতে বের হলাম আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই ছিল গাড়ির গ্যারেজ সেই গ্যারেজের পেছনে পড়ে থাকত অনেক পুরোনো লোহালক্কড় সেখানে যে বেশ কিছু লোহার তার ছিল সেটা আমি আগেই দেখেছিলাম ঠিক হল বাঁকা তারগুলোকে সোজা করে, সেগুলোয় কাপড় বা কাগজ জড়িয়ে সেগুলো দিয়ে তির তৈরি হবে এমন লোহার তার টাকলু নিল দুটো, আমিও নিলাম দুটো এবার ধনুক তৈরির পালা একটা বড়ো লোহার তার বাঁকিয়ে তাতে সুতো জড়িয়ে ধনুক তৈরির চেষ্টা হল কিন্তু আমাদের চেষ্টাটা বিশেষ সফল হল না জড়ানো সুতো বার বার খুলে খুলে আসছে
অবশেষে অনেক ভেবে ঠিক হল যে আমরা রেডিমেড ধনুক কিনে নেব কিন্তু ধনুক কোথা থেকে কেনা যাবে? সেটা আমার বা টাকলুর কারুরই জানা নেই বাধ্য হয়ে আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম অবশ্য আমাদের রামায়ণের যুদ্ধের পরিকল্পনার কথাটা পুরোপুরি চেপে গেলাম
মা বলল, কলকাতার সল্টলেকের কাছেই আছে ছোটোদের খেলার জায়গা বিধান শিশু উদ্যান সেখানে একজন ফেরিওয়ালা তির-ধনুক বিক্রি করে বটে
আমি নাচতে নাচতে মায়ের হাত ধরে বিধান শিশু উদ্যানে গেলাম ভাগ্য ভালো ছিল দেখলাম সেই ফেরিওয়ালা তির-ধনুক আর বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কাছ থেকে একটা ধনুক আর তিনটে তির কেনা হল লোকটার কাছে রাক্ষসের মুখোশও ছিল কিন্তু আমি তো রাবণ হতে চাই না অগত্যা... মুখোশ বাদ

এরপর যুদ্ধের দিনক্ষণ ঠিক হল টাকলুদের ফ্ল্যাট ছিল একতলায় আমি জানতাম টাকলু কোন ঘরে থাকে নির্দিষ্ট দিনে আমি নিচে বেরিয়ে হাঁক দিলাম, “টাকলু, আমি তির-ধনুক নিয়ে রেডি তুই তোর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আয় যুদ্ধ শুরু করি
কথাগুলো বলছি আর উত্তেজনায় আমার রক্ত টগবগ করছে সত্যি কি কোনোদিন ভেবেছিলাম যে আমিও একদিন রামায়ণের মতো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব! আমার তির বাতাসে সাঁই সাঁই করে উড়ে শত্রুকে আঘাত করার জন্য ছুটবে!
আমার এই ভাবনাচিন্তার মাঝখানে টাকলু একটা বিরাট বড়ো পুঁটলি নিয়ে ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল আমার খুব কৌতূহল হল কী আছে পুঁটলিতে?
তা পুঁটলি থেকে যা বেরোল, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ টাকলুর কাছে দুটো সরু সরু লোহার তির, একটা রাংতা জড়ানো বিশাল মোটা তির এবং পাঁচটা কাঠের তির বেশ বড়ো সাইজের একটা খেলনা ধনুক তার সঙ্গে আবার একটা বড়োসড়ো গদা! টাকলু তো মহা শয়তান ছেলে দেখছি নিজেকে শান্তিকামী বলে দেখিয়ে গোপনে গোপনে বিপুল অস্ত্র মজুত করেছে! এদিকে আমার দুটো সরু লোহার তির আর তিনটে কাঠের তির
যুদ্ধ করার আগেই মনমরা হয়ে গেলাম যাই হোক, আমরা লোহার তির দিয়ে যুদ্ধ শুরু করলাম তির যদি কারোর গায়ে লেগে যায় তাহলে বিপক্ষের এক পয়েন্ট দু’জনেই এক-দুই-তিন করে গুনে তির ছুড়লাম লোহার তিরগুলো কিছুটা বাতাসে গিয়েই গোঁত্তা খেয়ে পড়ে গেল ব্যাপারটা যে ঠিক টিভিতে উড়ন্ত তিরের মতো হল না, সেটা দেখে আমরা দু’জনেই খুব হতাশ হলাম আবার দ্বিতীয়বারের জন্য তির ছোড়াছুড়ি হল এবারেও তিরগুলো মাঝপথেই ধপাস করে পড়ে গেল টাকলু এবার নিজের মোটা তিরটাকে ধনুকের সুতোয় বসিয়ে সুতোটা পেছন দিকে টানতে শুরু করল আমি ভয় মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “ওটা কী রে?
টাকলু নির্বিকারভাবে জবাব দিল, “ব্রহ্মাস্ত্র
টাকলুর উত্তর শুনে আমার শিরদাঁড়া পর্যন্ত কেঁপে উঠল ভাবলাম, ব্রহ্মাস্ত্র তো ভয়ানক জিনিস আমি তো কোন ছার, আমাদের আশেপাশের সবকিছুও তো ওতে ধ্বংস হয়ে যাবে
আমি টাকলুকে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা তুই বানালি কীভাবে?
টাকলু একটা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “অনেক মাল-মশলা দিয়ে বানিয়েছি
আমি এবার সত্যিই ভয় পেলাম ওকে বললাম, “ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করিস না চারপাশে আগুন-টাগুন লেগে যেতে পারে বিটকেল কাণ্ড হবে
টাকলু মহা বিচ্ছু ছেলেদের মতো বলল, “বেশ করব, ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করবই
তারপরেই সেই ঘটনা আমার মনে হল আমার মরতে আর বেশি দেরি নেই অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আতঙ্কে নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই আর কয়েক মুহূর্ত পরেই ব্রহ্মাস্ত্র এসে আমায় মেরে ফেলবে
টাকলু গায়ের সমস্ত জোর প্রয়োগ করে ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে ব্রহ্মাস্ত্রকে আমার দিকে ছুড়ে দিল খুব সম্ভবত আমার অবস্থা দেখে ব্রহ্মাস্ত্রর মায়া হয়েছিল তাই তিনি বাতাসে এতটুকুও না উড়ে টাকলুর থেকে সামান্য দূরে মাটিতে ঠং-ঠং শব্দ করে পড়ে গেলেন
নিজের সেরা অস্ত্রের এই পরিণতি দেখে টাকলু রীতিমতো খেপে গেল এবং আমি পরবর্তী তিরটা টাকলুর দিকে নিক্ষেপ করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহী হয়ে উঠলাম বেপরোয়া টাকলু এবার শরসন্ধান ছেড়ে গদা হাতে তুলে নিল তারপর রে রে করে আমার দিকে গদা হাতে তেড়ে এল
আমি টাকলুকে সতর্ক করলাম, “টাকলু, খবরদার কাছে আসবি না আমি তোর মাথা লক্ষ্য করে তির ছুড়ব কিন্তু
টাকলু খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলল, “লাগুক মাথায় তির তবু আমি তোকে গদার বাড়ি মারব
গদার আঘাত সাঙ্ঘাতিক হতে পারে ভয়ে আমি তির-ধনুক নিয়ে কাঁপছিলাম
ঠিক সেই সময় স্বর্গের দেবীর মতো আমায় রক্ষা করলেন টাকলুর মা একতলার ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে তাঁর গলার স্বর ভেসে এল, “আবার দুধ, বিস্কুট না খেয়ে খেলতে যাওয়া হয়েছে! টাকলু, কোথায় তুই? শিগগির এসে খেয়ে যা বলছি
টাকলু নিজের মা-বাবাকে ভালোই ভয় পায় সে ছুটতে ছুটতে দাঁড়িয়ে পড়ল তারপর পেছনে ফিরতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার দুষ্টু বুদ্ধি যাবে কোথায় বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ গদাটা সজোরে আমার দিকে ছুড়ে দিল ভাগ্যিস আমি প্রস্তুত ছিলাম পটাং করে সরে গেলাম একপাশে প্লাস্টিকের গদা আমার ডান কাঁধের কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল
গদা, ব্রহ্মাস্ত্র সবই বিফলে গেল দেখে টাকলু বিমর্ষ মুখে দুধ আর বিস্কুট খেতে চলে গেল আমি এগিয়ে গেলাম গদাটার দিকে সে বেচারি আমায় আঘাত না করতে পেরে ভারী পানসে মুখে মাটিতে পড়েছিল আমি তার ধুলো ঝেড়ে তাকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিলাম নিজের ভেতর বেশ একটা হনুমান-হনুমান ভাব এল
এমন সময় টাকলুর গলার স্বর শোনা গেল, “এই খবরদার, আমার গদায় হাত দিবি না বলে দিলাম তাকিয়ে দেখি, টাকলু এর মধ্যেই দুধের গ্লাস হাতে কখন একতলার ফ্ল্যাটের জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে আর আমার উদ্দেশে চেঁচামেচি করছে
আমি বললাম, “বেশ করব হাত দেব তির-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল, তুই গদা ব্যবহার করবি কেন? যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য তোর গদা বাজেয়াপ্ত করা হল
টাকলু আবার চেঁচাল, “আমার গদা আমার বাড়িতে রেখে যা বলছি!
আমি নিজের ফ্ল্যাটের দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে বললাম, “কাল বিকেলের আগে পাবি না
এইভাবে রাম-রাবণের যুদ্ধে একজন দুধ-বিস্কুটের জন্য রণক্ষেত্র ত্যাগ করায় এবং অন্যজন শত্রুপক্ষের গদা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় যুদ্ধ অমীমাংসিত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হল
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment