আলোমামাদাদুর গল্প
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
কথাটা অনেকদিন আগেকার। তখন এই লকডাউন সবে শুরু হবে হবে করছে। ভয়ঙ্কর ভাইরাসটা পৃথিবীতে দারুণ থাবা মেলেছে। ইতালি, ফ্রান্সের মতো বড়ো বড়ো দেশে কত লোক যে মারা গেছে তার ইয়ত্তা নেই। দিনমানেই সেখানে কার্ফু জারি হয়েছে। রাতের বেলা তো কথাই নেই। ভারতের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়।
সেবার সবে সবে আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ইস্কুলে দোল, হোলি আর তারপর শনি-রবি পর পর পড়ে যাবার জন্য চার দিন একসঙ্গে ছুটি পেয়েছিলুম। আর একসঙ্গে বেশি ছুটি পেয়েই বরাবরের মতো এবারেও চলে এসেছিলুম হাওড়ায়। আমার মামার বাড়িতে। মামার বাড়ি ভারি মজা কিল-চড় নাই। এখানে এলেই দাদু-দিদানের সঙ্গে সারাদিন অনেক গল্প শোনা, মামার সঙ্গে বেড়ানো আর খাওয়া-দাওয়া। সেদিন ছিল অন্নপূর্ণা পুজো। সেই যে পড়েছিলুম,
পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটনীরে।।
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।
ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি।।
ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পাটনী।
একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি।।…”
সেই অন্নপূর্ণা-ঠাকুরের পুজো। নেমন্তন্ন আসলে ছিল মামা-মামির। কিন্তু পাড়ার যে মুখুজ্জেবাড়ি, তারা আমায় খুব চেনে। ভারি ভালোওবাসে। আমি যতবারই মামার বাড়ি আসি, ওখানে যাই। মুখুজ্জে কাকিমা, মেজদিদা আর পিয়ালী বৌদিও আমাকে খুব ভালোবাসে। ওখানে আমার ডিমান্ডই আলাদা। তাছাড়া যারা ক্লাসে ফার্স্ট হয় তাদের একটা বিশেষ সম্মান থাকে সবসময়। ও বাড়িতে পারণের জন্য আমার নাম বাঁধা থাকে। ওদের বাড়ির বড়দির বিয়ের সময় আমি নিতকনেও হয়েছিলাম। এই পুজোটা সেই মুখুজ্জে বাড়িরই। তাই সেবারে অন্নপূর্ণা পুজোর সময় আমি আছি জেনেই ওরা মামা-মামির সঙ্গে আমাকে বলে গিয়েছিল যাবার জন্য।
যদিও ওদের বাড়ি আমার মামাবাড়ির খুবই কাছে, কিন্তু পুজোটা হচ্ছিল কিছুটা দূরে, প্যাণ্ডেল করে। আসলে মুখুজ্জেরা খুব বনেদি তো! ওদের অনেক শরিক, এটা নাকি সেজ তরফের পুজো। তবে ভাগ নেই সেরকম। দিদা বলেছিল। সবাই খুব মিলেমিশে থাকে। ওদের বাড়িতে গেলেই দারুণ মজা হয়! তবে আমার মাথাটা নাকি নেড়ু হয়েছিল, ওই সেবারে অসুখ হবার জন্য। খুব ভুগেছিলাম তো, তাই মা আমার মাথার চুল মানত করেছিল ঠাকুরের কাছে। আর সেরে যেতেই, ঘ্যাচাং!... তার জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে নেড়ু নেড়ু করে খুব খ্যাপাচ্ছিল। আমাকে ন্যাকাচৈতন বলে ডাকতে শুরু করেছিল ক্লাসের দুটো ছেলে। আমাদের কো-এড ইস্কুল তো! ওরা আসলে খুব বদমাইশ। মাষ্টারমশাইরাও ওদের এড়িয়ে চলেন। তাই আমি কিছু
বিমর্ষ ছিলাম। কিন্তু, যেহেতু আমি ক্লাসে ফার্স্ট হই, ভালো গান গাই, আর আঁকাতেও প্রাইজ পাই, তাই আমাকে বাকিরা সবাই খুব ভালোবাসেন, কিন্তু ওই, ঘুরে ফিরে ইস্কুলের ওই ছেলেগুলোর কথা আমার খুব মনে আসত। তাই মনে মনে ভয় ছিল, যে পুজোবাড়িতেও যদি সেরকম কেউ থাকে? কিন্তু নাহ্! সেরকম কিছু ঘটল না। সেজকাকিমাকে সেই প্রথম দেখলুম। তিনি এ বাড়িতে নতুন। চৈত্রমাসের গরম হাওয়ায় ফরসা টুকটুকে কাকিমা ঘেমেনেয়ে যাচ্ছিলেন! একমাথা সিঁদুর আর সিল্কের শাড়িতে কী চমৎকার যে লাগছিল কাকিমাকে! মৃণ্ময়ী মা অন্নপূর্ণার পাশে জ্যান্ত মা বলে মনে হচ্ছিল। বিকেলবেলাতেও দিদা যখন নতুন শাড়ি আর নতুন কিনে দেওয়া মোতির গয়নায় সাজুগুজু করিয়ে দিল, তখনও বুঝতে পারিনি যে সেদিনটা আসলে কেমন কাটতে চলেছে। সেই যে কথা আছে না, সকাল দেখেই দিন কেমন যাবে সেটা বোঝা যায়? ওইটে এক্কেবারে ভুল কথা। কারণ, সেদিনের সকালটা দিব্যি শান্তশিষ্ট ছিল। অনেকটা আমাদের বাড়ির ছোট্ট বাগানের যে আমগাছটা, ওটায় বাসা বাঁধা বাবুইপাখির ছানাগুলোর মতোই। কোনো চিৎকার নেই, হই হই নেই! কিন্তু বাস্তবে আর তা হল কই?
বিকেলে যখন পুজোবাড়িতে গেছি, তারপর নেমন্তন্ন খেয়েছি, তখনও পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল। কিন্তু, আসল গোলটা বাঁধল যখন ঝড়টা উঠল। অনেকদিন পর কারেন্ট চলে গেল। আমি খেয়েদেয়ে বড়োদিদার দুই নাতনির সঙ্গে মণ্ডপ থেকে একটু দূরে যে ফুটবল খেলার মাঠটা ছিল, ওখানে গিয়ে বসে গল্প করছিলুম। ওরাও খুব ভালো মেয়ে; ইস্কুলে ফার্স্ট-সেকেণ্ড হয়! নতুন গান আর ক্রিকেটের দিকেও খুব খবর রাখে! এর মধ্যে বিনিতা খুব ভালো গল্প বলতে পারে। ও এ পাড়াতেই থাকে। ও-ই বলছিল ওই মাঠটার নাকি একটা ইতিহাস আছে! ওখানে নাকি একটা ফাঁসিমঞ্চ ছিল। আর এই মাঠটার নাম তাই নাকি ফাঁসির মাঠ! সেই কথাটাই মন দিয়ে শুনছিলুম, এমন সময়ই অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। দূর থেকে দেখলাম পুজোবাড়িটার আলোগুলো নিভে গেছে!
অন্ধকারটা হয়ে যাবার সময় আমরা এত মগ্ন ছিলুম নিজেদের মধ্যে গল্পে, যে প্রথমদিকটায় টের পাইনি। টের পেলাম যখন, তখন ঝড়টা উঠে গেছে। পুজোবাড়িতে হই হই শুরু হয়ে গেছে। আমার দুই নতুন বন্ধুই দৌড়ে মাঠ পার হয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা, কেবল আমিই পিছিয়ে পড়েছি। আসলে পিছিয়ে পড়ার কারণও ছিল। আমার খুব ছোট্টবেলা থেকেই ঝড় খুব ভালো লাগে। সেদিন যা গুমোট গিয়েছিল। হঠাৎ ঠাণ্ডা হাওয়াটায় আমার খুব ভালো লাগছিল। ওরা যখন দৌড় শুরু করেছিল, আমি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে থাকা ঝাঁকড়া গাছগুলোর চমৎকার নাচ দেখছিলাম। চারদিক অন্ধকারে ডুবে যাবার ফলে হঠাৎ করে মাঠের পাশের বাগানের জোনাকিগুলো জেগে উঠেছে। অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে পূজামণ্ডপ! সেখানকার হই হই-টা এখান অবধি আসছে না, অনেকটাই দূর, কিন্তু দেখা যাচ্ছে। পিলপিল করে বেশ কিছু লোক ছোটাছুটি করছে, মোবাইলের আলো জ্বেলে দৌড়োনো কালোকোলো মূর্তিগুলোকেও একেকটা চলমান জোনাকি মনে হচ্ছিল। সেসবই দেখতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম! মা চিরকাল আমাকে বকাবকি করে আমার এরকম অন্যমনস্ক স্বভাবের জন্য। আমার নাকি একদম হুঁশ থাকে না। বন্ধুদের স্কেচপেন দিয়ে ভুলে যাই, খাতা-পেনসিল দিয়ে ভুলে যাই, টিফিন বন্ধুদের ভাগ করে দিতে গিয়ে নিজেরটা রাখতে ভুলে যাই। মা বলে এসবের জন্য নাকি আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে! কী জানি!
তারপর ঝড়টা আরও ঘন হয়ে এল। আমার চারপাশ দিয়ে গরম বাতাসের ফাঁকে প্রথমে আস্তে আস্তে পরে দারুণ জোরে ঠাণ্ডা বাতাস ঘুরতে শুরু করল! এইটে আমার দারুণ লাগে। আমি চোখ বন্ধ করে হাত দু’খানা ছড়িয়ে দিলুম। কেমন চমৎকার লাগছিল! সে আর কী বলব! কিন্তু, সেই যে রূপকথার গল্পে ছেলেবেলায় পড়েছিলুম না, ভালো হতে না হতেই মন্দ চলে আসে!
হঠাৎ টের পেলুম আমার হাতটা কেউ ধরেছে! আমি ছোটোবেলা থেকেই খুব পিটপিটে! মা ছাড়া আর কেউ আমাকে ধরলেই আমার বিরক্ত লাগে! আর এই যে হাতটা ধরেছে আমার হাতটা, সেটা একদম ভালো নয়। আমি সেই মুহূর্তেই হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু পারছিলুম না। কেমন যেন চটচটে একটা আঠালো হাত! ঠাণ্ডা আর শক্ত! আমার হঠাৎ খুব ভয় করল। আমি চিৎকার করতে চেষ্টা করলুম! কিন্তু পারলুম না। গলাটা শুকিয়ে আসছে! টের পেলাম আমি খুব বিপদে পড়েছি। একটা নয়। প্রায় তিন-চারটে লোক! এরা ছেলেধরা! বুঝতে আমার একটুও দেরি হল না। কিন্তু আমি কী করব? এদের মধ্যে একজন চাপা গলায় বলল, “এই, একদম কথা বলবি না। আমাদের সঙ্গে চুপচাপ চল!” আমি বুঝে গেছিলাম যে চেঁচিয়েও খুব বেশি লাভ নেই। পুজোবাড়ি খুব বেশি দূর না হলেও আমার গলা শোনার পক্ষে অনেকটা দূর! আমি চিরকালই খুব ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে! কিন্তু এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখেও কী হবে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।
খুব ভয়ের সময় আমি চোখ বুজে ফেলি! এখনও তাই করেছিলাম সম্ভবতঃ! কারণ সেই মুহূর্তে আমি ঠিক কী করেছিলাম সেটা আমার এখন আর মনে নেই! তাই ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল আমি বলতে পারব না। কিন্তু হঠাৎই দেখলাম যে আমার হাতে আর টানটা নেই। সভয়ে চোখ খুলেই একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। লোকগুলো আমার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে আছে সামনে। সেখানে এখন একজন অদ্ভুত মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন! অদ্ভুত কারণ, সেই অন্ধকারে, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে এরকম জ্বলজ্বলে মূর্তি কোথা থেকে আসবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। যেন আলো দিয়ে গড়া একজন মানুষ! মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি সব আলোময়! তাকে দেখেই এরা যেন কেমন হয়ে গেল। খুব ভয় পেয়েছে ওরা বুঝতে পারছিলুম! তো তিনি এক-পা এক-পা করে এগিয়ে আসতেই ওরা ভয় পেয়ে যে যেদিকে পারল দৌড় দিল। আমি তাকিয়ে দেখলুম তাঁর দুই চোখ যেন আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে! কিন্তু আমার কেন যেন ভয় করছে না! আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম! এঁকে তো সাধারণ মানুষ বলে মনে হচ্ছে না! কে ইনি? ভূত? প্রেত? ভূত এরকম হয় নাকি? উনি যেন আমার মনের কথা পড়তে পারলেন! খুব ধীরে প্রায় বাতাসে ভেসেই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। কী যেন শুনলেন এক মুহূর্তের জন্য। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগেনি তখন।
“আমি তোমার আলোমামাদাদু! সোনা মা, তুমি এখানে একা থেকো না। কেমন? এটা ভালো জায়গা নয়, চলো আমি তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি!” আমার হাতটা ধরে ঝড়ের মধ্যে দিয়ে আমাকে এগিয়ে নিয়ে চললেন তিনি! পুজোবাড়ির কাছাকাছি এসে হাত ছাড়লেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “ন্যাকাচৈতন কথাটা খুব খারাপ! কেউ অমন বললে তাকে বোলো এটা কেবল অযোগ্যরা বলে! যাদের চোখে হিংসের কালো চশমা থাকে তারা ভালোটাকে মোটে সহ্য করতে পারে না। তার মতো হতে পারে না, তাই তাকে ছোটো করে! আর তাদের মনেও বেশি সাহস থাকে না একদম, জানবে। তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। তুমি খুব ভালো মেয়ে। তাই তুমি জোর দিয়ে কিছু করলে সফল হবেই। আর অন্যমনস্ক হওয়াটা শিল্পীর লক্ষণ, তবে সতর্ক হওয়াটাও কিন্তু শিল্পীর কাজ! তাই তোমাকে সতর্কও হতে হবে মা। সব জায়গায় তো আলোমামা্দাদু থাকবে না।… ওই দেখ, তোমার মামা-মামি আসছেন! আমি আসি কেমন? মঙ্গল হোক।…”
দেখলাম আলো এসে গেছে পুজোবাড়িতে। চারদিক আবার ঝলমল করছে! আমি কিছু বলার সু্যোগই পেলাম না। মামা কোথা থেকে এল, তার গলায় অমন গোল একটা দাগ কেন কিছুই বুঝতে পারলাম না।
পেরেছিলাম অনেক পরে। যখন রাতে মামা আমাকে ফাঁসির মাঠে না বলে যাবার জন্য বকাবকি করছিল, তারপর! আসলে আমি ওদের কিছুই বলিনি কিন্তু! ওরা বলছিল জায়গাটা খারাপ! কিন্তু কেন? সেটা কেউ বলেনি আগে। আর ওদের এসব বলে লাভ নেই। ওরা বিশ্বাসই করবে না হয়তো! আমি জানি তো! বড়োরা অনেক সময় অনেক কথা বোঝে না। তাই সব কথা জমিয়ে রেখেছিলুম। রাতে দিদার পাশে শুয়ে চুপি চুপি আমি যখন সব কথা বললুম, তখন দিদার মুখেই জানলুম। ওই ফাঁসির মাঠের পাশের বাগানে সাহেবদের তৈরি ফাঁসিমঞ্চ ছিল। অনেক বিপ্লবীকে সেখানে ফাঁসি দেওয়া হত। তার মধ্যে একজন ছিলেন আলো সেন। আমার দিদার সম্পর্কে এক কাকা। লোকে বলে তিনি আজও আছেন। দেশ স্বাধীন হলেও তাঁর কাজ শেষ হয়নি। হবেও না, যতদিন না আমরা তাঁর কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারব। দিদা বলেছিল! আর বলেছিল, আমি নাকি ঠিক পারব! আমার নামেই তো শক্তি!
সেদিনটার কথা আজও ভুলিনি। এখনও সেই চেষ্টা সমানেই চালিয়ে যাচ্ছি।
আমার নামটা? মহামায়া!
ছবি - অতনু দেব
বড্ড ভালো লাগলো।
ReplyDelete